(অলংকরণ: বিপ্লব দত্ত)













[]
প্রেম নারায়ণ নাথ-এর দুটি কবিতা
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস





লুম্বিনীর পারে

লুম্বিনির পারে মন্দির প্রাঙ্গণ এখন শূন্য
চারপাশ নীরব নিস্তব্ধ
তালিম না নেওয়া বাদ্যযন্ত্র ও
নিস্তব্ধ নিদ্রায়
যতক্ষণ পর্যন্ত থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত
স্পন্দনহীন যেন মহাকাল

কে কোথায় আছ এখন
কে কোথায় আছে দেবতা এখন
জেগে উঠেছে কি কেউ
স্বপ্ন দেখে কি কোনো দেবতা

আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি
কোথাও আমার শান্তি নেই
খুঁড়ে খুঁড়ে  মাটি দিয়েই পুঁতেছি
মাটি
দেবতাকে দেওয়া ফুল শুকালো
প্রদীপ নিভে গেল
ধুপ জ্বলে জ্বলে হল নিঃশেষ
আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি ভ্রান্তি  বিভ্রান্তির বলয়ে 
বুদ্ধকে
কোনো সমাধান
কোনো নিদান

বুদ্ধ শুনেছি কি বুকের ধপ ধপানি
তিনি কি ঘুমোন এক পলকের জন্য ঘুমোন কি
আমরা ডাকলেই আসবেন কি তিনি
আমাদের বুকের ধব ধপানি শুনতে
যত নীরব ছিল লুম্বিনী
তত নীরব ছিল কি কলং
দ্রুত পদক্ষেপে কলঙের ওপর দিয়ে হেঁটে 
কোথায় যায় বুড়ো ডাঙরিয়া বামন গোঁসাই জিজ্ঞেস করব নাকি তাকে
আছে নাকি কোনো সমাধান কিম্বা নিদান।





 

পাথরগুলি বুকে নিয়ে পাহাড়

পাথরগুলি বুকে নিয়ে পাহাড়
ভুলতে পারেনি মানুষের কথা

পাথর ভাবে
মানুষগুলি দেখছি কখন ও
আমার চেয়েও কঠিন হয়
অদৃশ্য ঈশ্বরকে আমার বুকে স্থাপন করে করে
হৃদয় বিগলিত সুরে ডেকে ডেকে
কখন ও দেখছি আমার চেয়েও হাজার গুণ কোমল হয়ে পড়ে

খাজুরাহোর

আমি তো কোনোদিন ভাবি নি
হতে হবে ঈশ্বরের ঘরের ঠিকানা

পাহাড়ের শোভা কি দেখবে
চারপাশে দেখছি জোকই জোক
মানুষের মুখের দিকে কী দেখবে
কুন্দে কাটা কথার যে ধার
 









[]
মৃদুল শর্মা-এর দুটি কবিতা 
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ- বাসুদেব দাস






একপ্রকার মুক্তির খোঁজে

একপ্রকার মুক্তির খোঁজে ভেতরে ভেতরে আন্দোলন করছি
নিজের জন্য বেঁচে থাকি যদিও
আমাকে আমার শত্রুর আশ্রয়ের জন্য তৈরি করতে হয়েছে ঘর
তার জন্যই একটি গাড়ি
পণবন্দী করে রেখেছে সে আজীবন আমার অসহায়তাকে
তুমি তাকে আমি বলে ভাব
যদিও আমি সে নই সেও আমি নয়
তার অসমর্থতাকে মানুষ আমার অক্ষমতা বলে ধরে নেয়
আর আমি হয়ে পড়ি অসুস্থ
তাকে আমি ঘৃণা করি
কারণ তার জন্যই আমাকে সর্বদা ইচ্ছার বিরুদ্ধে
অনেক কিছু করতে হয়
এমনকি সে দুঃখ পেলে আমাকেই সেবা শুশ্রূষা করতে হয়
সে আমার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ভাবেনা
এমন কি ভাবে না যে তাকে দেখাশোনা করার জন্য ও আমার একটা জীবন আছে
সেটাই আমার জীবন
জীবনটা বাঁচতে চেয়ে হাহাকার করি আমি
দেহহীন একটি অস্তিত্ব হয়ে কল্পনা কর  তো,
তোমার সঙ্গে মিশে যেতে কত ভালো হবে হে দেহহীনতা
কেবল প্রেম হয়ে
কেবল প্রেম হয়ে
প্রেমের জন্য কি দেহ একটা লাগেই






আমার নাকি একটা জাতি ছিল

আমার নাকি একটা জাতি ছিল
বুঝতে কষ্ট হয় বলে বলতেও লজ্জা হয়
কিন্তু ইতিহাসের শিলালিপিতে নাকি লেখা আছে কথাটা
তৃতীয় শ্রেণি বললে কি রকম থার্ড ক্লাস থার্ড ক্লাস মনে হয়
তাই নাকি সভ্য হতে শুরু করতেই
আমার জাতিটাকে করা হল দ্বিতীয় শ্রেণির
দ্বিতীয় শ্রেণির নেতা ছিল না আমাদের
নেতা আনা হল যোগ্যতার বিচারে অন্য জাতি থেকে
রেলগাড়ি চলে গেল
আর আমরা দিয়ে গেলাম,
এক দিক থেকে
চানাচুর সিদ্ধ ডিম চানা গরম গরম চা- কফি
টাইম পাস টাইম পাস
অনেক টাইম পাস হয়ে গেল আর আমরা সভ্য হয়ে উঠলাম
সভ্য হয়ে উঠেই বুঝতে পারলাম রাজনীতি কাকে বলে
প্রত্যেকেই রাজা হতে পারে না
এখন বেড়ায় গেঁথে রাখা আছে বিদেশি মিউজিয়ামের 
উলঙ্গ প্রতিবাদীর হাত উত্তোলন করা কিছু হুংকার
যাদের অসভ্য বর্বর বলা হয়েছিল
তার সামনে দাঁড়িয়ে সগৌরবে তাকিয়ে আছি আমরা
দেখিয়ে দিয়েছি সন্তানকে










[]
পরাগজ‍্যোতি মহন্ত-এর দুটি কবিতা 
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ- বাসুদেব দাস





মৃত্যুর শীতল ছায়ায়

শীতের রাতে রাতেই হাতের ইশারায় ডাকতে থাকে
নদীটির ওপারে
কুয়াশা নামের সুন্দরী মেয়েটি
আসুন, এখানে বরফ বৃষ্টি হচ্ছে
বৈশাখের প্রথম ঝাঁকবৃষ্টির মতো ভিজি  এসো
এসো স্পর্শ করি নিজেকে নিজে
দেহরূপ নৌকা ভাসিয়ে দিই
কুয়াশা সমুদ্রে
আঃ, কুয়াশা নামের সুন্দরী মেয়েটি
একটা সাদা চাদরে ঘিরে ধরেছে আমার সর্বাঙ্গ শরীর
ইস জল কামড়াচ্ছে
হালকা আঙ্গুলগুলি বিকল হয়ে এসেছে
চোখের সামনে হলদে সর্ষেফুল দেখছি
শ্বাস প্রশ্বাস গুলি ঠান্ডা বরফে জমাট বেঁধেছে
দেহরূপী নৌকা আমার কুয়াশার অতল  সমুদ্রে
অদৃশ্য হয়ে পড়েছে
আঃ মৃত্যুর কী শীতল স্পর্শ






পাথর কথা

পাথর কথা বলে কি পাথরের কথা। অপদেবতায় ভর করা পাহাড়ের ভাস্কর্যের মধ্যে একটি পাথুরে কণ্ঠস্বর
মাকে ডাকতে থাকে।
ছিলকি সে আমার পূর্বজন্মের পার্বতী। উড়ন্ত অপ্সরা এসে কানে কানে আমাকে বলল, সে পার্বতী ছিল না পাথর? আমি পাথর না শিব?
বলতে পারিনা
শেওলা জন্মান পাথরগুলির পাথুরে কণ্ঠস্বরে
ভেঙ্গে পড়া শুকনো গাছের ডালের মতো বুকটা ভাঙ্গে
মাথার ওপরে উড়ে বেড়ানো একঝাঁক মৌমাছির গুঞ্জনে
আকাশটা খসে পড়া বলে মনে হয়
চিতা বাঘের গর্জন। গুঁইসাপের আওয়াজে
 পা টিপে টিপে অতিক্রম করি অপ দেবতায় পাওয়া পাহাড়ের পথ

অন্ধ, মূক, বধির,শিলাস্তম্ভগুলির মধ্যে দেখি
নাভিপদ্মে জন্ম হওয়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমারই স্বরূপ
পাথরেই জন্ম আমার, পাথরেই আয়ুষ্মান আমি
পাথর, শিব না পার্বতী
বলতে পারিনা আমি।।










[]
প্রণব কুমার বর্মন-এর দুটি কবিতা 
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ‐ বাসুদেব দাস




বৃষ্টির দিনগুলিতে তোমার কথা মনে করব

বৃষ্টির দিনগুলিতে তোমার কথা মনে করব
আর একা ভিজব
অর্ধ সমাপ্ত ঋতুর সমবেদনায় শোক প্রকাশ করব
সম্প্রতি তোমার উপস্থিতি আমার শহরে শূন্য
সম্প্রতি তোমার নিয়ম মাফিক পরিভ্রমণ আমার শহরে শূন্য
সম্প্রতি আমার শহর ঘিরে থাকা দুঃখের হোৰ্ডিংগুলিতে
তোমার বিজ্ঞাপনশূন্য
শূন্য তোমার সমস্ত স্লোগান আমার শহরের দেওয়ালে

তোমাকে এই জন্যই ধন্যবাদ যে
তুমি ফুলে শোভিত একটা ছাতি দিয়ে বৃষ্টিকে আমার শহরে
প্রবেশ করতে দাও নি
তোমার ছাতির নিচে, তোমার ছাতির নিচে
প্রত্যেকের দৃষ্টির পরিচিত- অপরিচিত নিক্ষেপের পারে পারে
আমি অনিন্দ্য স্বপ্নের সেই স্টপে চলে যাচ্ছিলাম 
তুমি যদি ছলনার ছলে মজা দেখছিলে
তুমি যদি নারকীয় সুখের ভাবনায়
আমার পথের ভুল নির্দেশ দিয়েছিলে
তুমি যদি, তুমি যদি আমার এক একটি উচ্চারিত
শব্দকে তোমার হৃদয়ের ভাষায় তর্জমা করার জন্য
অপারগ ছিলে
বৃষ্টির দিনগুলি আমার শহরে দ্বিতীয়বার না আসুক
বিদায় বৃষ্টি, বিদায় বৃষ্টির দিনগুলি

আমি জানি সুখী হওয়ার সমস্ত পথ সম্প্রতি বন্ধ

সুখী হব না আমি আর কখনও
সুখী হব না স্মৃতির নিদারুণ অত্যাচারের জন্য
সুখী হব না শূন্যতার প্রলেপ বুকের কোঠায় 
কোঠায় পরার জন্য
তোমার চিরদিনের অনুপস্থিতি আমাকে দুঃখী করে রাখবে
সম্প্রতি আমার শহর বিষাদ শহর আর আমি সেই
শহরের পুরোনো বাসিন্দা

বৃষ্টির দিনগুলিকে শীতলভাবেই সম্ভাষণ জানাব
শীতল ভাবেই ছাতা মেলে দিয়ে
বৃষ্টির দিনগুলিতে তোমার কথা মনে করব
বৃষ্টিতে ভেজার বাসনাকে বিদায় জানাব

আসলে আমার শহরে উন্মাদ বৃষ্টির দিনগুলি নেই
তোমার সঙ্গে চলে গেছে বৃষ্টির দিনগুলি
একটি ফুলশোভিত ছাতির সম্মোহনে!







সন্দিকৈ কলেজের তুমি সাগরিকা বরদলৈ

তুমি সাগরিকা বরদলৈ
কুশলে আছ তো!

তোমার জন্যই আমার শব্দের দুহাতে গজে উঠে দীর্ঘশ্বাস!!
পানবাজারে সন্ধেবেলা যেও না
সান্ধ‍্য আইনে মাতাল দীঘলী পুকুরপার
অশ্লীল হয়ে পড়তে পারে তারা গুলি
কত অশান্ত বাতাস, নিশান্তের কামনা

সাগরিকা, তুমি তো জানই আমি প্রেমিক পাখি
তোমার অভিমানের পুকুর সেচে আমি নিয়ে আসব দারিকণা 
আমার আমার একোরিয়ামে সে নাচবে
আমি দারিকণা  ধরতে বরশি বাইব না 
তোমার দুঃখের পোশাক ধোবার জন্য আমি ধোবি হই
তুমি গরমে কী ভালোবাস-সিটরা,মিরাণ্ডা না পেপসি থামস আপ
'আমেরিকা' আমাদের জন্য ঘৃণ্য শব্দ
ঘোলা জলে কলেরা খেয়ে যৌবনপ্রাপ্ত আমাদের দেশের অযুত শৈশব
তুমি কী ভালোবাসো- ম্যাডোনা না মাইকেল জ্যাকসন
আমাকে বধির করে তোলা ফেল  সাগরিকা
সেই চিৎকার বুভুক্ষ মানুষের আমি সইতে পারিনা
আশির দশকের মধ্য দিয়ে হেঁটে আসা প্রতিটি মানুষকে জিজ্ঞেস কর
বেত্রাঘাতের সংজ্ঞা
মাদের জিজ্ঞেস কর তাদের কতবার উলঙ্গ করা হয়েছিল অন্ধকারে
শার্টের পকেটে যখন নিয়ে বেড়াই হৃদয় রঙের একটি খাম
বন্ধুরা ক্ষ্যাপায় কেন নিয়ে বেড়াও রেশনের কার্ড
তারা তো জানে না তাতে লেখা থাকে বসন্ত এবং প্রেমের ঠিকানা

তুমি সিসিফাসের গল্প শুনেছ কি? স্পার্টাকাসের?
কীভাবে মাংস খাই বলে ছাগলীর মাথা নিয়ে ফিরে আসে শিক্ষক বায়রণ
টিবিতে মরে কৃষক কীটস,উদ্ধত শ‍্যেলী  নিরুদ্দিষ্ট হয়
মহানগরীতে মৌন বুদ্ধ, মৃত ঈশ্বর, ক্রুশবিদ্ধ যিশু
তুমি হিকমতের হাত দুটি কখন ও চেয়েছ কি?লরকাকে?? নেরুদাকে ??
খাবে? খাও আমার হৃদয় রাশিয়ার ভডকা
খেয়ে কি খিলখিলিয়ে হাসে তোমার হৃদয়ের একটি যূঁই
আমি ধূমপান করি, এটা আমার নেশা
তুমি একটি গানের সিগারেট
দেখা হলে আমার বাবাকে জিজ্ঞেস কর–
তাঁর নেশা মাঠের সবুজ, অরুণ্যের দুঃখ
শোষণের ভারে তিনি একজন কুঁজো মানুষ।

সাগরিকা, দুঃখের অরণ্য না থাকলে কোথায় এসে বিশ্রাম নেবে সুখের পাখি
একদিন তুমিও চলে যাবে আমার হৃদয়ের রক্ত জবা ছিঁড়ে,
জালুকবাড়ি অথবা গৃহিণী
দুঃখের বাতাসেও যদি উড়ে থাকে তোমার হাসির নিশান
ও' নতুন দিনের আং-ছাং-ছ‍্যুকী
দিয়ে যাবে কেবল আমার কলমে রক্তের কালি
বারুদের অক্ষর লিখব।

তুমি সাগরিকা বরদলৈ
কুশলে আছতো

 







[]
মনোজ কুমার দেওরজা-এর দুটি কবিতা 
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস




তোমারটা আমার নয়

আমার হাতটা তোমার হাতে 
তোমারটা আমার
তোমার স্বপ্নগুলি এখন আমি দেখি
আমারগুলি তুমি 
আমি যে কিছু একটা লিখি 
সেটা তোমার কথা
তুমি লেখাগুলি আমার 
তোমার হাসা হাসিটা প্রকৃতপক্ষে আমার
আমারটা তোমার
আমি কাঁদা কান্নাটা তোমার 
কিন্তু তোমারটা আমার নয়।





মাটির মতো মানুষগুলি

আকাশের বিশালতাকে একদিন প্রত্যেকেই মেনে নিল

আকাশের মতো হতে পারিনি বলেই 
মাটি আমার আপন
মাটির মতো হতে চাওয়া মানুষগুলি আমার প্রিয় 

আমার বুক স্পর্শ করে পার হয়ে যায় কত তুফান 
গা পিছলে বয়ে যায় কত রোদ
আমি নীরবে সই মাটির মতো 
মাটির স্পর্শে আমার মন ভরে থাকে 

আমার কাছে এসে কাউকে খালি হাতে ফিরতে হয় না

স্বপ্ন দেখা 
স্বপ্ন ভাঙ্গা 
কত মানুষ
আমার বুকে গোপনে জমে 

মানুষের দুঃখের চোখেরজলগুলি সুখের বৃষ্টি হয়ে 
আমার বুকে ঝরে পড়ে 
প্রতিফোঁটা চোখের জলে সাগরের মতো গভীরতা 

সাগরের গভীরতাকে প্রত্যেকে স্বীকার করল বলেই 
আমি সাগর ভালোবাসি 
সাগরের মতো মানুষগুলি আমার প্রতি প্রিয় 
মাটির মতো মানুষগুলি এক একটি সাগর।
  




বাসুদেব দাস 

(অনুবাদক)

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন