লিপি নাসরিন 





শূন্যতার গান

নিঃসঙ্গতায় আলোকিত হয়ে ওঠে বারান্দায় ঝুলে থাকা শূন্যতা, একটি- দুটি ঝরাপাতা কিংবা মরা আমের মুকুলে শিরশির শব্দরা খেলে বেড়ায়।
প্রশ্ন করতে পারো শূন্যের নিঃসঙ্গতা কেমন, পুরানো দেয়ালের জেগে থাকা দ্বিমাত্রিক  ছবিগুলোর দিকে তাকালে বুঝতে পারবে। কতো কাল ওরা চেয়ে আছে সমুখপানে অপলক। পরাশ্রায়ীর মতো রৌদ্রকুয়াশায় ঘোলাটে দুপুরে একরাশ বিরামহীন চলে যাওয়া স্বপ্ন। ওদের ভাব আছে ভাষাহীন, শব্দ আছে তরঙ্গহীন। মহাকালের বিরামচিহ্ন থামিয়ে রাখে না গতিপথ। তাপিত কংক্রিটে বাষ্পায়িত ছায়া ঘিরে রাখে ঘন হয়ে ধীরানুক্রমে নেমে আসা মধ্যাহ্ন। চৈতালি মেঘভুক দোলনচাঁপা ঘিরে খাদকের অগ্রাহ্য বিলাস। বুননে মাখা শুচিসিদ্ধ পিঙ্গল রোদে আকাশের বুকে জেগে ওঠা  সুতোল রেখায় উড়ে যায় কুহক। তীর্যক পতনে অশ্রুবিন্দুতে হীরকদ্যুতি পাখির ডানায়।






লেওনে কাএতানির খোঁজে 

জলাশয়ে চরে বেড়ানো মীন প্লাকয়েড আঁশের চকচকে পৃষ্ঠদেশে চিত্রায়িত শতাব্দীর ছায়া ভেঙে ভোর আসে। বিলেতি বেগুনের পাতায় নাচতে থাকে হাইডাথোড থেকে নির্গত  পুঞ্জতরল। সামনে তাকাতেই দেখতে পাই কিছুটা আবছায়ায় লেওনে কাএতানির নির্জন কুটির। আমি তাঁকে খুঁজছি এক শতাব্দী জ্বল্যমান বনকিনারায়। সহস্রাব্দের বড়ঁশি ফেলে তিনি বসে আছেন। রোমের ডিউক প্রাসাদের ঝাড়বাতির নিচে থেমে থাকা কলরবের মধ্যে পড়ে আসে 'আন্নাল দেল ইসলাম'- লিওনে কাএতানির পদ্মহৃদয়ে যে ছিলো 'প্যতিত আমির'। প্রিয়ার চুম্বন থেকে ঠোঁট সরিয়ে তিনি চুমুক দিলেন আন্নালির দ্রাক্ষাশর্করায়। ভুলে গেলেন নগ্ন বাহুর উষ্ণ আলিঙ্গনের স্পর্শ। একদিন তিনি মোহমুক্ত হয়ে হারিয়ে গেলেন ভ্যাঙ্কুবারের বনরাজির নির্জন রাজ্যে। ডেপুটেড পণ্ডিতবর্গ ক্যান্ডেলের আলোয় কালো কফিতে ভারমুক্ত হলেন সম্মতিপত্রে।লেওনে কাএতানি তাঁর তুলির শেষ আঁচড় টানবেন আন্নাল দেল ইসলামের একাদশ এপিসোডে। কিন্তু সম্মতিপত্রের কথা ভুলে  উনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে লেওনে কাএতানি আভেরএসের ভাস্কর্যের দিকে তাকিয়ে আছে মর্মর মূর্ত চোখে।







জলযানে কোরাল

পশ্চিমে মেঘের শীর্ণরেখা গতিচক্র আঁকে। মসৃণ মেঝেতে আপতিত রশ্মি বাঁক নেয় পূর্বে দেবদারুর শীর্ষে। পাখিদের কণ্ঠে বেজে ওঠে মধ্যাহ্নর নিদাঘ বাষ্পাশ্রয়ী সঙ্গীত। বাতাসে জলযানের করাঘাতে ফেনিল ধোঁয়াশা দিগন্তে কোরাল জেগে ওঠার বিস্ময়ে আমরা ভেঙে যেতে থাকি। আমাদের সঞ্চয় ফুরাতে ফুরাতে সমুদ্রশৈবালের জন্ম তিরোহিত হয়। মেরুভালুকের সাদা লোমে আটকে থাকা বরফ কুচির প্রার্থনায় আমরা নীত হই আটকে যাওয়া হিমবাহের কাছে।







প্রার্থনাপদ্ম

শান্ত স্বরের প্রতিবাদে বিধ্বস্ত নক্ষত্র মন্ডলীর টুকরো জানালার মর্মমূলে এঁকে যায় সামঞ্জস্য রেখা। পাতাটনে ফেঁপে ওঠা বাষ্পায়িত ধুম্র  মিথোজীবী নস্টকের নাভিমূলে উষ্ণ সুবাস ছড়ায়। মধ্যরজনীর নিকষ কান্তি খুলে ফেলে আবরণ। কে আছে প্রার্থনার মতো কাতর স্বরে পঙ্কিলতার জঙ্গলে জাগিয়ে তোলে আদরিনী পদ্ম? অচঞ্চল সৌম্য শিহরন জাগিয়ে যায় মোহিনী বাতাস। তারা হেসে ওঠে শব্দহীন বনে ঘুমিয়ে থাকা রাতের নিবিড় মায়ায়।





কাঠবেড়ালির চিত্রপট 

ভরদুপুরে এক কাঠবেড়ালিকে দেখলাম নান্দনিক চলনে মাতিয়ে রাখতে প্রাচীরের ঢালু পাশ থেকে শূন্য নারিকেল গাছের ভেঙে পড়া পত্রমুকুটকে। নিচে ছড়িয়ে রাখা শরীরে রোদের তরঙ্গে ওর লেজ উড়ছিল কলাপাতার তিরতির শব্দে। ওর চোখে গভীর ও তীক্ষ্ম বীক্ষণে আমার কবিতার কল্প দৃশ্যাতীত বিভায় বিচূর্ণ একখণ্ড পরিপাটি জমিন। আমি গেঁথে নিই সময়ের রঙে এক নান্দনিক পালকের অত্যুজ্জ্বল দীপন কবিতার করপুটে। ও পালিয়ে যায় আবার ফিরে আসে, লুকোচুরিতে মাতিয়ে, নিজেকে শুইয়ে রাখে স্বচ্ছ আকাশের উদোম ঢেউয়ে। প্রাচীরের শুকনো মসে রয়েছে ওর রৌদ্রভুক শরীরের তাপিত স্নিগ্ধতা। ও এলো চকিত আবার ফিরেও গেলো তুলতুলে প্রতিধ্বনিতে; শুধু রেখে গেল ভাবনার এক অখণ্ড আল্পনা।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন