গৌরাঙ্গ মোহান্ত
নিঃসঙ্গ যাত্রা
নিঃসঙ্গ যাত্রার চেয়ে সত্য কোনো অভিজ্ঞতা নেই। টার্মিনাল ভবনের হোল্ডরুমে বিমানযাত্রীকে অশ্রুজলে ভাসতে দেখেছি; অতীত ও বর্তমান যে সমস্ত অ্যালকোভ সৃষ্টি করে তার ভেতর অঙ্গুরীর অন্তর্লীন ঔজ্জ্বল্য, জামপাতার আনন্দি, আমছায়ায় স্কুলপথের নিদ্রাভোল, নীলসারে সঞ্চিত মাঠের ধুলো, শালপাতারং দিঘির সংলাপ, নারকেল বীথির যুদ্ধকথা, অজ্ঞাত হুতাশে বিদীর্ণ রবীন্দ্র-বাতাস সরব হয়ে ওঠে। অনাগত তরঙ্গের ভেতর প্রভাত কী রাত্রির ধ্বনি শ্রুতিগম্য হবে তা কেউ জানে না বলে অনিশ্চয়তা ও নিঃসঙ্গতা কালভার্টের দৃশ্য মুছে ফেলতে থাকে।
নিস্তব্ধতার দিকে
মেসেঞ্জারের কিবোর্ড অঙ্গুলিমুখে চেতনাবিন্দু আঁকবে না, দুষ্প্রাপ্য বইগুলোর নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা পেনসিল-উলকিতে সজ্জিত হবে না, চশমার অবতলতা চোখের শুশ্রূষার ভার নেবে না, ফোনকলে স্বজনের স্বরমণ্ডল ধ্বনিত হবে না, পাখি-বৃক্ষ-নদী-প্রান্তর-সমুদ্র-সৈকত থেকে কৌশিক ধ্বনি ভেসে আসবে না--এ সব নাস্তির কথা ভেবে নিশ্চুপ থাকি। পৃথিবীর সবকিছু ক্রমশ নিস্তব্ধতার দিকে এগিয়ে যায়। তবুও বস্তুর অভাবনীয় অবয়ব নির্মাণের ভেতর দিয়ে আমরা আনন্দ-তরঙ্গে ভেসে যেতে থাকি।
পিকোলোর সুর ও অপ্সরা
পিকোলোর সুর বেজে উঠলেই আমি প্রায় নির্জন পথের দৃশ্য দেখি; প্রতিটি চন্দ্রকম্পের পর স্নিগ্ধকিরণ-অপ্সরা নেমে আসে নির্দিষ্ট শিলাখণ্ডের কাছে যেখানে সহিষ্ণু যুবক বসে অরণ্য ও প্রান্তরের কথা ভাবে, তার চোখে ও বর্শায় অপার্থিব কিরণ-তরঙ্গ। যুবকের সারমেয় এবং দুজন রমণী কিরণ-সম্মোহনের কোনো কূল খুঁজে পায় নি।
নেক্রপলিস
মৃতের সৃজনশীলতা নেই বলে নেক্রপলিস নিস্তব্ধ। পার্কে বসে শিল্পী ব্রোঞ্জ বা মোমপত্রে সমুদ্র-প্রতীক আঁকতে পারেন কিন্তু নেক্রপলিসের অধিবাসী আঁকতে পারেন না বলে তাদের শহরে কখনো আলো জ্বলে না। সাধারণভাবে আলোকময় ঘর চিরস্থায়ী নয়; অগ্নির নীল শিখা দিয়ে ঘরকে উজ্জ্বল রাখা হলে ঘরের বর্ণ অপরিবর্তিত থাকে। কেননা নেক্রপলিসের অসীম নীলত্বের সাথে মানুষের ঘর ক্রমশ মিশে যেতে থাকে।
নারকেল বনের এসরাজ
বইয়ের দিকে তাকিয়ে যখন ভেজা বালুকণা হয়ে উঠি তখন গৃহে কিংবা সমস্ত দ্বীপে আকাশের ছায়া গ্রন্থিহীন সুতোর ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুষ্পসন্ধির দৃশ্যে মিশে যেতে থাকে--নারকেল বনের এসরাজ সুতোর দীর্ঘতার সহযাত্রী--সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডে প্রতিধ্বনিত সুরের ভেতর জেগে থাকে ক্রন্দন--স্বচ্ছ দিঘির ঔদাস্য জুড়ে উড়তে থাকে পাড়ের ধুলো।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন