(ধরাবাহিক গদ্য)

শূন্যে ফেরিওয়ালা বৃত্তে বেলুন 

পর্ব-৪





দেখতে দেখতে ট্রাক এসে যায়। সমস্ত জিনিসপত্র ওদের নিয়ম অনুযায়ী ঘরে পৌঁছে দেয় প্যাকারসের লোকেরা। আসবাবপত্র জায়গা মতো রেখে ওরা চলে যায়। শুরু হয় আমার কাজ। এই সব এক দিনের কাজ না৷ প্রায় একমাস লেগেই যায়। তাও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে করতে সেদিন রাত ন'টা বেজে গেছিল। 

রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমোতে গিয়ে ভাবছি প্রথমবার বাড়ির বাইরে থাকার দিনগুলো। পনেরো বছর বয়স। মাধ্যমিক দেবার পর স্কুল হোস্টেল। ভর্তির আগে বড় আনন্দ হত এই ভেবে যে একা একা থাকব নিজের দায়িত্বে। নতুন বন্ধু বান্ধব, পরিবেশ৷ তার আগে সকলের কাছে সেই রহস্যময় হোস্টেল জীবনের গল্পই শুনেছি৷ আমার এবার নিজের অভিজ্ঞতা অর্জন করার পালা৷ 

জানেন তো ব্যাগপত্র গুছিয়ে একদিন ভোর বেলায় বাবা মা দাদা মাসি মেসো মিলে আমাকে হোস্টেলে দিতে গেছিল। আমি হোস্টেলে পড়তে যাচ্ছি না যুদ্ধ ক্ষেত্রে লড়াই করতে আজ ভাবি। সত্যিই কি এতো মানুষের যাবার দরকার ছিল? কি জানি হয়তো ছিল হয়তো বা না৷ বহু পুরনো দিনের একটা বাড়ি যার বাইরেটা শ্যাওলা জমে কালো হয়ে গেছে আর ভেতরটা রঙ করা থাকলেও গায়ে উঠে আসে৷ আমার জন্য যে ঘরটা বরাদ্দ ছিল তাকে মাঝের রুম বলে আখ্যা দেওয়া হত। ঘরগুলোয় সূর্যের আলো প্রায় ঢোকে না বললেই চলে৷ তাও দরজার সামনের খালি বেডে ভুল করে এক দু ছটাক আলো পড়ে। 

সেদিনটা রুমে কেউ নেই৷ দুজনেই বাড়ি গেছে৷ বাবা বিছানা বালিশ পেতে দিয়ে একটা বুক সেল্ফ কিনে আনল। সামান্য কিছু টাকা হাতে দিয়ে ওরা ফিরে যাবে৷ তখন প্রথমবার মনে হলো আমি ঘরছাড়া হলাম। চোখ জলে ভরে যাচ্ছিল। মায়া। মায়া কাটানো সহজ কথা না৷ 

আমি বড় হয়েছি প্রায় চল্লিশ জনের একান্নবর্তী পরিবারে৷ সেখান থেকে জীবনে প্রথমবার চলে এলাম এমন একটা ঘরে যেখানে আমি একা। পাশের রুমের দিদিরা ছিল। কেউ কেউ দেখা করতে এলো৷ খেতে ডেকে নিয়ে গেল৷ সুমনা দি, রাখীদি, পাপিয়াদি। বড় কাছের করে নিল মুহুর্তে৷ রাখীদি শেখাল রবিবার মাংসের দিনে বড় বাটি দিতে হয়। এছাড়াও হোস্টেলের টেবিল ম্যানারস খাবার ম্যানারস টুকটাক নিয়মকানুন৷ যে যার খেয়ে রুমে চলে গেল। দুপুরে ঘুমনোর অভ্যেস নেই৷ সম্ভবত ডাইরি লিখছিলাম। সেই দিন গুলোতে দিনলিপি লিখতাম৷ আজ যদিও সে সব পাঠ নেই৷ দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। ঘরের পেছনের দরজার কড়া নড়ল৷ নীল জামাপরা ধপধপে ফরসা একটি মেয়ে এলো। চোখে জলের ঝাপটা মেরেছে মুখ দেখলেই বোঝা যায়৷ আমি বুঝতে পারছিনা ও আমার ক্লাসমেট না দিদি৷ এক ঢাল লম্বা চুল। জীবনে প্রথমবার দেখেছিলাম এমন লম্বা চুল। হাসতে হাসতে বলেছিল, "কি রে কাঁদছিস? মনখারাপ করছে খুব? আমি বাসবদত্তা। তুই আমাকে দত্তাদি বলিস" ওকে দেখে আমার আরও কান্না পাচ্ছিল৷ আমার পাশে বসল। বলল গান শোনা একটা৷ আমি ভাবিনি ও কিভাবে জানল আমি গান জানি৷ তাও সিনিয়র বলেছে কথা না বাড়িয়ে গাইলাম। মনে হয় দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে। তারপর ওকেই বললাম "দত্তাদি আমাকে শোনাবে না" আবার সেই মায়াবী হাসি। খিলখিল করে ঘর ভরিয়ে দেয়। শোনালো৷ সে কী মধুর সুর... "দীপ নিবে গেছে মম"। দত্তাদি আমার থেকে চার মাসের ছোট। তাও দিদি। শুধু দিদি না ওর গায়ে অদ্ভুত মায়ের গন্ধ৷ নরম কোলটা যেন শুধুই আমার। আস্তে আস্তে আমিই হয়ে গেলাম দত্তাদির গার্ডিয়ান!  ওর সব কিছুতে আমার অধিকার৷ সব গোপন কথা আমি জানব। কৌটো খুলে নাড়ু খাবো। কাকু রাজভোগ নিয়ে এলে প্রথম কামড় আমার। যেন দত্তাদির নিজের বলতে কিছু নেই৷ সাদা জামাটা একবার জোর করেই পরলাম। আচ্ছা আমার নিজের দিদি থাকলে কি এমনটাই হতো? 

দেখতে দেখতে দিন চলে যায়। দত্তাদি টুয়েলভ পাশ করে চলে যায়। ওখানেই কলেজে পড়ত তাই আমার সাথে দেখা সাক্ষাৎ প্রায়ই হত৷ তবে আমি চলে আসার পর প্রায় ষোলো বছর দেখিনি আমার প্রিয় " দীপ নিবে গেছে মম"-কে। হোস্টেল জীবন শুরু শুধু দত্তাদিকে দিয়ে তা না। আমার দুই পরম বন্ধু ঈশিতা রুবাই, নানান লেখায় ওদের কথা বলি। আর যাকে হারিয়ে ফেললাম সকলের আদরের শুভেচ্ছা। মাঝে মাঝেই বড় মনে পড়ে৷ সেই গৃহহীন হয়ে যাবার দিনগুলোতে তো এরাই পরিবার এরাই প্রাণ এরাই নিরাময়। কেউ কারুর সাথে নেই তাও কেমন জুড়ে থাকি। 

এই সব গল্প শেষ হবার নয়৷ তাও করি। বার বার করি। জীবনের প্রতিটি প্রথম অভিজ্ঞতাই অন্যরকম। তাই না? সেই প্রথম থেকে আজ এতো বছর হয়ে গেল আমার আর ঘরে ফেরা হয়নি শুধু ঠিকানাই বদলে বদলে এগিয়ে চলেছি একটা স্টেশন থেকে আরেকটা স্টেশন।


(চলবে...) 




নীলম সামন্ত 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন