মার্গারেট অ্যাটউডের কবিতা
‘দিস ইজ অ্যা ফটোগ্রাফ অফ মি’
ভূমিকা ও অনুবাদঃ সুজিত কুসুম পাল
কাব্যিক প্রকাশে অস্পষ্টতার আবহ নির্মাণে মার্গারেট অ্যাটউডের চাতুর্য চিরকালিন। ‘দিস ইজ অ্যা ফটোগ্রাফ অফ মি’ শিরোনাম না হয়ে হতে পারতো কবিতার প্রথম লাইন। প্রথম স্তবকের প্রারম্ভিক লাইন থেকেই অস্পষ্টতার আবহাওয়া। পুরনো দিনের তোলা একটি মুদ্রিত কাগুজে ছবি। কালের সিন্দুকের চাপা খেয়ে ছবির মুদ্রণকালি ল্যাপটে গেছে। ঝাপসা হয়ে গেছে ধূসর রঙের হাজারো দানায়; নির্বাক হয়ে গেছে একটি অবাক চিত্র।
দ্বিতীয় স্তবকে এসে প্রথম স্তবকের ঝাপসা ছবির মাঝখান থেকে কিছু স্পষ্ট ভূ-চিত্র তথা ল্যান্ডস্কেপকে অবমুক্ত করতে গিয়ে কবি আবারো প্রয়োগ করেছেন অস্পষ্টতা নির্মাণের কৌশল। এখানে ছবির বাম কোণে বৃক্ষশাখার মতো দেখতে কিছু একটা আছে; হতে পারে বালসাম অথবা স্প্রুস গাছের বাড়ন্ত কোনো অংশ। ডান দিকে ঢালু পথের মাঝখানে দৃশ্যমান বাড়িটিকে তিনি চিহ্নিত করেছেন ‘স্মল ফ্রেম হাউজ’ হিসেবে। বাড়ির সৌন্দর্য বর্ধন কিংবা প্রাইভেসি রক্ষণের নিমিত্ত বেড়া কিংবা ‘ফেন্স’-এর কথা না বলে কবি এখানে ‘ফ্রেম’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ফলে, ফ্রেমবন্দী বাড়ির মধ্যে ‘গৃহবন্দী’ কেউ আছেন কিনা এই প্রশ্নটি জাগতেই পারে পাঠকের মনে।
তৃতীয় স্তবকে এসে তিনি খোলসা করেছেন, ছবির পেছনে একটি হ্রদ আছে; কাছাকাছি কিছু নিচু টিলাও আছে। তিন তিনটি স্তবক শেষ করে চৌদ্দটি লাইন পাড়ি দিয়েও কোনো কাব্যিক বার্তার সন্ধান পৌঁছেনি আমার মতো নিরীহ পাঠকের মগজে কিংবা হৃদয়ে। ঝাপসা একটি ফটোগ্রাফ থেকে ভূ-চিত্রের এতো বৈচিত্র্য উদ্ধারের পর মানুষের মুখ বিহীন এই ফটোগ্রাফটিকে না বলা যায় ঝাপসা, না বলা যায় ফটোগ্রাফটি কবির নিজের।
প্রকৃতপক্ষে, পঞ্চদশ থেকে শেষ তথা ছাব্বিশতম লাইন ব্যাপী কবিতার গুরুগম্ভীর বার্তা বহনকারী খামের মুখটি খোলা হয়েছে একটি লঘু বন্ধনীর (গণিতের প্রথম বন্ধনী) মধ্য দিয়ে।
(The photograph was taken
the day after I drowned. … )
আচমকা, চতুর্থ স্তবকে, তৃতীয় পুরুষের পর্দা সরিয়ে বক্তা জানান দিলেন প্রথম পুরুষেঃ আমি যেদিন ডুবে মরেছিলাম, তার পরদিনই ছবিটি ধারণ করা হয়েছিলো। ছবির ধারণকর্তার নাম আড়াল করা হলো। মৃতজনের মুক্তকণ্ঠে উচ্চারিত হলো একটি অসম্পূর্ণ সুরতহাল প্রতিবেদনঃ
(… It is difficult to say where
precisely, or to say
how large or small I am:
the effect of water
on light is a distortion … )
আমি ছবির মাঝখানে জলপৃষ্ঠের একটু নিচেই আছি। তবে, সুনির্দিষ্টভাবে আমার সাকার অবস্থান ঠিক কোনখানে কিংবা আয়তনে আমি কতোখানি বড়ো বা ছোটো বলা মুশকিল। আমার শরীরী অস্তিত্বও বিভ্রান্তিকরভাবে বিকৃত হয়ে গেছে জলের পিঠে আলোর প্রতিসরণে।
শেষ স্তবকে এসে পাঠকদের তিনি অন্তরীন করেছেন আত্মবিশ্বাসের বৃত্তে। বিদায় নেয়ার আগে, একটি ভয়াবহ লঘু বন্ধনীর মধ্যে গুরুগম্ভীর বার্তাকে অবমুক্ত করে দৃঢ় প্রত্যয়ে মৃতকণ্ঠ জানিয়ে গেলেন, সময় নিয়ে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলে হ্রদের মধ্যেই পাওয়া যাবে তাঁর অস্তিত্বের সন্ধান। হ্রদের জলের সাথে আলোর চিরকালিন ক্রীড়াযজ্ঞে তাঁর শরীরী অস্তিত্ব ছবিতে বিকৃত হলেও তিনি আছেন জলপৃষ্টের নিচেই। এইরকম একটি চ্যালেঞ্জিং ঘোষণার পর ঝাপসা ছবিটি ফর্সা হয়ে গেলো অকস্মাৎ। কাব্যিক ক্যানভাসে আঁকা উদ্বোধনী ভূ-চিত্রের অংশ হয়ে গেলেন অ্যাটউড নিজেই। আর, ঘোষণাকৃত নিজের ছবিটি হয়ে গেলো ষাটের দশকের অবহেলিত বলয়ের প্রান্তিক মানুষের নিয়তি।
২৫ বছর বয়সী মার্গারেট অ্যাটউড (১৯৩৯)-এর প্রথম কাব্য সংকলন ‘দ্য সার্কেল গেম’ (১৯৬৪)-এর উদ্বোধনী কবিতা 'দিস ইজ অ্যা ফটোগ্রাফ অফ মি'। গভর্নর জেনারেল এ্যাওয়ার্ড (১৯৬৬) প্রাপ্ত ক্লাসিক কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটি গড়ে উঠেছে একটি অত্যন্ত প্রতীকী ফটোগ্রাফকে কেন্দ্র করে। আলোচিত ফটোগ্রাফটি এখানে ইতিহাসেরই প্রতিনিধি। প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা যে ছবিকে ধারণ করি, সেই ছবিটি ইতিহাসের পরিপূর্ণ আয়না হতে পারে না। তাছাড়া, কালের রাজ্যে চলমান বন্যতায় আড়াল হয়ে যায় মানব সভ্যতা। দেখার পরেও দেখার বিষয় অ-দেখা থেকে যায়। প্রত্নতাত্বিক খনন চালিয়ে একটি প্রাচীন সভ্যতাকে মাটির নিচ থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত খননকৃত এলাকাটি আমাদের ক্যামেরায় ভূ-মানচিত্রেরই অংশ মাত্র। বলা যায়, প্রতিটি ভূ-চিত্র একটি অন্ধকার কিংবা আলোকিত ইতিহাসকে আড়াল করে। মাটি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসে সভ্যতা। প্রকৃতিকে বিবেচনায় নিয়ে প্রযুক্তিকে বিয়োজন করলে উন্মোচিত হয় স্পষ্টতা। হ্রদের মাঝখানে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ক্যামেরায় ডুবে মরা মেয়েদের প্রাণজ অস্তিত্ব।
এটি আমারই একটি ফটোগ্রাফ
বেশ কিছু দিন আগের ধারণ করা।
প্রথম দেখায় মনে হবে
ছবিতে কালির ছাপ, মুদ্রণ জনিত দাগ;
ঝাপসা লাইন আর অস্পষ্ট কণাচিত্র
কাগজের রঙে নির্বাক।
দ্বিতীয় পরখে দেখবে, ছবির বাম কোণে,
দেখতে বৃক্ষশাখার মতো কিছু একটা আছে;
হবে হয়তো বালসাম কিংবা স্প্রুস গাছের
বাড়ন্ত কোনো অংশ আছে।
ডানদিকে, একটি প্রশান্ত ঢালু পথ– মাঝখানে
বেড়া দিয়ে ঘেরা ছোটো একটি ঘর আছে।
একটি হ্রদ আছে পশ্চাদভূমে
নিচু নিচু কিছু টিলা আছে
হ্রদের চরণ চুমে।
(ছবিটি তোলা হয়েছিলো সেদিনই
যেদিন আমি ডুবে গিয়েছিলাম।
আমি জলের মধ্যেই আছি
ছবির মাঝখানে
জলপৃষ্ঠের একটু নিচেই আছি।
সুনির্দিষ্টভাবে বলা মুশকিল
আমি ঠিক কোনখানে আছি;
বড়ো কিংবা ছোটো আয়তনে কতোখানি;
আলোর পিঠে জলের খেলায় বিকৃত মম অঙ্গখানি।
নেত্রপাত করো যদি সময়ের তীরে
একেবারে শেষ অব্দি
আমাকে দেখবে তুমি হ্রদের হৃদয় জুড়ে।)
[ছাব্বিশ লাইনের মূল কবিতাটিকে ছাব্বিশ লাইনেই অন্তরীন করা হয়েছে। একশো তেতাল্লিশ শব্দের কবিতাকে সীমিত করা হয়েছে একশো তেইশ শব্দে।]
Original: This Is a Photograph of Me
By Margaret Atwood
It was taken some time ago.
At first it seems to be
a smeared
print: blurred lines and grey flecks
blended with the paper;
then, as you scan
it, you see in the left-hand corner
a thing that is like a branch: part of a tree
(balsam or spruce) emerging
and, to the right, halfway up
what ought to be a gentle
slope, a small frame house.
In the background there is a lake,
and beyond that, some low hills.
(The photograph was taken
the day after I drowned.
I am in the lake, in the center
of the picture, just under the surface.
It is difficult to say where
precisely, or to say
how large or small I am:
the effect of water
on light is a distortion
but if you look long enough,
eventually
you will be able to see me.)
সুজিত কুসুম পাল
(অনুবাদক)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন