চন্দ্রালোকিত রাত


সেই চন্দ্রালোকিত রাতে
একটা নেকড়ে দেখা দিল
নগ্ন পাহাড়ের উপর ।
 
  
যেন সে এলো
আকাশের ভেতর থেকে
অথবা পাহাড়ই জন্ম দিল তাকে।
  

সে গেল নদীর তীরে
এবং জল পান করল
 
এবং ডেকে উঠলো
আউউউউউউউউউ ...আউউউউউউউউউ...







গান


ঠাকুরদা হাত ধরে
নাতিকে নিয়ে যায় বাইরে
গাছেদের অভ্যর্থনা জানাতে,
তাদের সঙ্গে কথা বলতে,
তাদের ত্বকে হাত বোলাতে,
গন্ধ নিতে তাদের পাতার
  

আর গাছেরাও
তাদের নাম ধরে গান গায়।


 





পথিক


সারারাত আমি হাঁটলাম
আমার ছায়ার খোঁজে।


সে ফিরে এলো
অন্ধকারের সঙ্গে।


উতিউউউউউউ...
একটা নেকড়ে ডাকে।
 

আমি হেঁটেই চললাম।


তু তু তুকুররররররর
একটা পেঁচা।


আমি হেঁটেই চললাম।

সত্ৎজ সত্ৎজ  সত্ৎজ...
একটা বাদুর চিবিয়ে চলে
কোন শুকর ছানার কান।
 

উষার আলো না ফোটা পর্যন্ত।


আমার ছায়া এতটা লম্বা
যে সে ঢেকে ফেলল সবটুকু পথ।
 







চিতাবাঘ


অন্যান্য সময়ে আমি একটা চিতা,
নদী উপত্যকা ধরে আমি দৌড়াই,
টিলার উপর লাফাই,
পাহাড়ে চড়ি।
   

আমি আকাশের ওপারে তাকাই,
জলের ওধারে,
পৃথিবীর বাইরে।
 

আমি কথা বলি সূর্যের সঙ্গে ,
চাঁদের সঙ্গে খেলি,
তারাদের তুলে এনে
আমার শরীরে গাঁথি।
 

যখন আমি লেজ নাড়ি,
আমি লাফিয়ে পড়ি ঘাসের উপর,
আমার জিভ বেরিয়ে পড়ে।









সুখী


আমি জেগে উঠলাম সুখী
আমার চুল এলোমেলো ।


একটা পাখি বাসা গড়ল
আমার মাথার উপর
এবং পাড়ল তার ছোট্ট ডিমগুলো।


আজ
তার ছানাগুলো
জেগে উঠলো গান গেয়ে।


আমি সুখী।








ঘাসের মাদুরে বসে


ঘাসের মাদুরে বসে
রান্না ঘরের মেঝের উপর
আমরা খেতাম  তামালে, মাংস- ভুট্টার কেক, নুন দিয়ে
এবং পান করতাম গরম কফি।।


আমাদের সঙ্গে মুরগিগুলো,
কুকুরগুলো এবং একটা শুকরছানা।







যাই হোক আছে, আছেই


বাদ দেয়া যাক এসব ফালতু কথা
ভূত আছে কি নেই;
আছেই।
 

ভূত ছাড়া কোন গ্রাম
সত্যিকারের গ্রামই নয়।


তবে
ভূতেদেরও
হতে হবে সত্যিকারের ভুল।







যন্ত্রণা


দুরবস্থা,
দারিদ্র,
তারা কষ্ট দেয়,
কষ্ট দেয়।
  

তবুও কীভাবে আমি  চাই হতে
এক টুকরো নেকড়া


অন্তত যেন তার প্রয়োজন হয়
তালিতাপ্পির কাজেও।








ভুট্টা তোলা



এসো, হাঁটা যাক,
ভেতরে আসা যাক,
এটাই তো ভুট্টার প্রাকৃতিক মন্দির।


আমাদের পাগুলো কাদা মাখামাখি,
এর চেয়ে বড়ো কোনো শ্রদ্ধা নেই।


ভূট্টার ঝোপঝাড়,
ভুট্টাদানার হাসি ।
 

এসো, আমরা ওদের তুলে রাখি মোটা বস্তায়,
জালে ভর্তি করি,
কাঁধের ব্যাগে রাখা যাক ছোট্ট আকার যাদের।
 

কালোপাখিরা খেলে,
টিয়াদের কচরমচর
এত কালো, এত সবুজ ।
  

জালোলিলো, জালোলিলো, লেলেলে লেলেলে... বাড়ির ভেতর মাদুর  বসে
ভুট্টাক্ষেতের প্রহরীর শেষ গান
খোসা ছাড়িয়ে শাঁস বার করে,
শস্য তোলার শেষ হলো এবার।



এসো আমরা পায়ের উপর দাঁড়াই
এবং হেঁটে চলি।







উমবের্তো আক'আবাল


কিসে ভাষার অক্ষরযোজনা

উমবের্তো আক'আবাল-এর কবিতা

সাম্প্রতিক গুয়েতেমালার কবিতায় উল্লেখযোগ্য কবিতাস্রষ্টার নাম উমবের্তো আক’আবাল (Humbarto Akabal, 1952-2019)। তাঁর জন্ম ১৯৫২ তে মোমোস্টেনানগো (Monostenango) নামের একটি গ্রামে। খুব কম বয়সেই তাঁর লেখাপড়ার পাট চুকে যায়। দ্রারিদ্র-পীড়িত পরিবারকে সাহায্য করতে কত কিছুই না তাঁকে করতে হয়েছিল। ভেড়ার পালের রাখাল, কাপড় বোনা, রাস্তার ফেরিওলা, কুলি- জীবনের বহু-বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর। এই অভিজ্ঞতার স্ফুলিঙ্গ তাঁর কবিতায় বারে বারে প্রকাশিত। আক’আবাল-এর কবিতাকে গুয়েতেমালার মানুষ দেশের সাংস্কৃতিক ঘটনা বা 'কালচারাল ফেনোমেনন' বলে মনে করেন। প্রতিবাদী ও বিপ্লবী চেতনার অগ্নি-স্পর্শ নিয়ে উমবের্তো আক’আবাল-এর কবিতা নান্দনিকতার পরিশীলনের অধিকারী। নান্দনিক পরিমিতিবোধই তাঁর কবিতাকে স্লোগান-হওয়া থেকে রক্ষা করেছে, তাকে শিল্পের গৌরবে উজ্জ্বল করে তুলেছে। স্থানিক জল মাটির গন্ধ, মানবিক মূল্যবোধ ও নান্দনিকতা— এইসব উপাদানের সংমিশ্রণ ও মিথস্ক্রিয়ার ভেতর দিয়ে উমবের্তো আক’আবাল নির্মাণ করেছেন তাঁর লিখনবিশ্ব। এই তাঁর কবিজীবনের অর্জন।

বিচিত্র পেশা ও জীবনের অভিজ্ঞতার বিচিত্র আগুনতপ্ত উমবের্তো-র কবিজীবনের প্রস্তুতিপর্ব। আক’আবালের পিতামহ তাকে গ্রন্থ স্পর্শ করতে না করতেন কারণ তাঁর মতে বই মানুষকে বিপথগামী করে। উত্তর ঔপনিবেশিক অবলোকন একথা দৃঢ়তার সাথে বলে যে, আধিপত্যবাদী ইউরোপীয় অক্ষরচর্চা মানুষকে কতভাবেই না শিকড়-চ্যুত করেছে।
পিতামহের সাবধান বাণী সত্ত্বেও উমবের্তো কেবল অক্ষর প্রেমিকই হলেন না, হয়ে উঠলেন অক্ষরস্রষ্টা।

১৯৮০-র দশক থেকেই উমবের্তো আক’আবাল তাঁর মাতৃভাষা 'মায়াকিউসে'-তে কবিতা রচনা শুরু করেন। ‘কিউসে' (Quiche) স্প্যানিশ সম্মত উচ্চারণ, কিন্তু এই ভাষায় নিজস্ব উচ্চারণ 'কিসে' (Kiché)। 'কিসে' একটি মায়া-ভাষা (Maya Language) যা গুয়েতেমালার কেন্দ্রীয় পাহাড়ি অঞ্চলের বাসিন্দা কিসে-জনজাতির মাতৃভাষা। এখানে উল্লেখ্য যে, গুয়েতেমালার সরকারি ও প্রতিপত্তিশালী ভাষা স্প্যানিশ। মায়াকিউসে ভাষায় কবিতা লেখা সেই সময় গুয়েতেমালার একজন কবির কাছে ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। প্রত্যাখ্যান ও প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগের কথা মাথায় রেখেও আক’আবাল মাতৃভাষাতেই লিখেছেন তাঁর কবিতা। তিনি মায়াকিউসে ভাষার এক নবীন স্বপ্নদ্রষ্টা। এই ভাষার সাংস্কৃতিক শিকড় ইউরোপীয় পরিসরের অনেক সংস্কৃতির চেয়েই প্রাচীন। তাই এই ভাষার কাব্যিক প্রকাশ-ক্ষমতা বিষয়ে উমবের্তো একশো শতাংশ নিশ্চিত ছিলেন। এই ভাষার কবির কোনো সমার্থক শব্দ নেই। কবি ও গায়ক- উভয়ই গায়ক, এই মায়াকিউসে ভাষায়। সম্ভাবনাময় এই ভাষাতেই উমবের্তো রচনা করেছেন তাঁর কবিতা যেখানে এই বিশ্বসত্তা গাছপালা পশুপাখির মিলিত চেতনা। একটি কবিতায় উমবের্তো আক'আবাল লিখছেন:

গাছেরা বেড়ে উঠছে

কুঠারের কথা না ভেবেই...

উমবের্তো মায়াকিউসে ভাষায় লিখে নিজেই নিজের রচনা অনুবাদ করতেন স্প্যানিশ ভাষায়। কিন্তু প্রায় দশ-বারো বছর অপেক্ষার পর ১৯৯৩ সালে তিনি প্রকাশক খুঁজে পেলেন। ওই বছরই প্রকাশিত হল তার প্রথম দ্বিভাষিক কাব্যসংকলন ‘আজউক-এল আনিমালেরো' (দি অ্যানিম্যাল কিপার, ১৯৯৩)।

জীবনের একটি বড়ো অংশ তিনি তাঁর নিজের গ্রামে থেকেছিলেন। লেখাই ছিল তাঁর জীবন ও জীবিকা । তাঁর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ:
•গার্ডিয়ান অব দ্য ওয়াটারফল, ১৯৯৩

লিভস অন দ্য বার্ড-টি, ১৯৯৫

উইভাব অব ওয়ার্ডস, ১৯৯৬

ইয়েলো স্কাই, ২০০০

হানি ওয়ার্ড, ২০০১

চ'অনালিক, ২০০৪

অঁত্রে পাতোজস, ২০০৫

দ্রাম অব স্টোন, ২০১০

প্রকৃতিমুখিনতা, শিকড়-অভিলাষী চৈতন্য ও উত্তর-ঔপনিবেশিক চেতনা পরিসর এইসব বৈশিষ্ট্য বা অভিমুখ পরিলক্ষিত উমবের্তো আক আবালের অক্ষরশস্যের কেন্দ্র-পরিধিতে। ফরাসি, ইটালিয়ান, স্যুইডিস, ডেনিশ, জার্মান প্রভৃতি নানান ভাষায় অনূদিত অনুসৃজিত আক’আবালের কবিতা। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বহু পুরস্কারে ভূষিত এই কবি।

আক’আবালের কবিতা স্বচ্ছ, সহজ বোধগম্য। কিন্তু এর বৈশিষ্ট্যগুলির কারণে তাঁর কবিতার গায়ে অনাধুনিকতার ছাপ লাগিয়ে তাঁকে বাতিল করা যাবে না। মায়া-কিসে ভাষা, সংস্কৃতি এবং এই ভাষার মানুষের আত্মপরিচয় ও সাস্কৃতিক শিকড়ানুসন্ধানের প্রেক্ষিতে পড়তে হবে তাঁর কবিতা। পাঠের এই কৌণিকতা সাহায্য করবে আক’আবালের কবিতার ভিন্নতর অর্থ-স্তর উদ্ঘাটনে। মায়া-কিসে সভ্যতার বহু সাংস্কৃতিক উপাদান মিশে আছে তাঁর কবিতায়। তাই তাঁর কবিতার সরলতা অনেক সময়ই আপেক্ষিক। তাঁর অক্ষরের গূঢ়তা অবশ্যম্ভাবীভাবেই চোখ এড়াবে না মনোজ্ঞ পাঠকের। সমালোচক নরমান মিনিক (Norman Minnick) লিখছেন:

AK'abal's is a poetry of contraconquista (counterconquest), which is a way of not submitting, to conventions defined by the dominant culture.

আক আবাল একটি কবিতায় লিখেছেন:

They have stolen from us lands, trees, water.

What they have not been able to prossess is the nawal.

They never will.

‘নাওয়াল’ (Nawal) কথার দু’টি অর্থ ‘কিসে’ এবং ‘স্পিরিট’ (আত্মশক্তি)।

আক’আবালের মৃত্যু নেই, এঁদের মৃত্যু হয় না। অগণিত কিসে জনতার আনন্দ-ক্রোধ-ভালোবাসার ভাষা হয়ে তাঁর কবিতা তাদের হৃদয়ে প্রতিনিয়ত অনুরণিত হয়।








রুদ্র কিংশুক 

(ভূমিকা ও অনুবাদ)

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন