তাপস গুপ্ত
ভয়, নেতি..অ্যাকুরেসি
কবিতাটি প্রায় সম্পূর্ণতা পেয়েছে এরকম একটি ধারণার পরিসমাপ্তির শান্তিপূর্ণ সমাপন অথবা সমাপতন ঘটিয়ে ফেলা গেছে এই ভাব বা ভাবনার উন্মীলন ঘটলেই প্রায় একইসঙ্গে দোসর এসে উঁকি মারে , তা হল ভয়। আপাতভাবে এই মন্তব্যটির শিরোধার্যতার গুরুত্ব কম বেশি বিচারে না গিয়েও একটা নিস্পৃহ মান্যতা দিলে অতি বিস্তার ক্ষতি হবে না একথা আস্থা সংশয়ে ভর করে বলা যেতে পারে। সংশয় আর সংশয় হীনতার সংশ্লেষিত চিত্তের তথা চেতন অবচেতনের অবভাসে কবিরা মেনে নিয়েছেন,
বাক্যে কেউ দেখেও না, বাক কে কেউ শুনেও শোনেনা; সুবাসা জায়া পতির কাছে যেমন অনাবৃত, বাক আবার কারো কাছে তেমনি প্রকাশিত: ঋকবেদের এ মন্ত্র স্মরণ করিয়ে দেয়, কবিতার সমীপে উপনীত হওয়া সহজ কাজ নয়। পুরনো কাব্যভাষা ঝেড়ে ফেলে নির্মাণের অভিনব ভাষায় রচিত কবিতার কাছে যাওয়া আরো কঠিন। কবিতার ভাষা স্বরূপের সন্ধান জানা যায় নানা দিক দিয়ে: রূপ ও সংরূপের দিক, কল্পচিত্র ও আদিকল্প চিত্রের দিক, পুরাণ প্রতীকের দিক।
(১)
শব্দ,বিজ্ঞান। হ্যাঁ,সেই পাণিনির সময় মান্য সম্মান পেয়েছে।ভাষা বিজ্ঞানী গ্লিসন জানাচ্ছেন,
"And it should be a source of humility to modern linguists to recognise that the most successful and complete description is very probably still Sanskrit grammar of Panini and his associates antedating modern descriptive linguistics by millenia".(২)
এই হাওয়া - শব্দের উচ্চারণ কৌশলে হয়ে ওঠে আমার আপনার মুখের ভাষা, কথ্য ভাষা।আর এই হাওয়াময় ভাষাকে সাংকেতিক লিপি আকারে
বেঁধে দিলে সেটি হয়ে লেখ্য ভাষা অক্ষর।কবি জানেন,কবিতায় এই ভাষা এক শিল্প সুষমামন্ডিত দেহী রূপ পেতে চায়। কবির ওই ভিতরের শিল্প বোধ সম্পন্ন "আর্টিস্ট" সত্ত্বাটি প্রথম ভয়টি পায়।কারণ সে জানে , অডেন যখন কবিতাকে মেমোরেবল স্পীচ বলেন তখন জীবনানন্দের সংশোধনে সেটি দাঁড়ায়, অবিস্মরণীয় বাণী ছাড়া কবিতার অন্য কোন সংজ্ঞা আমি সম্প্রতি খুঁজে পাচ্ছি না (৩)। কবিতা তাঁর কাছে, মহাবিশ্ব লোকের ইশারার থেকে উচ্চারিত সময় চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতি সাধক অপরিহার্য সত্যের মতন, কবিতা লিখবার পথে কিছুদূর অগ্রসর হয়েই আমি বুঝেছি, গ্রহণ করেছি ।এর থেকে বিচ্যুতির কোনো মানে নেই আমার কাছে(৪)। এবং এর পরেই তিনি আমাদের জানিয়ে দেন, তবে সময় চেতনার নতুন মূল্য আবিষ্কৃত হতে পারে। পাশাপশি স্মরণে এসেই যায়, এলিয়টের এই উক্তিটি,
"The historical sense of the timeless,as well as of the temporal and of the timeless and temporal together is what makes a writer traditional."(৫)।
এই " সময়ের কাছে" কবির আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মনিবেদন। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর কবিতা আলোচনার প্রাসঙ্গিকতায় শঙ্খ ঘোষ আমাদের জানিয়ে দিয়ে বলেন,
ভয়গুলি এসে যে ঢেকে দিতে চায় এই শব্দ, সে কথা অবশ্য কবি গোপন করেন না। নিজের অনুভব আর অভিজ্ঞতার সমগ্রতা থেকে কথা বলতে চান বলে ক্লান্ত শ্বাস ফেলতেও ইতস্তত করেন না তিনি, মাঝে মাঝে মনে হয় ' চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে, পারলাম না' , আর তখন,' সেই থেকে সারাদিন আমি মাথা খুঁড়েছি, শব্দের কাছে, মন্ত্রের কাছে, ভালোবাসার কাছে, ঘৃণার কাছে,..'(৬)।ভয়ের আবরণ সরিয়ে ''নেতি নেতি'র এক মহৎ অসন্তোষ তাকে অ্যাকুরেসির অভিমুখে নিষ্ঠ করে। ঠাকুরের ভাষায়," নেতি নেতি করে আত্মাকে ধরার নাম জ্ঞান"(৭)।আর জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই। অবিস্মরণীয় বাণী আবর্তিত হয়ে শুনিয়ে যায়,
মানুষের ভাষা তবু অনু অনুভূতি দেশ থেকে আলো
না পেলে নিছক ক্রিয়া; বিশেষণ; এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল
জ্ঞানের নিকট থেকে ঢের দূরে থাকে।
অনেক বিদ্যার দান উত্তরাধিকারে পেয়ে তবু
আমাদের এই শতকের
বিজ্ঞান তো সংকলিত জিনিসের ভিড় শুধু-- বেড়ে যায় শুধু;
তবুও কোথাও তার প্রাণ নেই বলে অর্থময়
জ্ঞান নেই আজ এই পৃথিবীতে; জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই। (৮)
শব্দভাষা অনুপমবাচনের রীতি মনসিজ মন্থনে যখন 'আর্টের মূল্যে ' অবয়ব পেতে চায় তখন অবশ্যম্ভাবিতায় মনে হয়,
আমার কিছু দেবার আছে।না দিয়ে আমার শান্তি নেই। আর্ট একটা ছল ,একটা মাধ্যম। ওর আড়ালে রয়েছে আরও একটা ব্যাপার। দেওয়া আর পাওয়া। জানা আর জানানো।আমি দাতা,আর পাঠক যিনি নিচ্ছেন তিনি জ্ঞাতা,তিনি গ্রহীতা,তিনি রসিক।রসিক গ্রহণ করেন একজনের আত্মদান।আপনি জ্ঞাতা ,তাই জ্ঞাত হন আর একজনের অন্তর। আর্ট একজনের অন্তরবাসীকে আরেকজনের অন্তরগোচর করে।একজনের সত্য পরিচয় আরেকজনের হৃদয়ে পোঁছে দেয়।(৯)।
এই সত্যহলাহল কবি ধারণ করে নিয়ে চলেছেন বলেই সৃষ্টির সৌন্দর্য নির্মাণ অন্তেও তিনি নিস্পৃহ থাকেন, কুণ্ঠিত দ্বিধায় তিনি তোরঙে লুকিয়ে রাখেন ধ্রুপদী সৃষ্টি । ভূতপূর্ব অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র কেবল বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন সাহিত্যরসিক, উপসংহারে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার রাখলাম
১৯৪৯--৫০ এর কথা বলছি। আমি, অরুণকুমার সরকার, নরেশ গুহ, আরো কেউ ছিলেন কি না এখন মনে নেই--একদিন ওঁর (কবি জীবনানন্দ দাশ) বাড়ি গেছি। আবদার জানিয়েছি ওঁর কবিতার ঝুলি থেকে অপ্রকাশিত কবিতা বের করে আমাদের যেন দেখান। খুব কুণ্ঠাভরে তোরঙ্গ খুলে ' অন্ধকার ' কবিতাটি বের করলেন। এক্সারসাইজ বুকের রুল টানা পৃষ্ঠায় পেন্সিলে লেখা প্রায় ধূসর হয়ে এসেছে:" এটা কি চলবে?" পড়ে আমরা থ। আমাদের সমবেত চিৎকার," এ জিনিস এতদিন ফেলে রেখেছেন আপনি?"(১০)।
কবিতা এক অন্তরাবৃত রহস্যময় খনন প্রক্রিয়া। নিজের সঙ্গে নিজের সংঘর্ষ ও সহাবস্থান, এর সঙ্গে তার সম্পর্কে দ্বান্দ্বিকতার নির্মাণ। কবি প্রাবন্ধিক সুধীর দত্ত ওপরের মন্তব্যটি বদলেয়ার সম্পর্কে করলেও এটি যে কোন কবির অন্তর্জগত ক্ষেত্রে অতি প্রাসঙ্গিক। শিল্পী পরিতোষ সেন ক্রিয়েটিভ প্রসেসের আলোচনা প্রসঙ্গে জার্মান শিল্পী পল ক্লীর একটি মন্তব্য তুলে ধরেছিলেন,মন্তব্য টি হল,
"…At first I was not capable of producing very much, because the discrepancy between initial inspiration and final expression was to great for me to overcome.I had to keep on waiting…I preferred to do nothing until I was sure of the pure form and until the work forced itself upon me…!" এবং শ্রী সেন আমাদের জানিয়ে দিতে বলেন, সৃজনী শিল্পে অগ্রগমন বা প্রণালী কে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি ক্রিয়া ইচ্ছাশক্তির দ্বারা পরিচালিত অপরটি অনৈতিক বা বহুলাংশে স্বজ্ঞা লব্ধ(intuitive)।
কবি তাঁর এই বিশ্লিষ্ট আত্ম সত্যকে যত আন্তরিক নির্মমতায় ধারণ করে নিতে পারবেন ততটাই তিনি একুরেসির অভিমুখ শক্তির গমনপথের সহায়ক হয়ে উঠবেন।
তথ্য ঋণ:
অতি কুণ্ঠিত ভাবেই জানিয়ে রাখতে চাই এই গ্রন্থ ঋণ দেওয়া শুধুমাত্র পান্ডিত্যের বিজ্ঞাপন বহর পেটানোর জন্য নয়। দিচ্ছি এই কারণে যে, কিঞ্চিতকর লেখাটি পাঠে যদি অতৃপ্তি থেকে যায় তাহলে উৎসাহীগণ নিম্নস্থ প্রবন্ধ গুলি পড়ে নিলে আরো বেশি তৃপ্তি সহায়তা লাভ করবেনএবং এটাও নিশ্চিত বুঝবেন কুম্ভীলকবৃত্তির একটি আপগ্রেড ভার্সন হয়ে উঠেছে আমার লেখাটি। এসব ব্যতিরেকে আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো প্রবন্ধকারদের প্রতি সবিনয় কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন।।
১. কবিতার ভাষা কবিতায় ভাষা: বীতশোক ভট্টাচার্য
২. ভাষাবিদ্যা পরিচয়: পরেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য
৩. জীবনানন্দ দাশের কাব্যাদর্শ : অলোক রায়
৪. কবিতার কথা: জীবনানন্দ দাশ
৫. ট্রাডিশনাল এন্ড ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট: টি. এস. এলিয়ট
৬. কবিতার মুহূর্ত: শঙ্খ ঘোষ
৭. রামকৃষ্ণ কথামৃত: শ্রীম
৮.১৯৪৬--৪৭: জীবনানন্দ দাশ
৯. লক্ষ্য এবং উপলক্ষ: অন্নদাশঙ্কর রায়
১০. জীবনানন্দ প্রসঙ্গ: অশোক মিত্র, কোরক,১৯৯৪
নিমজ্জমান মানুষের অনুচ্চারিত যন্ত্রণা:সুধীর দত্ত,দেশ,২০২১
কবির ছবি: কয়েকটি ভাবনা: পরিতোষ সেন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন