মহুয়ার নেশায় 

(ছোটগল্প) 


স্কুল থেকে বদলির অর্ডারটা অবশেষে চলেই এল। বাড়ি থেকে খেয়ে পড়ে মায়ের আদরে, বাবার স্নেহে ছিলাম। আর তার উপায় রইলো না। হাওড়া থেকে সেই সুদূর বাঁকুড়ায় বদলি হয়েছে আমার। বাড়ির মানুষগুলোর কথা বাদ দিলে একদিকে এই বদলিতে আমি খুশী। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল গ্রাম-গঞ্জ ঘুরে বেড়াবো। বিভিন্ন গ্রাম, সেখানকার মানুষ-জন, তাদের সংস্কৃতিকে চিনবো, জানবো।বাংলার মাটিতেই কত অজানা স্থান আছে যা কাশ্মীর, কুলু-মানালির সৌন্দর্যকেও হার মানায়। সেইসব সৌন্দর্য মন-প্রাণ ভরে উপভোগ করব। এরই নাম তো জীবন।

কখনই মনের কোণায় কাউকে বিয়ে করার কথা মাথায় আসেনি। মা, বাবা বহুবার বুঝিয়েছে বটে! তবে, স্বাধীনচেতা এই জীবনে অন্য কাউকে জড়াতে ভয় লাগে। অপরজন যদি আমার মত না হয়। এখনকার মেয়েরা কি গাঁয়ে গঞ্জে মানিয়ে নিয়ে চলতে পারবে??? আমার চেনা একজন ছিল, সে একেবারে অন্য ধাতুতে তৈরী। তার জীবন যাপন, ভাবনা-চিন্তা এখনকার মেয়েদের সাথে কানাকড়িও মেলে না। ভগবান বোধহয় তাকে খুব যত্নে তৈরী করেছেন, তাই তো সে ছিল সবার চেয়ে আলাদা, আমার চোখে সে ছিল অনন্যা।

আমার স্কুলে যোগ দেওয়ার দিন ছিল পয়লা বৈশাখের পরেরদিন। তাই সময় নষ্ট না করে আমি রওনা হয়ে যাই তার ঠিক একদিন আগে। হাতে দুদিন সময় রাখা ভালো। যে জায়গায় শিক্ষকতা করতে চলেছি, তার চারপাশের হাল-চাল বুঝে নিলে তা আমার কাজের ক্ষেত্রে অনেকটা সহজ হয়ে যাবে।

লাগেজ সমেত বাসটা আমাকে ভরদুপুর বেলা একটা কাঁচা মাটির রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে ধুলো ওড়াতে ওড়াতে আমার দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।কাঠফাটা রোদের মধ্যে একবার রাস্তার এপাশ ওপাশ তাকিয়ে দেখতে পেলাম অনেকটা দূরে মাঠে কিছু লোক মাটি কোপানোর কাজ করছে। তাদের উদ্দেশ্যে হাঁক পড়লাম, ' ও ভাই শুনছেন,,,,, এই.....এই যে এদিকে, একবার এইদিকে আসবেন।'
আমার হাঁকডাক শুনে তারা কাজ ফেলে ছুটে এল আমার কাছে। লোকগুলো হাঁফাতে হাঁফাতে বলে উঠল,' কি ব্যাপার কত্তা? এত হাঁক ডাক কিসের জন্য???' সংক্ষেপে আমার পরিচয় তাদেরকে দিয়ে স্কুলের ঠিকানা বললাম। আমার সমস্ত কথা শুনে তারা যেন মনে হল সাক্ষাৎ মানবরূপী ভগবানের দেখা পেয়ে গেছে। চারিদিকে শোরগোল ফেলে দিল সকলে। গ্রামের নতুন মাষ্টার, না কি সদ্য বিবাহিত নতুন জামাই এসেছে .....ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না তাদের ব্যবহারে। এটুকু বুঝলাম গ্রামের মানুষগুলো বড্ড ভালো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই একটা গরুর গাড়ীর জোগাড় হয়ে গেল। মিনিট দশেকের রাস্তা আসতে মিনিট পঁচিশ লেগে গেল। ততক্ষণে আমার পিঠ, কোমড় টনটন করতে শুরু করেছে। গরুর গাড়ি এসে দাঁড়ালো কোয়ার্টারের সামনে। কোয়ার্টার কম, পরিত্যক্ত বাড়ি বেশী বলা চলে। ঐ মাথা গোঁজার ঠাঁই আর কি। গাড়োয়ানকে পয়সা মেটাতে গেলে সে তো পয়সা নিলই না বরং আমার লাগেজ ব্যাগটা কোয়ার্টার পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এল। যাবার সময় আমায় সেই বাবার বয়সী গাড়োয়ান হাজার মানা সত্বেও প্রণাম করে তবে বিদায় নিল। কোয়ার্টারে ঢোকার মুখে আলাপ হল আমার কলিগ কাম স্কুলের অন্য একজন শিক্ষক মধুকান্ত রায়ের সাথে। বয়স আমার থেকে দুগুণ। অবসর হতে আর মাত্র একবছর হাতে আছে। উনি আমাকে গ্রাম, স্কুল সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য প্রদান করলেন। খুব অল্প সময়ে ভাব জমে গেল প্রাণখোলা মানুষটার সাথে।ওনার সাথে কথা বলে বুঝলাম এই গ্রামে এই একটি মাত্র সরকারী স্কুল। উনি ছাড়া বাকি যে দুজন মাষ্টার আছেন তারা নামেই মাষ্টার কাজে তারা এক নম্বরের ফাঁকিবাজ। এই স্কুলের হেড স্যার সদানন্দ বাবু ভীষণ সজ্জন ব্যক্তি। স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য উনি প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। স্কুলটিতে উচ্চ শিক্ষার পঠনপাঠনের ব্যবস্থা থাকলেও সরকারী সমস্ত অনুদান আসার আগেই হাপিস হয়ে যায়। ফলে উচচবিদ্যালয় এখন পাঠশালায় রূপান্তরিত হয়েছে। শ দুয়েক গ্রামের ছেলে মেয়ে যারা পড়তে আসে তারা প্রত্যেকেই মিড ডে মিলের টানে স্কুলে আসে। তাও কোন কোন দিন তাদের ভাগ্যে জোটেনা। স্কুলের বাকি মাস্টারেরা ছুটিতে বাড়ি গেছে, কোয়ার্টারে এখন মানুষ বলতে আমি মধুকান্ত বাবু এবং কেয়ারটেকার ফল্গু দা। হেড স্যার সদানন্দ বাবু তার নিজের মাটির বাড়িতে পরিবারের সাথে থাকেন। এতটুকু বলে মধুকান্ত বাবু খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। এইসময় ফল্গু দা এক কাপ করে গরম চা ও সিঙাড়া ভেজে দিয়ে গেল, যেগুলোর আমার ভীষণ প্রয়োজন ছিল। চা, সিঙাড়া শেষ করে মধুকান্ত বাবু বললেন, 'চলো ভায়া তোমাকে রঘুবীর মন্দিরটা ঘুরিয়ে আনি। সারা বৈশাখ জুড়ে ওখানে উৎসব চলে। নববর্ষের আগের দিন থেকে এর শুভারম্ভ হয়ে থাকে। মেলা বসে, হাট বসে। গ্রামের লোক আমোদ-আল্হাদে মেতে ওঠে। সবথেকে বড় ব্যাপার কি জানো?? এখানে নববর্ষে লক্ষী গণেশ নয় বরং লক্ষী-নারায়ণনের মূর্তি পূজা হয়। অবশ্য যুগের পর যুগ ধরে এই নিয়মই চলে আসছে। আরও একটা আর্কষণ আছে। সেটা হল 'মহুয়া মায়ে'র বাউল গান। ও গান শুনলে তুমি পাগল হয়ে যাবে। বাকি কথা পথে যেতে যেতে বলছি। এখন চলো আমার সাথে। দেরী করলে বাউল গান শুরু হয়ে যাবে।'

'মহুয়া' নামটা শুনতেই গা টা কেমন শিরশিরিয়ে ওঠে। নামটা শুনেই মনে হয় এ আমার পরিচিত, ভীষণ পরিচিত কেউ......। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় এ অসম্ভব।

' আরে ভাই! ভাবনা -চিন্তা বন্ধ রেখে এখন আমার সাথে চলোতো দেখি। ফল্গু ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ করে তুইও আস্তে আস্তে চলে আয়, দেরী করিস নে।' মধুকান্ত বাবুর পেছনে পেছনে কাঁচা মাটির পথ ধরে চলতে শুরু করলাম। যত হাঁটছি, চারিদিকের প্রাকৃতিক শোভার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। এই অপার সৌন্দর্য বর্ণনা ভাষাতে প্রকাশ একেবারেই সম্ভবপর নয়। মিনিট দশেক হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। রঘুনাথ মন্দির এবং ঐ সংলগ্ন মেলা ও হাট প্রাঙ্গণ ঘিরে গ্রামের মানুষের মনে খুশির জোয়ার বইছে। এরা এতটাই সরল যে, প্রতিটা ছোট ছোট জিনিসে নিজেদের সুখ খুঁজে নেয়। না পাওয়া কোন কিছু এদের মধ্যে নেই। শহুরে জন জোয়ার হয়তো গ্রামের মেলায় খুঁজে পেলাম না, তবে যে আন্তরিকতা এবং নতুন মানুষকে অভ্যর্থনা করার যে উচ্চ মানসিকতা ওদের মধ্যে লক্ষ্য করলাম তা বোধহয় গ্রাম বলেই সম্ভব। আমার পরিচয় জানার পর সকলেই আমাকে দেখতে উৎসাহী হয়ে পড়ল। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল তাদের নতুন মাষ্টার মশাইকে। তখন থেকেই পণ করলাম আমি, ভগবান সুযোগ যখন দিয়েছেন এই গ্রাম থেকেই শুরু হবে আমার সমাজ সেবা। এক একটা হীরে এখানে লুকিয়ে আছে, শুধু কয়লার খনি থেকে পরিশুদ্ধির মাধ্যমে তাদের উদ্ধারের অপেক্ষা। এমন সময় মধুকান্ত বাবু সকলকে সরিয়ে আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এলেন মেলা শেষে , যেখান বাউল একটি মেয়ে কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম গেয়ে শোনাচ্ছিল উপস্থিত সকলকে। মধুকান্ত বাবু আমার কানের কাছে মুখটি এনে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন, 'ঐ যে মেয়েটিকে দেখছো, ঐ গ্রামের আট থেকে আশি সকলের 'মহুয়া মা'। ভীষণ সুন্দর গানের গলা। ওর বাউল গান শুনলে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। তবে, কি জানো মেয়েটি এই গাঁয়ে জন্মালেও, উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতার কলেজে পড়াশোনা করেছে। তবে, মানুষের মনের খেয়াল। বাউল বেশে জেলা থেকে জেলা ঘুরে বেড়ায়। এই গ্রামের প্রতিটা মানুষের বিপদে-আপদে পাশে থাকে। বড় ভালো মেয়ে। আর কিছুটা গেলেই ওদের আখড়া। তোমায় কাল বরং নিয়ে যাবো একবার। পরিচয় করিয়ে দেব।'

মধুকান্ত বাবু একটানা কথাগুলো বলে গেলেও আমার কানে একটা শব্দও পৌঁছাছিল না। আমি সামনে তাকিয়ে ছিলাম 'মহুয়া মা' এর দিকে। মনে পড়ে যাচ্ছিল কলেজের নবীনবরণের দিনের কথা।
আমি তখন থার্ড ইয়ারে পড়ি। যেহেতু কলেজ শেষের বছর তাই নবীনবরণের সব ভার আমাদের থার্ড ইয়ারের ছেলে-মেয়েদের ওপর এসে পড়ে। নবীনবরণের দিন যা হয় প্রতিটা কলেজে। অল্প আলাপচারিতা, নাচ, গান, আবৃত্তি কিছু একটা করতে বলা। এই সবই চলছিল। আধুনিক, দাম্ভিক, স্মার্ট মেয়েদের মাঝে একটি মেয়ে আমার দৃষ্টি আর্কষণ করল। সাদামাটা, গলায় তুলসী কাঠির মালা, জটা যুক্ত লম্বা চুল চুড়ো করে বাধা। সবথেকে মনে রাখার মত বিষয় যেটা সেটা হল ওকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, ও কি হতে চায়? খুব সাবলীল ও স্বচ্ছ মনে বলে ওঠে, ' আমি মেয়ে বাউল হতে চাই।' এই কথার পর কলেজের সকলে ওকে নিয়ে মজা -তামাশা শুরু করে। ওকে নিয়ে প্যারোডি গান বানিয়ে গাইতে থাকে। তবে, সে দিন থেকেই কেন জানিনা আমি ওর প্রতি একটা তীব্র আর্কষণ বোধ করি। আর পাঁচজনের থেকে ও বেমানান হলেও বুঝতে পারি মহুয়া সাধারণ নয়। ও যা ভাবে, তার সাথে আমাদের ভাবনার হয়তো কোন মিল থাকেনা। তবে, সেই ভাবনায় গভীর একটি অন্তর্নিহিত অর্থ আছে যা আমাদের বোঝার সাধ্যি নেই। কলেজে যে কটা দিন ছিলাম ওর সাথে মাঝে মাঝেই দেখা হলে কথা হতো। পরে বুঝলাম মনের গহীন কোণে একটা দুর্বলতা ওর জন্য আমি অনুভব করি। কিন্তু এও জানতাম আমার চাওয়া, ভালোলাগা এইসব অলীক সুখ। বাস্তবে এগুলোর কোন নাম দেওয়া যায় না। এ ভালোলাগা পরিচয় বিহীন, নাম না জানা একটা সম্পর্ক। কলেজের শেষের দিনে আমাদের শেষ বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, সেখানে মহুয়া একটি বাউল গান পরিবেশন করে। আজও সেই গানের প্রতিটা লাইন আমার অন্তরে গাঁথা রয়েছে। একসময়ের জন্য এও ভেবেছিলাম হয়তো গানটা আমাকে উদ্দেশ্য করেই গাওয়া। তারপর আবার নিজের অলীক ভাবনায় ছাই চাপা দিয়েছিলাম নিজেই। এতদিনেও ওকে আমি মুছতে পারিনি আমার স্মৃতির পাতা থেকে। আজকে সেই 'মহুয়া' ওরফে ' মহুয়া মা' কে দেখে আমার ভেতরের ভালোলাগার নিভে যাওয়া দীপটা যেন একটু একটু করে আলো ছড়াতে ছড়াতে শিখাটাকে বাড়িয়ে তুলেছে। জানি না এ আমার মনের ভুল নাকি ঠিক???

সেই রাতে আর দুচোখের পাতা এক করতে পারিনা। চোখ বন্ধ করলেই মনের মধ্যে একতারা হাতে এক বাউল মেয়ের অবয়ব ফুটে ওঠে। ঘুমের মধ্যে মধ্যে জেগে উঠি, আর অনবরত জল খাই।

পরদিন সকালে কোনরকমে সকালের খাবারটুকু শেষ করে মধুকান্ত বাবুর সাথে রওনা দি 'মহুয়া মা' য়ের আখড়ায়। মাটির দালানে বসে হাতে ভাজা মুড়ি ও বাতাসা দিয়ে আরও একপ্রস্থ খাওয়া সেরে নিই। কিন্তু আমি যার সাথে আলাপ করতে চাই, যাকে একটিবার দেখতে চাই সে কোথায়??? অন্য এক শিষ্য বাউলের থেকে জানতে পারি তাদের মা গেছেন হরিসভার সূচনায়। অষ্টপ্রহর সেখানে ঠাকুরের নামগান চলবে নববর্ষ উপলক্ষ্যে। অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করেই ফেরৎ আসবেন এখানে। ইতিমধ্যে মধুকান্ত বাবুর হেড স্যারের সাথে জরুরি কিছু কাজ থাকায় তিনি আমাকে ওখানে বসিয়ে রেখে চলে যান। আমি অপেক্ষা করতে থাকি। কিছুটা সময় পর বাইরে এক পরিচিত কন্ঠ স্বর শুনতে পাই, 'জয় গৌর, জয় নিতাই।' পরিচিতার কন্ঠে আমি নড়েচড়ে বসি। মহুয়া বাড়িতে ঢুকে দালানে আমায় বসে থাকতে দেখে আমায় অবাক করে দিয়ে বলে ওঠে, ' শ্রীজিৎ দা শুভ নববর্ষ। গৌরের কৃপায় মঙ্গল হোক তোমার। আমি কালই শুনেছি তুমি এ গাঁয়ে এসেছো সরকারি স্কুলের শিক্ষক হয়ে। আমি খুব খুশী হয়েছি। আজ থেকে এই গাঁয়ের প্রতিটা মানুষের দায়িত্ব ভার তোমার। আমার এখান থেকে আপাতত মুক্তি। '

আমি মহুয়ার কথায় অবাক হয়ে বলি, ' তুমি আমায় চিনতে পেরেছো?? শেষ মেষ সেই বাউল জীবনটাই তুমি বেছে নিলে??'

মহুয়া উদাস হয়ে বলে ওঠে, ' কি করবো বলো?? সংসারের বন্ধন থেকে মুক্ত না হলে মানুষের জন্য কাজ করবো কিভাবে?? আর এ ইচ্ছা তো আমার বহুদিনের। তা তো তোমার অজানা নয়। একতারা হাতে নিলে আমি আর আমার মধ্যে থাকি না গো। আমি তো ভেসে বেড়াই ডানা মেলে। নিতাই গৌরের আশীর্বাদে এই জীবনই আমার শ্রেষ্ঠ জীবন, বুঝলে?'

মহুয়ার কথায় চুপ করে থাকি। এত তত্ত্বকথা বোঝার মত মানষিক ক্ষমতা বোধহয় আমার সত্যি নেই। রোজ যদি ফ্যান ভাত জোটে, তবে পোলাওয়ের স্বাদ যে কিরকম তা আমি জানবো কি করে??'

'এই নাও , নতুন ধান ঝেড়ে সেই চালে পায়েস করে ঈশ্বরকে নিবেদন করা হয়েছে। এই সরা করে রেখে দিলুম একটু। নিয়ে যেও কেমন??? নতুন বছর মিষ্টি দিয়ে শুরু করলে সারা বছরটা মিষ্টি যায়। '

মহুয়ার কথায় আমি দুম করে বলে বসি, 'আর নববর্ষের প্রথম দিনে যদি মনের মানুষের দেখা পাই, তাহলে কি সারাজীবন তার সাথে কাটানো যায় মহুয়া?'

চারিদিকে এক অসীম, অপার নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরল আমাদের দুজনকে। ফস করে কথাটা বলে ফেলে নিজেরও কেমন একটা অপরাধবোধ কাজ করছে। কি জানি মহুয়া কি ভাবছে?? তাই ব্যাপারটাকে সামাল দিতে পায়েসের সরাখানা হাতে নিয়ে বলে উঠি, ' আসি মহুয়া।'

মহুয়া এতক্ষণের নীরবতা ভেঙে আমার উদ্দেশ্যে বলে, ' আজ বিকেলে বোসেদের পুকুরের ধারে চলে এস। প্রতিবছর নববর্ষের দিন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মিলে মাছ ধরার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ওখানে। এবারে তুমিও এসো। তোমার ভালো লাগবে।'

বিকেলে পুকুর পাড়ে গিয়ে দেখি সব কচিকাঁচাদের ভীড়, মাছ ধরার উল্লাস। অদূরে একটা অশ্বত্থ গাছের তলায় উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে মহুয়া আনমনে একতারায় সুর তুলে গুনগুনিয়ে কি যেন একটা গান করছে। আমি ওর পাশে গিয়ে বসতেই ও চমকে খানিকটা সরে বসে।
দুজনেই খানিকক্ষণ চুপ থাকি, মাছ ধরা দেখতে থাকি। কিছুক্ষণ পর আমিই পরিস্থিতিটাকে হালকা করতে বলি, ' আচ্ছা মহুয়া আমায় একতারা বাজানো শেখাবে??'

আমার কথা শুনে মহুয়া হেসে হেসে বলে ওঠে, ' কেন তুমি বাউল হবে??

'ধরো যদি তাই হই। তোমার সাথে ঘুরে বেড়াবো পথে ঘাটে, গান গাইবো। ঈশ্বরের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবো। ঠিক তোমার মত।'

' সবার দ্বারা সব কিছু হয়?? ঠিক আছে একতারা একখানা তোমায় দেবো। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো তোমায়?'

'হ্যাঁ, নিঃসংকোচে বলো।'

' তুমি কেন সংসার পাতলে না?'

আমি অকপটে মহুয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দি, ' যদি বলি তোমার মতো মনের মানুষ কাউকে পেলাম না খুঁজে।'

মহুয়া চুপ করে যায়। আমিও আর কথা বাড়াই না। ওখান থেকে উঠে চলে আসি কোয়ার্টারে। পরদিন স্নিগ্ধ ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই তৈরী হয়ে নিই নিজে এবং তৈরী করি নিজের মনকে। আমি সারা বিকেল, সন্ধ্যা, রাত ভেবে স্থির করি এই গ্রামে আর থাকবো না আমি। এই গ্রামে মহুয়া কে সকলের প্রয়োজন। আমার এ গ্রামে না থাকলেও চলবে। কিন্তু সারাক্ষণ মহুয়ার কাছে কাছে থাকলে ওর ব্রক্ষচারিণী মনে কলঙ্কের ছাপ পড়বে অথচ ওর কথা না ভেবে, ওকে ভালো না বেসে আমার পক্ষে একমুহূর্ত থাকা সম্ভব নয়। তাতে চাকরি যায়, যাক। পড়াশোনা জানা শিক্ষিত ছেলে আমি। চাকরির অভাব আমার হবেনা। কোয়ার্টারে লাগেজপত্র রেখে আখড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দি। ওখানে পৌঁছে দেখতে পাই আগের দিনের সেই বাউল শিষ্য বসে পুজোর জোগাড় করছে। আমি তাকে দেখে মহুয়ার কথা জিজ্ঞেস করি। আমি চাইছিলাম যাওয়ার আগে শেষ বারের মত একবার ভালোবাসার মানুষটাকে দেখে যেতে। কিন্তু সেই বাউল শিষ্য আমায় অবাক করে দিয়ে বলে ওঠে, মহুয়া তার সঙ্গীদের নিয়ে অন্য গ্রামে পাড়ি দিয়েছে। আমি বিহ্বল হয়ে দাওয়ায় ধপ করে বসে পড়ি। বাউল শিষ্যটি আমার হাতে তুলে দেয় একটা চিঠি ও মহুয়ার প্রিয় একতারাটা। চিঠিটা হাতে পেয়ে খুলে পড়তে শুরু করি, 'প্রিয় শ্রীজিৎ দা, আমি জানি বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে তুমি চাকরি ছাড়ার মতলব আঁটছো। কিন্তু এই 'মহুয়া ' তা হতে দেবেনা। তুমি ভাবছো হয়তো, মহুয়াকে ভালোবেসে তুমি কলুষিত করে তুলছো। তাহলে আমি বলি, তোমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ভালোবাসা কখনই পাপ নয়। তবে সংসারের যে বন্ধনে তুমি আমায় জড়াতে চাইছো সে বন্ধন আমার জন্য নয়। আমার মার্গ পথে বন্ধনের কোনরকম মূল্য নেই। তাই আমি স্বেচ্ছায় চলে গেলাম। তুলে গেলাম এই গোটা গ্রামের দায়িত্ব ভার। মনে রেখো, দায়িত্ব অবহেলা করোনা। আমার সাধের প্রিয় একতারাটিকে তোমার জন্য রেখে গেলাম। জানিনা, আর কখনও দেখা হবে কিনা। আসলে দেখা হলেও কোন লাভ নেই আর দেখা না হলেও কোন ক্ষতি নেই। গৌর-নিতাই তোমার মঙ্গল করুন। ইতি-মহুয়া .....।'

চিঠিটা পকেটস্থ করে একতারাটা বুকে চেপে আমি বসে রইলাম কিছুক্ষণ। দূর থেকে ভেসে আসছে একটা বাউল গানের সুর। গানের কথাগুলো আমার অন্তরকে ছুঁয়ে যেতে লাগল, মনে মনে মহুয়ার উদ্দেশ্যে বলে উঠলাম, ' যেখানেই থেকো ভালো থেকো। দায়িত্ব থেকে অবিচল আমি কখনও হবো না। দেখা তো আবার হবে কোন না কোন দিন। ঠিকই দেখা হবে।'

আখড়া থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে কোয়ার্টারের পথে হাঁটা দিলাম। আজ থেকে এক নতুন অধ্যায়ের শুরু আমার জীবনে। দূর থেকে তখনও শুনতে পাচ্ছি, বাউলের দল মেঠো আলের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে গাইতে গাইতে,
"তারে ধরতে পারলে মন বেড়ি,
ধরতে পারলে মন বেড়ি
দিতাম পাখির পায়ে।
কেমনে আসে যায়,
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।"

একতারাটা আষ্ঠেপৃষ্ঠে বুকে জড়িয়ে ধরে এগিয়ে চলি সামনের দিকে।












রূপস্মিতা গাঙ্গুলী 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন