ভাষার রাজনীতি ও রাজনীতির ভাষা



(গত ১৯ মে ২০২২, আসামের ভাষা-শহিদদের স্মরণে ভুবনডাঙা ওয়েব ও পাবলিকেশন-এর উদ্যোগে ফেসবুক লাইভে একটা অনুষ্ঠান ছিল, শিরোনাম ‘এবং মাতৃভাষা’, তাতে আমিও যোগ দিয়েছিলাম এবং আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে আমার বক্তব্য জানিয়েছিলাম। অনেকেই অনুরোধ করেছেন সেই বক্তব্যের একটা লিখিত বয়ান যেন দেওয়া হয়। তাঁদের অনুরোধে, আমার সেই বক্তব্যের বিষয়বস্তুতে কিছু সংশোধন ও সংযোজন করেই এই গদ্য।) 

প্রশ্ন- ভাষা বদলায়, প্রশাসক ও শাসিতের ভাষা আলাদা, রাষ্ট্রের ভাষা আর রাষ্ট্রবাসীর ভাষা, অত্যাচারী আর অত্যাচারিতের ভাষা আলাদা। ভাষা বদলের এই রাজনীতিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

উত্তর- নমস্কার, প্রথমেই সমস্ত ভাষা শহিদ, যাঁরা মাতৃভাষার সম্মান রক্ষায় লড়াই করেছেন এবং নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, তাঁদের শ্রদ্ধা ও প্রণাম। সহবক্তা সঞ্চালিকা ও শ্রোতাদের শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ। আমাকে যে প্রশ্ন করা হল তা অবশ্যই খুব ভালো প্রশ্ন, যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক। যতটা সম্ভন আমি তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি। 
প্রশ্নের প্রথম অংশ, ভাষা বদলায়। অবশ্যই পরিবর্তনের নিয়ম মেনেই ভাষাও বদলে যায়, এ নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। ভাষার বদল খুবই স্বাভাবিক এবং একটা স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা। ভাষা না বদলালে আমরা আজো সেই আদিম যুগেই পড়ে থাকতাম। পণ্ডিতেরা বলে থাকেন, ভাষা আসলে বহতা নদীর মতোই, যুগে যুগে তার নানা বাঁক-বদল, ঝোঁক-বদল এবং নানা ভাঙাগড়া। 
প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশ, শাসক ও শাসিত, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রবাসী, অত্যাচারী ও অত্যাচারিতের ভাষা- আলাদা। শাসক-শাসিত, অত্যাচারী-অত্যাচারিত—এসব তো রাজনীতির কথা, প্রশ্নের এই অংশটা তাই ভাষা নিয়ে রাজনীতির প্রশ্ন। সেটাও প্রাসঙ্গিক। জীবনের কোন বিষয়টা নিয়ে রাজনীতি নেই বলুনতো? কোথাও সোচ্চার, কোথাও নিরুচ্চার; জীবন-জীবিকার সব কিছুতেই কোনো না কোনোভাবে রাজনীতি মিশে যায়। আর ভাষা যেহেতু মানুষের ভাব-প্রকাশ ও যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম, সুতরাং ভাষা নিয়ে যে রাজনীতি থাকবে এ আর বেশি কথা কী?  
প্রশ্নের শেষ অংশ, কী ভাবে সেই রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করা যায়। তার উত্তর খোঁজার জন্য এখন কিছু আলোচনার প্রয়োজন। সেই আলোচনার শুরুতেই একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি; গতকাল বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছি, পাশ দিয়ে দুটো ছেলে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। কানে এল, একজন বলছে ওকে সব বলে দিয়েছি, এরপর যদি কোনো ব্যাগড়বাঁই করে, কথা না শোনে, তাহলে একদিন পার্টি-অফিসে ঢুকিয়ে এমন কুঁদুনি দেব না…; আজকের দিনে এটাই হল ভাষা-রাজনীতি, একই সঙ্গে এটাই হল আজকের রাজনীতির ভাষা, যার সঙ্গে মিশে আছে আধিপত্যবাদ, ক্ষমতা ও মাস্তানি। আশা করি ব্যাপারটা কিছুটা বোঝাতে পারলাম। 
এবার একটু বিস্তৃতভাবে বলি, এই ভাষা-রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল বাকস্বাধীনতা হরণ; ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ। সমাজে যারা শাসিত শোষিত অত্যাচারিত সেই নীচের মহলের কমজোরী মানুষজনকে নিজের ভাষায় নিজেদের কথা বলতে না দেওয়া; এবং সমস্ত প্রতিবাদী কণ্ঠকে রুদ্ধ করা; সঙ্গে সঙ্গে প্রজাদের উপর রাষ্ট্র তথা শাসকের ভাষা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া; এইভাবে সমাজে জাতি বর্ণ ও ধর্ম-ভিত্তিক বিভেদ-বিদ্বেষকে টিকিয়ে রাখা এবং লিঙ্গ-বৈষম্যকে উৎসাহিত করা। এমনকী পুরুষতান্ত্রিক পরিবারে অবদমিত নারীদেরও পুরুষ-কণ্ঠে কথা বলতে বাধ্য করা হয়; এসব দেখে শুনেই গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক প্রশ্ন তুলেছেন- Can the subaltern speak ? 
এই ভাষা-সন্ত্রাস আজকের দিনে ভীষণভাবে প্রকট, যদিও তা নতুন কোনো ঘটনা নয়, অনেক কালের পুরোনো মামলা; সাহিত্য সৃষ্টির প্রায় প্রথম যুগ থেকেই, সে সব কথা বলতে গেলে আমদেরও অনেকটা সময় পিছিয়ে যেতে হবে। 
আমরা যদি আমাদের মাতৃভাষা বাংলার কথাই ধরি, তাহলে বলতে হয়, বাংলার উৎস যে ভারতীয় আর্যভাষা, সেই ভাষার যারা ধারক ও বাহক, আমরা জানি সেই আর্যরা এ দেশের মানুষ ছিল না, তারা বহিরাগত এবং একই ভাষাগোষ্ঠীর লোকজন। তারা নানা দলে ও গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে নানা সময়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। কিন্তু তাদের মুখের ভাষা ছিল একটাই। ভারতবর্ষে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আর্যরা সেই এক-ভাষার সূত্রেই নিজেদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে পেরেছিল। এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। অস্বীকার করার উপায় নেই। 
উলটো দিকে এদেশের যাঁরা ভূমিপুত্র সেই অনার্যরা দেশের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের নানা অঞ্চলে বসবাস করত, তারা নানান আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলত। স্বীকার করে নিতে হয়, ভাষার ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোনো একতা গড়ে ওঠেনি, তাই বহিরাগত আর্যদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনার্যরা জোটবদ্ধ হতে পারেননি। যে যার নিজের মতো বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধ করেছে, এবং হেরে গেছে; এটাও একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। 
তাহলেই বোঝা যাচ্ছে, সামরিক শক্তি ছাড়াও অন্যদের দাবিয়ে রাখতে ভাষাশক্তি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই জন্যেই বলে রাজ্য শাসন করতে গেলে গায়ের জোরের সঙ্গে গলার জোরও দরকার।  
স্বাভাবিকভাবেই, তখনকার শাসক আর্যরা তাদের নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম সব কিছুই এদেশের মানুষের উপর জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইল। শুরু হল ভাষা নিয়ে রাজনীতি। প্রতিষ্ঠানের রাজনীতি, ক্ষমতার রাজনীতি, সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসনের রাজনীতি, সমাজের বৃহত্তম অংশের মানুষকে অবদমিত করে রাখার রাজনীতি। সেই রাজনীতির কাছে প্রথম-পর্বে অনার্যদের নতিস্বীকার করতেই হল। সেই সময়ের সাহিত্যে এদেশের ভুমিপুত্ররা নিজেদের ভাষায় কথা বলতে পারল না। সেই ভূমিপুত্র বা অনার্যদের সম্পর্কে যা কিছু লেখা হল সবই উচ্চ-মহলের আর্য-ঋষিদের কলম-প্রসূত। ফলে তা হল একপেশে, যেখানে এদেশের আদি বাসিন্দাদের সম্পর্কে রাশি রাশি ঘৃণা, অবজ্ঞা, অবহেলা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না।   
বেদ পরবর্তী সময়ে, প্রাচীন আর্যদের এই ভাষা-আধিপত্যকে প্রথম চ্যালেঞ্জ জানালেন এবং প্রচণ্ড ধাক্কা দিলেন শাক্যমুনি তথাগত বুদ্ধদেব। সূচনা হল কাউন্টার ন্যারেটিভের। বুদ্ধদেব ছিলেন প্রগতিশীল, প্রতিবাদী এবং বিপ্লবী। তিনি বেদকে অস্বীকার করলেন, প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করলেন, ক্ষমতাকে অস্বীকার করলেন, তিনি নিজের মতো করে নিজস্ব দর্শন ও মতবাদ প্রচার করলেন, আর তার জন্যে বেছে নিলেন জনগণের মুখের ভাষা, প্রাকৃতকে। যে কারণে সারাদেশে বুদ্ধদেব এবং তাঁর দর্শন অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেল। সুতরাং বুদ্ধদেব এবং তাঁর শিষ্যরাই প্রথমে লোকসমাজের ভাষাকে সাহিত্যে তুলে নিয়ে এলেন।    
দেশের এক এক অঞ্চলে প্রাকৃতের এক এক রকম রূপ ছিল। ভাষা-প্রবাহের সাধারণ নিয়ম মেনেই সেই কথ্য ভাষাও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল না। সময়ের সঙ্গে তা বদলাতে থাকল। সেই সময়ের অভিজাত-সমাজ সেই ভাষা পছন্দ করলেন না, কারণ তাঁরা মনে করলেন এতে ব্রাহ্মণ্যবাদের পবিত্রতা বা শুদ্ধতা নষ্ট হচ্ছে। পতিত জনগণের দ্বারা দেবভাষা দূষিত হচ্ছে। অন্ত্যজ জনগণের বিকৃত ও আড়ষ্ঠ উচ্চারণে ভেঙে যাওয়া সেই ভাষাকে মার্জনা করে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নিজেদের জন্যে একটা প্রামাণিক ভাষা তৈরি করলেন, অভিজাত ও ভদ্রলোকেদের ভাষা; তার নাম হল সংস্কৃত; যদিও তা হল পুরোপুরি সাহিত্যের ভাষা। 
সময় গড়িয়ে চলল। মহাকাব্য-পুরাণ-ধর্মশাস্ত্র লেখা হতে লাগল। সবই সংস্কৃতে। 
এরপর সংস্কৃত ভাষার উপর দ্বিতীয় ঝটকাটা এল সংস্কৃত নাট্যকারদের কাছ থেকে। এতদিন দেখা যাচ্ছিল মহাকাব্য ও পুরাণে আর্য নারী-পুরুষ ছাড়াও অনার্য দৈত্য-দানব-রাক্ষস-বানর-অসুর গোষ্ঠীর লোকজনের মুখে তাদের নিজস্ব ভাষা দেওয়া হয়নি, তারা সকলেই কথা বলছে বিশুদ্ধ সংস্কৃতে। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য-সমাজের তৈরি করা ভাষায়। এটা ছিল ভাষা আধিপত্যের বা ভাষা-আগ্রাসনের ভালো নমুনা। অনার্য মানুষদের মুখেও ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নিজেদের ভাষা বসিয়ে দিয়ে তাদের বাক-স্বাধীনতা হরণ করেছিল। শাসক, অভিজাত এবং বুদ্ধিজীবী সকলেই চেয়েছিল সমাজের নীচের মহলের লোকেরা নিজেদের ভাষা-সত্তা বিসর্জন দিক।   
কিন্তু ভাস-শূদ্রক-কালিদাসের নাটকে সেটা সম্ভব হল না। তখন সমাজ অনেক বদলে গেছে। সংস্কৃত নাটকে দেখা গেল, আর্য-পুরুষরাই শুধু সংস্কৃতে কথা বলছে, নীচ কুলের মানুষজন বা তথাকথিত ছোটোলোকেরা তাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলছে, গান গাইছে, এমনকি সেখানে নারী-চরিত্রদের মুখের ভাষাও প্রাকৃত। এই ঘটনা প্রাকৃতজনের মুখে সংস্কৃতকে চাপিয়ে দেবার চেষ্টার বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্রোহ ও প্রতিবাদ।  
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলাতে লাগল সমাজ। তার চেহারায় নানা ওলট-পালট চলল।  
বুদ্ধধর্মের চোখ-ধাঁধাঁনো জনপ্রিয়তায় হাজার বছর নিষ্প্রভ হয়ে থাকার পরে ব্রাহ্মণ্যধর্ম আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইল এবং প্রতি-বিপ্লবের ধাঁচে বুদ্ধ-অনুরাগীদের উপর প্রচণ্ড আঘাত হানল।
আর কী আশ্চর্য দেখুন, ব্রাহ্মণ্যধর্মের এই পুনরুত্থান ব্রাহ্মণ্যধর্মের জন্মভূমি আর্যাবর্ত বা উত্তর-ভারত থেকে হল না, হল অনার্য অধ্যূষিত দক্ষিণ-ভারত অর্থাৎ দ্রাবিড়ভূমি থেকে। নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে তাঁরা বহিরাগত ব্রাহ্মণ্যধর্মের তাঁবেদারি শুরু করল। এই প্রতি-বিপ্লবের নেতৃত্ব দিলেন আদি শংকরাচার্য। এই ধাপে অজস্র বৌদ্ধমঠ ধ্বংস করা হল, বৌদ্ধ পুঁথিপত্র বা সাহিত্যিক নিদর্শন নির্বিচারে নষ্ট করা হল, মুখোমুখি তর্কে হারিয়ে অনেক বৌদ্ধ পণ্ডিতকে গরম তেলের কড়াইয়ে পুড়ে মরতে বাধ্য করা হল; বাকি বৌদ্ধরা প্রাণ বাঁচাতে দলে দলে শাস্ত্র-পুঁথি বগলদাবা করে আশ্রয় নিলেন প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও তিব্বতে। কী দুর্ভাগ্য দেখুন, বুদ্ধদেবের নিজের জন্মভূমি থেকেই বৌদ্ধ-সন্ন্যাসীদের এবং বুদ্ধ-সাহিত্যকে চিরতরে নির্বাসিত করা হল। 
যদিও বুদ্ধধর্ম নিশ্চিহ্ন হয়েও হল না। তার শেষ নিদর্শন টিকে রইল খানা-খন্দে ভরা এই বঙ্গভূমি এবং তার সংলগ্ন উড়িষ্যা ও আসামের বিস্তীর্ণ দুর্গম অঞ্চলে। নিম্নকোটীর অনার্য জনগণের মধ্যে।
এই পর্বে যেটা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, বাঙালি জাতিসত্তার নির্মাণ ও বিকাশ শুরু হল সেই বৌদ্ধযোগীদের হাত ধরেই। ভুলে গেলে চলবে না, আত্মপ্রকাশের প্রথম-পর্বে গোটা বাংলাই ছিল বৌদ্ধ-বাংলা। তথাগতের ভক্তদের ছোঁয়া পেয়ে বাংলা-ভাষা ও সাহিত্যের শুরু হয়েছিল। সেই জায়মান বাংলা-ভাষাতেই লেখা হল চর্যাপদ। এই ঘটনা অবশ্যই তখনকার দিনে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে জাঁকিয়ে বসা ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক নিঃশব্দ বিপ্লব। এক ভাষা-বিপ্লব।  
সিদ্ধাইযোগীরা নিজেদের সহজ সাধনার কথা প্রচার করার জন্য বেছে নিলেন খেটে-খাওয়া মানুষের মুখের ভাষাকেই। চর্যগীতিতে তুলে ধরলেন সেই সময়ের সাধারণ মানুষের রোজকার জীবনের নানান ছবি। সেখানে সমাজের অভিজাত মহলের কোনো সংবাদই রইল না। শাস্ত্র-পুরাণ রইল না। তার মানে চর্যাপদের গীতিকারেরা তাঁদের দেহতত্ত্বের গানে সাবলটার্ন মানুষদের কথা বললেন প্রান্তজনের মুখের ভাষাতেই। সাহিত্যের ভাষা আর ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত বা টোলের অধ্যাপকদের দখলে থাকল না; সিদ্ধাই-যোগীরা ব্রাহ্মণ-গুরুর পাশেই বসিয়ে দিলেন অচ্ছুত চণ্ডালীকে। এইভাবে চিরকেলে ঘাড়ব্যাঁকা বাঙালি সেই হাজার বছর আগের বাংলায় ঘটিয়ে দিল এক গুরুচণ্ডালী দোষ।  
চর্যাপদ যখন লেখা হয় তখন ছিল পালবংশের শাসন। পাল-রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ । তারপর শাসন চলে গেল ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন-রাজাদের দখলে। সেন-রাজারাও আদতে দক্ষিণ-ভারতীয়। গোঁড়া ও রক্ষণশীল। বঙ্গভূমির রাজসভা ও অভিজাত-সমাজে কদর পেল সংস্কৃত ভাষার চর্চা। সেনরাজাদের দরবারে জনগণের মুখের ভাষা বাংলা ব্রাত্যই থেকে গেল। যদিও কবি জয়দেব সংস্কৃত সাহিত্যের শেষ মাস্টারপিস হিসেবে যে ‘গীতগোবিন্দ’ লিখলেন, তার ভাষাকে সংস্কৃত বলে চেনা গেল না, সেই সংস্কৃত হল বাংলাঘেঁষা। উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতের মৌলবাদী ব্রাহ্মণ্য-সমাজ সেই ভাষাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বললেন এটা গৌড়ীয়-রীতি, সেখানে আছে অক্ষর-ডম্বর ও অলঙ্কার-ডম্বর, যা সংস্কৃতের পক্ষে আদর্শ নয়। সুতরাং সেই সাহিত্যকে বর্জন করা হোক। কিন্তু সমাজের কেষ্ট-বিষ্টুরা নিদান দিলে কী হবে, তার ভাষা ও সাহিত্য-রসের কারণে গীতগোবিন্দ পেয়ে গেল অসাধারণ জনপ্রিয়তা। আরো একবার পূর্ব-ভারতের মানুষদের উচ্চারণে বদলে যাওয়া ভাষার জয় ঘোষিত হল। 
সেন রাজাদের পর বাংলার বুকে নেমে এল তুর্কি শাসন। বহিরাগতদের আমলে ভাষা বা সাহিত্যের চর্চার কী দশা হল, তার কিছুই বোঝা গেল না। চর্যাপদের পর দুশো বছর একদম ফাঁকা। সেই সময়ের বাংলা-সাহিত্যের কোনো নিদর্শন আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। পণ্ডিতেরা এই সময়ের নাম দিলেন অন্ধকার-যুগ। বিদেশিদের শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালিরা মুখে রা কাড়ল না। আত্মরক্ষার এই নীতিকে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বললেন ‘কমোঠ-বৃত্তি’। কমোঠ মানে কচ্ছপ, বিপদের সামনে কচ্ছপ যেমন নিজেকে গুটিয়ে নেয়, মুসলিম শাসকের অত্যাচারের সামনে তেমনি করে বাঙালি দীর্ঘদিন নিজেদের গুটিয়ে রাখল। 
এরপর শুরু হল মধ্যযুগ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা অজস্র ডালপালা গজিয়ে নানা দিকে নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ল। ভাষা-সাহিত্যের সেই অসাধারণ ও বিপুল-সম্পদ আজও বাঙালির গর্ব। তার মধ্যেই ধরা আছে বাঙালি সত্তার নির্মাণ ও বিকাশের নানান ধাপ। যদিও সেই মধ্যযুগের মুঘল আমলে রাজসভার ভাষা হল ফারসি, সেখানেও বাংলা ভাষা ব্রাত্যই রইল। 
মুসলিম শাসকরা বাংলাকে ব্রাত্য করলেও বাঙালি কিন্তু মুসলিম সংস্কৃতি থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল না। বাংলা ভাষার নমনীয় শব্দভাণ্ডারে অজস্র ফারসি তুর্কি আরবি শব্দ গৃহীত হল। মধ্যযুগের শেষ কবি ভারতচন্দ্র তাঁর অন্নদামঙ্গলে জানিয়ে দিলেন- এবার কহিব ভাষা যাবনি-মিশাল। 
তারপর তো ব্রিটিশ শাসন। ছাপাখানার যুগ। ইংরেজি শিক্ষার শুরু। সেই ইংরেজিকেও বাঙালি গ্রহণ করল নির্দ্বিধায়। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উদ্দীপিত বাঙালি জেগে উঠল নতুন করে। গোটা উনিশ শতক জুড়ে চলল বাঙালির নিজেকে নতুন করে জানার বোঝার ও প্রকাশের পালা। বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালা সংস্কার করে লিখলেন বর্ণপরিচয়। রামমোহন বিদ্যাসাগরের হাত ধরে যাত্রা শুরু হল বাংলা-গদ্যের। নিধুবাবু বা রামনিধিগুপ্ত গান লিখলেন- ‘নানান দেশের নানান ভাষা/ বিনে স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা’। নিজেদের সেই মাতৃভাষায় বাঙালি লিখল আধুনিক সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে বাংলা সাহিত্য জায়গা পেল বিশ্বের দরবারে। মাতৃভাষার জোরেই বাঙালি মনীষীরা মাথা উঁচু করে ভারতীয় ধর্ম সমাজ সাহিত্য সংস্কৃতি ও  রাজনীতিতে নানা সংস্কারের কাজ করলেন। ভারতবাসীকে বুঝিয়ে দিলেন একটা আঞ্চলিক ভাষার শক্তি কত। 
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাধীনতার পরে সেই বাঙালির বাসভূমি সমাজ সংস্কৃতি ধর্ম ও ভাষা আক্রান্ত হল নানা ভাবে। এই আক্রমণটা এল স্বাধীনদেশে কেন্দ্রের শাসকদের কাছ থেকে। তারা ক্ষমতার লোভে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ করল, তার চরম মূল্য চোকাতে হল বাঙালিকে। ধর্মের ভিত্তিতে বাংলাও ভাগ হয়ে গেল, একদা পূর্ববঙ্গ হয়ে গেল পূর্ব-পাকিস্তান। পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে সে হল বিদেশ। আবার দেখুন, ধর্মীয় উন্মাদনায় মেতে পূর্ববঙ্গের জনগণ পাকিস্তানে যোগ দিলেও যখন পশ্চিম-পাকিস্তানের শাসকরা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বানাতে চেয়ে তাদের উপর জোরদবস্তি শুরু করল, তখন বাংলাভাষার উপর নির্ভর করে পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষদের মধ্যে জেগে উঠল বাঙালি জাতিসত্তা। যার ফলশ্রুতি ভাষা আন্দোলন, ২১ ফেব্রুয়ারি, এবং শেষমেশ এক রক্তক্ষয়ী লড়ায়ের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ। এইভাবে ওপার-বাংলার মানুষেরা নিজেদের মাতৃভূমির জন্য লড়াই করলেন নিজেদের মাতৃভাষায়। 
এপার বাংলার পরিস্থিতিটা হল অন্য রকম, আসামে বরাক উপত্যকার শিলচরে বাংলা-ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন হল, শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি চলল, শহিদ হলেন ১১ জন। সেই ঘটনার স্মরণেই আজকের এই অনুষ্ঠান। 
এই প্রসঙ্গে আরো দুটো ঘটনার উল্লেখ জরুরি। তার প্রথমটা হল, স্বাধীনতার পরেই পশ্চিম-বাংলার অস্তিত্বকে বিলুপ্ত করার জন্যে তৎকালীন কেন্দ্রীয় শাসকরা পশ্চিমবঙ্গকে বিহারের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে গঠন করতে চেয়েছিলেন পূর্ব-প্রদেশ। আমাদের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ও তাতে সায় দিয়েছিলেন, কিন্তু জন্মবিদ্রোহী বাঙালির প্রবল আন্দোলনের চাপে কেন্দ্রের ও রাজ্যের কংগ্রেস সরকার সেটা আর করে উঠতে পারল না। 
দ্বিতীয় ঘটনা, তখনকার মানভূম জেলার বাঙালিদের ভাষা-আন্দোলন। স্বাধীনতার পর মানভূম ছিল বিহার রাজ্যের মধ্যে, সেখানে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তাদের উপর জোর করে হিন্দি চাপানোর চেষ্টা চলেছিল। তার বিরুদ্ধে সেখানকার বাঙালিরা জোটবদ্ধ আন্দোলন করেছিলেন। এই আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল টুসুগান। টুসুগান গেয়েই শুরু হয়েছিল সত্যাগ্রহ, প্রতিবাদ। এই জনপ্রিয় লোকগানের কথা ও সুর প্রান্তিক জনগণের প্রতিবাদ আন্দোলনকে যে কতখানি উদ্বুদ্ধ করতে পারে তার উদাহরণ এই টুসুগান। সত্যাগ্রহের নামই হয়ে গেল টুসু-সত্যাগ্রহ। যথারীতি আন্দোলন প্রতিহত করতে বিহার সরকার প্রচণ্ড দমন-পীড়ন চালাতে লাগল। কিন্তু সত্যাগ্রহীদের থামানো গেল না। ভজহরি মাহাত গান বাঁধলেন- শোন বিহারি ভাই, মোদের রাখতে লারবি ডাঙ দেখাই। তারপর ১৯৫৬ সালের ২০ এপ্রিল শুরু হল বিখ্যাত পদযাত্রা, মানভূম থেকে কলকাতা পর্যন্ত। টুসুগান গাইতে গাইতে হাজার মানুষ সেই মিছিলে পথ হাঁটলেন। অবশেষে কেন্দ্রীয়-সরকার ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর পুরুলিয়াকে আলাদা জেলা হিসেবে ঘোষণা করে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে জুড়ে দিতে বাধ্য হল। পুরুলিয়াবাসীর টুসু-সত্যাগ্রহ সফল হল। 
এই সেদিনের কথা, অথচ সবচেয়ে পুরোনো এবং সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী (১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত) সেই আন্দোলনের ইতিহাস কেন্দ্রের শাসক দল আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছে, রাজ্যের শাসক এবং নাগরিক সমাজও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। ভাষা-রাজনীতির কী অদ্ভূত গতি-প্রকৃতি। 
মুখে যতই বলি না কেন, ‘মোদের গরব মোদের আশা আ-মরি বাংলা ভাষা’, আসলে নিজেদের মাতৃভাষা নিয়ে নাগরিক সমাজের সেই আবেগ বা দরদ কোনোটাই নেই। তাঁদের সব বাগাড়ম্ভর ড্রয়িংরুম এবং সোশালমিডিয়া-কেন্দ্রিক। ভাষার জন্যে পথে নামা, আন্দোলন করা, শাসককে শঙ্কিত করা এসব ব্যাপার তাঁদের কুষ্ঠি-ঠিকুজিতে নেই। সেই সংবেদনশীলতা থাকলে শহর কলকাতায় উপযুক্ত মর্যাদায় পুরুলিয়া-দিবসও উদযাপিত হত।
জরুরি অবস্থার সময় কেন্দ্রের শাসক দল ঘোষিতভাবে নাগরিকদের বাকস্বাধীনতা হরণ করেছিল, আজকের এই অঘোষিত জরুরি অবস্থায় বাকস্বাধীনতার অবস্থা আরো করুণ। সব জায়গায় কর্তাবাবুদের ভাষার কী রমরমা। সেখানে স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে নতুন সংযোজন ধর্মীয় মৌলবাদ। নতুন স্লোগান হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান। সেখানে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের নামে চালানো হচ্ছে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ; কালচারাল হেগেমনি; তার বিরোধিতা করলে কী ভয়ংকর পরিণাম হতে পারে কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশ, দাভোলকার, পানসারে প্রমুখের হত্যার ঘটনায় তা আমাদের বিলক্ষণ জানা হয়ে গেছে। সেই আতঙ্কে এখন বেশি মুখ খোলা বারণ। এই একবিংশ শতকেও ভাষা-রাজনীতিতে শাসক-দলের এতটাই দাপট। 
আজকের শাসকও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। সেই ক্ষমতার যথেচ্ছাচার ও অপব্যবহার শাসকের মজ্জাগত। তার উপর আছে রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডা যা রাষ্ট্র-অনুমোদিত শিক্ষিত শ্রেণির একটা অংশ এবং রাষ্ট্রের অনুগত মিডিয়া দ্বারা সমর্থিত হচ্ছে; তার কী ভয়াবহ প্রভাব, আমরা তা দেখতেই পাচ্ছি। বহুজাতিক পুঁজিবাদ-পোষিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার নামে ব্যাপক ভাবে অজ্ঞতার চাষ হচ্ছে এবং খুব পরিকল্পিতভাবে অপ্রাসঙ্গিক, অদরকারি,  তুচ্ছ তথ্যের বিরামহীন বন্যায় জনগণের মনোযোগ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ও দরকারি ইস্যুগুলো থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি বহুদিনই কেন্সের ওয়েলফেয়ার-স্টেট ইকোনমির ধারণা থেকে সরে এসেছে।  যার ফলে, এই পোস্টমডার্ন কালখণ্ডে যে সব সৃজনশীলতাহীন সংস্কৃতির মানচিত্র দিয়ে জনগণকে বিমুগ্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে সেগুলো হল জঘন্য সব টিভি-সিরিয়াল, রিয়েলিটি-শো, ওয়েব-সিরিজ, রিডার্স ডাইজেস্ট সংস্কৃতি,  বিজ্ঞাপন, বিপণন, প্রচার, দ্বিতীয় শ্রেণির সিনেমা,  প্যারালিটারেচার নামে পরিচিত তথাকথিত মূলধারার লেখালিখি,  জনপ্রিয় ফিল্মস্টার-ক্রিকেটার প্রভৃতি সেলিব্রিটিদের ব্যক্তিগত জীবনের নানান কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি,  রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতি-স্বজনপোষণ,  যাদের সব কটাই উদারনৈতিক বা বহুজাতিক পুঁজিবাদের অবদান। এই পুঁজিবাদই সমাজকে ব্যাপ্টাইজড করে যেখানে নিয়ে যাচ্ছে তার নাম – কনজিউমার-সোসাইটি, মিডিয়া-সোসাইটি, ইনফরমেশন-সোসাইটি, ইলেকট্রনিক বা হাই-টেকনোলজি-সোসাইটি এই সব।
তবু বলব, আন্দোলনের ভাষা, প্রতিবাদের ভাষা আমাদের মতৃভাষা। বাঙালির মুখের ভাষা কোনোদিনই শাসকের বশ্যতা স্বীকার করেনি। অনেকদিন ব্রাহ্মণ্য শাসনে থেকেও বাঙালি সংস্কৃত-ভাষাকে নিজের করে গ্রহণ করেনি, ছশো বছর মুসলিম শাসনে থেকেও বাঙালি ফারসি বা আরবিকে গ্রহণ করেনি,  আড়াইশো বছর ব্রিটিশ শাসনে থেকেও বাঙালি ইংরেজিতে বিলীন হয়ে যায়নি। আজ আকছার হিন্দি-ব্যবহারের আবহেও সে তার নিজস্বতা বিসর্জন দিতে রাজি নয়। 
এ কথা ভুললে চলবে না, বাংলা ভাষার জন্ম ও বেড়ে ওঠা প্রান্তিকে, লোকসাধারণের মুখে মুখে। নাক-উঁচু বাবু-বিবিদের বৈঠকখানায় নয়, অভিজাতদের মজলিশে নয়, বরং সেই প্রান্তজনের দরবারে যাদের হাত ধরেই একদিন জন্ম নিয়েছিল বাঙালির জাতিসত্তা, বাংলার সাহিত্য। তাদের কল্যাণেই আজ আমরা বাংলায় কথা বলতে পারি, লেখালিখি করতে পারি, বিশ্বের দরবার থেকে নোবেল পুরস্কার ছিনিয়ে আনতে পারি। 
বাংলা ভাষা কোনোদিনই সেভাবে রাজসভা বা অভিজাত সমাজের দাক্ষিণ্য পায়নি। সেন আমলে রাজভাষা ছিল সংস্কৃত, মুসলিম আমলে ফারসি, ব্রিটিশ আমলে ইংরেজি। আমরা যাঁকে বীরবল বলে চিনি সেই প্রমথ চৌধুরী একটা লেখায় বলেছিলেন বাংলা কোনোদিনই পলান্নের ভাষা ছিল না, তা বরাবরই শাকান্নের ভাষা। আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও বাংলা সেই শাকান্নের ভাষা হয়েই রয়ে গেছে, আজো সরকারি ভাষা হিসেবে তার কোনো স্বীকৃতি নেই। 
সরকারি অবহেলায় অনেক বাংলা স্কুল আজ উঠে যাবার মুখে, সমস্ত শিক্ষা-ব্যবস্থাকে বেসরকারিকরণ করে কর্পোরেট পুঁজির হাতে তুলে দেবার এক জঘন্য এবং গোপন চক্রান্ত শুরু হয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় অলিতে-গলিতে বাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুল। আজো রাজ্যের শাসকদের পক্ষ থেকে এখানকার ইংরেজি মিডিয়াম ইস্কুলগুলোতে বাংলা ভাষা-শিক্ষাকে আবশ্যিক করার কোনো গরজ নেই, যদিও অন্যান্য অনেক রাজ্য ইতিমধ্যেই এটা করে দেখিয়েছে। 
আমাদের মাতৃভাষা, বাংলা; কে তাকে সম্মান করলো, কে করল না, তাতে অবশ্য তার কিছুই যায় আসে না। তার জন্ম যে প্রান্তিকে, সেই প্রান্তবাসী-জনগণই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সেই বাংলা ভাষা আপন খেয়ালে পথ চলে। অদম্য তার প্রাণশক্তি। সেই প্রাণশক্তির জোরেই, অজস্র তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য-নিন্দা-অবহেলা ও বঞ্চনা উপেক্ষা করে, বাংলা-ভাষা হাজার বছরের উপর বেঁচে আছে, এবং বেঁচে থাকবে আরো হাজার হাজার বছর। এটা কোনো আবেগের কথা নয়, ঐতিহাসিক ভাবেই তা প্রমাণিত। 





মুরারি সিংহ

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন