তৈমুর খানের গুচ্ছ কবিতা



পাঠশালা

 প্রাচীন স্কুলগুলি স্মৃতির রোদ্দুরে জেগে আছে

 আমরা চট পেতে বসি বটের ছায়ায়

 নীলজামা গায়ে, দ্রুত পাখিদের আনাগোনা

 পর্যাপ্ত রঙের ভাষা মেলে দেয়;

 ভাষার সংস্কৃতি বোঝে নবীন সাধনা।


 বর্ণপরিচয় হাতে ঈশ্বর দাঁড়ান

 ঈশ্বরের দীর্ঘছায়ায় আমরা মুগ্ধতা ভিক্ষা করি

 পাতা উল্টাই শুধু

 জীবনখাতায় ছবি আঁকি


 কত ছবি!

 ছবিরাও প্রাণ ফিরে পায় রোজ

 পাঠশালা হেসে ওঠে; আর সব প্রাচীন পদ্ধতি।



ঝড়

 ঝড় আসছে।

 আমরা মরুর উট। কথা বলি না। চেঁচাই না।

 ঝড় সামলে নিই বালিতে মুখ গুঁজে।

 যারা ঝড় আনছে তারাই শুধু চেঁচাচ্ছে।

 আতঙ্ক ছড়াচ্ছে আর নিয়ত বাঁশি বাজিয়ে দিচ্ছে।

 কোলাহলে কোলাহলে একটা দেশ 

           ক্রমশই দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে কেবলই।


 দেশের বসন্তকে শুষে নিচ্ছে গ্রীষ্ম।

 দেশের শরৎকে ঢেকে দিচ্ছে শীত।

 বর্ষা আনছে দুর্যোগের মেঘ। ঘন কালো মেঘ।

 ঘনঘন বজ্র ছুঁড়েছে এসে।


 কার কী সফলতা এখন?

 ভাবতে ভাবতে রাত নামছে। 

 বার্ধক্য এসে পিঠে বসছে আমাদের।

 কয়েকটি মরুর পাখি উড়ে যাচ্ছে আকাশের দিকে

 আমরাই শুধু বাকি যৌবনটুকু 

               দিয়ে যেতে চাই মরু সভ্যতাকে।


 যারা ঝড় আনছে তারা কেউ সভ্য নয়

 যুদ্ধবাজ ধ্বংসকারী গভীর মিথ্যুক…




সন্ধ্যায় 

যদিও আলোর কোনো উদাহরণ নেই 

তবু তা জ্বলে ওঠে চোখেমুখে 

নিহিত প্রজ্ঞায় 


ভ্রমের বর্ষণে যেমন ছাতা নেই মাথায় 

রাস্তা তবুও হাঁটায় নির্ভার বিদ্যুৎ 

মনে মনে ভিজে যায় সব 

আমরা কোন অভিসার মাপি   

আমাদের মর্মের সন্ধ্যায়? 


ফাল্গুনের নেশা থেকে আগুনের হাতে

ডেকে নিই কাকে? 

নিজের হৃদয় সেঁকে বলি ভালো আছি 

এই সন্ধ্যার বারুদ বসন্তকে! 


একবার মুখ দেখে যাও 

স্বপ্নের প্রস্তুতি এইসব নতুন কবিতায়।




রাত্রিজীবী

 গানের সুরে ধমক দিলে

 যাব আমি কেমন করে?

 ফুল তুলতে পারলাম না।


 বৃষ্টি এল পথে

 বৃষ্টির সাথে দেখা হল

 আবেগ ছিল সাথে।


 এ-শহর তো একটি খাঁচা

 সব পথেই তার গোলকধাঁধা

 বৃষ্টির হাতে বজ্র ছিল

 বজ্রে আমি ভয় পাইনি

 আবেগ শুধু কাঁপিয়ে দিল।


 আজও আমি বিশ্রাম চাই

 বিশ্রামের দুয়ার খুঁজি

 কোথায় হিয়া?

 ধমক শুধু, ধমকই ক্রিয়া!


 আমার কোনো জমক নেই

 বাক্যজল, জলবাক্যেই নদী

 পার হতে গিয়ে রাত হল তাই

 এখন রাত্রিজীবী।





উজান নগর

 উজান নগরে এত ঢেউ!

 সব মানুষেরা ভাসে

 ভাসায় তাদের দেহ-মন রস ও রভসে


 কোন কিনারায় গিয়ে দাঁড়াবো কার কাছে?

 কে ডাকে বারবার?

 অজস্র মুখের ভিড়ে চিনতে পারি না মুখ

 দূর থেকে দেখি ঠোঁট নড়ে…


 বাতাসে মিশে যায় ঘ্রাণ

 উড়ে আসে আলতা রাঙা ছায়া

 শব্দের কিরণে মুগ্ধ করে যাওয়া-আসা


 বুক জুড়ে ফসলের মাঠ

 মাঠে মাঠে আগুনের ঘর

 আলো ও আগুনে এক বিস্ময় বিস্ময়


 কাকে ছোঁবো?

 বিভ্রান্তির অনুঘটকেরা নেমেছে রাস্তায়!




আমারই ভারতবর্ষ

আজ সভ্যতার একটা সকাল 

আজ সভ্যতার একটা দিন 

আমি কি বেঁচে আছি ? 

আমরা কি বেঁচে আছি ? 


নিরুত্তর একাকী নিজের কুয়াশায় 

নিজেই অস্পষ্ট চেয়ে আছি 

ওরা কাঁদছে, কান্নার শব্দ মুহুর্মুহু 

বন্দুকের নল ঘুরে আছে এইদিকে এখন 

রক্তেভেজা আর্তনাদ গড়ে আসছে  এদিকেই 

ধর্ম না ঘাতক ? কী উগ্র বুট পরেছে আজ ! 


এটাতো ভারত! আমারই ভারতবর্ষ! 

আমি অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছি 

আমার পিপাসা পাচ্ছে খুব 

আমার মায়ের মুখখানা ভেসে উঠছে বারবার 

হয়তো আর কিছুক্ষণ পর আমিও লাশ হব 

হয়তো আমার রক্তে ভিজে যাবে মাটি 

একটা সকাল ক্রমশ রাত্রির দিকে যাবে 

একটা দুপুরও  ক্লান্ত বিষণ্ণ নীরবতায় 

ঘুরে ঘুরে পাক খাবে এখানেই 

কেউ আর ডাকবে না আমাকে 

যুগের সংকটে ভেসে যাবে দেশ।




নতুন তীর্থক্ষেত্র

পলাশে পলাশে রঙ্ লাগে

পৃথিবী এক নতুন তীর্থক্ষেত্র


আমরা নতুন গানের কাছে যাই

আমরা পুরোনো গানের দেশে

বড়ো হই

পাখিরাও উড়ে আসে যথারীতি দেখি

মানবকাঙাল ভোরে সূর্য বাঁধে রাখি

আকাশ বলয়ে ওড়ে সাতরঙ্ সুতো

আমাদের হৃদয়গুলো এক একটা ঘুড়ি


আজ সব উড়তে চায়,

পথচারীর একটাই পথ

যে বাঁশি বাজায়, আজ ওঠে একসুর...





স্পর্শ

এই হাত, আমারই হাত, আমিই স্পর্শ করি
সমস্ত শরীর জুড়ে এখনও সেই স্পর্শের শিহরন পাই
 যে আলো নিভে গেছে বহুদিন
 এখনও তার উজ্জ্বলতা আছে
 এখনও অক্ষরগুলি পড়ে নিতে পারি

হৃদয় পাথর হয়ে গেছে, যে শোকে পাথর হয়
সব বেদনার অশ্রুগুলি
পথও হারায় পথে
 ঠিকানাও বদল হয় অন্য কোনও ঠিকানায়

একটা শূন্যের মতো পৃথিবী গড়াতে গড়াতে
দিনরাত্রি প্রসব করে শুধু
ফেল করা ছাত্রের মতো আমরা শুধু অংকে শূন্য পাই
ঘর বানাতে বানাতে প্রতিদিন ঘর ভেঙে ফেলি 
প্রদীপ জ্বালাতে জ্বালাতে প্রতিদিন ডাকি অন্ধকার

স্মৃতির কাচ মুছতে মুছতে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়
শুধু হাতখানি স্পর্শ ধরে রাখে

যে স্পর্শ তার একান্ত ঈশ্বরীর...




নারীজন্ম 

তোমার জানালায় চাঁদ এসে উঁকি দেয় 

তোমার দরজা খোলে সূর্য 

তোমার মাথাভর্তি নক্ষত্রফুল ফোটে 

একটি নারীজন্ম পার করে দাও তুমি 


আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি এবর্ষায় নির্মাণ করেনি নৌকা 

কী করে পার হবে এপার ওপার যুগ ? 

সাঁতারবিহীন প্রবল জোয়ারে ভেসে যাবে সম্পর্ক 

তুমি আকাশের ওপারে আকাশ সাজাবে 


ডমরুধর এসে বসবে তোমার আকাশে 

নিত্য পদ্ম ফুটে উঠবে রাশি রাশি 

পূজায় আনন্দ প্রাণ ভরে যাবে 

তুমি বিছানা পাতবে অনন্ত শয়ন ঘরে 

একটি পৃথিবীর ভেতর আর একটি পৃথিবী জন্ম নেবে




১০

ব্যাখ্যা 

মৃত্যুকে দেখতে দেখতে রাস্তা ফুরিয়ে আসছে আমাদের 

হলুদ পাখিদের ঠোঁটে ঝুলে আছে বিকেলের রোদ 

চৈতন্য ঘেরা বাড়িতে কারা বসবাস করে? 

রেলিং এর ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় বোধ 


রাস্তায় ধর্ষণ চিৎকার করে 

পুলিশ ছুটে যায় 

মর্গের উদ্বোধনে নতুন যুবতী 

চকচকে অস্ত্রগুলি হাসে 


মানুষ যদিও মানুষের ব্যাখ্যা করে 

আর মৃত্যুরও ব্যাখ্যা হয় 

ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে বেলা পড়ে আসে 

হলুদ পাখিরা উড়ে যায় কোন্ অন্ধকার বনে! 




১১

আমার মৃতদেহ

ঝাঁক ঝাঁক পিঁপড়েরা আমার রক্তমাংস খুঁটে নিয়ে যাচ্ছে 

আমি বাধা দিচ্ছি না 

আমার তর্জনী আর কলম ধরতে পারছে না 

আমার বোধের শব্দ ও অক্ষরগুলি ঝরে পড়ছে 

কে লিখবে তাদের? 


সময়ের কবরের নিচে শুয়ে আছি 

কে খুঁড়বে সময়? 


উপর দিয়ে সাপ চলে যাচ্ছে 

বিস্ফোরক বোঝাই গাড়িও 

ন্যাংটো মানুষের দল 

আর রাতের সঙ্গম 


আমার পাথরচোখ দেখতে দেখতে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে 




১২

যুক্তি 

যুক্তি, এসো, আজ নান্দনিক দিন 

চোখে সম্মোহন আলো 

ছলকায় সূর্যের গান  পদ্মভোরের উচ্ছল ঢেউ 

ঢেউয়ে ঢেউয়ে উত্তাল মানববাগান 


তোমাকে বসাই জীবনতীর্থের নৌকায় 

যতদূর ভেসে যাবে যাক 

আমাদের জন্ম-জন্মান্তর ঘোরে   ব্যাপ্ত পরিচয় 

সভ্যতাগামী মানব উত্থান 


মৃতকে জাগাও এসে 

মুহূর্তগুলি মরমি সংঘাত 

সত্যের দুর্জয় পথে বেজে ওঠে বাঁশি 

সমূহ আরোগ্য এসে       ধুয়ে যায় রাত 

আমরা খুঁজে পেতে চাই মুক্তির প্রভাত 






তৈমুর খান


জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৭, বীরভূম জেলার রামপুরহাট ব্লকের পানিসাইল গ্রামে। পিতা জিকির খান ও মাতা নাওরাতুন।  পড়াশোনা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে মাস্টার ডিগ্রি এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা নিয়ে পি এইচ ডি প্রাপ্তি । 

বর্রমানে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহ শিক্ষকতা করছেন । তার প্রকাশিত কাব্যগুলি হল কোথায় পা রাখি (১৯৯৪), বৃষ্টিতরু (১৯৯৯), খা শূন্য আমাকে খা (২০০৩), আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা (২০০৪), বিষাদের লেখা কবিতা (২০০৪), একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ (২০০৭), জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর (২০০৮), প্রত্নচরিত (২০১১), নির্বাচিত কবিতা (২০১৬), জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা (২০১৭) ইত্যাদি। 

পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্যে রয়েছে–  কবিরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার ও দৌড় সাহিত্য সম্মান, নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার, কবি আলোক সরকার স্মারক পুরস্কার ইত্যাদি।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন