পোস্টমডার্ন ভাবনা ও কিছু কবিতা:
পর্ব: ১০
গত পর্বের সাক্ষাৎকারটি থেকে যে দুটি বক্তব্য চুম্বকসম আকর্ষণে আলোচনায় বিবেচিত হয় তা হল, তিনি ব্যাখ্যাকার নন এবং দ্বিতীয়ত তিনি মনে করেন তিনি একজন ক্রণিক্যাল রাইটার।একটা দিনলিপি লিখছেন মাত্র এবং যা লিখছেন তিনি জানেন তা পাঠক বুঝবে -- এই কনফিডেন্ট তাঁর আছে।
পোস্ট মডার্ন চিন্তার দর্শনে এই ব্যাখ্যায় এসে আমাদের একটু থমকে দাঁড়াতে হয়। সাক্ষাৎকারের একটি অংশে উৎপল কুমার বসু বলছেন, "ফর্ম আর কনটেন্ট কোন কোন সময় আলাদা করা যায় না, যখন কাজে লাগে তখন শব্দ দুটো কে ( ফর্ম আর কনটেন্ট) আমরা ব্যবহার করি, আবার কাজেই যখন লাগে না তখন বলি ফর্ম আর কনটেন্ট একই জিনিস।.. ফর্ম ধরে ব্যাখ্যা হয় কিনা এ সমস্ত ব্যাপারে আমি নিজে তেমন উৎসাহী নয়। এগুলো আমার কনসার্ন নয়, সংশ্লেষ নয়। আমার সংশ্লেষ হচ্ছে -- একটা মনোজগৎ তার সঙ্গে ভাষা জগত এবং ভাষা জগতের সঙ্গে ত্রিভুজ হিসেবে একটা যৌনতার জগত আছে।"
অনেক টা এভাবেই ফ্রেগে,রাসেল এবং ভিটগেনস্টাইন (প্রথমের দিকে) মনে করতেন, ভাষাই হচ্ছে কনসেপ্ট এর বাহক। জগতকে চিনতে ও জানতে হবে ভাষার ভেতর দিয়ে।' কনসেপ্টের জালে ' র ভেতর দিয়ে জগত কে দেখতে হবে। জগতকে জানার আগে ঠিক করে নিতে হবে তুমি জগতকে জানবে কিভাবে অর্থাৎ কি ভাববে সেটা ভাবনার পাশাপাশি কিভাবে ভাববে এই ভাবনায় জোর দিতে হবে বেশি। কি হবে এই জানার পদ্ধতি, ভিটগেনস্টাইন এই প্রসঙ্গেই বললেন, ব্যাখ্যা চেয়ো না,বর্ণনা কর।আর এই বর্ণনা হবে কনসেপ্টের জাল (যা আদতে ভাষা) দিয়ে।
এই জাল যদি গোল বা ত্রিভুজাকার হয় তাহলে দৃষ্ট জগত হবে সেই রকম আকারের। সুতরাং জগত ত্রিকোণ বা গোল যাই হোক না কেন তার উপাদান এবং উপাদানের বিন্যাস এক। তবে আরও নিয়ম আছে, যুক্তির স্বার্থে কনসেপ্ট বা ভাষাকে এক ধরে নিলে ভিটগেনস্টাইন এর মতে প্রচলিত ভাষা বা কাল্পনিক ভাষার (তাঁর মতে ভাষা জগতের প্রতিচ্ছবি) উপাদান এক। এই লজিকে জগতের উপাদান এক,জগতের গঠন বা স্ট্রাকচারের ফর্ম এক। এখানে মনে রাখার মত বিষয় টি এই যে,এই ফর্ম হল গঠন বা স্ট্রাকচারের সম্ভবনা (ফর্ম ইজ দ্য পসিবিলিটি ওফ স্ট্রাকচার) আর গঠন বা স্ট্রাকচার হল ফর্মে র নিদর্শন( স্ট্রাকচার ইজ দ্য অ্যাকচুয়েলাই জেসন অফ ফর্ম)। ব্যাপারটিকে এভাবে বোঝা যেতে পারে, পাশাপাশি একই রঙের একই কাঠামোর একই মাপের একই উচ্চতার দুটি বাড়ি দৃশ্যত কোন পার্থক্য নেই, কিন্তু ভেতরের ড্রইং রুম বেডরুম অথবা কিচেন আলাদা রকমের।তাহলে ফর্ম এক হয়েও স্ট্রাকচার ভিন্ন।
যেমন -- রাম যদুকে মেরেছে।
যদু রামকে মেরেছে।
দুটিতেই একটি কর্তা,একটি কর্ম ও ক্রিয়াপদ আছে। ফর্ম এর দিক দিয়ে এক।কিন্তু একটিতে রাম কর্তা, অন্যটায় যদু -- অর্থাৎ স্ট্রাকচার ভিন্ন।
আবার কান্ট বললেন, জগতের প্রকৃত স্বরূপ এভাবে জানা যাবেনা, তবে চিন্তার কাঠামো থাকবে, এটাও ঠিক কিনা তা জানা যাবেনা
ভিটগেনস্টাইন আমাদের জানালেন, জগতের যে গঠন,সেই গঠন আমাদের ভাষারও গঠন। কিন্তু হাজার ১৯৩০ সালের পর অর্থাৎ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ানোর সময় থেকেই তার ধ্যান ধারণা পাল্টে যেতে শুরু করে।তিনি বললেন অনুষঙ্গের কথা, বললেন বাক্যের অনুষঙ্গে পথ অর্থ খুঁজে পায়। ( এ এক আলাদা পর্ব, চেষ্টা করব পরের সপ্তাহে আলোচনায় আনার।)। এই শব্দ এবং ভাষার আবহে খুব এবং খুব বেশি করে মনজ চিন্তার ডালে সবুজ হয়ে ওঠে জীবনানন্দের কবিতার এই কিয়দংশ:
আমরা এ পৃথিবীর বহু দিন কার
কথা কাজ ব্যথা ভুল সংকল্প চিন্তা র
মর্যাদায় গড়া কাহিনীর মূল্য নিংড়ে এখন
সঞ্চয় করেছি বাক্য শব্দ ভাষা অনুপমবাচনের রীতি
মানুষের ভাষা তবু অনুভূতি দেশ থেকে আলো
না পেলে নিছক্রিয়া; বিশেষণ; এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল।
এই শব্দ পুঞ্জ আরও গভীর থেকে গভীরতর চেতন রহস্যের অতল স্পর্শে পৌঁছে বিস্ময়াবিষ্ট করে আমাদের। আশ্চর্য ও অভিভূত হয়ে লক্ষ্য করি গত সাক্ষাৎকারে উত্তর আধুনিক প্রথম বাংলা কবি হিসেবে তাঁরই নাম এসেছে।
রইল এবার জন এ্যাসবেরির একটি কবিতার অনুবাদ:
মূল কবিতা: My Erotic Double
অনুবাদ: আমার প্রেমজ দোহার
সে বলল দিনটি তার কাছে কর্মমুখর দিন হিসেবে অনুভবে ছিল না,
এমনি গড়পড়তা ভাবে মন্দ দিন নয়।
এখানে বাড়ির পাশ টির ছায়াময় আঁচল থেকে
দূরবর্তী ছিল রাস্তার কোলাহল,
জনৈক জন পারে পুরনো অনুভব গুলিকে ঠেলে সরিয়ে অন্যের জন্যে রেখে এগিয়ে যেতে।
পরের শব্দের খেলাগুলি যখন
আমাদের মধ্যে তীব্র হয়ে ওঠা মৃদু সংবেদন বিভ্রান্ত হয়। আর একবার পাক খেয়ে কি ঘুরপথে যাওয়া? না, কিন্তু অন্তিমে বলার জন্য খুঁজে পাবে কমনীয় মনোহর কিছু এবং রাত নামার আগে আমাকে বাঁচাবে।
আমরা বরফের বানানো বজরায় স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছি,
নক্ষত্রের আলোকময় অন্ধিসন্ধি ছিঁড়ে প্রশ্ন গুলি ছুটে এসে জাগিয়ে স্বপ্নের কথা ভাবায়
যেমনটা ঘটে চলেছে।কিছু ঘটনা। তুমিই বলেছিলে।
আমি এটা বলেছি কিন্তু আড়াল করি নি।কারণ এটা আমার পছন্দের নয়।তুমি বেশ চমৎকার মানুষ। ধন্যবাদ।তুমিও নিও।
(চলবে)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন