অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায় 




তারিখ 

উত্তরে দু'টি জানালা। উত্তুরে হাওয়ার ঘর। এঘরে গ্রীষ্মে টিকতে পারা দায়। শীতেও ঘরখানা সহ্যশক্তির সীমা ছাড়িয়ে যায়। এখন ঘরজুড়ে নির্জন হেমন্ত জেগে থাকে। মেঝেয় পাতা ওড়ে। আর আমার কথা ফুরিয়ে যায়। 
প্রতিবছর হেমন্ত আসে, প্রতিবছর হেমন্তে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। খুব ইচ্ছে করে। এই উত্তুরে হাওয়ার ঘর আমাকে বন্দি করে রাখে। রাতে কী শীত! কী ছায়াময় যন্ত্রণা! তারই মাঝে দূর থেকে কীর্তনের শব্দ ভেসে আসে। এক পুরুষকণ্ঠ কী যেন গায়। কথা বোঝা যায় না, সুর ভোঁতা হয়ে জানালার কাচের গায়ে লাগে, শুধু বোঝা যায় গাইতে গাইতে কেঁদে ফেলছে সেই কণ্ঠ। ভাসানের শব্দও আসে। দূরে কোথায়, কোন রাস্তায় একটি মূর্তি নিয়ে কিছু মানুষ চলতে থাকে। ঢাক, তাসা, উল্লাসের শব্দ টুকরো টুকরো হয়ে ধাক্কা খায়। রেল যায়, ঘনঘন আরও সুদূরের আভাস দিয়ে ঝমাঝম দূরত্বে সরে যেতে থাকে। পাড়াতুতো পশু-পাখি ডাকে, মাছ ঘাই মারে জলে। মাঝে মাঝে কেউ জোরে কথা বলে ওঠে। কেউ শব্দ করে দরজা বন্ধ করে। মুমূর্ষু বৃদ্ধের কাশির শব্দ ভেসে আসে। দোকানপাট নিভে যাওয়ার জীবন ফুরোনো এক শব্দ আমাকে একটা কুয়োয় নামিয়ে দেয়। বন্ধ ঘরে তখন মরে যেতে ইচ্ছে করে। হেমন্ত আমার মৃত্যুর স্মৃতি বয়ে আনে। 
এক হেমন্তে আমার মরে যাওয়ার স্মৃতি আছে বেশ। কবেকার এক নভেম্বরের দুপুরে আমি কবিতার বই খুঁজতে গিয়েছিলাম। একটি ছোট্ট দু'ফর্মার বই, আলমারিতে সহজে হারিয়ে যায়, এমন একখানা বই খুঁজতে নভেম্বরের বুক চিরে হাঁটছিলাম। হেঁটে হেঁটে  নিজস্ব পায়ে চলার পথ গড়েছিলাম। দুপুর, রোদ, ভিড় আমাকে ক্রমাগত অজুহাত খুঁজতে বলেছিল। খোঁজো, কীসের জন্য এসেছ, কীসের জন্য এখনও বাড়ি ফিরছ না, পথে ঘুরছ, তার এক জুতসই অজুহাত খুঁজে আনো। এই যে তোমার অপেক্ষা একটি মাত্র তিরিশ পাতার বইয়ের জন্য, কয়েকটি কবিতার জন্য পাঁচতলা অন্ধকারে ওঠানামা করে চলেছ, ফুটপাতে ঘুরছ, আবার ফিরে আসছ; এই মৃত্যু ভাবতে লজ্জা করছে না? বরং এক মানানসই অজুহাত খুঁজে নাও। মনকে বোঝাও তোমার অন্য কাজ। নয়ত মৃত্যু তোমাকে খাবে। 
কত আড়ম্বরে মৃত্যুর হাতে আমার রক্ত-মাংস তুলে দিলাম! 
আমি কে? কী আমার পরিচয়? একবার দুই শীতবালিকা এসে প্রশ্ন করে গেল। সেদিন থেকে ভাবি, কী আমার পরিচয়, কবেই বা সেই খাঁচা কেটে ফেলা যাবে। সেদিনও ছিল উত্তুরে হাওয়ার ঘোর। বড়দিনের আয়োজনে জাঁকিয়ে শীত, খবরের কাগজে, চ্যানেলে যেমন বলে-  "শীতের ঝোড়ো ব্যাটিং"। বড়দিনের সকালে পরিপাটি সাহেবিয়ানায় ময়দান মেট্রো স্টেশনের গেটে অপেক্ষা করছিলাম। দক্ষিণ থেকে আসবে এক বন্ধু, আমরা যাবো পার্কস্ট্রিট, অ্যালেন পার্ক। পরিপাটি সাজ, ঘনঘন ফোন, বাড়তে থাকা ভিড়, হাওয়ার কামড় আর অপেক্ষা.. অপেক্ষার মাঝে মিশনারী স্কুলের ইউনিফর্ম পরা দুই কিশোরী এল আমার সামনে। আমার কাছে আসবার আগে কিছু দূরে তারা নিজেদের মধ্যে গল্প করছিল, পথচলতি মানুষকে লিফলেট বিলি করছিল। আমার কাছে এসেই তারা হিন্দিতে প্রশ্ন ছুঁড়ল, "আপনি বাঙালি?" 
হেসে জবাব দিলাম, "আমি তো তাই জানি!" 
ওদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত লম্বা মেয়েটি বলল, "ওহ! আমরা ভাবলাম পাঞ্জাবী।"
কী কারণে কে জানে, মনে কৌতুক জাগল। দেহে কি মাতৃভাষা, জাতি লেখা থাকে? কিছুটা আন্দাজমতো থাকে হয়ত। চেককাটা শার্ট, ছাই রঙের ব্লেজার ও স্কার্ট পরা ছোটো দু'টি মেয়ে। বাজি হেরে যাওয়া হাসিসমেত দুলে দুলে মেট্রো স্টেশনের গর্ভে নেমে গেল দুই বালিকা। 
বন্ধুটি এল। আমরা এক বিকট ভিড়ে ঝাঁপ দিলাম, আনন্দ করব বলে। রাস্তায় বেহালা বাজানো ছেলেটা, অ্যালেন পার্কের সাজসজ্জা, কবরখানার পিকনিক, পাবে ঢুকে যাওয়া ও বেরোতে থাকা মুখগুলি, রঙিন চশমা, দামী খাবারের স্বাদ; সেদিন সব ভাল লাগছিল। কিন্তু ভয় পেলাম। মেট্রো স্টেশনের দুই মেয়ে ফিরে এল মস্তিষ্কের ভিতরে। হালকা একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দুই কিশোরী আমাকে এক গভীর কুয়োর কাছে রেখে চলে গেছে। তাদের ভাবনা ছিল অন্য। অথচ তাদেরই প্রশ্নে আমি ভাবছি অন্য। কে আমি? বাঙালি, পাঞ্জাবী, অঙ্কিতা, অমৃতা, বন্দ্যোপাধ্যায়, সেন, ডাকনাম, ভালনাম; কিছুই তো না! সেই ভিড়ে কোথাও আমার পরিচয় খুঁজে পেলাম না। বেলা বাড়ল, রাস্তা বন্ধ হল। ভিড়ের অভিমুখ ঘুরে গেল, আর মস্তিষ্কের ভিতরে আমি দুই বালিকার সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে গেলাম। তর্কে হারলামও। চোখা চোখা বাক্যবাণে তারা বুঝিয়ে দিল, আমি অন্য কেউ সেজে ঘুরছি। আমাকে আমার মতো লাগে না, অন্য কেউ সেজে আছি। অবশেষে হার মেনে বন্ধুটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, "আমি কে বল তো?" 
সে বলল, "ভিড়ের চোটে মাথা খারাপ হল নাকি? তুই অঙ্কিতা। হয়েছে?" 
মরিয়া হয়ে বললাম, "কী করব আমি?" 
সে বলল, "কী আবার? চাকরি।" 
সেদিন পার্কস্ট্রিটের ফুটপাত থেকে একটি বাদ্যযন্ত্র কিনেছিলাম। তার সুরের ভিতর মরুভূমি। বাজাতে জানি না, তবু কিনে অতি সাবধানে ঘরে নিয়ে এলাম। এখন, এতবছর পরে, শীতের মাঝে দুই বালিকা আসে। আমার পাশে বসে। খেলনা বাদ্যযন্ত্র ভেঙে গেছে কবেই, আমি সেই ভেঙে যাওয়া যন্ত্র থেকে এলোমেলো সুর বাজাই। কানফাটানো শব্দ বেরোয়। শীতবালিকারা বলে- ভিড়ে যাবে, না একা মেট্রোস্টেশনের গেটে দাঁড়িয়ে থাকবে, বুঝতে না পেরে আধখানা হয়ে আছ। কিছুই হল না। কিছুই হবে না। জানবে না তুমি কে। কেউ জানতে পারে না। তুমি শুধু আধখানা মানুষ হারানো ভাঙা যন্ত্র থেকে এলোমেলো শব্দ তুলবে। উল্লসিত পৃথিবী তোমাকে ঘিরবে, আর তুমি সিদ্ধান্তহীনতায় ডুববে। তোমাকে ঘিরে নাচ চলছে, ঘুরে ঘুরে আনন্দের নাচ। আর তুমি এক সার্থকতাহীন, অসফল, আধখানা মানুষ অন্য কিছু সেজে দাঁড়িয়ে আছ কতকাল। এখনও শুধু একটা কবিতার বই খুঁজতে ঘুরে মরছ। আর কতকাল ঘুরে মরবে? 
এখন হেমন্ত এলে ভাবি, আমার তো তেমন কিছু নেই। পুরনো খাতা, কলম সম্পত্তি নয়। শুধু মস্তিষ্ক জুড়ে এক ছাই-ছাই হেমন্তকাল ছেয়ে আছে। এই-ই আমার সম্পদ। আমি তার তল পাবো না। কাউকে লিখে দেব না। কে আমি, তা খুঁজতেও যাব না। শুধু একটি হেমন্তের রাতের মায়ায় বারবার পৃথিবীতে ফিরে আসবো। মায়া কাটবে না। আসবই। 
শুনেছি, পৌষের শেষ দিনে আমার জন্ম। চাই, একটি নির্জন হেমন্তের দিনে আমার মৃত্যু হোক। 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন