শূন্যে ফেরিওয়ালা বৃত্তে বেলুন

রাবাহিক


পর্ব-১

এখানে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা লোভাতুর ঘর নেই, না আছে অতিসাজ্জের অভ্যর্থনা।  যতদুর চোখ যায় পাহাড়ের জঙ্গল, ঘন পাতলা গায়ে গা লাগিয়ে থাকা আবার ছাড়াছাড়ি মুখ দেখাদেখি বন্ধের গাছ। কোথায় যে আছি! সারাদিন গাড়ি চালিয়ে একটা আস্তানা জুটেছে রাতটুকু কাটানোর৷ 

খাওয়াদাওয়া শেষ করে বসে আছি৷ প্রচন্ড ক্লান্তির চোখ, মনে পড়ছে ভুবনডাঙার জন্য কোন সাজ সরঞ্জাম না নীলমের নানান দেশ বিদেশের অভিজ্ঞতা, সরাসরি। কিভাবে শুরু করব ভাবিনি৷ এই পাহাড়ের কোলে বসে বসে যখন গতদিনগুলোর ক্লান্তি বিলিয়ে দিচ্ছি, মনে হচ্ছে শুরু করাই যায়৷ 

গত সন্ধ্যায় যখন সংসার বোঝাই কন্টেনার ট্রাক ফ্ল্যাটের নিচ থেকে বেরিয়ে গেল প্রচন্ড নোংরা ঘরটা পরিষ্কার করতে করতে ভাবছিলাম আমার ঠিকানা বদলের কথা। এই চৌত্রিশ বছরের জীবনে কতবার সংসার সহ আমার ঠিকানা বদল হয়েছে তা আসলেই হিসেবহীন৷ বিদেশের গল্প অন্যরকম। সেখান থেকে কিছু আনা জায়না বলে মায়া মমতা এমনিই ধুয়ে দিতে হয়। কিন্তু দেশের মধ্যে? প্রফেশনাল প্যাকারসের দাদারা এসেছিল মাত্র পাঁচ জন। বেলা এগারোটায় যুদ্ধ চলল। যুদ্ধই বটে। ওদের না বলে দিলে হয়তো আমাকেই একটা বাক্সে বন্দী করে দিত৷ আসলে ওদের কাজ প্যাকিং করা। তাই ভাল মন্দ বাতিল, না বাতিল এসব দেখা ওদের কাজ না৷ ঝড়ের গতিতে আমার চোখের পলক সরাতেই দেখি চারটে বক্স রেডি আর খালি হয়ে গেছে আমার বইয়ের আলমারি! লোকটি বললেন "ভাবি কো পড়নে কা সখ হ্যায় ক্যয়া?" আমি নির্ভেজাল ভাবে মাথা নাড়লাম৷ 

জামা, কাপড় বিছানা, ইত্যাদি দেখতে দেখতে বালিশগুলো গায়েব হয়ে গেল সোফার পেটে। ভাবলাম যাই রান্নাঘরে কি হচ্ছে দেখে আসি। একটি ছেলে খুব পরিপাটি করে এক একটা চেম্বার খালি করছে। ওদিকে বসার জায়গার সমস্ত জিনিসপত্র প্যাক হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ মানুষ নাকি যন্ত্র? না না এরা মানুষই। আমাকে বলল "ভাবি চায়ে বানা দো" আমি বললাম বাসন তো সব প্যাক করে দিয়েছ কি করে বানাই? হাসতে হাসতে দেখালো একটা বড় গোছের স্টিলের তরকারি রাখা বাটি ছেড়ে প্যাক করেছে৷ বুঝলাম এদের চা চাই। চা বসিয়েছি, ছেলেটি বলল "ভাবি, গ্যাস হাম লাস্টমে প্যাক করেঙ্গে" মানে আরও চা চাই৷ 

চা হল, কাজও হল। এমন প্যাকিংয়ের দিনে খাওয়াদাওয়া ঠিক থাকেনা। তাও বেলা গড়িয়ে যেতে খাওয়ার ব্যবস্থা হলো সকলের জন্য বড়া পাও৷ বিকেল পাঁচটার এদিক ওদিক সময়ের দিকে দেখলাম আমার ঘরটাতে আর কিছুই নেই। যাবতীয় বক্স বন্দি৷ মহারাষ্ট্রে কাছাকাছি ন'বছরের বাস৷ এই ন বছরের সংসার একটা ট্রাকে ভর্তি হবার পর ভাবছি এতো জিনিসপত্র আমার কিভাবে ছিল। 

ট্রাক বেরিয়ে গেলে পড়ে থাকে শূন্য ঘর। আর অনেক নোংরা, ঝুল, ধুলো, আর থাকে আমাদের পায়ের ছাপ। বিকেল বা সন্ধের দিক করে কাজের লোক পাওয়া যায় না৷ তাই নিজেই সমস্ত পরিষ্কার করলাম। প্রথমবারে ধুলো ময়লা। দ্বিতীয় বারে আমার মায়া মমতা সহ পিছুটান। সত্যি বলতে কি এই যাযাবরি জীবনে আমাদের পিছুটান নেই। এসবই অভ্যাস। 

শূন্য ঘরে বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে খেলাম। পোষা পাখিগুলো সব হারিয়েছে ভেবে তুমুল চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল। ওদের কিভাবে বোঝাবো আমরা অন্য জায়গায় যাচ্ছি। খানিক তাকালাম। একটা লাকি ব্যাম্বু ছিল সেটা ভরতে ভরতে মনে পড়ল আমার সাধের গাছগুলো বক্সে করে ট্রাকে উঠে গেছে। এই বোধহয় যুগের পরিবর্তন।  যেখানে আমাদের নদীর বহতার সাথে বয়ে যেতেই হবে। থেমে যাবার অনুমতি আমাদের কেউ দেয়নি৷






নীলম সামন্ত 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন