গ্রন্থালোচনা






এর্নাক্সের ‘সিম্পল প্যাশন’: একটি সর্বজনীন বিলাসিতা



গ্রন্থঃ সিম্পল প্যাশন, গ্রন্থকারঃ অ্যানি এর্নাক্স, প্রকাশকালঃ ১৯৯১, অনুবাদঃ ফরাসি থেকে ইংরেজি, অনুবাদকঃ তানিয়া লেস্লি, প্রকাশকালঃ ২০০৩, আইএসবিএনঃ ৯৭৮১৯১৩০৯৭৫৫৪, প্রকাশকঃ ফিট্জকারালডো এডিসন, লন্ডন, যুক্তরাজ্য। মূল্যঃ ১৩.৭৪ ইউএস ডলার। 
পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের অবসরপ্রাপ্ত ইমেরিটাস অধ্যাপক ল্যান্স ডোনাল্ডসন-ইভান্স-এর বিবেচনায় ২০২২ সালের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী অ্যানি এর্নাক্সের উপন্যাস ‘সিম্পল প্যাশন’ সম্প্রতি নির্বাচিত হয়েছে সেরা শত ফরাসি গ্রন্থের একটি হিসেবে। ল্যান্স ডোনাল্ডসন-ইভান্স তেতাল্লিশ বছরের শিক্ষকতা শেষে অবসরে যান ২০১১ সালে। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর 'ওয়ান হান্ড্রেড গ্রেট ফ্রেঞ্চ বুকস' গ্রন্থটি, যেখানে ঠাঁই করে নিয়েছে ‘সিম্পল প্যাশন’।
একটি নির্মল রচনা শৈলী প্রয়োগ করে অ্যানি এর্নাক্স তাঁর ‘সিম্পল প্যাশন’ গ্রন্থে সর্বগ্রাসী আবেগে আটকে থাকা সম্ভ্রমহারা একটি মানব হৃদয়ের আকাংখাকে নিখাদ আন্তরিকতার সাথে নথিভুক্ত করেছেন। কাহিনি শুরু করেছেন একজন নারী কথক। দুই ছেলে সন্তানের জননী ডিভোর্সি এই কথক নিজের নাম পরিচয় গোপন রেখেছেন। বাস্তবতা এবং কল্পকাহিনির সীমানারেখাকে ঝাপসা করে দিয়ে তিনি নির্মাণ করেছেন একজন বিবাহিত পুরুষের সাথে তাঁর ৫২৯ দিনের (২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৮৮-০৯ এপ্রিল ১৯৯০) মানসিক এবং শারীরিক সম্পর্কের একটি সহজাত উপাখ্যান। পুরুষটি হচ্ছেন প্যারিসে কর্মরত একজন পূর্ব ইউরোপীয় ব্যবসায়ী। কথক তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মিঃ ‘এ’ হিসেবে। অত্যন্ত সাহসিকতা এবং যথার্থতার সাথে একটি স্বল্পকালিন যাপিত জীবনের পিছনে সত্যের অনুসন্ধান করেছেন কাহিনির এই অনামিকা কথক। তিনি জানেন, একজন ঔপন্যাসিকের কাজ সত্য বলা। সমকালে নিজেকে ডুবিয়ে রাখা এবং ডুব দিয়ে উঠে এসে কালের তলদেশের গল্প বলাই একজন ঔপন্যাসিকের কাজ। কথকের ভাষায়, ‘এই গ্রন্থে আমি আমার আবেগের পেছনে কোনো কৈফিয়ত দাঁড় করাতে চাই না। অত্যন্ত সরলভাবে আমার আবেগের অবয়বকে আমি পাঠকের কাছে পোঁছে দিতে চাই।‘‘সিম্পল প্যাশন’এর পাঠকরা উপলব্ধি করতে পারেন, কীভাবে একটি আবেগপ্রবণ প্রেম এমন এক ঘূর্ণি সৃষ্টি করে যার চারপাশে জীবনের অন্যান্য ঘটমান বিষয়গুলো নিস্তরঙ্গ জলের মতো চুপচাপ থাকে, মনোযোগ পায় না। লেখক তার প্রেমিকের সাথে সম্পর্কিত নয় এমন সব নির্ঘণ্টে ভীষণ উদাসীন হয়ে থাকতেন। জীবনের সমস্ত কোলাহল আনন্দ বেদনার নিয়ন্ত্রণভার ছিলো একটি মাত্র ফোন কলের ওপর। অনামিকা কথকের বর্ণনা পড়ে মনে হয়, গ্রন্থটি যেনো একজন মাদকাসক্ত নারীর বিষণ্ণ দিনলিপি। মেট্রোতে তিনি ভিক্ষুকদের টাকা দিতেন। তাদের কাপে কয়েন ফেলতে গিয়ে মনে মনে উইস করতেন, তিনি আজ রাতে ‘এ’র কাছ থেকে একটি ফোন কল পাবেন। কথক লিখেছেন, "আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে তিনি একটি নির্দিষ্ট তারিখের আগে ‘এ’ আমাকে দেখতে আসলে ইউনিসেফকে আমি ২০০ ফ্রাঙ্ক পাঠাব।" আবার যখন তিনি তাঁকে নিজের চার দেয়ালের মধ্যে পেয়ে যেতেন কোনো এক প্রতিশ্রুত বিকেলে, তারপর থেকেই শুরু হতো ক্ষণ গণনা; কখন মিঃ ‘এ’ একটি বিকেলকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে আরেকটি বিকেলে ফিরে আসার অঙ্গীকার করে বিদায় নেবেন। তখন তাঁর প্রতিটি ঘণ্টা কাটতো দীর্ঘ রজনীর মতো, মুহূর্ত যেতো সপ্তাহের যাতনা দিয়ে। তাদের তিন থেকে চার ঘণ্টার নির্দিষ্ট বিকেলগুলো যাপিত হতো নির্বাচিত ওয়াইন, সিলেক্টিভ ফুড আর চর্চিত যৌনতার নীরব মঞ্চে। অন্তরঙ্গ মুহূর্তে তিনি একটুখানি আবেগ কাটিয়ে উঠে বোঝার চেষ্টা করতেন, মিঃ ‘এ’ও তাঁকে নিয়ে একই ভাবনা ভাবেন কিনা। কিন্তু বোঝার উপায় ছিলো না। ভাষাগত ভিন্নতার কারণে, যৌন তৃপ্তির পূর্ণতাও ছিলো অত্যন্ত যাতনাদায়ক। গ্রন্থে উল্লেখ করা হয় নি যে তিনি রাশিয়ান। তবে, ২০০১ সালে প্রকাশিত মূল ফরাসি গ্রন্থ, এবং ২০২২ সালে প্রকাশিত অ্যানি এর্নাক্সের ‘গেটিং লস্ট’ শীর্ষক আত্মজীবনীমূলক ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থ পাঠ করে জানা যায়, ৩৫ বছর বয়সী একজন সোভিয়েত কূটনীতিকের সাথে এক ধরণের অপরিকল্পিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন ১১৯তম নোবেল লরিয়েট (সাহিত্য) এর্নাক্স নিজের ৪৮ বছর বয়সে। দেড় বছরের অসাধারণ এক আবেশী সম্পর্কের খতিয়ান নিয়ে গড়ে ওঠে সোভিয়েত সংস্কৃতির সমজদার এর্নাক্সের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘গেটিং লস্ট’। তদানীন্তন পুরস্কার বিজয়ী ফরাসি লেখক অ্যানি এর্নাক্স সোভিয়েত রাশিয়া সফর করেন ১৯৮৮ সালে। সফরের শেষ দিন লেনিনগ্রাদে তিনি জড়িয়ে পড়েন ফ্রান্সে সোভিয়েত দূতাবাসের একজন বিবাহিত রাশিয়ান কূটনীতিকের সাথে। লেনিনগ্রাদে শরীর দিয়ে শুরু করা সম্পর্কটি প্যারিসে এসে ছাড়িয়ে যায় শরীরের সীমানাকে। ক্রমশ এই সম্পর্ক উন্মত্ততার সীমানাকেও ছাড়িয়ে যায়। ডিভোর্সি এর্নাক্স তখন মা-বাবাকে হারিয়ে ভীষণ একা। দুই সন্তানও তখন তাঁকে ছেড়ে আলাদা থাকে। ট্রলি নিয়ে বাজার করা বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। একটি ছোট্ট ঝুড়িতেই সংসারটা অবরুদ্ধ হয়ে আছে। থাকেন প্যারিসের বাইরে একটি ছোট্ট শহরে। উচ্চ শিক্ষিত হয়ে তিনি তখন শ্রেণিবিচ্ছিন্ন। নব্য মধ্যবিত্ত হিসেবে বুর্জোয়া শ্রেণিতেও ঠাঁই মিলেনি। ছোট্ট ঝুড়িতে বাজার করতে করতে নিজেকে যখন ভীষণ সঙ্গকাতর মনে হচ্ছিলো, ঠিক এই সময়ই মিঃ এস (‘গেটিং লস্ট’ গ্রন্থে সোভিয়েত কূটনীতিককে ‘এস’ হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়েছে) এসেছিলেন এর্নাক্সের চার দেয়ালের বেষ্টনীতে। ‘এস’-এর কাছে তাঁর চাওয়া ছিলো ভিখেরির মতো। টেলিফোনে কথা হলে এমনভাবে কথা বলতেন যেনো এই কথাই শেষ কথা। এমনভাবে উপলব্ধি করতেন, এই সঙ্গই শেষ সঙ্গ। প্রতিটি মিলনকে ভোগ করতেন শেষেরটি মনে করে। দেখতেন ‘লিমনিক আই’ দিয়ে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘I realized that I’d lost a contact lens, I found it on his penis … in one afternoon, I lost it three times.’ তারপর একদিন ০৯ নভেম্বর ১৯৮৯ এলো, বার্লিনের দেয়াল ভাঙলো। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙলো। ‘এস’-এর দেশে ফেরার বাঁশি বাজলো। 
২০২২ সালে এর্নাক্সের স্মৃতিচারণমূলক ২৩৪ পৃষ্ঠার গ্রন্থ ‘গেটিং লস্ট’-এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর বেস্ট সেলার ৬৭ পৃষ্ঠার ‘সিম্পল প্যাশন’ গ্রন্থটি পুনরায় পাঠকের মনোযোগ করে নেয়। মুদির দোকানির মেয়ে অ্যানি এর্নাক্স (৮২)। প্রথম ফরাসি নারী যিনি স্বীকৃতি পেলেন ২০২২ সালের নোবেল লরিয়েট ইন্ লিটারেচার হিসেবে। জন্ম ১৯৪০ সালে। উত্তর ফ্রান্সের নরম্যান্ডি অঞ্চলের লিলেবন সিটিতে। বেড়ে ওঠেন একই অঞ্চলের ইভটো নামের ছোট্ট একটি শহরে। চূড়ান্ত পড়াশোনা রুয়েন বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষকতা শুরু করেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিস্ট্যান্স এডুকেশন-এ ১৯৭৭ সালে অধ্যাপনা জীবন শুরু করে অবসর নেন ২০০০ সালে। 
শ্রমজীবী মা-বাবার আর্থিক সহায়তায় অর্জিত উচ্চ শিক্ষা শেষে মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী এর্নাক্সের মধ্যকার শ্রেণিদ্বন্দ্বের শিকার হয়ে নতুনরূপে জন্ম নেয়া একজন এর্নাক্সের অনর্গল জবানি থেকে উদ্ভূত হয়েছে তাঁর সকল গ্রন্থরাজি। উচ্চশিক্ষা এর্নাক্সকে ক্রমশ দূরে সরিয়ে দিয়েছে তাঁর পরিবারের কাছ থেকে। বিলাসী মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাথে একাত্ম হতে গিয়ে তিনি মত্ত হয়েছিলেন অবাধ মেলামেশায়। প্রকৃত পক্ষে, শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া একজন নিঃসঙ্গ নারীর জীবনকথাকে তিনি স্বাধীন ফ্রান্সের পরাধীন নারীকুলের গল্পকথায় রূপান্তরিত করে বিশ্বসাহিত্যের মুরব্বীদের চমকে দিয়েছেন। সাহিত্যে বিশ্বের সতেরতম নারী নোবেল বিজয়ী এর্নাক্স লিখতে শুরু করেন গোপনে, তার স্বামীর অজান্তেই। তাঁর লেখায় যৌনতার কথা আছে, আছে গোপন গর্ভপাতের মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণার কথা। বুর্জোয়া শ্রেণির স্বামীর সাথে ডিভোর্স, নিজের জীবনে কর্কটরাজের সাথে লড়াই করার সামর্থ্য অর্জন, দুই ছেলের আলাদা জীবন যাপন, মা-বাবার প্রয়াণ পর্ব এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ফ্রান্সের সমাজজীবনের এগিয়ে পিছিয়ে থাকার সরল কথাকে তিনি উপাত্ত হিসেবে তুলে ধরেছেন একের পর এক প্রকাশিত তাঁর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থসমূহে। 
প্রকৃতপক্ষে এর্নাক্স অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন দুটি সংস্কৃতির মাঝখানে। জন্মগতভাবে শ্রমজীবী হয়ে উচ্চশিক্ষার বিনিময়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে অনুপ্রবেশ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কোনো শ্রেণির কাছেই তিনি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেন নি। তাঁর অন্তরঙ্গ এবং যন্ত্রনাদগ্ধ এই ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতার বর্ণনায় অনেক বেশি অপরিশোধিত হওয়ার অভিযোগে ফরাসি সাহিত্যের মুরব্বীরাও তাঁকে গ্রহন করেন নি। ফরাসি সাহিত্যমহলের এই উদ্বেগকে তিনি চিরকাল প্রত্যাখ্যান করেছেন। ধারালো ছুরির মতো শব্দ ব্যবহার করে নিজেকে তিনি উন্মুক্ত করেছেন। তাঁর ভাষা ‘নির্দয়ভাবে সরাসরি, প্রলেতারিয়েত শ্রেণির এবং কখনও কখনও অপরিশীলিত’। অথবা নোবেল কমিটি যেমন বলেছে, ‘আপোষহীন এবং সরল ভাষায় লেখা, স্ক্র্যাপড ক্লিন’। সুইডিশ একাডেমির ভাষায় “তাঁর লেখায় সাহসিকতা এবং ক্লিনিকাল তীক্ষ্ণতা আছে যার সাহায্যে তিনি পারিবারিক শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার বেদনাকে সর্বজনীন অনুশাসন দিয়ে উন্মোচন করেছেন তাঁরই একান্ত স্মৃতিকথায়।“








অনুবাদক অ্যালিসন স্ট্রেয়ারকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ ও অনেক কৃতজ্ঞতা। এর্নাক্স আন্তর্জাতিক এবং সর্বজনীন পাঠক সমাজের নজরে আসেন ২০১৭ সালে; ২০০৮ সালে ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত ‘দ্য ইয়ার্স’ গ্রন্থটি এই বছর অনুবাদক অ্যালিসন স্ট্রেয়ার কর্তৃক ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। একজন নারীর জীবনের গল্পের উপাত্ত হিসেবে এই গ্রন্থে উঠে আসে ১৯৪১ সালের পর থেকে শুরু করে বর্তমান কালের ফরাসি মুল্লুকের সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থার ক্রমচিত্র। মায়ের দোকানে বসে গোপনে শোনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের সংলাপ, ১৯৬৮ সালের ফ্রান্সের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে জাতীয় ভিত্তিক নারী আন্দোলন, ষাটের দশকের জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি আবিষ্কার, এবং এই বড়ি প্রেসক্রিপশনে চিকিৎসকদের স্বেচ্ছাচারিতা, টেলিভিশনে ‘ক্যানেল প্লাস’ নামের পর্ণ চ্যানেলে ফরাসি বুদ্ধিজীবীদের আসক্তি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে রচিত ‘দ্য ইয়ার্স’ গ্রন্থটি অর্জন করতে থাকে নানান পুরস্কার ও স্বীকৃতি। ২০১৯ সালে বইটি আন্তর্জাতিক বুকার প্রাইজের শর্ট লিস্টের অন্তর্ভুক্ত হলে সাহিত্য বিশ্লেষকদের মূল্যায়নে এর্নাক্স হয়ে ওঠেন সমকালিন ক্ল্যাসিক গ্রন্থের প্রণেতা। সমালোচকরা এখন ‘দ্য ইয়ার্স’ গ্রন্থটিকে তুলনা করছেন ফরাসি লেখক মার্সেল প্রুস্টের সাত খণ্ডে রচিত উপন্যাস ‘ইন সার্চ অফ লস্ট টাইম’-এর সাথে। 
‘সিম্পল প্যাশন’-এর ‘এ’  টুকটাক চালিয়ে নেয়ার মতো ফরাসি ভাষা জানলেও গভীর উপলব্ধি প্রকাশ করার দক্ষতা তাঁর ছিলো না। তখন আটচল্লিশ বছর বয়সী কথক (‘সিম্পল প্যাশন’ গ্রন্থে এই কথকই হচ্ছেন লেখক অ্যানি এর্নাক্স) তো রাশিয়ান ভাষার কিছুই জানতেন না। তবে তিনি পত্র-পত্রিকা পড়ে রাশিয়ার সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছেন। রাশিয়ানদের মতো করে তাঁদের মিলনশয্যা সাজিয়েছেন। ঘরের আসবাব পরিবর্তন করেছেন। তাঁর জন্যে খাবারের সঠিক মেনু এবং জামাকাপড় নিশ্চিত করেছেন। তিনি রাশিয়ান লেখক ভ্যাসিলি গ্রসম্যানের ‘লাইফ অ্যান্ড ফেইট’ উপন্যাসটি পাঠ করে জেনেছেন, “… people in love kiss with their eyes closed.” চুমু দেয়ার সময় ‘এ’-এর চোখ বন্ধ দেখে তাঁর মনে হয়েছে মানুষটি তাঁকে ভালোবাসেন। তারপরও, একটি শরীরী ফ্রেমে দুজন ‘অন্তর্ভুক্ত’ থাকলেও, ভাষার কারণে কেউ কারো ‘অন্তর্গত’ হতে পারেন নি। 
অনামিকা এই নারী আবেগ দিয়ে মেপেছেন নিজের শরীরকে, আর শরীর দিয়ে পরিমাপ করেছেন সময়কে। কথকের ভাষায়, “I measured time differently, with all my body.” তাঁর সঙ্গকাতরতা এতো বেশি উন্মাদনাগ্রস্থ ছিলো যে, প্রিয়জনের সাথে কাটানো চার ঘণ্টার ব্যাপকতাকে তিনি তুলনা করেছেন গাড়ির দুটো শব্দের মধ্যকালিনতার সাথে। ‘এ’-এর রেনল্ট ২৫ ব্র্যান্ডের গাড়িটি তাঁর বাড়ির সামনে এসে পৌঁছালে তিনি জানালা দিয়ে দেখতেন এবং কান পেতে প্রথমে শুনতেন ব্রেক চাপার শব্দ, পরক্ষণে শুনতেন ইঞ্জিন বন্ধের শব্দ। চার ঘণ্টার একটি বিকেলকে তিনি ব্রেক এবং ইঞ্জিনের শব্দের মধ্যবর্তীকালিন ব্যবধানের মধ্যে অন্তরীন করেছেন। দুটো শব্দের ঘটমানতার মধ্যকার অতি স্বল্প সময়ের ব্যবধানের চিত্রকল্প দিয়ে তিনি নির্মাণ করেছেন একটি নিষ্পেষিত বিকেলের বিষণ্ণ অবয়ব। রেনল্ট ২৫ ব্র্যান্ডের গাড়িটি তার চালককে নিয়ে দৃশ্যমানতার বাইরে চলে যাবার পরের বেদনাকে তিনি সেভ করেছেন এইভাবেঃ
তারপর অবসাদের তরঙ্গগুলো এমনভাবে আছড়ে পড়তো, আমি কাবু হয়ে যেতাম। সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারতাম না। বেডরুম আর করিডোর জুড়ে পড়ে থাকা পানীয়শূন্য পাত্র, থালার উচ্ছিষ্ট, উপচে পড়া অ্যাশট্রে, জামাকাপড়, অন্তর্বাস, এবং কার্পেটে ঝুলে থাকা বিছানার চাদরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতাম। সেই এলোমেলো পড়ে থাকা জিনিষগুলোকে আমি সেভাবেই দেখতে পছন্দ করতাম। স্নান না করে নিজের দুমড়ানো সুরতটাকে আয়নার কাছে টেনে নিয়ে যেতাম।  জগাখিচুড়ির এমন একটি জগতে প্রতিটি বস্তু আবেশ ছড়াতো, দাঁড় করিয়ে দিতো কিছু যাপিত মুহূর্তের মূর্ছনাকে। উদ্ভাস ছড়াতো একটি প্রাণহীন জীবনের, যার তীব্রতা এবং বেদনাকে কোনো যাদুঘরের কোনো চিত্রকর্মও কোনোদিন অবরুদ্ধ করতে পারেনি। 
এইভাবে একটি নির্দিষ্ট বিকেল যায়, অনামিকার দিন কাটে পরবর্তী অনির্দিষ্ট আরেকটি বিকেলের অপেক্ষায়। কখন বাজবে আশির দশকের ল্যান্ড ফোনের একটি রিং টোন, বরাদ্দ হবে আরেকটি বিকেল। তারপর শুরু হতো তাঁর শপিং ক্র্যাজ। মিলনের প্রতিটি বিকেলে তিনি নিজেকে নতুন বসনে সাজিয়ে নিতে গিয়ে শিহরিত হতেন। যদিও তিনি জানতেন মিঃ ‘এ’ ঘরে আসার পর এইসব বসন আর ভূষণ তাঁর নেত্রকোনায় আশ্রয় পাবার আগেই পৌঁছে যাবে গৃহকোণে। তবু অনামিকার সান্ত্বনা, প্রিয়জনের এক জোড়া বিশ্বস্ত হাতের নান্দনিক তরঙ্গে ক্রমশ অনাবৃত হবে ফরাসি সৌরভ আর ফ্যাশনের জৌলুষে আবৃত একটি শরীর। 
পাঠক উপলব্ধি করতে পারেন, এই গল্পটি একজন বিবাহিত পুরুষের সাথে একজন ডিভোর্সি নারীর যৌন সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সাহিত্যে সাধারণত মনের সম্পর্কের সিঁড়ি বেয়ে শরীরী ছাদে আরোহণের ঘটনাই ঘটে বেশি। আজকের ফরাসি গল্পের কথক তার বিদেশি প্রেমিকের প্রতি সম্পূর্ণরূপে আচ্ছন্ন। তিনি তাঁর জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে এই পুরুষটিকে যাপন করেছেন; ধারণ করেছেন অন্তর্জগতে, মূর্তিমান করেছেন অপেক্ষার ক্যানভাসে। কালের করুণায় কেটে গেছে তাঁর প্রায় দেড় বছরের জীবনকাল। গাড়ির ব্রেক চাপা, দড়াম করে দরোজা বন্ধ করা আর কংক্রিটের বারান্দায় প্রত্যাশিত চরণধ্বনি প্রতিনিয়ত নিয়ন্ত্রণ করেছে তাঁর কালের কণ্ঠ। অথচ তাঁরা দুজনই জানতেন খুব সহসা এইসব মোহ, আবেগ কিংবা আকাঙ্খার মৃত্যু হবে। মৃত্যুর এই নিশ্চয়তার কারণে অনামিকার মনে হতো, ‘I experienced pleasure like a future pain.’ অর্থাৎ বর্তমানের আনন্দ প্রস্তরের ওপর নির্মিত হতে চলেছে আগামি দিনের যন্ত্রণার চিন্ময়ী ভাস্কর্য। 
‘সিম্পল প্যাশন’ আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে প্রেম বরাবরই একটি সর্বজনীন আবেগ; প্রেক্ষাপটের ভিন্নতার কারণে তার আদল প্রকাশিত হয় বহুরূপের ব্যঞ্জনায়। এই আবেগ আমাদেরকে কখনো অবরুদ্ধ করে, কখনো বা করে অনিরুদ্ধ। উন্মত্ত আবেগ শেষ পর্যন্ত আমাদের ইন্দ্রিয়কেই কলংকিত করে। এই কাহিনি চূড়ান্ত পর্যায়ে মানবিক আকাংখার সর্বজনীনতাকেই উন্মোচন করেছে। সম্মোহিত পাঠকদের কেউ যদি নিজেকে কথকের আড়ালে লুকিয়ে ফেলেন, তাতে আলোচক হিসেবে আমি বিস্মিত হবো না। 
গ্রন্থের শেষ জবানিতে কথক কিছু বর্ণমালাকে সাজিয়েছেন উপলব্ধির ছোঁয়া দিয়ে। তিনি লিখেছেনঃ 
When I was a child, luxury was fur coats, evening dresses, and villas by the sea. Later on, I thought it meant leading the life of an intellectual. Now I feel that it is also being able to live out a passion for a man or a woman.
ছোটোবেলায় মনে হতো, বিলাসিতা মানে পশম কোট, সান্ধ্যকালিন পোশাক কিংবা সমুদ্রের ধারে একটি বাড়ি কেনা। পরে ভেবেছিলাম, বিলাসিতা মানে একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিজের জীবনকে চালিত করা। এখন মনে হচ্ছে, কোনো একজন বিশেষ নারী বা পুরুষের কাছ থেকে আবেগমুক্ত হয়ে কারো বেঁচে থাকাটাই বড়ো ধরণের বিলাসিতা। 





সুজিত কুসুম পাল


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন