রুদ্র কিংশুকের নির্বাচিত গল্প





১. কুবোপাখি ও  অলৌকিক বৃষ্টিপাত


শেষ আশ্বিনের সকাল। নিখিলেশ বাড়ির সদর দরজায় বসে। গায়ে জামা নেই। পরনের কাপড়টার একটা আঁচল দিয়ে গা-টা জড়ানো । সকাল বেলায় একটা লিকলিকে বাতাস বইছে। নিখিলেশের শীত শীত করছে। কার্তিক পড়ব পড়ব। কলাপাতা থেকে অনবরত শিশির ঝরছে ঘাসের নিচু মাথায়। টুপটুপ আওয়াজ। এ সময়টা বেশ একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব থাকে। গরম পোশাক না হোক একটা জামা দরকার। ছোট ! ছেলেমেয়েদের কথা ছেড়ে দিলাম। নিখিলেশের তো বয়স হয়েছে। ষাট ছুঁই ছুঁই। তারপর সদ্য নিমোনিয়ার আক্রমণ। শরীরে রোগের চিহ্ন একেবারে মুছে যায়নি। চোখের নীচে কালি। বড় বড় টানা চোখের গভীরতা হয়তো এখনও আছে। উজ্জ্বলতা একেবারে নেই। একটা বিড়ি পুড়ছে দু' আঙুলের ফাঁকে। নিখিলেশ টানতে ভুলে গেছে। তবু বিড়িটা নিভে যায়নি। বাতাসে আগুনটা থেকে থেকে বুক ভরে দম নিচ্ছে।

একটা লিকলিকে ধোঁয়া ওপরে উঠছে। মাঝে মাঝে হাওয়া এসে সেই ঊর্ধ্বগতি ভেঙে দিচ্ছে। সেই ভেঙে যাওয়াটার মধ্যে কোন ছন্দ নেই। অতর্কিততা আছে। নিখিলেশ সেই অগ্নিমান বিড়ির টুকরোর দিকে তাকিয়ে। তবু এর দহনকে সে দেখছে না। এই ঔদাসীন্যের অনেক ভাঁজ আছে, ভিয়েন আছে। একান্ত নিজস্ব বয়নশিল্প আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বুঝতে শেখে।

সামনেই সামন্তদের দিঘি। জলে টইটুম্বুর। আঙুলের টোকা দিলেই শরীর থেকে গান বেরিয়ে আসবে। ঘাটে মেয়েরা সাত সকালে ঘড়া বালতি মাজামাজি শুরু করে দিয়েছে। আজ সপ্তমী। কাঁঠাল গাছের ছায়া দিঘির জলে স্থির হয়ে আছে। এই আশ্বিনের সকালে সে স্নান চিকন দেহাতি মেয়ে। জলের আয়নায় নিজের বাড়বাড়ন্ত শরীর দেখে নিজেই হাসছে। একটা মাছরাঙা ঝুপ করে জলে পড়ে আবার উড়ে বসল জামগাছের কচি ডালে। তার ঠোটের মধ্যে একটা দাঁড়কে মাছ ছটফট করছে। একটা বক কোচ কোচ শব্দ করতে করতে দিঘির ওপর দিয়ে উড়ে গেল। তার পা জল-ছুঁই-ছুঁই। বকটা বার তিনেক দিঘির পিঠের ওপর চক্কর খেয়ে বসল বাবলাগাছের একটা সরু ডালে। ডালটা সঙ্গে সঙ্গে নুয়ে পড়ল। ডানা ঝাপটিয়ে বকটা একটু ওপরে উঠে গেল।

ঘোষদের বড় বউ এখন খুব ব্যস্ত। তার দাদা তাকে নিতে এসেছে পুজোয়। বুলবুলিতলা। তার বাপের বাড়ি। সমুদ্রগড়ে বাসে চেপে ধাত্রীগ্রাম নামতে হবে। তার পর কালনা-বর্ধমান রুটের বাস ধরে নামতে হবে বুলবুলিতলা বাসস্টপ। অনেক ঝক্কি। সময়ও লাগে। বাচ্চাকাচ্চা সঙ্গে যাবে। আজকাল বাসে যা ভিড়! যত বেলা বাড়বে ভিড়ও বাড়বে তত । তাই শাশুড়ির তাড়ায় এই সাতসকালে গা ধুতে এসেছে। ঘোষবউ ঘড়া মাজছে। তার লম্বা লম্বা আঙুলগুলো পিতলের ঘড়াটার শরীরে তেঁতুল মাখাচ্ছে। ঘড়াটা টক্কর খাচ্ছে ঘাটের বাঁধানো সানে । টুং টুং টুং টুং টুং টুং ... । একটা মিস্টি আওয়াজ। পায়ে ঘুঙুরবাঁধা ছোটো ছেলে আনন্দে নাচছে। মাঝে মাঝে দিঘির জলে শব্দ হচ্ছে ছপাৎ ছপাৎ। ঘোষবউয়ের উচ্ছ্বাস দিঘির জলে গুড়ো গুড়ো হয়ে মিশে যাচ্ছে। সেই উচ্ছ্বাস নৃত্যের মোচড় দিচ্ছে কলমিলতায়, ফলুইমাছের শরীরে। সরপুঁটি, দাঁড়কে আর খলসে মাছগুলির তিড়িক তাড়াক লাফের ভেতর দিয়ে জলের বাজনা বেজে উঠছে। একটা নিজস্ব বাজনা নিয়েই প্রতিটি শরীর
গড়ে ওঠে। যে-দিন এই বাজনা বাজে, মনে পড়ে মাটির কথা, জলের কথা, স্মৃতিময় নাভিমূলের কথা।

দীনুগোয়ালাদের বাঘি গাইটা দড়ি ছিঁড়ে কলাবাগানে ঢুকেছে। পাতা ছেঁড়ার ফ্যাচ ফ্যাচ আওয়াজ। ঠাকুরদের বহলগাছের জঙ্গল থেকে একটা পাখি ডাকছে—পিউ কাঁহা পিউ কাহা। ছেলেবেলায় এই ডাক বুকের মধ্যে একটা পাগলামি ছড়িয়ে দিত। বিড়িটা টানতে টানতে নিখিলেশ ডাকটা শুনছে। নিখিলেশ শেষ সুখটানটা দিয়ে বিড়িটা ছুড়ে ফেলল রাস্তার ধুলোয়। মুখ থুবড়ে পড়া বিড়িটার পোড়া বুক থেকে এখনও একটা রোগাটে ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। নিখিলেশের বুক হঠাৎ ধড়াস করে কেঁপে উঠল !

নিখিলেশ আর বসে থাকতে পারল না। এই একটুকরো বিড়ি ও তার নীরবে পুড়ে যাওয়ার সামনে নিখিলেশ সন্ত্রস্ত। মনে হল অই ধোঁয়ার ভেতর অসংখ্য আয়না লাফিয়ে উঠতে চাইছে। সেই গলিত কাচ ছুরি-র ফলার মত ধারালো ও নির্দয়। নিখিলেশ আক্রান্ত বোধ করল। মনে হল প্রতিটি আয়নাই এক এক জন ঘাতক।

ভানু ঘোষের বড় ছেলে এখন কলাবউকে খড়ি নদীতে চান করিয়ে ফিরছে। সঙ্গে আছে রবি গাঙ্গলি। রবি গাঙ্গলি জীবনে লেখা থাক, একটা পদ্যও পড়েনি। তবু সবাই তাকে রবিঠাকুর বলে। হাড্ডিসার চেহারা । বয়স চল্লিশ-একচল্লিশ হবে। ঠাকুরমশাইয়ের একটু পান দোষ আছে। পুজোর কদিন খুব কষ্ট তার। ধুপছায়া গাঁয়ের বারোয়ারী কালীপুজো, দুগ্গাপুজো সে-ই করে। ঠাকুরমশাইয়ের হাতে মঙ্গলঘট। ভানু ঘোষের ছেলের কচি বাঁশের মতো চেহারা। পিছনে কালিপদ দাসের ঢোলের বাদ্যি। এক দঙ্গল ছেলে পিল পিল্‌ করছে।

এককালে বারোয়ারী পুজো-আজা নিখিলেশই দেখাশোনা করত ৷ তার ঘাড়েই দুলত কলাবউয়ের কচি নরম শরীর। সারা শরীরে একটা বুনোমোষের উদ্দামতা ভর করত। নিখিলেশ তখন কুড়ি কী বাইশ। কালিপদর ঢাকের তালে তালে দুলত নিখিলেশের শরীর। নিখিলেশের শরীর থেকে একটা গাঢ় উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ত শরতের শিশির ভেজা বাতাসে। যেমন করে শিমুলতুলো কুচি কুচি হয়ে বাতাসে মিশে যায়। পুজোর বিশ দিন আগে থেকেই শুরু হত ব্যস্ততা। কিন্তু মোড়লকে সঙ্গে নিয়ে চাঁদা তুলত। সমুদ্রগড়ের হাট থেকে একাই ঘাড়ে করে আনত বাতাবি লেবুর পাহাড়, নারকেল আর আখের বোঝা। কৃষ্ণনগর থেকে আসত গগন পাল। খড়ের বাঁধুনির ওপর মাটির প্রলেপ দিতে দিতে ঠাকুরের রূপ ফুটে উঠত। শেষ রঙের দিন বাড়ি ফিরতে নিখিলেশের অনেকটা রাত হত। বাকি রাত আর তার ঘুম আসত না। ঘুম এলেই নিখিলেশ স্বপ্ন দেখত। আর সে সব ছোটো ছোটো স্বপ্নগুলো হত দুগ্গাঠাকুরের রঙে মাখামাখি। রঙের গন্ধে স্বপ্নগুলো আহ্লাদে আটখানা হয়ে যেত।

পাখিদের মতো দিনগুলোরও ডানা আছে। নিখিলেশের বড়োছেলে, ছোটোছেলে চাকরি পেয়ে কলকাতায়। ওখানেই পাকাপাকি থাকে ওরা । অবশ্য মাসে মাসে নিখিলেশের নামে মানিওর্ডার পাঠায়। নিখিলেশ মেজোছেলের কাছেই থাকে। তাছাড়া মেজোছেলের বউ তাকে যত্ন আত্তি করে। মেজোবউয়ের বাপের বাড়ি বাহিরি। দুপুরবেলা তাকে ডেকে বলে—বাবা তুমি এখন স্নান কর। কথাটা প্রতিবারই নিখিলেশের কাছে নতুন লাগে। যেমন প্রতিবছর বর্ষার প্রথম বৃষ্টিপাত। বাউল গান আর মেজোবউয়ের ভালোবাসা বীরভূমের লালমাটির প্রতি নিখিলেশের ভালোবাসাকে আরেকটু গাঢ়ত্ব দিয়েছে।

বিশ্বাসদের মেজোছেলে ধোপপুরস্ত কাপড়জামা পরে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। পেছনে নতুন বউ। খোঁড় আসা ধানের জমির মতো শরীর। • বাঁহাতের ওপর ডানহাত বোলাতে বোলাতে নিখিলেশ নিজের শরীরটা একবার দেখে। চামড়া ঢিলে হয়ে গেছে। ছিলা বাঁধা ধনুকের টানটান ভাবটা কোথায় যে হারিয়ে গেল! নিখিলেশ হাঁটুর ওপর হাত রেখে
কালিপদর ঢাকের তালে তালে দুলত নিখিলেশের শরীর। নিখিলেশের শরীর থেকে একটা গাঢ় উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ত শরতের শিশির ভেজা বাতাসে। যেমন করে শিমুলতুলো কুচি কুচি হয়ে বাতাসে মিশে যায়। পুজোর বিশ দিন আগে থেকেই শুরু হত ব্যস্ততা। কিন্তু মোড়লকে সঙ্গে নিয়ে চাঁদা তুলত। সমুদ্রগড়ের হাট থেকে একাই ঘাড়ে করে আনত বাতাবি লেবুর পাহাড়, নারকেল আর আখের বোঝা। কৃষ্ণনগর থেকে আসত গগন পাল। খড়ের বাঁধুনির ওপর মাটির প্রলেপ দিতে দিতে ঠাকুরের রূপ ফুটে উঠত। শেষ রঙের দিন বাড়ি ফিরতে নিখিলেশের অনেকটা রাত হত। বাকি রাত আর তার ঘুম আসত না। ঘুম এলেই নিখিলেশ স্বপ্ন দেখত। আর সে সব ছোটো ছোটো স্বপ্নগুলো হত দুগ্গাঠাকুরের রঙে মাখামাখি। রঙের গন্ধে স্বপ্নগুলো আহ্লাদে আটখানা হয়ে যেত।

বিশ্বাসদের মেজোছেলে ধোপপুরস্ত কাপড়জামা পরে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। পেছনে নতুন বউ। খোঁড় আসা ধানের জমির মতো শরীর। • বাঁহাতের ওপর ডানহাত বোলাতে বোলাতে নিখিলেশ নিজের শরীরটা একবার দেখে। চামড়া ঢিলে হয়ে গেছে। ছিলা বাঁধা ধনুকের টানটান ভাবটা কোথায় যে হারিয়ে গেল! নিখিলেশ হাঁটুর ওপর হাত রেখেউঠে দাঁড়াল। তার পর বিড়বিড় করতে করতে বাড়িতে ঢুকে গেল। পুজোর সময়েও বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। নাতিটার টিকিটি দেখার জো নেই। পুজোর ক'দিন সে খুব ব্যস্ত। সারাদিন পড়ে থাকে পুজো মণ্ডপে। আগে বাড়িতে লোক গমগম করতো। পুজোর সময় সে শ্বশুরবাড়ি যেত না। তার দিদিরা শ্বশুরবাড়ি থেকে আসত। সঙ্গে ছেলেমেয়েরা। আর আসত পিসিমারা। সকাল সকাল গোরা জেলে এসে মাছ ধরে গাদা মারত উঠোনে। তিন তিনটে পুকুর। অঢেল মাছ। জমিজমাও কম ছিল না। পুকুরের মাছ বেচার প্রয়োজন কোনোদিনই হয়নি। এখন দিন বদলে গেছে। নিখিলেশরা তিনভাই । পুকুর ভাগাভাগি হয়ে গেছে। জোত জমিও চলে গেছে। তবুও গাঁয়ে তাদের নামডাক আছে। নাম হলে সহজে যায় না। ঘটি না ডুবলেও তালপুকুর। নিখিলেশের মন কেমন কেমন করে। মনে হয় এই তো সে-দিনকার গল্প। এর মধ্যেই কীভাবে কতগুলো বছর চলে গেছে। একটা বিরাট বড় বায়োস্কোপের জানালাগুলো খুলে গেছে নিখিলেশের বুকের ভেতর। আর চড়াই শালিক, বুলবুল আর লটোরাপাখিরা সেই বায়োস্কোপের ভেতর অলৌকিক এক উড়ানের আলো গন্ধ হয়ে ফুটে উঠছে।

নিখিলেশ বারান্দায় এক কোণে বসে আছে। মেজবউ কুরুনিতে নারকোল কুঁরছে। যেমন করে নিখিলেশের মা এককালে কুঁরতো। নিখিলেশ এখনও নারকোল শুভ্রতায় তার চুড়ির গান মিশে যেতে দেখতে পায় ৷ মেজোবউয়ের হাত নারকোলের দুধে জবজবে। নিখিলেশ মাটিতেই বসে আছে। পাশে নামানো হুকো তামাক, টিকে, একখণ্ড শোলা আর চকমকি। যদিও এখন দেশলাই সস্তা, তবু নিখিলেশ চকমকিই ব্যবহার করে। এ তার বাপ ঠাকুরদার আমলের চকমকি। তিনপুরুষ বয়েস। তবু এখনও বুক ভর্তি আগুন। বারান্দায় বসে বসে উঠোনের এককোণের জামগাছটাকে দেখা যায়। একটা পুরনো গল্পের মতো লাগে। অনেক কাল আগে এই গাছে একটি কুবোপাখি রোজ সকালে আসত। একদিনও কামাই দিত না। মাকে অনেক জিজ্ঞেস করেও জানতে পারেনি পাখিটার নাম। হঠাৎ পাখিটা একদিন কোথায় হারিয়ে গেল। গাছটাকে দেখে নিখিলেশের বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ।একটা ভয়ের বেলুন হঠাৎ তার বুকে ফুলতে শুরু করল। নিখিলেশ ধড়ফড় করে উঠে পড়ল। তারপর হঠাৎ মেজো বউয়ের নারকেল দুধে ভিজিয়ে হাত দুটো চাটতে লাগলো। মেজ বউয়ের হাত থেকে ধপ করে নারকোলের মালাটা পড়ে গেল।

বৃষ্টি হচ্ছে। অনন্ত কাল বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ভেতরে সপসপে ভিজে যাচ্ছে কাক, শালিক। একটা লটোরা পাখি বসে আছে সেয়াকুল গাছটার নোয়ানো ডালে। নৌকো ভেসে যাচ্ছে খড়ি নদীর ভেতরে।  সবুজ ধানের ওপরে সাদা পালের আলো এসে পড়েছে।  কদিন পরেই তো ডাকসংক্রান্তি। সবুজ মাঠ সংগীতমহল হয়ে উঠবে। শাঁখের গানে ধান গাছরা খুলে দেবে তাদের গর্ভসিন্দুক।

নিখিলেশের জ্বরটা কমেছে আজ। বিকেলে সে জামগাছটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। জামগাছটা তার বুকের মধ্যে সেঁদিয়ে যাচ্ছে। নদী, মেঘ, সব গল্প--- তাদের বীজ  পুঁতে দিচ্ছে নিখিলেশের শরীরে। মেজো বউ ডাকলো---
বাবা তুমি এখন স্নান করো । নিখিলের ঘার নাড়তে নাড়তে কেঁদে উঠল। তারপর দাঁত দিয়ে কামড়াতে লাগলো জামগাছের শরীর। জামগাছের আলোড়িত শরীর থেকে হঠাৎ অসংখ্য কুবো পাখি বেরিয়ে উড়ে গেল আকাশের দিকে। জামগাছের মাথার আকাশ ভরে উঠলো উড়ন্ত পাখিদের সন্তরণ দৃশ্যে। আকাশ আজ  অনন্ত তাঁবু। তার নীলের বিভার ভেতর পাখিরা এঁকে দিচ্ছে নাচের মুদ্রাগুলি । বিশ্ব চরাচর উথলে উঠছে ক্রমাগত এক সংগীত --- কুব ---কুব--- কুব।








২. জাদুঅলার নীলকন্ঠ ও নিশাপতি ব্যাধ


বীরভূমের দুটি গ্রাম। চারকলগ্রাম, বনগ্রাম। দুই গ্রামের মধ্যবর্তী সুবিস্তীর্ণ মাঠ। আর এই মাঠের প্রায় মধ্যিখানে বনজঙ্গলে ঘেরা দিনার শাহী পীরের থান। লোকের বিশ্বাস পীর খুব জাগ্রত। তাই চারপাশের গ্রামগুলোর মানুষ তাঁর থানে মানত দেয়, পূজা করে। পীরের মহিমায় অনুর্বর জমি হয় শস্যশ্যামল, বন্ধ্যা নারী সন্তানবতী। এলাকার  মানুষেরা তাই জমির প্রথম ফসল, গাছের প্রথম ফল, গরুর প্রথম দুধ পৌঁছে দেয় পীর বাবার থানে। অনেক মানুষ রাতের গভীর অন্ধকারে হাওয়ার বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দেখেছে কেউ একজন ছুটে যাচ্ছে। ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজে আকাশ বাতাস মুখরিত। মানুষের বিশ্বাস তিনি আছেন।


ছোটবেলা থেকেই নিশাপপতি শিকারী। মাঠঘাটের কাজ তার ভালো লাগে না।  বনজঙ্গলে সে ঘুরে বেড়ায়।  কাঁধের ব্যাগে তার পাখি শিকারের যাবতীয় সরঞ্জাম। পাখি দেখলেই তার হাত নিসফিস করে। চোখ জ্বলে ওঠে পাউস বেড়ালের মতো। পাউস বেড়ালও  তার নিশানা থেকে রেহাই পায়না।


পাখি মেরে মেরে  নিশাপতি  এই এলাকা ফাঁকা করে ফেলেছে। পাখি বলতে একটা দুটো নীলকন্ঠ বসন্তবৌড়ি আর কাঞ্চনপাখি। আর গ্রীষ্মকালে দিনার শাহী পীরের মাঠে ঝাঁকে ঝাঁকে মাঠচড়াই আর লালাগুরগুরি। উড়ন্ত পাখিদের বিস্তীর্ণ ছায়া গ্রীষ্মের তপ্ত আকাশে পীরের গানের মতোই শীতল, ভরসাদায়ক। কিন্তু নিশাপতির কাছে এসব অর্থহীন। তার কাছে পাখি মানে নরম মাংস। জিভে তার  জল চলকে ওঠে। কিন্তু আজকাল এই এলাকায় শিকার করার মত পাখি কই? নিশাপতি ব্যাধ মনে মনে মুষরে পড়ে, মনমরা তার দিনগুলো।

হঠাৎ একদিন গ্রামে এল এক জাদুঅলা। মাদারি খেলের ওস্তাদ। ধরমঠাকুরের মন্দিরে সামনে সে পেতেছে খেলার সরঞ্জাম। গোটা গ্রামের ছেলেবুড়ো, মেয়েরা ভেঙে পড়েছে ধর্মতলায় মাদারির খেল দেখতে। প্রথমেই ভালুকনাচ। তারপর তাসের খেলা। এরপর কাগজ থেকে ফুলের মালা তৈরির খেলা। এই পর্ব শেষ হলে জাদুঅলা এক মুঠো মাটি থেকে বানিয়ে ফেলল একটা আশ্চর্য নীলকন্ঠ পাখি। তাই দেখে উপস্থিত জনতা বিষ্ময়ে হতবাক। করতালিতে ধরমঠাকুরের মন্দিরচত্বর উদ্বেলিত। জাদুকর এবার তার হাতের করতলের উপর নীলকন্ঠ পাখিটিকে রেখে বলল-- যাও পাখি । আকস্মাৎ  আকাশের দিকে উড়ে গেল আস্ত একটা নীল সাদা অপরাজিতা।

মাদারির খেলা শেষ এবার সকলে বাড়ি গেল নিশ্চয়ই কিছুটা চাল পয়সা নিয়ে আবার ফিরে আসবে। জাদুঅলার পারিশ্রমিক তো গ্রামের মানুষ এভাবেই দেয়।


নিশাপতি খুব মনোযোগ দিয়ে মাদারির খেল দেখছিল।  সে এবার ধীরে ধীরে জাদুঅলার কাছে এগিয়ে এল।  তারপর সে বলল-- জাদুকর , মাটি দিয়ে তুমি কী করে ওই নীলকন্ঠ পাখি তৈরি করলে? এটা কি সম্ভব,  না, তোমার হাতের ভেলকি শুধুই? জাদুঅলা নিশাপতিকে তীক্ষ্ণ নজরে মেপে নিল। তারপর সে বলল -- তুমি কে?
মিশাপতি বলল--- আজ্ঞে, আমি নিশাপতি ব্যাধ। পাখি মেরে বেড়াই মন বনবাদাড়ে।
জাদুঅলা হেসে বলল ---সম্ভব । তুমিও পারবে। মাটি থেকে নীলকন্ঠ বানাতে। মাটি থেকেই তো সব। সোনার ফসল আর সোনার পাখি ।সব ঐ মাটিতেই। শূন্য আসমানের নিচে দাঁড়িয়ে একদিন চেষ্টা করে দেখো।


চৈত্রের শেষ।  প্রখর তাপে দিনার শাহী পীরের মাঠ খাঁ খাঁ করছে। নিশাপতি ব্যাধ একটা বাবলা গাছের তলায় বসে আছে সেই সকাল থেকে। জাদুঅলা বলেছে মাটি থেকে নীলকন্ঠ পাখিরা বের হবে ঠিক। মাটির গভীরে নাকি তাদের বাস। নিশাপতি নিশ্চল। হঠাৎ মাটির ফাটল থেকে যাদুমন্ত্র বলে বেরিয়ে এলো নীলকন্ঠপাখি। একটা --দুটো -- তিনটে---অসংখ্য । বিরাট আকাশ ঢেকে গেল নীল অপরাজিতায়। আকাশের বুকে আশ্চর্য নকশা। তার ছায়া পড়েছে মাটির উপর।  নির্বাক নিশাপতির হাত থেকে খসে পড়লো বিহঙ্গ  শিকারের যাবতীয় সরঞ্জাম।


নিশাপতি ব্যাধ মূর্ছা যাবার আগে কেবল বললো: তোমাকে পেন্নাম।






৩. ঘুড়ি


ফুরফুরে বাতাসে ভগবতীতলার মাঠ বাঁশির মতো বাজে। খড়িনান থেকে মেদগাছির যাওয়ার নতুন রাস্তায় অরূপরতন দাঁড়িয়েছে।  আরও কিছুটা দক্ষিণে হাঁটলেই মানিকহারের ধর্মঠাকুরের মেলার মাঠ।  অরুপরতনের ইচ্ছে হচ্ছে হেঁটে হেঁটে একবার মেলার মাঠ ঘুরে আসবে। কতকগুলো ছেলে মাঠে ঘুড়ি উড়াচ্ছে। ভগবতীতলার মাঠের ওপরের আকাশে পাখি উড়ছে। কোথাও একটা বুনো ফুল ফুটেছে। বাতাসে তার  মৃদু গন্ধ ভেসে আসে। কিন্তু কিছুতেই ফুলটার নাম মনে আসছে না অরূপরতনের।



মেদগাছি গ্রামে ঢুকবার মুখেই বাড়িটা তার চোখে পড়ল। বাড়ির রঙটা বদলে গেছে। এখন রঙটা লাল। কিন্তু তখন রঙ কেমন ছিল? অরূপরতন মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই মনে আসছে না। এই বাড়িতে চাঁদনিহারা থাকতো। ওর বাবা, ওর মা আর দাদা রহমান।  রহমান আর অরূপরতন মাধ্যমিক পাশ করে স্কুলে  বিজ্ঞান বিভাগে একাদশ।  চাঁদনিহারা ক্লাস নাইন।  ওদের বাবা নিয়াজুল স্যার স্কুলের গণিত শিক্ষক। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে অরূপরতন কলকাতায়। রহমান চেন্নাই। বছর দুয়েক পর বদলি হয়ে নিয়াজুল স্যার নিজের গ্রাম নতুন হাটে। মাঝে একবার দুবার দেখা হয়েছিল চাঁদনিহারার সঙ্গে।

আজ কুড়ি বছর পর আবার অরূপরতন মানিকহারের ধর্মরাজ ঠাকুরের মেলার মাঠে। একটা বুনো ফুল ফুটেছে। বাতাসে ভাসে তার মৃদু গন্ধ। কিন্তু কিছুতেই তার নাম মনে করতে পারছে না অরূপরতন।



বুনো ফুলের গন্ধ। আয়না। অরূপরতন আয়নার ভেতর নিজেকে দেখে। কোন দূরবর্তী দ্বীপে একটা বাড়ি। মেঘ ও ছায়ার বাড়ি। অতর্কিত আতাবনের উচ্ছ্বাস। তীব্র আয়নার ভেতর অরূপরতন ধীরে ধীরে ঢুকে যায়। ঊর্ণনাভের বিরাট জালের  ভেতরে শিশিরবিন্দু। সে এক অপূর্ব দর্পণ। তার ভেতরে কি দূরদেশে উড়ে যাওয়া একটি টিয়ার ছবি আছে? গভীর অন্ধকারে ভয় পেয়ে আজও কি সে আম্মা বলে ডাকে? আম্মা কথাটার ভেতর অরূপরতন একটা ভিজে নদীর গন্ধ পায়।



টিয়ার গন্ধ ভেসে আসে।   এক বুনো ফুলের  গন্ধ ভেসে আসে বাতাসে। কিন্তু তার নাম কিছুতেই মনে আসছে না অরূপরতনের। স্রোতগন্ধী স্মৃতির ঊর্মিমালা। বাতাসের খেলনা সেই মাঘের  গমক্ষেত।মাঝে মাঝে কোথাও দু-একটি যবশীষ। বাগদেবীর লেখনী। স্কুলের সরস্বতী পূজা। দেয়াল পত্রিকায় অরূবরতনের প্রথম কবিতা:

বাকদেবীর মুখের হাসি, চাঁদের আলো /
তাহার পাশে কাহার ছায়া কি জমকালো/
  কে চমকালো?



আরো কয়েকটা পংক্তি ছিল । আজ আর কিছুতেই অরূপরতনের মনে পড়ছে না। অরূপরতন খুব মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না। আর কিছু কি আদৌ ছিল? আরূপরতন ভাবে। পড়াশোনার চাপ, ক্যারিয়ার তৈরীর নিরন্তর একটা ঝোঁকে অরূপরতন ভুলে গিয়েছিল যে সে একদিন একটা কবিতা লিখেছিল। সরকারি অফিসের বড়ো অফিসার না হয়ে সে যদি কবি হতো! যদি এই গ্রামের একটা মাটির বাড়িতে তার জীবনটা কেটে যেত!  তাহলে কি খুব ক্ষতি হতো? ভাবার চেষ্টা করে  অরূপরতন।আর তার মাথার ভেতর বহুকাল আগে লেখা তারই প্রথম এবং একমাত্র কবিতার কয়েকটি লাইন ঘুরপাক খেতে থাকে। পৃথিবীর কোথাও তারা লিখিত নেই। কিন্তু আজ তারা অবাধ্য, দূরপনেয়। সে বৃত্তশালী, ক্ষমতাশালী। তবু পৃথিবীর কোথাও কি একটু স্থান নেই তার এই স্বরচিত আড়াই পংক্তিকে রাখার? অরূপরতনের মনে হলো সে যেন অনাথ। তার যেন কিছু নেই এই পৃথিবীতে। অরূপরতনের ভেতরে কোথাও একটা গভীর হূতাসন কুণ্ডলিত ধোঁয়া।  এক গভীর বেদনা ইথার তরঙ্গে মিশে যেতে লাগলো। কোথাও কি স্থান নেই তার অনাথ পংক্তিগুলির? সত্যিই কি নেই? একটা বুনো ফুলের গন্ধ ভেসে আসে বাতাসে। কিছুতেই তার নাম মনে আসছে না।



ভগবতীতলার মাঠের আকাশ ঘুড়িময়। নীলিমার গায়ে কাগজের ঘুড়িগুলো স্থির। কোন অসীম শূন্যতা-ডিমের উপর তারা যেন তা দিচ্ছে । লাটাই হাতে ছেলেদের পাগুলো শ্যাওলা রঙিন মাঠের ওপর। তাদের মন  উধাও ওই পাখিদের দেশে। হঠাৎ একটা ঘুড়ি ভোকাট্টা। ছুট----- ছুট---- ছুট। অরূবরতন লাটাই ছিন্ন ঘুড়িটাকে একবার দেখে। আর একবার বালকটির মুখের ওপর তার দৃষ্টি পড়ে।


অরূপরতন তার ছেলেবেলার পড়ার ঘরে বসেছে। চাঁদের আলোর বিষাদে আজ ভরে গেছে চরাচর। সে এক টুকরো কাগজের ওপর লেখে:

ভোকাট্টা ঘুড়ি ফিরে আয়/
  বিরহী লাটাই হাতে আমি বহু কাল/
 
অরূপরতন বারবার শব্দকটি পড়ে। পড়েই চলে সে। তারপর কুটি কুটি করে ছিঁড়ে তাদের উড়িয়ে দেয় বাতাসে।
--- যা যা তোরা, ওই  ইথার তরঙ্গে। পৃথিবীতে কোথাও মন বলে যদি কিছু থাকে, সেখানে তোরা ভেসে উঠবি একদিন। অরূপরতন জানালা দিয়ে ঘরের বাইরে তাকায়। বাড়ির পিছন দিয়ে একটু দূরে বাঁকানদী। তার জলে চাঁদের আলোয় এক মায়াবী বিভ্রম। অমলতাসের বন ভেদ করে জাজ্জ্বল্যমান এক শিয়াল ছুটে চলেছে মহাকালের দিকে।





৪. মীনমঙ্গল

নদী দেখিয়া প্রাণমন উইড়্যা যায় এমন সোনার নাইয়া জলে ভাইস্যা যায়...
বাড়ির উঠানে সবেদাগাছে হেলান দিয়ে বসে কামাখ্যা আপন মনে গায়ছে। কামাখ্যা বলেই সবাই তাকে ডাকে।তার ভালো নাম কামাক্ষীপ্রসাদ।
সমুদ্রগড়ের কাছেই একটা গ্রাম। রামেশ্বরপুর। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে খড়ি নদী। অন্য পাশে রয়েছে ছোট্ট আর একটা নদী। গুরজোয়ানি। নান্দাই গাবতলার কাছে গুরজোয়ানি খড়ির দেহে মিলেছে। তারপর দু'জনে হাত ধরাধরি করে ঝাঁপ দিয়েছে বিপুল গঙ্গাপ্রবাহে। খড়ি নদীর পারেই কামাক্ষীপ্রসাদের বাঁশকাবাড়ির ঘর। নদীর জলো হাওয়া সব সময় ঘরে ঢুকছে।


কামাখ্যা মস্ত বড়ো মেছুয়া। রাতদিন মাছ ধরাই তার কাজ, তার নেশা। সামান্য একটু জমি হয়তো তার আছে। সেটা কোন রকমে সে চাষ করে আর বাকি সময় সে মাছ ধরে বেড়ায় খালবিল, নদীতে। কখনো জালে, কখনো ছিপে, কখনো বর্শা নিয়ে। মাছকে কেন্দ্র করে তার জীবন ঘুরপাক খায়। সে সারারাত মাছের স্বপ্ন দেখে। গ্রামের লোক বলে কামাখ্যার গায়ে অদ্ভূত একটা গন্ধ আছে যেটা মাছেদের খুব পছন্দের।  কামাখ্যা জলের ধারে দাঁড়ালে নাকি মাছেদের শরীর ও মনে একটা অস্থির ভাব দেখা যায়। তারা নাকি কামাখ্যাকে ধরা দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। অনেকে বলে কামাখ্যার শরীরে একটা ব্রহ্মদত্যি বাস করে যার ইচ্ছেতেই এসব হয়। এইজন্য তার কাছ থেকে গ্রামের লোকেরা অনেকেই দূরে থাকে।


অদ্ভূত চেহারা তার। কালো কুচকুচে শরীর। বিরাটাকার। মাথার ঝাঁকরা চুল যত্নহীন। চোখগুলো বড়ো বড়ো। লাল।  সদ্য রঙধরা করমচা। মাঝে মাঝে সে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। দশ দিন, বারো দিন পর সে বাড়ি ফেরে। তার অনুপস্থিতি বাড়ির লোক এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের অভ্যাস হয়ে গেছে। সে ঘুরে বেড়ায় নানান শক্তিতীর্থে। কখনো অম্বিকা কালনা, কখনো তারাপীঠ। কখনো চন্নাগ্রাম তো কখনো তমলুকের বর্গভীমা মন্দির। তাড়িত  জীবন তার। স্থির থাকা তার ধাতে নেই। অথচ মানুষজনের সঙ্গে তার বাক্য বিনিময়ে সে বড়ই সঞ্চয়ী। নীরবতাই তার ভাষা।


আজ সন্ধ্যেবেলা থেকেই প্রবল বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। বৃষ্টির এই গানে সব মানুষের ঘুম ঘুম পায়। কিন্তু এই বৃষ্টি গান কামাখ্যাকে পাগল করে তোলে। তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় ঘরের বাইরে। কামাখ্যা তার ছাতার ভাঙা শিক দিয়ে বানানো বর্শা নিয়ে এখন বেরুচ্ছে। তার বউ বলল---
আজ আর বেরুতে হবে না । আমার শরীরটা ভালো নেই।

কামাখ্যার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। কিন্তু কামাখ্যা কোন কথা কানে নিল না। আমি এখনই আসছি, বলেই সে চকিতে বেরিয়ে গেল। গ্রামের মোড়লদের পুকুরটায় প্রচুর শোল-মাগুর মাছ হয়েছে ।বর্ষার এই প্রথম বৃষ্টিপাতে মাছেদের শরীরে নাচ জেগে উঠবে। রাস্তার জল যেখান দিয়ে পুকুরে নামছে সেখানকার জলরেখা ধরে এই মাছেরা উঠে আসবে ডাঙ্গায়। যদি উঠে না-ও আসে, তারা তীর-সংলগ্ন দলদামে ঘোরাঘুরি করবে। বর্শার আঘাতে এইসব মাছেদের গেঁথে তোলা কি এমন  কিছু কঠিন কাজ?


কামাখ্যা তালপাতার টোকা মাথায় বর্শা হাতে পুকুরটার পাড়ে উপস্থিত। পুকুর পাড়ের তালগাছগুলো ভিজছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎচমকের আলোয় গাছগুলোর মাথা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জল নামছে যে জায়গাটায় সেখানেই কী একটা  লাফালো। কামাখ্যা কালবিলম্ব না করে বর্শাটা ঝপ করে মারলো আর তা তোলা মাত্র সে অন্ধকারেও বুঝতে পারল কেজিখানেক একটা মাছ। বিদ্যুৎ চমকালে বুঝল একটা শোল মাছ। মাছটাকে বর্শা মুক্ত করে কামাখ্যা সেটাকে রাখল হাতে ধরা একটা ঝোলায়। তারপর সে পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। বাড়িতে এসে হ্যারিকেনের আলোর কাছে সে মাছটা ছুড়ে দিল।

কামাখ্যার বউ দেখল মাছটার পেটের নিচ দিয়ে তখনও রক্ত বার হচ্ছে। মাছটাকে হাতে নিয়ে সে দেখল মাছটার পেট ভর্তি ডিম। আর কিছুদিন পরেই হয়ত মাছটা ডিম ছাড়তো। কামাখ্যার বউয়ের শরীরটার ভেতরে একটা ঝাঁকুনি। পেটের ভেতরে তার একটা প্রাণ লাফাচ্ছে। চোখ বুজে সে দেখতে পেল অসংখ্য মৎস্যসন্তান জলের ভেতর খেলছে।

কামাখ্যার বউ বলল ---
তোমার কাছে একটা অনুরোধ। রাখবে?
  কামাক্ষা বলল---
   কী?
বউ বললো ---
মাছটার পেট ভর্তি ডিম। তুমি ওকে জলে ছেড়ে দিয়ে এসো। ও বেঁচে যাবে।
কামাখ্যা বললো ---
কী আবোল তাবোল বলছো? এত কষ্ট করে মাছ ধরলাম। আগেও তো এমন ডিমওয়ালা মাছ কত ধরেছি।
  কামাখ্যার বউয়ের চোখ জলে চিক চিক  করছে। সে বলল---
  আগে এ মন আমার ছিল না।

কামাখ্যা মাছটার মাথাটা ধরে আবার বাড়ির বাইরে গেল। বর্ষার জলে খড়িনদী এখন টইটম্বুর।  সেই প্রবহমান জলে সে মাছটাকে ছেড়ে দিয়ে বলল---
  তুমি কিন্তু আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি কি আর এত কিছু বুঝি!
 
হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকিত আকাশ আলোর বারিধি হয়ে উঠল। বিশ্বচরাচর অপার্থিব হাসির উচ্ছ্বাসে দেদীপ্যমান। নয়নচিহ্ন আঁকা ত্রিশুলের ভেতর স্বর্গমর্ত্য গাঁথা। কামাক্ষীপ্রসাদ নির্বাক।


একটা প্যাঁচা বর্ষারাতের জলভরা মেঘের ভেতর ভাসিয়ে দিল তার অনন্তকালের গান।




 




রুদ্র কিংশুক 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন