অন্বেষণ

গাছের ভেতরে তুমি গাছ
জল ও হাওয়ার মধ্যে 
            জল আর হাওয়া।
অথচ তোমাকে দেখি না
পথে-ঘাটে ছেঁড়া -ছেঁড়া ছায়া ফেলে রেখে
কখন উধাও হও 
সে-রহস্য বোধের অতীত
যদিও তোমায় খুঁজি   যত্রতত্র----
ধাতুতে, শীতলতায়, বিলুপ্ত আখ্যানে।

তুমিও হেঁয়ালি কর
কুহুতানে ডাক দিয়ে
শূন্যের ভেতরে ঢুকে তুলে দাও
শূন্যের দেওয়াল।
আমিও নাছোড়বান্দা 
নৈঃশব্দ্যে সিঁধ কেটে
সরাসরি ঢুকে পড়ি তোমার আত্মায়।
লুকোনো তোরঙ্গ খুলি
প্রাচীন পুথির মধ্যে যতসব দুর্বোধ্য লিপি
যাতে লেখা তোমার জন্মকাহিনি ----
চপলতা --- বিবিধ বিক্ষেপ
সমস্ত পাঠ করি
কিছুই বুঝতে পারি না
শুধু এক দিব্য শিহরণে জীবন শুদ্ধ হয়
রাত্রির শরীর কাঁপে
আর অন্ধকার ভেদ করে বৃষ্টিপাতের মতো
তারাগুলি খসে পড়তে থাকে
আমাদের ব্যক্তিগত দিনলিপির
প্রতিটা পৃষ্ঠায়।






পংক্তিভোজন

কথা বলো তাই দুপুর দগ্ধ করি চৈত্রের মাসে
শাকান্ন সমীপে রাখি ভগ্নাংশ দিন
এমন রাত্রি -- বাতায়ন-ছোঁয়া অন্ধকার
সবই ওই কথার ভেতরে কথা বলে
ধ্বনি ও অক্ষরপ্রান্তে লেগে থাকে জল ও আগুন
সমস্ত লেহন করি, অভুক্ত অন্নদাস যেন
সকৃতজ্ঞ বেদিমূলে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম রেখে বলি --
এই ভরা উন্মেষ-প্রদোষ---ক্ষুদ্ধ-রতিকাল
সারল্যের বেলাভূমি কিংবা ওই তরঙ্গ জটিল
সমস্ত ছাপিয়ে তুমি কথা বলো বসন্ত-ভাষায়
আমরা প্রাকৃতজন তন্মাত্র বসে যাবো পংক্তভোজনে।







ইনফার্নো 

উচ্চতা বিষয়ে কিছু শোনার আগেই তুমি
ডানা মুড়ে নেমে গেছো আরও আরও গভীর পাতালে
ওই প্রান্তদেশে কোনো জলশব্দ নেই, সমস্ত নীরব
তুমি নৈঃশব্দের ভিতরে গিয়ে 'প্রসারণ' কথাটির অর্থ খুঁজেছো মিছিমিছি
লঘুদৃশ্যের সামনে বারংবার হাত পেতে রেখে
তখন সম্পূর্ণ মর্যাদাহীন হয়ে গেছে তোমার পৈতৃক পত্রপুট
যে-পাখিরা সূর্যাস্তের ঠিক আগে ছাদের আলস্যে বসে 
মেঘের আখ্যান শুনিয়েছিল
তুমি সেই কূজনের সারেগামা বুঝতে পারোনি
উচ্ছিষ্ট খোঁটার লোভে তাই মেঘ ও রেদ্দুরের
হিরন্ময় সম্ভাষণ ছেড়ে
পাতালের চেয়েও অন্ধকার সব মঞ্চের দিকে চলে গেলে।

তোমার এই ভিক্ষাবৃত্তি বর্ণমালা সহ্য করেনি
কবিতার খাতা খুলে দেখো
সেখানে প্রতিটা লাইনে শুধু লজ্জাহীন স্তুতি
কোত্থাও এতটুকু সূর্যকিরণ লেগে নেই।







সেই মেয়েটাকে আজ বড্ড দরকার 

সর্ষেফুলের দুঃখকে আঁচলে বেঁধে যে-মেয়েটা
নাবাল জমির দিকে চলে গেছে
আজ শুধু তাকেই দরকার
সেই জানে সূর্যাস্তের আলোর নিচে মাঠ 
কীরকম বিষণ্ন হয়ে যায়।

গতবছর এ-সময় হঠাৎ নিম্নচাপে কদিন
প্রবল বৃষ্টি হয়েছিল
খলবল মাছ উঠে এসেছিল তালডাঙার জলায়
সেই মেয়ে বৃষ্টিতে হাপুস ভিজে 
মাছেদের দলে মিশে কেটেছিল তুমুল সাঁতার।

আজ যখন সবেমাত্র শীত পড়তে শুরু করেছে
বইমেলার ফেস্টুন উড়ছে হাওয়ায়
খয়েরী কার্ডিগানের দিকে একটু একটু ঝুঁকে পড়ছে
অসঙ্কোচ জিন্সের জ্যাকেট
তখন গোঘাট লোকালের লেডিজের পরের কামরায় 
সেই পাড়াগাঁর চুল-খোলা মেয়েটিকে
ভীষণ ভীষণ দরকার।

একমাত্র সেই সমস্ত ডাউন ট্রেনকে
লাইনের শীতল নিষেধাজ্ঞা ছাড়িয়ে
উধাও প্রান্তরের দিকে নিয়ে চলে যেতে পারে

সেখানে একদল সর্ষেফুল আদিগন্ত দুঃখ নিয়ে
শেষ বিকেলের আলোয় এখনও দাঁড়িয়ে আছে।







কোজাগরী

এখনও তেমন করে সন্ধেই নামেনি
তবু এরই মধ্যে নদীতীরে
কদম্ব তমাল লিখে রেখে গেছে কেউ! 
হয়তো তার সছিদ্র বাঁশির ভেতরে
বাহান্ন বসন্ত কেঁদেছিল।
হয়তো সে প্রস্ফুটিত শাখার নিচে
আরেকটি শাখাকে চেয়েছিল
পত্র ও পুষ্পের সলজ্জ আড়াল সরিয়ে
দেখে নিতে চেয়েছিল ঘুম-ভাঙা কোরকের
মৃদু বর্ণমালা।

এখন আকাশ জ্বালিয়ে দিচ্ছে 
সুপ্রাচীন স্বচ্ছাচারী চাঁদ
জলেরও ভেতরে আগুন
যেন কেউ বসন-উন্মোচন করে একে একে 
চিনিয়ে দিচ্ছে 
সঘন উপত্যকা-- উঁচুনিচু টিলা
আর প্রস্রবনের গিরিখাদ।

কে গো তুমি আলোছায়ার আড়ালে সরে গেলে ?
শিলাফলকের মতো উজ্জ্বল ললাট
রতিক্লান্ত স্বেদবিন্দু --লেপ্টে আছে চূর্ণ কুন্তল
নিঃশ্বাসে পতঙ্গ ওড়ে--আদিমনবীর মতো
বিশুদ্ধ কামনা ! 

আজ শুধু উদযাপন, শুধু স্মৃতিবিলাসের মাধুকরী
বাহান্ন বসন্তজোড়া তোমারই বিপর্যয়গাথা ! 





নীলোৎপল গুপ্ত

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন