সহজ প্রেমের কবিতাগুচ্ছ

[কবিতা কমেন্টারি হতে পারে না কে তোমায় বলেছে দেবলীনা?]




আমি বুঝতে পারছিলাম কেশববাবুর সাথে বিজয়কৃষ্ণের মনান্তর চলছে | মহেন মাস্টারের মতো আমি কেশববাবুর ভক্তও নই | তাও তাঁর সঙ্গে ভিড়ে গেছিলাম সেদিন, কারণ লোভ সামলাতে পারিনি | কিসের লোভ? শ্রীরামকৃষ্ণ-কে দেখার | নাস্তিকের লোভ ভয়ঙ্কর ! অনন্ত শরতের গগনতলে ফুটফুটে কোজাগরী জ্যোৎস্নায় পাগল ঠাকুরের নৌকাবিহার, ছাড়া যায় ! আমি তো তাঁকে আগে কখনো দেখিইনি, সেই প্রথম | ঠাকুরের তখন বাহ্যদশা লোপ পেয়েছে, বলছেন, 'মা আমায় এখানে আনলি কেনো? আমি কি এদের বেড়ার ভিতর থেকে রক্ষা করতে পারবো?' | জগৎ-সংসারে সকলেই বেড়ার মধ্যে? কই আমি তো নেই, এই যে আজ বাড়ি ফিরে পরমহংস-কে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা তোমায় বলবো, আমার সমস্ত বেড়া ভেঙে যাবে, তুমি কেড়ে নেবে | দিনে অন্তত একবারও যদি কথা বলতে পারি তোমার সঙ্গে, বা বিকেলের ডাকে তোমার একটা চিঠি এসে পৌঁছায়, আমার সমস্ত বেড়া ভেঙে যায়, অনন্তখন্ড পড়ে থাকে খালি | ঠাকুর-কে ঘিরে তাঁর ভক্তমন্ডলী, বলরাম বসু, মহেন মাস্টার, কেশব সেন, বিজয় গোসাঁই, গিরিশ, রাখাল, লাটু, যোগীন; ঠাকুর বলছেন হরিকথা | দক্ষিনেশ্বরের পাগল ঠাকুরকে আমি বলতে পারিনি একটা মেয়ে নাস্তিকের সমস্ত বেড়া চুরমার করে দ্যায়, বেড়া ভেঙে অনন্ত পড়ে থাকে টুকরো টুকরো হয়ে |





মংপুতে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার এলাম | তোমার সাথে এই প্রথম | দূরে পাহাড়ের বুকে মৃতপ্রায় পশুর আদিম নিমীলিতপ্রায় চোখের মতো জ্বলছে রাতের জোনাকি | এসে থেকেই গানটা গুনগুন করছো তুমি | মৈত্রেয়ী দেবীর বইটা কোলে ওলটানো, এখনো শেষ করোনি? হুইস্কি আর নেই? যাহ, কী করবো আমরা এখন? সন্ধ্যেটা কাটাবো কিকরে? পাঁচ হাজার বছর আগে মানুষ কীভাবে কাটাতো সন্ধ্যে? জুয়া খেলে? চোদ্দ বছর আগে বালক-আমি আর তরুণী-তুমি কী খেলেছিলাম? জুয়া? তখন থেকেই কি সর্বস্ব খুইয়েছি আমি? বেদ, ধর্ম, নীতি, শীল, মান, ঈশ্বর?





গম্ভীরার নির্জন কক্ষে বাতায়ন বেয়ে নেমেছে ফেনিল জ্যোৎস্নাধারা, সমুদ্র গর্জমান | রসবেত্তা স্বরূপ দামোদর গায়ন করছেন কীর্তনপদ কর্ণাট রাগে, গীতগোবিন্দ, 'নিন্দতি-চন্দনমিন্দুকিরণমনুবিন্দতি' | চন্দনের অনুলেপন ও চাঁদ-জোছনা রাধিকার বিরহতাপিত দেহকে শীতল করতে অপারগ  | গৌরসুন্দর শ্রবণ করছেন পরম পদাবলী, চোখ বেয়ে গড়িয়ে নামছে অবিরল বারিধারা | আমিও শুনছি তোমায়, অতুলপ্রসাদের রেকর্ড, এখন আর কারুর গান শুনি না আমি, কথা বলি না কারুর সাথে | নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে শুধু তোমার সুরের টুকরো আঁকড়ে বেঁচে আছি, রেকর্ডগুলো আমায় বাঁচিয়ে রেখেছে |





পঞ্চদশ শতকে লেখা বিপ্রদাসের 'মনসামঙ্গল' যতটা পোস্টমডার্ন গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা সাহিত্যে যে পোস্ট-মডার্ন আয়োজন শুরু হয়েছে তা কি তার নখাগ্র-ও স্পর্শ করতে পেরেছে? শিব, গৌরী, গঙ্গা, ধর্ম, গরুড়, মনসা প্রভৃতির মতো পোস্টমডার্ন চরিত্র আর কোথায় আছে বঙ্গদেশের ভাষাসাহিত্যে? ধরা যাক এই একুশ শতকে যদি আমি মঙ্গলকাব্য লিখি, চরিত্র হবে কারা? জ্যোতি বসু চারু মজুমদার ইন্দিরা গান্ধী? লেনিন চার্চিল কেনেডি? বুশ গদ্দাফি গর্বাচেভ? যদিও বিপ্রদাস শুরুতে গৌড়ের রাজা হুসেন শাহ-কে অভিবাদন জানিয়েছেন | আমি এই জায়গায় অভিবাদন জানাবো আমার দেশের আদিম শ্বাপদসংকুল অন্ধকার-কে | আমার রজকীনিও থাকবে কাব্যে, নাহলে আমি কানা |





বাঁ হাতের সিগারেটটা নিভে যাচ্ছে তুষারমাখা বাতাসের ঝাপটে | একা এসেছি, তুলিকাদি আসেনি | দাঁড়িয়ে আছি গুরুদোম্বা লেকের ধারে, সন্ধ্যাকালে, দূরে অন্ধকার পাহাড়শ্রেণী | অদূরে উড়ছে প্রার্থনার বৌদ্ধনিশান | গুরু রিংপোচে তিব্বত থেকে ফেরার পথে স্পর্শ করেছিলেন হ্রদের বরফ-জল, তাই নাম গুরুদোম্বা | আমি অপেক্ষা করছি কখন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান যাত্রা শুরু করবেন নেপাল হয়ে তিব্বতের পথে, তিব্বতের তাঁকে দরকার, বাতাস আমায় জানিয়ে দেবে ঠিক, আমি ঘড়ি বাড়িতে ফেলে এসেছি |





বৌদ্ধ গুহার নিঝুম অন্ধকারে হাজার বছরের পুরোনো বাঙ্গালা গান গাইছো তুমি, কে তৈরী করেছে এই গান? কোন সিদ্ধাচার্য? অদূরে তথাগত বুদ্ধের বিগ্রহ, এতো অন্ধকারেও আলোছায়াময় | তোমায় আমি নির্মাণ করবো লিপিতে, নিগুঢ় সাধন-সংকেত লিখে যাবো সান্ধ্য-ভাষায়, কেউ ধরতে পারবে না, আমি খ্যাপা বাঙালি কবি, আমায় ধরা অতো সহজ নয় | তুমি গানটা গেয়ে যাও





চন্দ্রগুপ্ত মগধ ত্যাগ করেছেন সন্ন্যাস গ্রহণ করে | একান্তে বৃদ্ধ চাণক্য রাজনীতির পাঠ দিচ্ছেন বিম্বিসারকে | ক্ষত্রশক্তি এবং ব্রহ্মশক্তি যদি মিলে যায়, অসম্ভবও সম্ভব হয়ে ওঠে, যদিও মৌর্যরা ক্ষত্রিয় নয় | রাজনীতির কূটচক্র গ্রাস করছে ভারতকে | হিংসাই সত্য, যুদ্ধই পরম, ক্ষমতা ও দম্ভই নীতি | কয়েক শতক পূর্বে এই মধ্যদেশে বুদ্ধ প্রচার করেছিলেন মৈত্রী, করুণা, অহিংসার বাণী | এখন ভারত জ্বলছে রণ-আগুনে | কোথাও কোনো ঈশ্বর নেই দেবলীনা, কোন দেবতায় লীন হবে তুমি? ছায়াআলো মন্দিরগর্ভে তুমি একা নৃত্য করে চলেছো নির্জন বিগ্রহের সামনে | আমি তোমার সামনে নতজানু হতে পারি দেবলীনা? ঈশ্বরী? রাজনীতির কূট-আঁধারের বাইরে আমারা সংসার করবো লীনা |





বৈদান্তিক 'পূর্ণ' থেকে বৌদ্ধ 'শূন্য', এই তো ভারতবর্ষের যাত্রা | এরই মধ্যে কাশী-পাঞ্চাল-কুরু-গান্ধার-মগধ-অঙ্গ-পাটলিপুত্র-কোশল-অবন্তী| এরই মধ্যে ধৃতরাষ্ট্র, বিম্বিসার, প্রসেনজিৎ, অশোক, কনিষ্ক, সমুদ্রগুপ্ত, হর্ষবর্ধন| স্বয়ং ইতিহাসই কি তাহলে অন্ধ শাসন-পরম্পরার জনক? বৈদান্তিক 'পূর্ণ' থেকে বৌদ্ধ 'শূন্য'-এর অভিমুখে আমরা চলেছি, কিসের সন্ধানে, তুমি জানো দেবলীনা?





ডিসেম্বরের শহরে কুয়াশা ভারী হয়ে আসে| এ কি কলকাতা, না নাজারেথ? যীশু ও জন ব্যাপ্তিস্ত মুখোমুখি হয়, আমি দেখি | কে কার গুরু? কে কার শিষ্য? কে কাকে দেবে মন্ত্র? সহসা খুলে গেছিল স্বর্গ, নেমে এসেছিলো সেই অনাদি পারাবত, সেই পবিত্র প্রেত| আমি কালো স্কার্ট পরা মেয়েটিকে খুঁজি, যার জন্মদিন ঘন হয় আসছে, সে কি শেক্সপিয়ারের সনেট থেকে উঠে এসেছে? রাজা খুন করতে চেয়েছিল যীশুকে, তাই পিতা জোসেফ যীশুকে প্রাণে বাঁচাতে তাঁকে নিয়ে চলে যান ইজিপ্ট০
| ইজিপ্ট না কলকাতা? আমি সেই কালো স্কার্ট পরা মেয়েটিকে খুঁজি, দেখি কলকাতায় সারি সারি দাঁড়িয়ে কুয়াশায় মোড়া কাফেতারিয়া, আমি রাস্তা খুঁজে পাই না | খুন-জখমে ভরা এই পৃথিবীতে যীশু জন্মেছিল, খুন-জখমে ভরা এই পৃথিবীতে আমি তোমাকে চেয়েছি|




১০
একটা গোপন কথা বলি | বোধগয়া-তে একদিন আমি আর তুলিকাদি হাঁটছিলাম | অকস্মাৎ দেখলাম মন্দিরের সোপানতলে দাঁড়িয়ে প্রবীণ রবীন্দ্রনাথ, অনুচ্চ স্বরে আবৃত্তি করছেন উপনিষদ থেকে, 'যস্তু সর্বানি ভূতানি আত্মন্যেবানুপশ্যতি', ভাবছেন বুদ্ধের কথা | সনসনে বাতাসের মধ্যেও আমি তখন তুলিকাদি-কে বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম বোধিসত্ব-তত্ত্ব | তুলিকাদি আমায় জিজ্ঞাসা করেছিল, 'তৃতীয় আর্যসত্য থেকে কিকরে জন্ম নিচ্ছে তন্ত্র?' | তুলিকাদি হঠাৎ কাঁদতে শুরু করে, আর বাতাসও কেমন চক্রের মতো ঘুরছিল, প্রার্থনাচক্রে ঘুরছিল আমার সমস্ত পাপ | আপনারা বিশ্বাস করছেন না, তুলিকাদিকে জিগ্যেস করে দেখবেন |




সৌমাল্য মুখোপাধ্যায়

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন