নীলিম কুমার
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
আমি বসন্তের পাতা চিবোলাম
আমি কয়েকটি বসন্তের পাতা চিবোলাম
আর আমার চুলগুলি হল সবুজ
আমার লোমগুলি হল সবুজ
আমি আরও কয়েকটি চিবিয়ে নিলাম
বসন্তের পাতা
আর আমার দুচোখ হল সবুজ
ত্বকের রং হল সবুজ
আমি গোটা মানুষটা হয়ে পড়লাম
সবুজ
আমি আর বসন্তের পাতা চিবোলাম না
কে জানে যদি হৃদয় হয়ে পড়ে সবুজ
আমি গাছ হতে চাই না
হৃদয় পরিবর্তিত করতে চাই না
আমার হৃদয় আমার হৃদয়ের মতোই হয়ে থাকুক
প্রেমে প্রতিবাদে রক্তিম
আমি একটু বৃষ্টির জল গিললাম
আর আমার ভেতরে বয়ে গেল
কুলু কুলু একটি ঝর্ণা
আমি আরও একটু বৃষ্টির জল গিললাম
আর দেখলাম আমার ভেতরের
ঝর্না হয়ে পড়েছে নদী
আমি আর একটুও বৃষ্টি গিললাম না
কে জানে যদি নদী হয়ে পড়ে সাগর
বুকের ভেতরে
এত ঢেউ এত গর্জন এত মাছ-মগর
সামুদ্রিক প্রাণী শঙ্খ শামুক
আমি নিয়ে বেড়াতে পারব না বুকের ভেতরে
আমি সাগর ভালোবাসি না
কারণ সাগর কখনও এগোতে পারেনা
সাগরের সীমা বালুচর
বালু অতিক্রম করতে না পেরে
গুঞ্জরে- গর্জাতে থাকে সাগর
এগোতে পারে না
এগোতে পারে না
বিশ্বকাপ ফুটবল
ভারত বর্ষ! তোমার হাতটা কে কেটেছে?
– হিন্দুরা কেটেছে।
তোমার পা টা কে কেটেছে?
– মুসলমানে কেটেছে।
ফুটবল খেলবে কীভাবে ভারত
বিশ্বকাপ ফুটবল খেলবে কীভাবে?
হে ভারত
খেলতে পারতে তুমি
দুর্নীতির বিশ্বকাপ
বিশ্বকাপ জুয়া
খেলতে পারতে তুমি হিংসা লুণ্ঠন
গুজরাট গুজরাট
তুমি তো হতে পারতে ক্যাপ্টেন
খেলতে পারতে বিশ্বকাপ সাম্প্রদায়িকতা
রাম সেবকদের প্র্যাকটিস শেষ হয়েছে কি
শেষ হয়েছে কি জিজ্ঞেস করা
স্বপ্নেও সোনার বুট জুতো দেখার
অধিকার নেই তোমার সন্তানের হে ভারতবর্ষ
এত দুর্ভাগা আমরা!
কে কেড়ে নিল আমাদের বুকের হর্ষ
কে কেড়ে নিল আমাদের খেলার বস্ত্র
আমরাও তো খেলেছিলাম বাতাবি লেবু
ফিফা তুমি জানো কি
ব্রাজিলের মতোই।
ব্রাজিল এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে
কতদূর পৌঁছে গেল সেই বাতাবি লেবু
টিভির পর্দায় দেখা যায় না
তথাপি বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে যাব
যদিও আমার সর্বাঙ্গ রক্তে মাখামাখি
যদিও আমার সর্বাঙ্গে হিংসার আঁচড়
বিশ্বকাপ দেখতে যাব
জাপান এবং কোরিয়া
তোমাদের বুদ্ধের জন্মস্থানের বাসিন্দা আমি
তোমাদের রেলওয়ে প্লেটফর্মে
রাত কাটানোর জন্য
আমার জন্য দুফুট জায়গা হবে না কি
বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে যাব
সমগ্র পৃথিবী যেখানে হামলে পড়বে
নাচতে থাকবে খেলোয়াড় দেশের রাষ্ট্রীয় পতাকা গুলি
সেখানে আমি আমাদের ত্রিরঙ্গাটা
কীভাবে পকেটে নিয়ে যাব!
ভারতবর্ষ! এত দুর্ভাগা আমি
বিশ্বব্যাংকের ভিখারি
হিন্দুরা তোমার একটা হাত কেটেছে
মুসলমান তোমার একটা পা কেটেছে
তবু বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে যাব
তোমাকে আমি দূর থেকেই
চিনতে পারব দাভোর ছুকের সোনার বুটের অধিকারী
চিনতে পারব জিনেদাইন জিদান, রোনাল্ডো
বাতিস্তুতা তোমাদেরকেও!
আমার রক্তে বিচরণ করা তোমরা
তোমাদের চাল- চলনের সংজ্ঞা জানি আমি
আমি যে ফুটবল ভালোবাসি
আমি যে শক্তিশালী ফুটবল ভালোবাসি
ক্রিকেটের মতো অকর্মণ্য খেলা নয়!
কোকাকোলা
তোমার সঙ্গে আমি যাব না
বিশ্বকাপ দেখতে
আদিদাস
তোমার সঙ্গেও যাব না
ফিফা, তুমি আমাকে একটা ফ্রি টিকেট দেবে কি
গ্যালারির এক কোণে আমি
চুপচাপ বসে থাকব
কেউ আমাকে চিনতে পারবে না
মুখে আঁকাআঁকি করব
লাগলে ভারতবাসী বলে
আমি কাউকে পরিচয় দেব না
ফিফা, তুমি আমাকে একটা
ফ্রি টিকেট দেবে কি?
দেবে কি বল
না হলে আমি মনে মনে
চোরের মতো খেলার মাঠে ঢুকব
একজন ফুটবল প্রেমিককে এই অপরাধে
ফিফা তুমি শাস্তি দিতে পারবে কি?
যেভাবেই আমি উপস্থিত হই না
জাপান এবং কোরিয়া
আমাকে বরণ করার জন্য প্রস্তুত থাকুক বা না থাকুক
বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে যাব।
মনে রাখবে দরিদ্র দেশেও ফুটবল ভালোবাসে
আমার মতো সবচেয়ে দরিদ্র জনও!
ভারতবর্ষ।
তুমি কিছু বলবে?
তোমার যন্ত্রনা নেই
তোমার একটা হাত কেটেছে হিন্দুরা
একটা পা কেটেছে মুসলমানে
তুমি কি কোনোদিনই
বিশ্বকাপ ফুটবল খেলতে পারবে না ভারত?
পারবে না??
কবি সম্মেলন
কবি সম্মেলন
আসলে যাতনার সম্মেলন।
যাতনার সম্মেলন মানে তো
হাসপাতাল-
বিছানায় পড়ে আছে যাতনা গুলি।
চিকিৎসক নেই,নার্স নেই
অপারেশন থিয়েটার অন্ধকার,
অক্সিজেন সিলিন্ডার খালি।ঔষধ নেই
নেই ইনজেকশন স্যালাইন…
সবাই চলে গেছে
যাতনাকে সম্মেলন পাততে দিয়ে!
যাতনার মধ্যে জ্যেষ্ঠ এক যাতনা
সঞ্চালক হয়েছে
যাতনাগুলি
একের পরে এক
যাতনা পড়ছে। আসলে কাব্য পাঠ
সঞ্চালক মাঝেমধ্যে
কোনো যাতনাকে জিজ্ঞেস করছে-
আপনি যাতনা হওয়ার জন্য
অসুখ পুষেছিলেন নাকি?
কোনো যাতনা বলছে
হ্যাঁ
কোনোটা বলেছে
না
শুনতে থাকা যাতনাগুলি
নিজের যাতনাগুলি পাঠ করার জন্য
অতি যাতনাময় হয়ে উঠেছে
কবি সম্মেলন আসলে
যাতনার সম্মেলন
যেভাবে কবিতার সমালোচক থাকে
সেভাবে যাতনার সমালোচক ছিল
ডিমেনসিয়া এবং স্কিজোফ্রেনিয়া
অন্য ওয়ার্ডে থাকা
ডিমনেসিয়া এবং স্কিজোফ্রেনিয়াকে
পর্যালোচনার জন্য ডাকা হল
ডিমনেশিয়া বলল-
যাতনাগুলি এখনও
শিল্প হয়ে উঠতে পারেনি,
যাতনাগুলি ছাড়তে হবে-উস আস
কাতরোক্তি এবং চোখের জল
স্কিজোফ্রেনিয়া বলল-
যাতনাগুলিকে করতে হবে
মৃত্যুকে অধ্যয়ন এবং অনুশীলন…
শিল্প অবিহনে যাতনা এক অসুখ মাত্র।
কবি ভাবেন
ডিমনেসিয়া এবং স্কিজোফ্রানিয়া
যাতনা নয়, কেবল শিল্প
নিজের স্বপক্ষে ডিমনেসিয়া বলে-
অশুদ্ধগুলি শুদ্ধ বলে ভাবাটা এবং
কিছু ভাবতে সবকিছু
ভুল করে ভাবাটাই শিল্প!
সঞ্চালক সবশেষে মন্তব্য করেঃ
যাতনাগুলি শিল্প হয়ে উঠতে পারেনি।
যাতনাগুলি হয়েছে কবির আঙ্গিকে করা
উস আস কাতরোক্তির ভাষা!
যাতনাগুলি কাতরোক্তি করবেই
কারণ কোথাও লিখে রাখা নেই-
'কীপ সাইলেন্ট'!
সৌরভ শইকীয়া
গোলকীপার
এই স্বপ্ন যেন আমি না দেখি।
এ যে একটি দুঃস্বপ্ন, ঠিক সেটাও নয়।
এই স্বপ্ন আমার কাছে আতশবাজির মতো
যার আগুন আমাকে পোড়াচ্ছে
কিন্তু, তার সৌন্দর্যকে আমি
অস্বীকার করতে
পারিনা।
খড়কুটোর মতো ভেসে গেল জীবন
হায়!
প্রত্যেকটি গোল খাবার সঙ্গে সঙ্গে একজন গোলকীপারের
একবার করে মৃত্যু হয়।
ফুটবল সূর্য
বসন্তের ভোরবেলার মতো
ফুলের গর্ভে ধীরে এসে প্রবেশ করল
ফুটবলটা।
বলল-
এখানেই ঘর বানাই । একটু জায়গা দেবে কি?
কলি ফুটানোর জন্য তোমার বুকে
সুবাসে সুবাসে শিহরণ বইবে
ফুটবলের একটি বাগিচা হবে
গীতি কাব্য রচি এসো
অজস্র নক্ষত্র নেমে ভিড় করবে মনের মধ্যে, ঘুরে বেড়াবে
সূর্যটিই যেন একটি ফুটবল
দিগ্বলয় কুরুক্ষেত্র
আর স্বপ্নের অভ্যন্তরে সৌন্দর্যের দিব্য-শুচিতা
কী নতুন…আঃ!
পিয়ানোর মতো বেজে উঠে
দুই পায়ে নয়
হৃদয়ের অনুভূতিতে সেটা, ওরা খেলছে ফুটবল
স্ৰোত বয়ে গেছে দর্শকের, দেখ!
ফ্লাইওভার থেকে গোলাকার স্টেডিয়ামটার দিকে ঘুরে তাকাও
আকাশের দিকে উঠে যাওয়া শেষ গ্যালারিটা থেকে লক্ষ্য কর
এটি একটি বাগান, ফুটবলের বাগান
ক্রীড়াঙ্গন রামধেনু হয়ে পড়েছে
রোমাঞ্চ গড়িয়ে গেছে দশ দিকে
ভুভুজেলা হলাম না কেন? আমি ভুভুজেলা হলাম না কেন?
আলোড়িত আত্মাগুলি চিৎকার করে উঠেছে আনন্দে-
এখানে স্বর্গ, আমি স্বর্গ রচনা করতে পারি।
টীকা-
ভুভুজেলা-এক ধরনের শিঙ্গাজাতীয় আফ্রিকান বাদ্যযন্ত্র।
কিশোর মনজিৎ বরা
একলব্য
ব্যাধের সন্তান আমি
এটাই আমার প্রথম এবং অন্তিম পরিচয়
ইতিহাস বারবার আমার হাতে
তুলে দেয় গুণবিহীন এক একটি ধনু
আর চতুর হাতে কেটে নেয় অংগুষ্ঠ
প্রাণাধিক গুরুদেব কেবল আমার
আঙ্গুলটা কেটে নিল
আমি তো মাথা পেতে দিতে প্রস্তুত ছিলাম
একটি মাত্র উত্তরীয় গায়ে নিয়ে
আমি একটি কল্পনার পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম
সেটাই আমার শরবর্ষণে কল্পনার শিল্প ছিল,
আরণ্যক নিস্তব্ধতা আর অদৃশ্য
দল হরিণের ঝাঁকের মধ্যেও সেই
সৃজনের সন্ধান করেছিলাম,এমনকি একজন
কাল্পনিক আচার্যের সামনে আমি দীক্ষা নিলাম
কুরুক্ষেত্রের কর্ণ আর আমি একত্রিত হলে
থমকে দাঁড়াত স্বয়ং ব্যাসদেবের কাপ
আর মধুসূদন তোমার সুদর্শন
অথচ আমরা নির্বিবাদে মেনে নিলাম
নিয়তির নির্দেশ
সঁপে দিলাম নিজেকে ভাগ্য দেবীর কোলে
আর মহাকাব্য বুড়ো আঙ্গুলটা কেটে নিয়ে
সমগ্র জীবনের জন্য আমাকে কল্পনার রাজ্যে নির্বাসন দিল–
ধন্য হে মহান ভারত রাষ্ট্র
বুদ্ধকে খুঁজে বেড়ানো রাত
একটি কলিঙ্গ
একজন অশোকের জন্ম দিয়েছিল
যন্ত্রণা কাতর একটি পাখির চিৎকারে
জন্ম দিয়েছিল একজন বুদ্ধকে
পথটা কোন দিকে
সিদ্ধার্থ বুদ্ধ হওয়ার
সেই প্রাচীন পথটা?
কেমন এই সময়
শিশির ঝরে পড়ার কথা
ঝরছে
রক্ত আর
চোখের জল
অনুশোচনার অশোক আছে কোথাও
আছে কি
সহানুভূতির সিদ্ধাৰ্থ?
কী এক প্রশ্ন
উত্তর আছে কি প্রশ্নের?
নাকি এই প্রশ্নের উত্তরটিও একটি
প্রশ্নই?
এই যে মানুষ রক্তের ওপর দিয়ে নির্বিচারে হেটে যায়
এইযে মানুষ ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে উকি দিয়ে তাকায়
অবান্তর।
আর আমি এই স্বপ্ন দেখি‐-
এই নির্মমতা
এই হৃদয়হীনতার একদিন অন্ত পড়বে
বেড়ায় ঝুলে থাকা বাপুর ছবিটি মুচকি হেসে বলে–
' এই প্রশ্নের
একটিই উত্তর‐-
প্ৰেম'
অজিত গগৈ
প্রেম কাব্য
সমস্ত ভালোবাসাই অসম্পূর্ণ
মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে নিজেকে
সেই জন্যই অতি সহজে অন্যের প্রেমে পড়ে
আর ভালোবাসার দাড়িপাল্লায় ওজন করে দেখতে চায় নিজেকে
এটাই মানুষের ভুল
এই ভুল পথে হাতড়ে কিছু মানুষ নিজেকে বিনাশ করে
অবশ্য দুই একজন সিদ্ধার্থের মতো নিজের থেকে বেরিয়ে গিয়ে পুনঃনির্মাণ হয়
আমি প্রেম-সর্বজ্ঞ নই যদিও
প্রেম কৃষ্ণের নাম লেখা সেই তুলসী পাতার মতো–' বিশ্বাসে মিলায়…'
না হলে হয়তো কৃষ্ণ গহ্বরের মতো
পরিপূর্ণ শূন্য
না হলে হয়তো প্রেম একটি পুরোনো রূপকথার মতো
'আমাদের কাপড় চোপড় কালো হল' বলে যাকে
আরম্ভ করতে পারি নতুন করে
প্রেমাস্পদের বিরহে কিছু মানুষ নিজেকে মারে যদিও বেশিরভাগই মরে না
কারুকে ভোলার জন্য যথেষ্ট দুটো উজাগরী রাত
কিছু হা-হুতাশ, অন্তর্দ্বন্দ্ব
হয়তো চোখের জল, হয়তো সূরার সাহচর্য
হয়তো সিগারেটের ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে উড়িয়ে পাঠানো কিছু অভিমান!
মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে নিজেকে
সেই জন্য নিজেকে ভোলার মাপে নিজের জীবনটা যথেষ্ট নয়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন