প্রদীপ চক্রবর্তী

"নব্বইয়ের এক জনৈক জাদুকর ও কথামালা"


কবিতার বই -- "আবার নতুন করে বর্ষাকাল" 
কবি - শুভাশিস মন্ডল 
প্রকাশক - নাটমন্দির / রঞ্জন আচার্য 
প্রচ্ছদ -  জিশান রায় 
প্রথম প্রকাশ -- নভেম্বর, ২০২২ 
মূল্য - ১২০ টাকা 


নব্বই দশকে যারা কবিতা চর্চা করতে আসেন, বাংলা কবিতায়, তার মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী কলমটির নাম শুভাশিস মন্ডল | নিবাস - রানীগঞ্জ | পেশা- শিক্ষকতা| সম্পাদিত পত্রিকা -- অনপেক্ষ | কবি'র প্রকাশিত আগের কবিতার বইগুলো হলো, যথাক্রমে, 'নির্বাপিত',
 'জেলিশরীরের দেবতারা',  'চোখে চোখ, একটু হাওয়া',  'অভিভূত  অসংকলিত '|  

বাংলা কবিতার বিস্তৃত ভুবনে যারা নীরবে, নিভৃতে, সাধকের মগ্নতা নিয়ে একাকী কাজ করে চলেছেন, তার মধ্যে অন্যতম মুখটি হলো, শুভাশিস মন্ডলের | যিনি প্রচারের আলোয় আলোকিত তিনি দুর্বল আর যিনি নীরবে নির্জনে কাজ করে চলেছেন তিনি শক্তিশালী, এই ধারণাটি ক্লিশে এবং মারাত্মকরকমের মিথ্যাচারে ভরা | 
আমরা সহজেই কবিতার মতো কিছু লিখলে তাকে কবি বলি অনায়াসে | এই অনায়াসে বলা শব্দটির ধার ও ভার না বুঝে বলে যাই বলেই, বর্তমানে এই বাংলায় বহুল প্রচারিত
 "বুদ্ধিজীবী" শব্দটির মতো তা ক্রমশ লঘু হতে হতে সাধারণের কাছে গুরুত্বহীন খিল্লির পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে | এখন আমি বললাম, সাধারণ শব্দটি | সাধারণ কারা?  আমআদমি?
 সাধারণ কী একটি গুরুত্বহীন শব্দ?  তা কেন হবে? 

শব্দ মাত্রই "ব্ৰহ্ম", বলেন প্রকৃত বিদগ্ধজন | তাই শব্দকে হেলাফেলা না করেই বলতে হয়, সাধারণ কোনও গুরুত্বহীন শব্দ নয় | বরং এর গুরুত্ব অসীম | কারণ, কবিতার পাঠক কারা সেটা যেমন প্রশ্ন, ঠিক তেমনি প্রতিটি সাধারণের জীবনে কিছু না কিছু কবিতা আছেই | প্রতিটি মানুষের মন, কোনও না কোনও পর্যায়ে সৌন্দর্য্য, প্রেম, ভক্তি, ভালোবাসা, বিষাদ, বেদনা, কষ্ট, মায়া, কামনার কাছে গিয়ে ভিজে যায় | সবাই শব্দে অব্যক্ত প্রগাঢ় অনুভূতি ধরতে পারেন না ঠিকই, কিন্তু যারা ধরতে পারেন তারাও "উৎস কবিতা" লিখতে পারেন না | চূড়ান্ত অনুভব ও ভাবনার মিশেলে যে অরূপ অনুভূতিগুলি উঠে আসে তাকে কবিতার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার জন্য, মানুষ কৌশল অবলম্বন করেন | শব্দের, প্রয়োগের, ছন্দের, ধ্বনির, এমনকি গদ্যের মধ্যে নিহিত "ফল্গু" ধারার মতো যে চোরা কবিতার রস লুকিয়ে থাকে, তাকেও কবিতা করে তোলেন কেউ কেউ | বিভিন্ন কবির পাঠক ভিন্ন | পৃথিবীর সবাই যে একজন কবিকে নিয়েই মাতামাতি করবে তা তো নয় | অনেকেই রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের কবিতা ভালোবাসেন না | অনেকের কাছে ছন্দ কবিতা প্রকাশের মাধ্যম নয় | আমাদের ট্যাবু, কুসংস্কার আমাদের এমন অর্ধ বোধের শূন্যতায় ডুবিয়ে রেখেছে যে আমরা নিয়মের বাইরে গেলে, গেলো গেলো করি !শাপশাপান্ত করি, যদি কেউ বলেন, রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ আমার প্রিয় কবি নন | 

আমরা যদি একটু সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে, একটু বড়ো জায়গা থেকে নানান রসের কবিতা অধ্যয়ন করি, তাহলে পাঠক হিসেবে আমরাই উপকৃত হই | সংকীর্ণ মন, পাঠকের হতে পারে না | এমনকি সে সত্যিকারের "সাধারণ" হয়েও উঠতে পারেনি | কারণ সত্যিকারের সাধারণের কোনও কাঁটাতার নেই | অনেকটা নাম না জানা পাখির মতো | সে দেখে ধরিত্রীকে | বসুমাতাকে | সে ভাবে, মুসুর ডালের মতো ছোট পৃথিবীতে থেকে, এই মহাজগতের মাঝখানে আমরা কতই না সংকীর্ণ! কত তুচ্ছ আমোদে মত্ত, অথচ, মানবশক্তির অহেতুক অপচয়ে আজ ক্রমশ কমে আসছে সহজে নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গাটা | 

ওই যে প্রথমেই বললাম না, প্রচার বা প্রচারহীনতা বড়ো কথা নয় | কবিতার উৎকর্ষই কবির শক্তি| কোনও প্রচারে যেমন অকবিকে কবি করা যায় না, তেমনি কবির মনন ও নিজস্ব জগৎ ও۔ তার জ্বলজ্যান্ত কবিতারাই তার কবিত্বের নির্ভার বহন করে|  মিল্কিওয়ে আর গ্যালাক্সিতে যেমন কোটি কোটি গ্রহ নক্ষত্র, তেমনি এই পৃথিবীকে বুঝে নেওয়ার দৃষ্টি এবং ভঙ্গি সবার আলাদা| প্রতিটি সংবেদনশীল মেধাবী ও সচেতন মানুষই উপলব্ধি করেন যে, একই পৃথিবীর মধ্যে লাখো লাখো পৃথিবী নিয়ে যে যার মতো চলেছে মানুষ | এই বিপুল বৈচিত্র ও ব্যাপ্তি, শিল্পের সব শাখার মতো কবিতাতেও অবশ্য মান্য | যারা মানেন না, তারা আসলে মূর্খের স্বর্গে বাস করা এক একজন অচলায়তনের মহাপঞ্চক!

তাই কোনও আলোচনাই, শেষ কথা বলতে পারে না | শিল্পে শেষ কথা বলে কিস্যু হয় না | আর কবিতাকে যদি ব্যক্তির একান্ত ভাবনার শিল্প হিসেবেও দেখি, তবুও কবি কবিতা লেখার পর, জনারণ্যে নিছক সেই জনৈক ও সাধারণ | কারণ তিনিও যে শব্দাতীত বিমূর্ততাকে ধরেছেন ভাবনায়, তাই কেবল বহন করে নিয়ে যাচ্ছে না লিখিত কবিতাটি | সেটি কবি 'র কলম থেকে ঠিক বেরোবার পরই, বিপজ্জনক ভাবে বেপরোয়া | স্রষ্টাকে কেয়ার করে না কবিতা | তাই মানুষে মানুষে ভাবনার ফারাকে, একই কবিতা কারোর কাছে অসহ্য, কারোর কাছে সহ্যাতীত অমৃত | কবিতা অনেকটা বারবনিতার মতো বাবু টু বাবু'র ফারাক বুঝে নিজের বরখা খোলে | নিজেকে মেলে ধরে, নানান মেখলায় | তাই কবিতা কারোর একার নয়, তা অনেকের ভেতর ভিন্নভিন্ন আভাস তৈরী করে | অনেকটা সেই রবি বাবুর গানের মতো ...

আমি    কান পেতে রই      ও আমার   আপন হৃদয়গহন-দ্বারে   বারে বারে

কোন্‌   গোপনবাসীর কান্নাহাসির   গোপন কথা শুনিবারে--   বারে বারে ॥

          ভ্রমর সেথা হয় বিবাগি   নিভৃত নীল পদ্ম লাগি রে,

কোন্‌   রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে   বারে বারে ॥

          কে সে মোর   কেই বা জানে,   কিছু তার   দেখি আভা।

          কিছু পাই   অনুমানে,   কিছু তার   বুঝি না বা।

          মাঝে মাঝে তার বারতা   আমার ভাষায় পায় কি কথা রে,

ও সে   আমায় জানি পাঠায় বাণী   গানের তানে লুকিয়ে তারে   বারে বারে ॥


আমাদের এই এক ও একমাত্র জীবনের কাজ, মনকে প্রসারিত করতে করতে সেই অনন্ত তরঙ্গের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া | 


রাষ্ট্র নিয়ে আমাদের যে সংকীর্ণ মন, যুদ্ধ গণহত্যা ধর্মের মুখোশ ধর্ষণের সুদীর্ঘ রক্তাক্ত ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি কী অনন্য সত্যের সাধক কবি শুভাশিস মন্ডল| তিনি এই বইয়ের আটাশ পাতায় গিয়ে, চব্বিশ সংখ্যক যে কবিতাটি লিখে ফেললেন, বাংলা কবিতার লুকোনো সংগ্রহশালায় তা অমর হয়ে রইলো | আমি দৃঢ়তার সঙ্গে এটা বললাম, কারণ আমি অত্যন্ত ভালোবেসে, সমস্ত রকমের কবিতার পাঠক | তাই এটা প্রত্যয়ের সঙ্গে বলা | পাঠক আপনি কবিতাটি পড়ুন ---- 


"তুমি আমি মিলে দেশ 
এ কখনও সত্যি হতে পারে? 
আমাদের অদ্যাবধি দেখাই হল না! 
আমরা দুজনেই বেশ বহুজন্ম ধরে 
দুজনকে মেরে কামড়ে ধর্ষণ করে 
ছিঁড়েখুঁড়ে চেটেপুটে নিঃশেষ করেছি| 
আজ মিলনের ভান থেকে 
খোলস - কঙ্কাল থেকে 
তৈরি হল 
রাষ্ট্র নামের এক জাল খেরো খাতা|" 


কী মারাত্মক রকমের সত্যি এবং গোপন সন্ত্রাসের মতো নামিয়ে আনে রক্তে মজ্জায় শিরায় উপশিরায় অভিঘাত | 


৬৪ পাতার আপাত নিরীহ ও ছিমছাম সুন্দর দেখতে এই বইটাতে মোট ৫৬ টি কবিতা আছে | এক থেকে ছাপ্পান্ন | এক দীর্ঘ কবিতার টুকরো টুকরো প্রলম্বিত অন্ধকার, ত্রাণহীন আর্ত নিসর্গ ও মানুষের অসমাপ্ত দাহকার্য | কখনো কখনো চৌষট্টিকলা ও তন্ত্রের ঘোর ভৈরব অলৌকিক কুয়াশার আদিগন্ত মোহিনী আড়ালকে রহস্যময় করে বাজিয়ে যায় বেদেনির মোহাবিষ্ট বীণ , কত অবতলে  অবরোহে, স্মৃতির মৃগনাভি মায়াবী নির্জনে প্রেমের ভাষ্য ছাড়াই অব্যক্ত ব্যথার অগোছালো অভিমান জমা রেখে যায় নানান আঙ্গিকে চাঁদের ফেরিঘাটে | ভোরের সপ্তর্ষি দেখে, লোকলাজ ভুলিয়ে সমাজ সংসারের রক্তচক্ষু নীতিমালা ভাসিয়ে কীভাবে, আমার আমি, আমার তুমি এবং আমি'র অসংখ্য চরিত্র, স্ববিকল্প আত্মকুশিলব, তার কোনও স্পর্শগ্রাহ্য অবয়ব নেই, কিন্তু নিজের জল মুকুরে সেই হয়ে ওঠে গৃহী কিংবা অবধূত | অনন্ত পিপাসা আর অজানা পথ | একই নৌকোয় চেপে চলেছে সময় কাল খণ্ডিত পল অনুপল দণ্ড মুহূর্তের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের মানুষ | 


এ বই যদি বলি প্রেম ও বিরহের? বিচ্ছেদ জেনেও নিজের ক্ষত'য় আঙুলের ধারালো নখ চেপে ধরে নিজের রুধির পান? এ এক অসামান্য নির্জন পার্বত্য অঞ্চল | পাশে গভীর গিরিখাত | তল্লাটজুড়ে কোনও দিন কোনও বসতি গড়ে ওঠে নি | যে পথে হেঁটে এলাম সে পথে কোনও দিন মানুষের পায়ের ছাপ পড়ে নি | আবার পট যায় বদলে | কবি র সংস্কার, অভিজ্ঞতা, মানুষের গভীরে যে অতলান্ত মানুষের বিচিত্র রূপ, পরতে পরতে উঠে আসে এক একটা আঁচড়ে | শুভাশিস লিখছেন ৩৯ নম্বর কবিতায়, প্রথম তিনটি লাইন বাদ দিয়ে, তারপর ۔۔۔۔

"ধরো, আমরা দুজনেই দুজনকে চাই না, / তবু দেখা হল কোনও ঘোরে কঙ্কালের বাসরের
 রাতে, / তখন কী হবে? / কোনও  দুর্দৈব? / হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি? / আমাদের ঝগড়াঝাঁটি, কানা কৌতূহল / নিয়ে গল্প লেখা শুরু হবে অচিরাৎ? / বা দীর্ঘ
নিঃশ্বাসের মতো একটি কবিতা? / কে লিখবে? 

কে জানে ততদিন ফুল ফুটবে কিনা! / শিশুরা আসবে কিনা দলবেঁধে সকাল রিবনে বেঁধে / ছুটে ছুটে ভেঙে - পড়া - আমাদের ঘরে! / তুমি শুধু ভাবো / আর আমি যেন শুনি" 

এক বহু প্রাচী গোলক, যার একাংশে সভ্যতার চূড়ান্ত মুখোশ পড়ে মানুষ ক্ষয়ে যাচ্ছে সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে, রক্তাক্ত হচ্ছে, মেকি সম্পর্কের কৃত্তিমতায়, যেখানে সামাজিক যে কোনও স্তরের মানুষ একা | যেখানে হাজার হাটের হট্টরোলে এতো এতো প্রলাপ বকেও মানুষ বুঝতে পারছে সে কত অসহায় একা ভালোবাসাহীন | তার মনের চারপাশে নিজের মুদ্রাদোষে একা হতে হতে তার আসল ভাষাই আজ বিপন্ন | তার বিস্ময় আজ পণ্যসংহিতা | এই তীব্র একাকিত্বের ক্ষয়িষ্ণু সময়ের প্রতিবিম্বে আমাদের আমোদ সেই শান্তি সেই আনন্দ ছুঁতে পারে না | একশো এক বছর পাশে পাশে থাকলেও কেউ কারোর মন বোঝে না | সব মানুষের ভেতরেই সুপ্ত আগ্নেয় লুকিয়ে আছে নিজের ব্যাকুল অনুভূতিকে প্রকাশ করার জন্য, অথচ দরজা বন্ধ | কেউ কোনোদিন তার ভেতরের বাড়িতে প্রবেশাধিকার পায় নি | এই চূড়ান্ত সময়ের ক্ষয়ে যাওয়া বিপন্ন, হতভাগ্য মানুষের প্রেম ও একাকী কথন, কখন যেন অল্টার ইগো হয়ে, বুকের ভেতর মস্ত পাষাণভারটাকে তুলে ধরে | 

শুভাশিস লেখেন .... 

"যেদিন আমার মৃত্যুসংবাদের পাতা / উড়ো চিঠির মতো / এসে পড়ল আমারই পায়ের কাছে, জানতে পারলাম, / তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না / তথাপি তুমি শাশ্বতের মতো নিষ্ক্রিয় | / বারোয়ারি জগতে করুণার মতো চিহ্নহীন | / আকাশ তোমার বক্ষপট / সেখানে আঙুলের দাগ ও রক্তের!" ( ৩২ নং কবিতা ) 


"অচেনা লোকের লেখা  তুরুক পংক্তিতে / কখনও হৃদয় দিতে নেই -- / তবু তুমি দিলে | উঠে এলে চিলেকোঠা তক | / দরজায় শিকল ঠুকলে ঠিক তিনবার | / নইলে সুগন্ধ কেন ! কেন রতিকোলাহল / থেমে গিয়ে এমন অস্ফুটে প্রিয় বাতাস বইছে | / বন্ধ দরজা, ঘরে তাপ বেড়ে যায়! / ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে ভবিষ্যতে দেয়ালে কেবল / শত চেষ্টাতেও না মোছা দাগের মতো থেকে যাব | / তবু দরজা খুলবো না | থেকে যাবে পাহাড় ডিঙোনো সব / স্মৃতির লতানো গান, পঙ্গুতা আর অনাথ পংক্তিটি ... / পাঠোদ্ধারের পরে দরজা ভাঙতে পারো তুমি | / অথবা অপেক্ষা করে থাক, / কাঠের দরজা মাংস থেকে / নিজে নিজে খুলে আসতে পারে|" 
( এগারো নং কবিতা ) 

আমরা এমন এক দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যেখানে সন্ত্রাস আসলে জীবনের ধ্রুব হয়ে উঠেছে | রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতি এমনই যে ক্ষমতার দম্ভ ও সিংহাসনে বসে প্রভুর রক্তচক্ষু, আমাদের গড্ডল প্রবাহে দাসানুদাস মনোভাবের ওপর সিলমোহর এমন ভাবে চাপিয়েছে যে আমরা জেনেও চুপ, বুঝেও, ভাবনার বাইরে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত এক শান্তির ক্রেতা হিসেবে আমরা আনখশির বিক্রয়যোগ্য ক্রীতদাস | এই আমি বা তুমি বা আমরা, সবাই মিডিয়ালালিত জীবনের সত্য বিস্মৃত অলীক কুনাট্য দেখার আমোদে বিভোর | 

আসলে প্রেম হীন এই জীবনের প্রতি পদে পদে একা মানুষের চাপা আত্মকথনও কখনো প্রেমের অস্ত্র হতে পারে | হতে পারে বিপজ্জনক চিৎকারের অব্যবহৃত মনোবিকলন! হ্যাঁ তাই | সরতে সরতে সরতে সরতে সরতে আমরা দেয়ালের এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি যেখানে দেয়ালটা আসলে কংক্রিটের নয়, ঘুণে ধরা অন্ধকারের | মন্দ্রিত কষ্টের অসহপ্রশ্রয় আমাদের বিবেককে ফালাফালা করে | স্বপ্নজীবনের স্বপ্নপ্রয়াণ যে ভূষণে যে অজুহাতে ঢাকা থাকে, সেই জনপদে আড়ালদষ্ট সময়ের মানুষটি থমথমে প্রহরের ডাকে আর থামতে পারে না | সে যায় আসমুদ্র ঢেউয়ের রক্তকমলে, অবিরাম পুঁজরক্তে ঢাকা আদিম অনাঘ্রাত ফুলটিকে বাঁচানোর লক্ষে | 

"আমার মত - পথ - হাঁটা সেসব মৃত্যুর মতোই প্রত্যাশিত | / জন্মের ব্যত্যয় থেকেই আমি অর্জন করেছি / অপৌরুষেয় এইসব ষড়যন্ত্রের সংগতি !/ বিশ্বাস করো, বগটুই গ্রামের দু একটি / ভিটের ভস্মের নীচে, বুঝতে পারি, এখনও পড়ে আছে / আমার, আমার ই প্রেমভর্তি নকশাকাটা ঝোলা / আমার উপস্থিতি / যদিও অব্যবহৃত .... যদিও সেটি এখনও  পোড়েনি ..."
( ৫৫ নং কবিতা ) 

"বহুদূর মহাশূন্যে তোমার মিটমিটে হাসি আর চোখের জল / পৃথিবীতে এসে পড়তেই / বুদ্ধপূর্ণিমার ধ্যানী গম্ভীর উদাসী নিটোল চাঁদ / চোখ খুলে  তাকাল | চোখ বন্ধ করল | / বুকের পাটায় গেঁথে গেল চার পাঁচটা চাঁদজলুই |

দুঃখী কোমলতার বিশ্বে মরা কাঁকর / কুতকুত করে সব দেখে / মাটিতে পড়েই বীজ -- দরজা খুলল | / দুদিন পর সাদা অংকুর, দু রাত পর প্রফুল্ল সবুজ / একা উদ্ভিদ | ক্রমশ বেড়ে ওঠা পাতায় / ঝমঝমে রগে  আছড়ে পড়ল, পড়তেই থাকল / কুটিল ও ব্যর্থ,  ক্ষেমংকরী জ্যোৎস্না |/ নিমীলিত চোখের ভিতরে দুঃসময় | 

বাইরে রোদ - বৃষ্টি - শীতে  এ - পর্যন্ত কোনও হেলদোল নেই | / পাতা নড়ে না | ডাল কঠোর  নিষ্কম্প | / একেই তুমি শেষ ভাবলে? / ওগো জলুইবেঁধা বুদ্ধ, এই তবে নীরবতার শুরু!" 
( ৫৬ নং কবিতা ) 

 মহাকালদর্পণ হাতে  এই কালবেলায় সময়ের তীঘ্ন প্রবাহে সবুজ কিছু পাতার ভেলা ভাসিয়েছেন কবি শুভাশিস মন্ডল | পাতার হলেও তা অনমনীয় কাঠের মতো | যেখানে সময়সরণি ধরে অমোঘ সত্য প্রেম শাশ্বত এবং তীব্র অভিঘাতে, প্রতিবাদে, শ্লেষ ও প্রণয়পানীয়ে আমাদের স্থবির স্নায়ুগুলোতে রক্তের সঞ্চার ঘটায় | তার লেখা শব্দগুলো নিছক শব্দ না হয়ে, শব্দভেদী বানের মতো আমাদের জড়ত্বকে আঘাত করে | তার বিমূর্ত ভাবনার প্রবাহ এতো উষ্ণ ও জীবন্ত, যে এই লেখাগুলোর ওপর কোনও মৃতের সৎকারগাঁথা লেখে না পোকার দল | এমন অত্যাশ্চর্য 
দেয়ালা, বা কাছের হয়েও কোনও সুদূর রাতের বেলাভূমিতে আমরা জ্বলতে দেখি
 "আঁধারমানিক"|

 সেই বহ্নিতাপ সহ্য করো বাংলাভাষা .....

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন