অনুবাদক : বাসুদেব দাস (মূল অসমিয়া থেকে বাংলা)
কথা ছিল
তাঁর সঙ্গে একদিন
ভুবনেশ্বরী পাহাড়ে যাওয়ার কথা ছিল
সেখান থেকে নাকি
একটা সাদা চাদরের মতো দেখায় ব্রহ্মপুত্রটা
পায়রার খোপের মতো দেখায় ঘরগুলি
সাপের মতো দেখায় পথঘাট গুলি
গাড়ি গুলি নাকি পুতুলের মতো দেখায়
পিঁপড়ার মত দেখায় মানুষগুলি…
তা দেখার জন্য তাঁর সঙ্গে
ভুবনেশ্বরী পাহাড়ে বেয়ে উঠার কথা ছিল,
পাথরে ধাক্কা খেয়ে প্রেমের সংলাপগুলির
প্রতিধ্বনি শোনার কথা ছিল,
ঝরা ফুল কুড়ানোর কথা ছিল,
তাঁর হাত ধরে মন্দিরের সিঁড়ি
বেয়ে উঠার কথা ছিল,
কথা ছিল নিঃসঙ্গ ঈশ্বরের চোখের জল মুছে দেওয়ার।
তিনি আসবেন বলে
রাঙ্গা হয়ে উঠেছিল পাহাড়টা
কঠোর হয়ে উঠেছিল পাথরগুলি, ফুল ফুটেছিল বুক ঢেকে
পাখিগুলি এসে অপেক্ষা করছিল গাছের ডালে
কোথা থেকে এক ঝাঁক অপরিচিত বাতাস ও এসেছিল
তাঁর চুলের অরণ্যে বাসা বাঁধবে বলে
সারাটা দিন আমি কামাখ্যা পাহাড়ের নিচে
তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলাম
কথাতো ছিল না তাঁর না আসার।
একটি বিস্কুটের কাহিনি
তিনটি বিস্কুট এবং
এক কাপ কফি দিয়ে
আরম্ভ হওয়া আমার দিনটির
শৃঙ্খলা আজ ভেঙ্গে গেল
কেননা
কফি বিস্কুট খাবার সময়
হঠাৎ আমার চোখে চোখ পড়ল
মহানগর!
(যদিও দূরে ছিল)
তাই আমি একটা বিস্কুট পাঠিয়ে দিলাম
মহানগরে
উড়ে উড়ে গেল সেই বিস্কুট
নাচতে নাচতে গেল সেই বিস্কুট
নিজের ভবিষ্যতের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে
হাসতে হাসতে উড়ে গেল সেই বিস্কুট
তখন বিস্কুটটা হয়েছিল
একটি বুলবুলি পাখি
শৃঙ্খলা ভাঙ্গাটা খারাপ নয়,
শৃঙ্খলা স্থবিরতার লক্ষণ।
তাই আমি চাইলাম—-
বুলবুলি পাখিটা
পুনরায় বিস্কুট হওয়া উচিত নয়!
আমি চাইলাম—
এই ঠান্ডায় উড়ে যাওয়া বুলবুলিটাকে
মহানগর নিজের উলের সোয়েটারের নিচে
একটু উষ্ণতা দিক!
আমি একটি গ্রাম
তিনি একটি মহানগর
সব সময় মহানগরের পেছন পেছন গাও
সেটাও এক শৃঙ্খলা
সেই শৃঙ্খলা ভেঙ্গে আমি একদিন
তার সঙ্গে একটা কবিতার সভায় সাক্ষাৎ করেছিলাম
আমি ভেবেছিলাম—-
কবিতায় গাও মহানগর একাকার
ওহো!
মহানগর জানাল
গ্রামের সঙ্গে যাবেনা।
গ্রামকে সব সময় মহানগরের
পেছন পেছন যেতে হবে।
মহানগর শৃঙ্খলা ভাঙবে না
পুনরায় বুলবুলি পাখিটা
বিস্কুট হল
আবার বিস্কুট ফিরে এল
চোখের জল মুছতে মুছতে
কুয়াশার মধ্য দিয়ে
তখন আমার
কফি কাপ শেষ
ঠান্ডা পেয়ে বিস্কুট ভিজে গেল
ভেজা মানেই বিস্কুটের মৃত্যু
কিন্তু এত নিদারুণভাবে
এত নিদারুণভাবে
একটি বিস্কুটের মৃত্যু হওয়া উচিত কি?
খেলা
হাত দুটি তোর কে নিয়েছে?
–রাজার চিল নিয়েছে।
চিল নিয়ে কী করেছে?
–জঙ্গলে ফেলেছে।
সেই জঙ্গলের কী হল?
—হাতের রক্তে পুড়ে ছাই হল।
সেই ছাই কে নিয়েছে?
—ধোবা নিয়েছে।
ধোবা নিয়ে কী করেছে?
—রাজার কাপড় ধুয়েছে।
সেই কাপড় পরে রাজা কোথায় গেল?
—শিকার করতে গেল।
শিকারে কী পেয়েছে?
—একটা ঘোড়ার বাচ্চা।
তাকে নিয়ে রাজা কী করলেন?
—পুষতে লাগলেন।
সে কী খায়?
—মানুষের মাংস।
পায় কোথায়?
—আমাদের দেহে।
ঘোড়াটাকে মারি চল
—চিল দেবে না।
চিলকে মারি চল
—রাজা দেবে না।
রাজাকে মারি চল
—চল।
তুই আগে যা…
বাবা
বহু বছর হল বাবা আমাদের ছেড়ে যাবার।
ওহো। ছেড়ে যাওয়া বলে ভেবেছিলাম! ছেড়ে যাননি। কেননা
আজকাল আমি একা গাড়ি চালাতে থাকলে
আমার পাশের সিটটাতে এসে বসে থাকেন বাবা।
কিছুই বলেন না। আমি ভাবি
বাবার কণ্ঠস্বরটা বরফ হয়ে গেছে। কিন্তু
আমার কথাগুলি বড়ো মনোযোগের সঙ্গে শুনে থাকেন বাবা।
আমারও মনে হয় যেন এত বছরে
কোনো কথাই বলা হয়নি বাবা এবং আমার!
কখনও কখনও ভিড় থাকা বাজারের মধ্যেও
হঠাৎ দেখতে পেয়ে যাই বাবাকে। কখনও
সিটি বাসে আমি যেতে থাকলে হঠাৎ দেখতে পাই
আমার দিকে একবারও না তাকিয়ে
হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বাবাকে।
আমি ভাবি আমাকে দেখার জন্য বাবা আসেন
না আমাকে লক্ষ্য করার জন্য!
কখনও বহুদিন না কামানো দাড়ির সঙ্গে
বাবার মুখটা দেখে আমার এমন মনে হয়
বাবার যেন তেষ্টা পেয়েছে।
আর আমি বাবাকে দেখিয়ে ঘট ঘট করে জল
খাই
বাবা কিন্তু জল চায়না। তৃষ্ণাহীন বাবা।
কখনও আমার গাড়িতে আমার পাশের সিটটাতে
বাবা বসে থাকলে আমি তার ভেতরে তাকাই
দেখতে পাই তাঁর বুকের তেরাস্তা চৌরাস্তায়
উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানো একটি ছেলে। কপালে একটি কাটা দাগ।
আমি আমার কপাল হাতড়ে দেখি—আমার সনাক্তকরণের দাগটা।
বাবা ভাবেন আমি হারিয়েছি।
আমার খোজেই হয়তো বাবা এভাবে ঘুরে বেড়ান।
তিনি আমাকে দেখেও খুঁজে পান না।
কেবল হয়তো সনাক্ত করেন আমাকে!
অনেক বছর হল বাবা আমাদের ছেড়ে যাবার।
তারপরও অনেক বছর সবই ছিল ঠিক।
কিন্তু এখন কিছু একটা হয়েছে—
আমাকে খুঁজে বেড়ান বাবা না আমি খুঁজে বেড়াই তাঁকে!
অন্যমনস্কতায় আমি ভুলে যাই গাড়ির স্টিয়ারিং
আর ঠিক তখনই দুর্ঘটনা থেকে বাঁচানোর জন্য
আমার স্টিয়ারিং সোজা করে দেয় বাবা।
কোথায় গতি পরিবর্তন করতে হবে
কোথায় মারতে হবে ব্রেক বাবা বলে দেন।
বাবা এখন আমাকে গাড়ি চালাতে শেখাচ্ছেন
(স্মৃতিগুলির মাঝে মধ্যে)। বেঁচে থাকতে
তিনি গাড়ি চালাতে জানতেন না।
আকাশের বিরুদ্ধে একটি কবিতা
আকাশকে কার ও ভ্রুক্ষেপ করতে হয় না।
আকাশ কী? আকাশ একটি ছলনামাত্র।
একটি বিশাল নীল আকার ধারণ করেছে যে ছলনা।
আসলে শূন্যতার নাম আকাশ। খালি জায়গাগুলির
নামই আকাশ। আলমারির থাকগুলিতে,
পথে পড়ে থাকা খালি বোতল গুলির ভেতরে ওটা আকাশ।
আমরা আসা-যাওয়া করা পথটিতে, দরজামুখে,
জানালার মুখে, ঘরে, ঘরের কোণটিতে, বিছানার নিচে
ওটা আকাশ। অথচ কেউ সেগুলিকে আকাশ বলে না।
আমাদের মাথার ওপরে শূন্যতা শূন্যতা শূন্যতা।
শূন্যতা সৃষ্টি করা নীল তাবুটাকেই আমরা আকাশ বলি।
কত মিথ্যা একটা দৃশ্যের নাম আকাশ। তথাপি
এরকম মনে হয় যেন আকাশ লালন করছে আমাদের পৃথিবী।
রোদের খুঁজি আমরা আকাশের দিকে তাকাই, বৃষ্টির খোঁজে
আমরা আকাশের দিকে তাকাই। অথচ রোদ বৃষ্টির সঙ্গে
কোনো সম্পর্ক নাই আকাশের।
ক্লান্ত লাগলে আমরা আকাশের দিকে তাকাই। হেরে গেলে
আমরা আকাশের দিকে তাকাই। ঘুম না এলে
বিছানা ছেড়ে উঠে এসে আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি।
যেন আকাশের কোন একটি তারা চুরি করেছে আমাদের ঘুম।
যেন আকাশ ফিরিয়ে দিতে পারে সেই ঘুম…
এভাবে অজস্র মিথ্যা কথার জন্ম দিয়েছে আকাশ আমাদের
খুলির অন্ধকারে। বারবার বিশৃংখল করেছে আমাদের ভাবনাকে। কত মিথ্যা একটি চিত্রাংকনের নাম আকাশ।
প্রায় প্রলাপ বলে বলতে পারি আমাদের কথাবার্তা কে, যখন
আমরা বলি আমাদের মাথার ওপরের আকাশটির কথা…
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন