আদি পর্ব

সলিলা বলল, আরে, দ্যাখো, দ্যাখো, কতো টাকা, দুহাজার আর পাঁচশো টাকার নোট, বালতি ভরা জল যেমন ছুঁড়ে ফেলা হয়, তেমন করে টাকাগুলো থলে থেকে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলেছে। কতো বোকা মেয়েটা আর মোটা লোকটা, একটা কাউন্টিঙ মেশিন কিনলে গুনে-গুনে সাজিয়ে রাখতে পারতো, সাধারণ মানুষের চোখে টাকার পিণ্ডি-চটকানোটা  এরকম চোখে লাগতো না।

দেখলুম, টিভিতে নয়, মোবাইলে । সত্যিই, সাধারণ মানুষের আঁতে লেগেছে ; টাকাকে ওইভাবে অশ্রদ্ধা করাটাই তারা মেনে নিতে পারেনি, তাও কোটি-কোটি ফ্রেশ টাকা । তাদের কাছে কেলেঙ্কারিটা টাকার অপমানকে ঘিরে, কালোটাকা নিয়ে ততোটা নয় ।  যে যুবতীকে বার-বার দেখানো হচ্ছে, তার মতনই ফ্রেশ টাকাগুলো।

সলিলা বলল, তুমি যখন ভেরিভিকেশানে নোট পোড়াবার অফিসার ছিলে, তখনও তো নোটের পাহাড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে ।

–হ্যাঁ, পচা, স্যাঁতসেতে, চটচটে, ছাতাপড়া, দুর্গন্ধে হাঁপিয়ে পড়ার পাহাড় । ভাগ্যিস ওই চাকরি ছেড়ে গ্রামীণ উন্নয়নের চাকরিটা পেলুম । কিন্তু সেসময়ে কাউন্টিঙ মেশিন ছিল না ; হয়তো ছিল, আমাদের দেশে আমদানি হয়নি । আমার স্টাফরা হাতে গুনতো,ওদের যে-কটা প্যাকেট দিতুম স্যাম্পল কাউন্টিঙের জন্য । ওদেরও হাতে আর লাংসে নানা অসুখ দেখা দিতো, যদিও অফিস থেকে অ্যাসপিরিনের কোটা ছিল ।

–সুন্দরী মেয়েরা সব সময় দেখি বিটকেল চেহারার পুরুষদের পছন্দ করে ।  

–যেমন মেরি সেটন, যিনি ভি. কে. কৃষ্ণমেননের প্রেমে পড়েছিলেন। ওনাদের সম্পর্কের ভাঙনের ফলে ১৯৩৫ সালে কৃষ্ণমেননকে লণ্ডনের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল । ব্যর্থ প্রেমে উনি আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন ।

–মেরি সেটনই তো সত্যজিৎ রায়, সের্গেই আইজেনস্টাইন আর জওহরলাল নেহেরুর জীবনী লিখেছেন । কৃষ্ণমেননকে দেখতে অমন হলেও, শুনেছি লণ্ডনে ওনার অসংখ্য অনুরাগিনী ছিল । স্বাধীন ভারতে আদি পর্বটা কিন্তু মেননই শুরু করেছিলেন ।

–মেরি সেটনই তো সত্যজিৎ রায়, সের্গেই আইজেনস্টাইন আর জওহরলাল নেহেরুর জীবনী লিখেছেন । কৃষ্ণমেননকে দেখতে অমন হলেও, শুনেছি লণ্ডনে ওনার অসংখ্য অনুরাগিনী ছিল । স্বাধীন ভারতে আদি পর্বটা কিন্তু মেননই শুরু করেছিলেন । ১৯৪৭-৪৮ সালে, দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে, পাকিস্তান দখল করতে চাইছে কাশ্মীর, তার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ভারতের আরও কিছু জিপ গাড়ির দরকার ছিল। তখন ব্রিটেনের ভারতীয় হাইকমিশনার ভি. কে. কৃষ্ণ মেনন পুরোনো মেরামত করা ২০০০ জিপ কেনার জন্য  অর্ডার দেন ৷ ওই পুরনো  জীপ কিনতে যে দাম দেওয়া হচ্ছিল সেই  দামেই নতুন জীপ কেনা যেত আমেরিকা বা কানাডা থেকে । নাম না-জানা  যে অ্যান্টি-মিস্টান্টেসকে জিপগুলো সরবরাহ করার জন্য বরাত দেওয়া হয়েছিল, তার মূলধন ছিল মাত্র ৬০৫ পাউন্ড। কৃষ্ণমেনন এজন্য ১৭২০০০ ডলার দিতে রাজি হন ।তার মধ্যে মোট পেমেন্টের ৬৫% কোনো পরিদর্শন শংসাপত্র ছাড়াই দেওয়া হয় আর ডেলিভারি দেওয়ার সময় ২০% । বাদবাকি টাকা ডেলিভারি হওয়ার এক মাস পরে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়৷ কোম্পানিটি অবশ্য দুই বছরে মাত্র ৫৯টি জিপ সরবরাহ করে  সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করে।ব্রিটেন কর্তৃক জিপগুলির অর্থ প্রদান ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ভারতকে ব্রিটিশ যুদ্ধ ঋণের অংশ হিসেবে ।  মেনন এই চুক্তিতে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন। মেনন প্রোটোকল এড়িয়ে একটি ৮০ লক্ষ টাকার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন । যদিও বেশিরভাগ টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছিল , মাত্র ১৫৫টা জিপ ডেলিভারি করা হয়েছিল ; যদিও প্রটোকল অনুসারে মেননকে পদত্যাগ করে ভারতে ফিরে আসতে বলা হয়, তবে নেহেরু সরকারকে জিপগুলি গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিলেন । এদিকে চুক্তির তথ্য ভারতে পৌঁছলে এখানকার সংসদ সহ গোটা দেশে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয় ।

–তুমি যে মোটা লোকটার কথা বলছ, তারও অনুরাগিণীর সংখ্যা কম নয় । পবিত্র সরকার এতো রেগে গেছেন যে বলেছেন লোকটার  হারেম । মেনন যদিও শুধু মেরি সেটনের প্রেমে পড়িছিলেন । ওনার জিপ কেনার কেলেঙ্কারি তদন্ত করেছিল আয়ঙ্গার সাব-কমিটি আর ১৯৫১ সালের ৯ই এপ্রিল নেহরুর কাছে পেশ করা রিপোর্টে গোলমালের তথ্যগুলো ছিল। তবে ১৯৫৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্ত আর ভারত সরকার ঘোষণা করে যে জীপ কেলেঙ্কারি সংক্রান্ত মামলার বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে । এই ভাবে অনন্তশয়নাম আয়ঙ্গার নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটির পরামর্শ উপেক্ষা করা হয়। তখন তিনি ঘোষণা করেছিলেন , ‘‘ সরকার যে ভাবে উদ্বিগ্ন ছিল তারই প্রেক্ষিতে বিষয়টি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।বিরোধীরা সন্তুষ্ট না হলে তারা এটাকে নির্বাচনী ইস্যুতে পরিণত করতে পারে ৷ ’’ এর পরেই, ১৯৫৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি, মেননকে কোনও পোর্টফোলিও ছাড়াই অবশ্য মন্ত্রী হিসেবে নেহরু মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে মেনন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বিশ্বস্ত বন্ধু হন। মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত সচিব , ইউ ভি কল্যাণম , এক সংবাদপত্রের সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, এটা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে নেহরু, কৃষ্ণমেননের মতো দুর্নীতিবাজ সহকর্মী তৈরি করেছিলেন যিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী থাকাকালীন কুখ্যাত ' জীপ কেলেঙ্কারি 'তে জড়িয়ে পড়েন৷

–ভারতীয় রাজনীতিকদের দুর্নীতির দায়ে শাস্তি দেওয়া খুবই কঠিন। কোনো কিছুই প্রমাণ হয় না, যদি শাসকের সঙ্গে একটু আপোস করা যায়। বোফর্সে রাজীব, হাওলায় নরসিংহ রাও, সাংসদ কেনাবেচায় শিব সোরেন, নারদা-সারদা-রোজভ্যালিতে তৃণমূল, কফিন কেলেঙ্কারিতে জর্জ ফার্নান্ডেজ, সঙ্গতিহীন সম্পদে মুলায়ম সিং বা মায়াবতী, ২জি কেলেঙ্কারিতে এ রাজা-কানিমোঝি, কমনওয়েলথ গেমস দুর্নীতিতে সুরেশ কালমাদি, গুজরাট গণহত্যায় নরেন্দ্র মোদি, সোহরাবুদ্দিন শেখ হত্যায় ও বিচারপতি লোয়ার মৃত্যুতে অমিত শাহ, কেউই দোষী সাব্যস্ত হয়নি। সকলেই ধোয়া তুলসি পাতা। ব্যতিক্রম কেবল লালু প্রসাদ যাদব। কারণ তিনি আদবানির রথ রুখেছিলেন ও সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে বিজেপির সঙ্গে আপোস করেননি।


মলয় রায়চৌধুরী


 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন