রবার্ট ফ্রস্ট



রেকর্ড চার বার পুলিৎজার প্রাপ্ত অ্যামেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা ‘নাথিং গোল্ড ক্যান স্টে’

অনুবাদ ও ভুমিকাঃ  সুজিত কুসুম পাল










বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) পর, সম্ভবত, ইংরেজি সাহিত্যের রবার্ট ফ্রস্ট (১৮৭৪-১৯৬৩) হলেন দ্বিতীয় জন, যিনি শৈশব থেকে শুরু করে মধ্য বয়স পর্যন্ত অনেক বেশি সংখ্যক প্রাণের মানুষের প্রয়াণ জনিত শোককে সামাল দিয়েছেন। মা, বাবা, বোন, স্ত্রী ও সন্তানসহ পরিবারের মোট আটজন সদস্যকে হারিয়ে তিনি পূর্ণ করেছেন নিজের ৪৮ বছরের কর্মকাল। বেদনার উজান স্রোতে সাঁতরাতে গিয়ে রপ্ত করেছেন বার্তার ব্যাপকতা প্রকাশে সীমিত শব্দের প্রয়োগ কৌশল। ইংরেজি সাহিত্যে, কারো কারো পর্যবেক্ষণে, উপন্যাসে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এবং কবিতায় রবার্ট ফ্রস্ট পাঠকের কাছে বার্তা প্রেরণকালে চরম সাবধানতার সাথে পালন করেছেন শব্দসংযম ব্রত; এবং সফল হয়েছেন চূড়ান্ত পর্যায়ে। জীবদ্দশায় শূন্যদূরত্বের প্রাণগুলোকে  হারিয়ে মৃত্যুর বেদনাকে অত্যন্ত আপন করে নিয়েছিলেন ফ্রস্ট। জীবনের পরিক্রমাকালিন পরিবর্তনকে উপজীব্য করে অত্যন্ত সফলতার সাথে তিনি তাই নির্মাণ করতে পেরেছেন একের পর এক নানান কাব্যিক ভাস্কর্য। পরিবর্তনের অনিবার্যতার আলোকে প্রকৃতি, কাল এবং পৌরাণিক কাহিনীর সমান্তরাল চলমানতার বার্তাকে উপাত্ত করে সৃজিত হয়েছে ‘নাথিং গোল্ড ক্যান স্টে’ টাইটেলের আজকের কবিতাটি। 
‘নাথিং গোল্ড ক্যান স্টে’ রবার্ট ফ্রস্টের  পুলিৎজার পুরষ্কার (১৯২৪) প্রাপ্ত ‘নিউ হ্যাম্পশায়ার’ (১৯২৩) কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ছোট্ট এই কবিতাটি বহুল পঠিত এবং আলোচিত। মূল ইংরেজি কবিতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে অনূদিত ‘সোনা থাকে না সোনাতে’ কবিতাটির টাইটেল চার শব্দে সীমিত রাখা হয়েছে। মূল কবিতার অনুসরণে পরিসর নির্মাণের ক্ষেত্রেও চল্লিশ শব্দের সমন্বয়ে রচিত আট লাইনের সীমানা অতিক্রম করা হয় নি। রাইম স্কিমের ডিজাইনও (এএ বিবি সিসি ডিডি) অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।  
ইংরেজি সাহিত্যে সবুজ শুধু একটি রঙ নয়; শুদ্ধতা, অপরিপক্কতা আর নিষ্কলুষতার প্রতীক এই সবুজ। অনুরূপভাবে সোনা মানে মূল্যবান ধাতু কিংবা কেবল সোনালি রঙ নয়; প্রাচীন মিথে সোনাকে উপস্থাপন করা হয়েছে শক্তি, সামর্থ্য, ঔজ্জ্বল্য আর স্বর্গীয় সামগ্রীর প্রতীক হিসেবে। কবিতার উদ্বোধনী লাইনে (Nature’s first green is gold) একটি সহজ সরল পর্যবেক্ষণের মধ্যেও ব্যতিক্রমী এক কাব্যিক কৌশলের আমেজ পাওয়া যায়, যখন পাঠক দেখে প্রকৃতির প্রথম সবুজ সোনা হয়ে যায়। বিভ্রান্তিকর এই প্রারম্ভিক পংতিতে ফ্রস্ট এখানে ‘গোল্ড’কে একটি চিত্রকল্প হিসেবে ব্যবহার করে সবুজের ক্ষণস্থায়ী বৈভবকেই মূল্যায়ন করেছেন। দ্বিতীয় লাইনে (Her hardest hue to hold) এসে তিনি অসাধারণ এক শক্তিশালী অনুপ্রাসের (হার – হার্ডেস্ট – হিউ - হোল্ড) অবতারণা করেছেন। এই অনুপ্রাসটি সবুজের সোনালিত্ব ধরে রাখতে না পারার বার্তা দিয়ে বরং সবুজকেই মহিমান্বিত করেছে। পরের লাইনে (Her early leaf’s a flower) এসে তিনি পাতা আর ফুলকে নিয়ে আবার এক বিভ্রান্তিকর খেলায় মেতেছেন। প্রথম খেলায় প্রশ্ন ছিলো ‘সবুজ কী করে সোনা হয়?’। দ্বিতীয় খেলার প্রশ্ন ‘পাতা কী করে ফুল হয়?’। ফুল নান্দনিকতার প্রতীক হলেও প্রকৃতিতে পাতার শৈশবের সৌন্দর্যকে প্রকাশ করার জন্য পাতাকে তিনি ফুলেরই রূপক হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু এই পাতার পরিণতি সেই সবুজের মতোই; সময়ের পরিক্রমায় সবুজ হারায় তার স্বর্নালী মর্যাদা, পাতা তার ফুলেল রূপ হারিয়ে ঝরে যায় পাতার মতো করে। পাতা তার রঙ হারায়; জীর্ণতার স্বাদ পরিপূর্ণ করে বৃন্তচ্যুত হয়। পাতা ঝরে যায়, ঝরাপাতা উড়ে যায়। একবার উড়ে গেলে আর ফেরে না। ঝরাপাতার না ফেরার এই খতিয়ানের মধ্যে নির্মিত হয়েছে শোকের সুরতহাল। ঝরাপাতার না ফেরার প্রক্রিয়ায় শোকের উচ্চতাকে একটি জাগতিক স্তরে নিয়ে যাবার জন্যে তিনি তার কবিতায় উদ্ভাসিত করেছেন পৌরাণিক আখ্যানের (Then leaf subsides to leaf. / So Eden sank to grief,) অংশ বিশেষকে। ইডেনে অ্যাডাম এবং ইভের নিষিদ্ধ জ্ঞান অর্জনের পর সমগ্র মানব জাতির ভবিষ্যৎ চিরকালের জন্যে পাল্টে গেলো। ইডেন বাগান হারালো তার জাগতিক নিত্যতা। বৃদ্ধি পেতে থাকলো পৃথিবীর বয়স; বয়সের অনুসঙ্গ হয়ে উঠলো এক অনিবার্য পরিবর্তন। যেই পরিবর্তনের অনিবার্যতায় ঊষাকাল নেমে যায় দিবসের সিঁড়ি বেয়ে। সপ্তম লাইনে (So dawn goes down to day) আরেকটি চমৎকার অনুপ্রাস (ডন-ডাউন-ডে) দিয়ে কবি আসলে সূর্যাস্তের বিষয়টিকে আড়াল করেছেন কাব্যকল্পের অবগুণ্ঠন দিয়ে। একটি দিবসের জন্ম হয় ঊষাকালিন সূর্যের পরিচর্যায়। দেখতে নবজাতক পাতার মতো ঊষার রূপখানা পুষ্পের মতো নান্দনিক হলেও তার স্থায়িত্ব প্রকৃতির প্রথম সবুজের মতোই ক্ষণিকের। এই ঊষা পর্যায়ক্রমে সকাল, মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ন, গোধূলি নামধারী সিঁড়িগুলো অতিক্রম করতে থাকে। ফ্রস্টীয় সিঁড়ির ‘গ্রাউন্ড টাচিং’ ধাপে এসে সুসম্পন্ন হয় ঊষাজাত দিবসের অবসান প্রক্রিয়া। অতিক্রান্ত সিঁড়ির যাত্রীর স্বপ্নভঙ্গ হয় মাটির স্পর্শে; পাঠক অনুধাবন করেন, প্রতিটি র্সূযোদয়ে যে দিবসের জন্ম হয়, সূর্যাস্তে সেই দিবসটির মৃত্যু অনিবার্য। দিবসের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় আকাশের পশ্চিম চুল্লিতে। এই নৈমিত্যিক যজ্ঞের পরিসমাপ্তি হয় সময়ের পৌরহিত্যে। আরো এক শতাব্দীকাল পূর্বে এইরকম কোনো এক দিবসের মৃত্যুতে শবযাত্রায় অংশ নেয়ার কথা জানিয়েছিলেন জন কিট্স তাঁর ‘টু অটাম’ কবিতায়। ১৮১৯ সালে রচিত এই কবিতায় একটি দিবসের শরৎকালিন শবযাত্রায় সেদিন কবি কিট্স একদল শোকার্ত ঝিঁ ঝিঁ পোকার মাতম দেখেছিলেন। লন্ডনের উইন্চেষ্টার কাউন্টির ইচেন নদীর তরঙ্গরাজিও সেদিন দিবসের বিদায়কালিন মুহূর্তে শোকে মুহ্যমান ছিলো। বিহঙ্গ রবিনের শিসে ছিলো অন্তিমতার আবহ। চূড়ান্ত পর্যায়ে, ফ্রস্টীয় কাব্যের আজকের পর্বে, এই দিবসটিই হচ্ছে মানবীয় কর্মকালের একটি সফল ও সর্বাত্মক চিত্রকল্প। 
প্রকৃতির জগতে পরিবর্তনের ডক্ট্রিন চিরকালের জন্যে অপরিবর্তনীয়। কোনো অধ্যাদেশ জারি করে এই পরিবর্তনে সংশোধনী সংযোজন সম্ভব নয়। অর্থনীতির ধারায় মুল্যস্ফীতি হয়, জাগতিক ধারায় হয় মূল্যের পরিবর্তন। কালের চক্রে মূল্যবান কোনো উপাদানকেই ধরে রাখা যায় না। স্বর্গীয় ইডেনও ডুবে যায় শোকের সাগরে, ঊষা ডুবে দিনের গভীরে। সবুজ থাকে না সোনাতে, পত্র থাকে না পুষ্পে। আকারে ছোটো, বিষয়ে সূক্ষ্ম এবং বার্তাগত গভীরতায় ব্যাপক এই কবিতাটি পরিপূর্ণ হয়েছে চিত্রকল্প, রূপক আর বিভ্রম জাগানো নানান শব্দমালার অবাধ বিচরণভূমিতে।


সোনা থাকে না সোনাতে 
প্রকৃতির প্রথম সবুজ স্বর্ণময়;
যেই রঙ ধরে রাখা দুরূহ হয়। 
তার শুরুর পাতাটি একটি ফুল; 
প্রথম ঘণ্টায় ভেঙে যায় ভুল। 
পাতা, তারপর, পাতা হয়ে যায়; 
ইডেন ডুবেছিলো শোকের কারায়;
ঊষাকাল ডুবে যায় দিবসের সিঁড়িতে। 
সোনা পারে না টিকতে সোনার পিঁড়িতে। 

Original: Nothing Gold Can Stay By Robert Frost 
Nature’s first green is gold,
Her hardest hue to hold.
Her early leaf’s a flower;
But only so an hour.
Then leaf subsides to leaf.
So Eden sank to grief,
So dawn goes down to day.
Nothing gold can stay.






সুজিত কুসুম পাল



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন