Nothing in that drawer

আমি মনে করি, কবিতা লেখার একটা অন্যতম উদ্দেশ্য কথার পর কথার জাল বুনে পাঠকের কাছে একটা ভারহীন অনুভূতি পৌঁছে দেওয়া। এই হালকা নির্ভার অনুভূতিকে আমরা শূন্যতা নামেও ডাকতে পারি। এই শূন্যতা একটা দার্শনিক শূন্যতা। তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে একটা সহজ আনন্দ। একটা ধীর-স্থির প্রশান্তি।  কর্মব্যস্ত ও নানা কাজে ব্যতিব্যস্ত মানুষের জীবনে মাজে মাঝে এই শূন্যতার অনুভূতি আসে।  কবিদের জীবনে তো বটেই। স্কুল-জীবনে পরীক্ষার খাতায় শূন্যস্থান পূরণ আমদের সকলকেই করতে হয়েছে। কবিতা-জীবনে এখন যেটা দরকার তা হল পূর্ণস্থান শূন্য করা। 
কথাগুলো বললাম বটে, শূন্যতা কী তার কিছুটা আভাসও দিলাম, তবু  অনেকের মনে আবার প্রশ্ন আসবে, এই শূন্যতার মানে কী? সেখানে কী আছে? সেটা সাকার না নিরাকার? প্রথমেই বলি এই শূন্যতা কোনো সংখ্যা নয়। ব্রহ্মগুপ্তের আবিষ্কার করা ০-এর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এই শূন্যতা ঈশ্বর বা ব্রহ্ম নন। সাকার বা নিরাকারের গণ্ডিতেও তাকে বাঁধা যায় না। সাকার বা নিরাকারকে অতিক্রম করে এই শূন্যতা এক অন্য মাত্রার কথা বলে; এই শূন্যতা  মানে তাই একটা অনির্দিষ্ট এবং অবাধ মুক্তাঞ্চল। মানুষের নিজেরই মনোজগতে একটা ওপেন এন্ড ফ্রি স্পেস। বুক ভরে নিশ্বাস নেবার একটা সহজ সতেজ পরিসর।  
শূন্যতা নিয়ে এর আগে অনেকের কলমে অনেক আলোচনা হয়েছে। শূন্যতা ও পূর্ণতা নিয়ে এর আগের একটা লেখায় আমিও কিছু আলোচনা করেছিলাম। সে-সব কথা আর রিপিট করতে চাই না। এই লেখায় বরং শূন্যতার ব্যাপারটা অন্য দিক থেকে দেখা যাক। 
যে পোস্টমডার্ন নিয়ে নব্বই-দশকে বাংলা-কবিতা প্রবল্ভাবে উত্তাল হয়েছিলে, বাংলা-কবিতায় সেই পোস্টমডার্ন ধারণার অন্যতম ভিত্তি ছিল পল হুভার সম্পাদিত ‘পোস্টমডার্ন আমেরিকান পোয়েট্রি: এ নর্টন আনথোলজি'-নামের একতা কবিতা-সংকলন। সেই সংকলনে রন প্যাজেটের একটা কবিতা আছে, যেখানে ‘Nothing in that drawer.’ এই বাক্যটাকেই চৌদ্দ-লাইনে ব্যবহার করা হয়েছে সনেটের আদলে। 
এক লাইনের একটা ভাবনা, সেই একটা লাইনকেই চৌদ্দটা লাইনে চৌদ্দবার বলা। অনেকে হয়ত ভাবছেন, ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর, একটা লাইনকে এই রকম চৌদ্দ বার লেখার কি কোনো দরকার ছিল?  আপাতভাবে মনে হতে পারে ছিল না। আবার কবি যখন ব্যবহার করেছেন তখন কিছু না ভেবেই করেছেন, এমন ভাবনার মধ্যেও যেতে মন চায় না। 
অতঃপর ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখতে হল। দেখা যাচ্ছে, প্যাজেটের কবিতাটার মধ্যে কিন্তু একটা খোঁজ আছে, একজন মানুষ ড্রয়ারের মধ্যে কিছু একটা খুঁজে চলেছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না। একটাই পঙ্‌ক্তি সেখানে বারবার লেখা হচ্ছে, তার মানে এটা হতে পারে, অনুসন্ধান অনেকটা সময় ধরে চলছে। অনেকক্ষণ ধরে চলা মানে, হয়ত পাগলের মতো সেই খোঁজ। “that drawer” মানে একটা নির্দিষ্ট ড্রয়ারের মধ্যেই হাঁটকে-পাঁটকে দেখা হচ্ছে। 
আবার এটাও বলা একাধিক ড্রয়ার পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে, সেখানে কী কী আছে। সেক্ষেত্রে ড্রয়ারের সংখ্যা একের বেশি হতে পারে। একের পর এক ড্রয়ার পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে, কোনোটাতেই কিছু নেই। হয়ত মানুষটা নিজের মনে বিরবির করেই কথাগুলো বলছেন। কখনো তার মধ্যে থাকছে বিভ্রান্তি,  কখনো আতঙ্ক,  কখনো উন্মত্ততা,  কখনো হতাশা, কখনো বা অন্য উপলব্ধি অথবা একটা বোঝাপড়া। এ-সবের বাইরে এমনও হতে পারে, কখনো কিছু অনুশোচনা,  তিক্ততা,  রাগ অথবা হাসাহাসি। সেক্ষেত্রে একটা খোঁজের মধ্যে পরপর অনেকগুলো আবেগের পর্ব চলে আসছে। 
এবার প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, ওই ড্রয়ার কি জীবনের প্রতীক?  জীবনের অর্থ খুঁজতে গিয়ে নানা অভিজঙতার জন্ম হচ্ছে, এক সময় এই উপলব্ধিও আসছে জীবনের আদতে কোনো অর্থই নেই। এই উপলব্ধি থেকেই কবির মনে উদাসীনতা আসছে, বৈরাগ্য আসছে, নির্লিপ্তি আসছে। আরো একটা উপলব্ধি ঘটে যাচ্ছে, তোমার কাছে জীবন যেভাবে ধরা দিতে চাইছে, তাকে ঠিক তেমনিভাবেই তুমি গ্রহণ করো। অনেক খোঁজার পরে তুমি দেখলে শূন্য ড্রয়ার। যদি এক রাশ শূন্যতা হাতে নিয়ে জীবন তোমার দরজায় কড়া নাড়ে, তাহলে তুমি চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দু-হাত পেতে নাও তার দেওয়া শূন্যতা। 
এই কবিতার বাংলা-অনুবাদ করতে গিয়ে কেউ বললেন ‘ওই ড্রয়ারে কিছু নেই’, আবার কেউ বললেন-“ওই ড্রয়ারে একটা না-আছে’। এটা বেশ মজার। একটা না-বাচক, একটা হ্যাঁ-বাচক। একটা অর্ধেক জলপূর্ণ জলের গেলাসকে নেতিবাচক দিক দিয়ে দেখলে যেমন বলা যায়, সেটা আধ-খালি; আবার ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে দেখলে তা হয়ে যায়- অর্ধেক পূর্ণ। তেমনি ফাঁকা ড্রয়ারে শূন্যতা থাকতে পারে, আবার একটা nothing থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে nothing-এর মধ্যেও একটা thing থেকে যাচ্ছে। আমরা যে আকাশ দেখি তা শূন্য, তার রং নীল; আবার মহাকাশচারীরা যে ব্রহ্মাণ্ড দেখেন সেটাও শূন্য কিন্তু তার রং কালো। পদার্থ-বিজ্ঞানে এই দেখার একটা ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু মানুষের মন তো পদার্থ নয়, তার কোনো পদার্থ-বিজ্ঞানও নেই।  
শূন্যতার বিপরীত শব্দ পূর্ণতা। এবার তাহলে পূর্ণতা নিয়ে কিছু কথা হোক। বেশিরভাগ মানুষই কেন পূর্ণতা পছন্দ করে এবং জীবনকে ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ করতে চায়, ভোগ-বিলাসের পূর্ণতা চায়, তার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হয় না। তার জন্য যেতে হয় ফিজিক্স থেকে মেটাফিজিক্সে। দার্শনিক উপলব্ধিতে। সেই উপলব্ধি বলে মানুষের কামনা-বাসনার কোনো শেষ নে, অনেক কিছু পাবার পরেও তার মনে তৃপ্ত আসে না। সে আরো কিছু পেতে চায়। এই দার্শনিক উপলব্ধি থেকেই একদিন প্রাচীন ঋষিরা মানব-জীবনকে চারটে আশ্রমে ভাগ করেছিলেন। ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। সুতরাং মানুষ যতই সংসারী হোক শাস্ত্র মতে তাকে একটা সময়ে ভোগ-বাসনা পরিত্যাগ করতে হয়। প্রথমে বাণপ্রস্থ শেষে সন্ন্যাসে যেতে হয়। কিন্তু কোথায় কী, চিরদিন যারা ধর্ম ধর্ম নিয়ে বাজার গরম করে, বা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে এবং ধর্মকে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও বিদ্বেষ তৈরির কাজে লাগায়, সেই মৌলবাদীরা সারা জীবনই ভোগ-বিলাস লোভ-লালসায় ডুবে থাকতে চায়। রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীরা ষাট পেরোনো বয়সেও তাদের গদি, চেয়ার ও পদ আঁকড়ে থাকতে চায়। সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীরাও মঠাধ্যক্ষ হতে চায়। বিষয় এবং ক্ষমতার লোভ সব জায়গাতেই। সুতরাং ধর্মগুরু রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রী বা সমাজের আদর্শ-স্থানীয় ব্যক্তিরা যখন বিষয়ের নেশাতে এত কাতর, তখন সাধারণ মানুষও যে বিষয়াসক্ত হবে এতে আর আশ্চর্যের কী আছে!  
বেশি বিষয়-চিন্তা মানে কামনা-বাসনাকে তীব্র করা। বস্তুবিশ্বের গভীরে যাওয়া। অর্থের গভীরে যাওয়া। ভাবের গভীরে যাওয়া। অনেক বন্ধু সেভাবেই ভাবের গভীরে যেতে উন্মুখ। নিজেদের  লেখালিখিতে তাঁরা মনে-প্রাণে সেই গভীরতার সন্ধান করেন। আবার গভীরের সঙ্গে গম্ভীরের একটা নিকট কুটুম্বিতে আছে। ফলে গভীর মানেই হয়ে পড়ে ভাব-গম্ভীর। গুরুতর। একটা গমগমে থমথমে ভাব। সেখানে যাকে বলে এক্কেবারে রামগড়ুরের ছানা। বেশি গভীরে যেতে গিয়ে এক সময় মানুষের মগজ আর কাজ করে না। হ্যাং হয়ে যায়।  
হ্যাং হয়, কারণ বেশি গভীরে চিন্তা করতে গিয়ে মাথায় দুশ্চিন্তারা ভিড় করে। যা মানুষকে সিরিয়াস করে তোলে। বিষয়াসক্ত করে তোলে। ভারাক্রান্ত করে তোলে। তার দুশ্চিন্তা বাড়ায়, স্ট্রেস বাড়ায়, টেনশন বাড়ায়। তার সুগার বাড়ে, প্রেসার বাড়ে, কোলেস্টেরল বাড়ে, ঘাড়ে স্পন্ডেলাইসিসের ব্যথা মাথা চাড়া দেয়, মানুষকে অসুস্থ করে তোলে। অগত্যা ডাক্তার, টেস্ট, কাঁড়ি কাঁড়ি ওষুধ। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন বরবাদ। 
গুরুগম্ভীরের বিপরীতে আছে গুরু-চণ্ডালি ভাব; সেখানে সব কিছুতেই যেন একটা অনাসৃষ্টি। পদে পদে হাসি, ঠাট্টা, তামাসা, রসিকতা আরো কতকিছু। কত সহজ, সরল ও অকপট। স্বয়ং রবি-ঠাকুরও শেষ বয়সে ‘খাপছাড়া’ হতে গিয়ে লিখেছিলে- ‘সহজ কথা যায় না লেখা সহজে।’ ঠাকুর আবার সেই কথার নাম দিলেনে ‘বাজে কথা’। 
রবি ঠাকুর পথ বাতলে দিলেও আমাদের কবিরা সেই ‘বাজে-কথা’ বলার ফাঁদে পা দিলেন না। তাই আমাদের বিষয়মুখী কবি ও কবিতার অবস্থা হল গমগমে-থমথমে। কবিরা শুধুই অনুভবের গভীরে যেতে চাইলেন। ফলে তাদের লেখালিখি হল একরোখা, জেদি, বদ্ধমুখ। সেই সব কবিতায় এক সময় শ্রীমান অভিজ্ঞান এসে হাজির হলেন। জ্ঞান মানেই তার ভারিক্কি চাল, নিজেকে জাহির করার চেষ্টা, নিজেকে ছাড়া সে অন্য কিছুকে দেখে না, দেখলেও পাত্তা দেয় না। ফলে কবিতা থেকে তার দূরত্ব বাড়ে। সেখানে জ্ঞানটাই প্রধান হয়ে ওঠে। আবার জ্ঞান মানেই তার অবসাদ আছে। ক্লান্তি ও বিষণ্ণতা আছে। মৃত্যুচিন্তা আছে। তাই ইহলোকে বর্তমান থেকেও এইসব  জ্ঞানীরা ইহলোকের চেয়ে পরলোক নিয়ে বেশি ভাবিত হলেন।  
নিজের স্বভাবেই কোনো মানুষের চিন্তা একমুখী হয় না। ক্ষণে ক্ষণে তার রং ও রূপের বদল হয়। অভিমুখ পালটে যায়। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো চিন্তার ঢেউও মানুষের মনভূমিতে মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ে। পাঁচ মিনিট পরে মানুষ মনে করতে পারে না, পাঁচ মিনিট আগে সে কী ভাবছিল। কিন্তু, ধ্যান ও তপস্যার মাধ্যমে মানুষ মনের গতিকে জোর করে এক দিকে চালিত করতে চায়। এইভাবে সাধকদের ভাবনায় লোক থেকে লোকোত্তরের কথা আসে। সাধকেরা পূর্ণজ্ঞান বা ভগবত-লাভ-এর নামে মনকে স্থির ও নিশ্চল করার কথা বলেন। অর্থাৎ জোর করে মনের স্বভাব বদলাতে চান। তাতে মানুষের সহজাত বোধ-বুদ্ধির বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ব্রহ্মচিন্তায় মগ্ন হয়ে মানুষ তখন নিজের সহজ প্রবৃত্তিকে ধ্বংস করতে চায়, ফলে জগৎ ও জীবনের বৈচিত্রকে দেখার ও উপলব্ধি করার যে সহজাত আনন্দ, বিস্ময়, শিহরণ, সুখ সে-সব কিছুই বাধা পায় ও বাদ পড়ে।  
অন্যান্য চিন্তার মতো অধ্যাত্মচিন্তাও এদেশের মানুষের সহজাত স্বভাব। মানুষের সেই দুর্বলতার সুযোগে নিয়ে এদেশের ধর্ম-ব্যবসায়ীরা তাদের কাছে যুগ যুগ ধরে ইহলোক-পরলোক স্বর্গ-মর্ত্য পাপ-পূণ্য এই রকম এক-একটা গ্র্যান্ড-ন্যারেটিভ বা মহা-আখ্যান হাজির করে বোঝাতে চেয়েছে ইহলোক নয়, তোমরা পরলোকের ভাবনায় মন দাও; এবং সাংসারিক দুঃখ-কষ্ট-দুর্ভোগকে নিয়তি ও পূর্বজন্মের কর্মফল বলে মেনে নিয়ে হাসি মুখে তা সহ্য করো। ভগবানের অস্তিত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন করো না, সংশয় ও সন্দেহ প্রকাশ করো না। এই জন্মে মন দিয়ে নিজের কাজ-কর্ম করো, পুণ্য সঞ্চয় করো, ভালো কাজ করলে পরজন্মে তোমার ভালো হবে, তখন স্বর্গসুখ লাভ করবে। ধর্মগুরুরা এইভাবে মানবজীবনের সমস্ত সমস্যার একটা আধ্যাত্মিক সমাধানের কথা বলেন। ফাইনাল সলিউশনের কথা বলেন। তাতে করে মানুষের জীবন-সংগ্রামকে অপমান করা হয়। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ ও আন্দোলনকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়।  
আবার আসি কবিতার কথায়। গভীরতা অভিলাষী কবির কথায়। কবিরা সাধারণত খুব বেশি বিষয়াসক্ত হতে চায় না। যে-সব কবির বোধে কবিতার বীজ রয়ে গেছে, তারা যতই বিষয় বা ভাবের গভীরে যেতে চান না কেন একটা সময়ে তাদের মনেও নির্লিপ্তি আসে, উদাসীনতা আসে, বৈরাগ্য আসে। তখন গভীরে যাবার ছলে তারা শূন্যতাকেই স্পর্শ করতে চায়। সহজাত অনুভবের গরজ থেকে তারা বস্তময় জগতের মধ্যে বর্তমান থেকেও একটু ফাঁকা জায়গার সন্ধান করেন, কিছুটা নির্জনতা খোঁজেন, সাদাপাতা খোঁজেন, বিষয়-চিন্তার ভার নামিয়ে শূন্যতাকে অনুভব করতে চান। এই শূন্যতাবোধের ভিতর কিন্তু কোনো আধ্যাত্মিকতা নেই, তবে একটা খোঁজ আছে। সে খোঁজ জীবনের, সে খোঁজ জীবন-সত্যের। এক এক কবির বেলায় সেটা এক এক রকম। 
ভাবের গভীরে না গিয়ে কবিরা তখন ভাব ও ভাবনার বিস্তারে মন দেন। জগৎ ও জীবনের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট-খাটো লৌকিক ঘটনার মধ্যে তারা অতিলৌকিকের উপস্থিতি টের পান। তখন সাধারণের বেশেই কিছু কিছু অসাধারণ তাদের কাছে এসে হাজির হয়। এই অসাধারণকে উপলব্ধি করা এবং তার খোঁজ পাঠকদের সামনে তুলে ধরাই একজন কবির কাজ। এতদিন যে-সব কথা বলা হয়নি, সেই কথা বলা। প্রাতিষ্ঠানিক শেখানো বুলি থেকে বেরিয়ে এসে নিজের সহজ অনুভবকে প্রকাশ করা। এটাও কবিতার আপডেট।  
ডুবসাঁতার মানে নিশ্বাস বন্ধ করে নিজেকে ভারী করে ক্রমাগত ভাবের গভীরে তলিয়ে যেতে চাওয়া, সেখানে চারপাশে শুধু জল, শ্যাওলা ও দলা-দাম, পাঁকের গন্ধ, জলজ প্রাণিদের ঘোরাফেরা; চিৎসাঁতার মানে কিন্তু তা নয়, চিৎসাঁতার মানে নিজেকে হালকা করে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে ভাবের উপরে ভাসতে থাকা। চিৎসাঁতার মানেই আকাশের দিকে মুখ করে জলের উপর হাস-পা ছোঁড়া। বিশ্ব-জগৎকে উলটোভাবে দেখা। আকাশ মানে এক অসাধারণ শূন্যতা। তাই যাঁরা ভাবের উপরে উঠতে ও ভেসে থাকতে পারেন তাঁদের চেতনায় ও বোধে জাগতিক ঘটনাবলি একটু অন্য রকম ভাবে ধরা দেয়। চর্যাপদকর্তার ভাষায় তাঁদের চিত্ত হয় খ-সম। কোনো বিভেদ বা বিদ্বেষ নয় তাঁরা সবকিছুকেই সমদৃষ্টিতে দেখেন। আবার চিৎসাঁতার মানে তার একটা গতি থাকে, চোখের সামনের সব ছবি দ্রুত বদলাতে বদলাতে চলচ্ছবি হয়ে যায়, চিত্রকল্প হয় চলচিত্রকল্প। ডুবসাঁতারে যেমন তলদেশকে ছোঁবার একটা লক্ষ্য থাকে, চিৎসাঁতারে তেমন কোনো লক্ষ্য থাকে না। শুধুই ভেসে থাকা এবং ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যাবার আনন্দ থাকে। তখন তাঁদের মনে হতেই পারে- ‘There is nothing in the drawer’; অথবা রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- “শূন্য,  তবু সে তো শূন্য নয়।” কিংবা “তবু শূন্য শূন্য নয়,/ ব্যথাময়/ অগ্নিবাষ্পে পূর্ণ সে গগন।” 
এই যে ব্যাথা ও বেদনা, তা তো মানুষের অস্তিত্বের বেদনা; শয়নে স্বপনে জাগরণে সেই বেদনাবোধ কবিকে তাড়িত করে চলে, ঘুমোতে দেয় না, খেতে-শুতে দেয় না, স্থির থাকতে দেয় না। কবির মন চঞ্চল হয়, সে সন্ধান করে এক সুদূরের। সেই যে সুদূর,  বিপুল সুদূর,  কবির কানের কাছে তার ব্যাকুল বাঁশরি বাজে। সেই বাঁশিতেই থাকে সীমার মাঝে অসীমের হাতছানি। চেতনায় শূন্যতার অগ্নিবাষ্প মেখে কবির যাত্রা শুরু হয় ভেদের সনাক্তকরণ থেকে অভেদের নীরব সহজানন্দের দিকে। বুদ্ধ-দর্শনের মতে এই সহজানন্দেরই আরেক নাম শূন্যতা। 
এই শূন্যতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। কেন্দ্র বা পরিধি নেই। তথাকথিত পবিত্রতা বা শুদ্ধতা নেই। তত্ত্ব নেই, ব্যাকরণ নেই। বিষয়-ভাবনা বা অর্থের ভার নেই। অন্তর বা বাহির নেই। ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব নেই। সমস্ত বায়োনারিকে অতিক্রম করে সে নিজের প্রকাশেই মশগুল থাকে। 
ইচ্ছা ও চেষ্টা থাকলেই এই শূন্যতাকে নিজের অনুভবের মধ্যে আনা যায়। 
শূন্যতাকে অনুভব করার আগে কবিকে যথাসম্ভব নিজেকে শূন্য করতে হবে। নিজের প্রথাগত জ্ঞান ও বিদ্যাকে ক্রমাগত বিয়োগ করতে হবে। নিজেকে ভেঙেচুরে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। প্রাচীন বিশ্বাস সংস্কার ও অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অহংকার ও ক্ষমতার দম্ভ এবং খবরদারি করার মানসিকতা থেকে সরে আসতে হবে। স্ব-কল্পিত ক্লান্তি, বিষাদ, হতাশা, নৈরাশ্য, একাকিত্ব এই-সব নেতিবাচক বোধকে গ্লোরিফাই করার আধুনিক মানসিকতা থেকে নিজের মনকে প্রত্যাহার করতে হবে।
কবিকে নিজের থেকেও নিজের দূরত্ব বাড়াতে হবে। সব কিছুর উপরে ভেসে থাকবে শুধু এক ভারহীন মন; যেমন জলের উপর ভেসে থাকে মাখন। আমাদের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব যেমন বলেছেন, দুধকে সরাসরি জলের সঙ্গে না মিশিয়ে তা থেকে দই পেতে মাখন তুলে তারপর সেই মাখনকে জলে রাখলে সে ভেসেই থাকে, আর ডোবে না। বিষয়ের মধ্যে থাকলেও কবিকে হতে হবে প্যাঁকাল-মাছের মতো, গায়ে পাঁক লাগানো চলবে না। 
এই শূন্যতার ভিতরেই কবিকে শেকড় নামাতে হবে, শূন্যতার ভিতরেই ডালাপালা মিলতে হবে, শূন্যতা থেকেই কবিকে সংগ্রহ করতে হবে লেখালিখির যাবতীয় রস ও রসদ। সংসারে আসক্ত হয়ে থাকলেও কবিকে নিজের মনে নিরাসক্তির ভাবটাই বেশি জাগিয়ে রাখতে হবে। 
নিজেকে শূন্য করতে করতে কবি যে শূন্যতার সঙ্গে একেবারে মিশে যাবে এমনটা নয়। শূন্যতার কয়েক ইঞ্চি দূরে হবে কবির অবস্থান। সেখানে তার যাবতীয় জাগতিক কাজকর্ম, তার দেখা ও অদেখা, চেনা ও অচেনা, সত্য ও মিথ্যা বহাল থাকবে, যাদের মধ্যে কোনো সীমানা থাকবে না, তারা ইচ্ছে মতো জায়গা বদল করবে। কবির মনোজগৎ হবে এক সাদাপাতার মতো, যার মধ্যে আছে অযূত সম্ভাবনা। এখানে-ওখানে, এ-পাড়া ও-পাড়া, এ-গলি ও-গলি, এ-ঘাট ও-ঘাট, যেখানে খুশি, যত খুশি বিস্তর ভ্রমণের আহ্লাদ।  কবির ইচ্ছে মতন। 
শূন্যতাকে যত অনুভব করতে পারবে জগৎ ও জীবনকে দেখার জন্য কবির মধ্যে ততই এক অন্য দৃষ্টি জেগে উঠবে। শান্ত ও করুণ সেই দৃষ্টি দিয়েই কবি দেখবে পায়ে চলা  বিশাল মাঠের মাঝে একা একা দাঁড়িয়ে থাকা একটা পাতাহীন গাছে দুটো ঘুঘুপাখি এসে বসে আবার উড়ে গেল, এমনি এমনি। কিংবা এক বদ্ধ জলাশয়ের নির্জনতায় হঠাৎ করে একটা ব্যাঙ লাফ দিল, জলে ছলাৎ শব্দ হল, তারপর আবার সব চুপচাপ, এমনি এমনি; যেমন বাশো দেখেছিলেন। কোনো মহা ভাব নয়, কেবলই এক ক্ষণিকের অন্যভূতি। 
কবি কী লিখবে, কেমন করে লিখবে, সেটা কোনো অভিভাবক বা পরামর্শদাতা ঠিক করে দিতে পারে না, কবির হয়ে কেউ কবির কথা লিখেও দেয় না; সবই কবির নিজস্ব ব্যাপার। এই অধমও তেমন কোনো অভিভাবক বা পরামর্শদাতা বলে নিজেকে দাবি করে না। এই সময়ের একটা মার্কিনি কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দীর্ঘদিন কবিতার সঙ্গে ঘরবাস করার সূত্রে এদেশের প্রেক্ষাপটে অর্জিত কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম মাত্র। কারো সেটা পছন্দ হলে ভালো, পছন্দ না হলেও কিছু বলার নেই। কবি ও কবিতা এগিয়ে চলুক তাদের নিজস্ব পথে, নিজের গতিতে। তাদের সামনে জয় করার জন্যে পড়ে আছে একটা আস্ত মাল্টিভার্স।  
অথবা হয়ত কিছুই নেই, এক অনন্ত খোঁজ ছাড়া। সব শেষে রন প্যাজেটের লাইনটাকেই আবৃত্তি করতে হবে- Nothing in that drawer। অথবা চর্যকবির ভাষায় বলতে হবে গুরু বোবা আর শিষ্য কালা। সেখানে কে শেখাবে আর কে শিখবে। এই সময়ের কবিদের কাছে চর্যার এই স্কুলিংটাও খানিক জরুরি। 






মুরারি সিংহ

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন