স্তুতি বন্দনা বরকাকতী
অন্ধকারের জোনাকি
(মূল অসমীয়া থেকে বাংলা অনুবাদ সপ্তর্ষি বর্ধন)
এক
আকাশ রঙিন করে ফুটে থাকে শুভকানার অসংখ্য ফুল। শেওলা পড়া পাথরগুলোর উপর দিয়ে যাওয়ার সময় তুমি ঠিক করে দিয়েছিলে কপালে বিঘ্নিত করা খোলা চুল। হাওয়াতে বেধে না রাখতে পারা ওড়নাটা ডান কাঁধে গাঁঠি বেধে দিয়েছিলে। আমি তুলে যাচ্ছিলাম একটার পর একটা ফটোগ্রাফ । ফাল্গুনের ? ফটো তোলাটা আমার সখ । আর তুমি আমার ফটো তোলা অভিযানের সঙ্গি। তোমাকে আমি শিখিয়ে দিয়েছিলাম কি করে একটা ভালো একটা তুলতে হয় আর কত সময় পার করেছিলাম ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়ে একটা পারফেক্ট ফটোর জন্য । একশটা ফটোর মধ্যে কোনোমতে দুটো ফটো ভালো হয়েছিল আর সেই ফটো আমি মোবাইলের ডিসপ্লে পিকচার করে রেখেছিলাম । বারে বারে কেঁপে যাওয়া ফটোগুলো দেখে লাগছিল কি জানি আমিই তোমাকে ফটো তোলার বিশেষ কায়দাগুলো শেখাতে পারিনি । অথবা এমন একটা ভাব ছিলো সব পারফেক্ট জিনিস সব সময় সন্তুষ্টি দেয়না , ইমপারফেক্ট কথাগুলোতেই নিহীত থাকে প্রেমের সীমাহীন লজিক । যেমন ভাবে আমার অতিশয় তেতো করে বানানো চাও তুমি সুন্দর হয়েছে বলে দিনটার আরম্ভ করেছিলে। আস্তে আস্তে আমি চা বানাতে শিখলাম। তোমার ভালোবাসাগুলোর প্রতি যত্ন দিয়েছিলাম, তুমি সেই একই তৃপ্তি চোখ মুখে রেখে প্রশংসা করেছিলে আর আজ কলেজের কলিগরা প্রত্যেক দিন আমার রান্না করা কিছু একটা স্পেশাল টিফিন খাবে বলে অপেক্ষা করে। তারা বলে আমার হাতে নাকি যাদু আছে ।
আজ আবার লাল হলদে ফুলের বেডকভার যেন আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। নতুন বাড়ির জানালার বাইরে। বিছানা করা কাজটা আমার ভালো লাগতো না। তোমার ভালো লাগতো কি না জানি না, কিন্তু কাজটা সব সময়ই করতে। কথাগুলো এখন ইল্যুশ্যন। ফুল ফুল বেডকভারের উঠে যাওয়া রঙগুলো ফিরে আবার রঙিন হতে সময় লাগবে ।
দুই
ফাল্গুনকে বলা হয় অহেতুক প্রেম । স্কুলে প্রায়ই আসা যাওয়া করায় উড়তে থাকা শিমুলের তুলো ধেয়ে আসা স্কুলের মাননীয় প্রধান শিক্ষককে সব সময় জবাব দিতে হয়েছিল। শ্রেণীকক্ষে কোনোমতেই মন বসে না। শুকনো দিনে একটা গান গুনগুন করে মনটা রঙিন হয়ে গেছিলো। স্কুল ছুটির ঘন্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে বাইরে বেড়িয়ে এসেছিলাম ঝরে পড়া পাতাগুলো পাড়িয়ে। তার থেকে হওয়া পাতার মরমর শব্দটা তৃপ্তি দিয়েছিল। স্কুল থেকে ফেরার সময় আমাদের সঙ্গে ছিল লিলি দি। দিদি ভাষা পড়ান। সাহিত্য - সংস্কৃতির বিষয়ে অগাধ জ্ঞান । বাড়ি যেতে যেতে দিদি বিভিন্ন গান গেয়ে যান, গানগুলো আমাদের শেখান আর সেরকমই বহু গান আমাদের মুখস্থ। মা আমরা শদিয়াতে যাব, মা আমরা শতফুল খাবো....। আরও যে কতো গান। বিছানাতে বসে মণিকা আওরাত সব কথা। তখনকার দুষ্টুমির একমাত্র সঙ্গী অভি এখন আমেরিকাতে। মহানগরীর অভিজাত ফ্ল্যাটের ঘরে বসে ফাগুনকে দেখেছে সে। পাতাহীন ডালগুলো চোখে পড়েনি, চোখে পড়েছে আকাশ কালো ধোঁয়া। জানালাটা বন্ধ করে দিলো। ঘড়িতে দেখলো দশটা বাজতে যায়। দুয়ারের সামনে থেকে দুধের প্যাকেটটা আর খবরের কাগজটা তুলে রান্নাঘরের দিকে গেল সে। এক কাপ চা করে খবরের কাগজে চোখ বোলালো। সরকারের নীতি বিরোধী কাজ, কেলেঙ্কারি, অনিয়ম, যৌতুকের জন্য স্বামীর বউকে খুন! এই খবরগুলো পড়ে পড়ে সে বিরক্ত । তারাতারি সাহিত্য চর্চার পাতাটায় চোখ বোলালো, ইংরেজি কাগজটার সম্পাদকীয় পৃষ্ঠাটা পড়ে স্নান করতে চলে গেল । বারোটা থেকে ক্লাস, সারে এগারোটায় বাড়ি থেকে বের হলেও হবে । দুই কিলোমিটার রাস্তা । বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতে একটা ফোন আসলো । নন্দার। মণিকার বোনের :
: হ্যা, নন্দা বল
: লাগবে না, কোনো কারণে তুই থাকতে পারবি না
: ডিভোর্সের পরে অন্য অপশন রাখবি না। বিকেলে কথা বলব, এখন আমার ক্লাস আছে। বাই...
মণিকা বরুয়া, পেশায় একজন অধ্যাপিকা। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্ৰী নিয়ে তারপর এম. ফিল , পি. এইচ. ডি করে কলেজে ঢোকে আজ প্রায় সাত বছর হল। ফাঁকা কপালটা মনে করিয়ে দেয় স্বামী সৌরভের না থাকার কথাটা। তাই আজকাল সে একটা বড়ো করে লাল টিপ পরে। শারীরিক ভাবে সৌরভ না থাকলেও সৌরভ লাল টিপ হয়ে মণিকার সাথে থাকে বলে তার বিশ্বাস। সঙ্গে থাকে সাহস হয়ে মণিকা আর সৌরভের প্রেমের প্রতীক কুঁহি। তার বয়স পাঁচ বছর। যদিও বয়স কম, বহু কথায় সমৃদ্ধ সে। মায়ের একান্ত সঙ্গি । সাড়ে এগারোটার সময় গাড়িটা গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে মণিকার কলেজের দিকে যায়। কুঁহির স্কুল ছুটি হয় বারোটার সময় যদিও মায়ের ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্কুলে থাকে। ক্লাসের শেষে স্কুল থেকে আনার পরের সময়টা মণিকা আর কুঁহির একান্ত নিজের। আজকে দুজন বাড়ি ঢোকা মাত্রই আবার নন্দার ফোন আসলো :
: কি হয়েছে তোর বল তো?
: জোড়া না লাগা কথাগুলো টেনে থাকার প্রয়োজন নেই ...
প্রায় পনেরো মিনিটের মতো কথা বলার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা কেটে দিল মণিকা। কতো যে সমস্যা সংসারগুলোতে। প্রত্যেকেই শুধু বাইরে সুখী সংসারের অভিনয় করে। বেশিরভাগই অন্তরের দ্বন্দ্বই ভেতর থেকে ঠুনকো করে রাখে। নন্দা আর রাজনিশের পাঁচ বছরের প্রেমের শেষে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের তিন বছর হতেই এতো অশান্তি । এতো অসহনশীলতা , রাজের ভেতরের এতো নিকৃষ্ট রূপটা নন্দার অকল্পনীয়। কেবল ভালোবাসার বাড়ি তৈরি করা নন্দা দেখেছিল রাজের দেহসর্বস্ব লালসা, স্বাধীনচেতা মনটাকে ভোগের শেকলে নন্দার মন মগজ সব অন্ধকারে ঢেকে ফেলেছিল। হাতড়ে হাতড়ে শুষেছিল বুকের রস। নন্দার সম্মতি ছাড়া । রাজের অস্বাভাবিক পরিবর্তন অথবা ভেতরের প্রকৃত স্বরূপটাকে মেনে নিতে নন্দা ভয় পেয়েছিলো। আস্তে আস্তে মনোমালিন্যগুলো অসহ্য হয়ে উঠছিলো। সে ভেবেছিল কথাগুলো কাউকে খুলে না বললে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। একবার রাজের আদেশে গোয়া ঘুরতে গেছিলো দুজন। নন্দা ভেবেছিলো অশান্তিগুলো শেষ হবে। সমুদ্র দেখা যায় এমন একটা পাঁচ তলা হোটেলের ৫১৩ নং ঘরে সে দেখছিল নিচের পৃথিবীটা। রাজ তখন ঘুমোচ্ছে। সে আওরাচ্ছে বহু কথা।
রাজ বলছিলো আর নন্দা ভাবছিলো। ভাবছিলো বহু কথা। একটা সময়ে এটাও ভাবছিলো রাজই সত্য, চরম সত্য। রাজ এটাও বলছিলো প্রেমের আনন্দের চরম বিন্দু সম্ভোগ । সম্ভোগের অভাবে কোথাও সংসারের ছিন্ন ভিন্ন অবস্থা। একটা সময়ে সময়ের পরিধি ভেঙে সময়ের আগেই নিয়ম নামের রেখাটা অতিক্রম করে একটা যুদ্ধে নামে, দেহের যুদ্ধ, প্রেমের যুদ্ধ । নিজেকে নিখুঁত বলে ভাবার অন্ধ ধারণা ।
নিচে ঢেউয়ের গর্জন করা সমুদ্রটার প্রতি মায়া জন্মালো নন্দার । দেখেছে একজোড়া ভিন্ন দেহের হাত বালিতে ছবি আঁকে । যাওয়ার মুখে রোদ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে । বিকেল ভালোবাসে চকচকে ল্যান্ডস্কেপ । কোথায়, তারা তো নির্ণয় করেনি প্রেমের দেহ সর্বোচ্চ সংজ্ঞা। কোমল হাতে প্ৰেমিক ঠিক করে দিয়েছিলো তার ওলটপালট হওয়া চুল। কোথায় নন্দার চুলে তো কেউ বোলায়নি রোদের উষ্ণতা, ভিড়ের মাঝে দেয়নি স্নেহের চুম্বন । তার প্রেম আলোকে ভয় পায়, রোদে পুড়ে মরে । অথচ তার ওড়া চুল আর সেই প্রেমিকার ওড়া চুলের আগা স্পর্শ করে একই সাগরের ভেজা বালি।
পার্থক্য... এখানে পার্থক্য আছে ।
রাজ আর নন্দার প্রেম পরিধির ভিতরে দু জোড়া চোখে ভুল দেখেছে আর সেই প্রেমিক যুগল দু জোড়া চোখে দেখলো একটা আকাশ । সে যেন প্রেম করছিলো না। এই ইল্যুশ্যন ঢেকে রেখেছিলো নন্দাকে।
সেই সময়টাতে অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলো সে। গোয়া থেকে ফিরে এসে বোনকে সব কথা খুলে বলবে নন্দা ।
তিন
আজ কিছু দিন থেকে কুঁহি কিছু প্রশ্ন মাকে জিজ্ঞেস করতে চাইছে। যে উত্তরগুলো তার হাতে নেই । নন্দার কথাগুলো তাকে একটু বিচলিত করে তুলেছে । তার উপরে আবার কুঁহির বাবাকে খোজার জেদ ধরা কথাগুলো কি সমাধান দেবে ভেবে পাচ্ছিলো না । কুঁহিকে বিকেলে আর্ট স্কুলে রেখে মণিকা কাছের একটা পার্কে ঢুকল। যে পার্কের সাথে তার অতীতের বহু স্মৃতি আছে । সৌরভের সঙ্গে বসে কতো স্বপ্ন দেখেছিলো এই পার্কের বেঞ্চে । তারা প্রায়ই অন্ধকারে এসে বসে থাকত। আকাশের তারা দেখতে দেখতে অনেক কথা বলতো। স্বপ্নের রঙিন ফুলের কথা । স্বপ্নগুলো এগিয়ে গিয়েছিল। তাদের বিয়ে হয়েছিল। সবটাই কল্পনার মতো অথবা তার থেকেও ভালো ভাবে চলছিল । দু’বছরের কুঁহিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠেছিল মণিকা, সৌরভের অনাকাংক্ষিত মৃত্যুর শোকে । সবকিছু স্বাভাবিক করে জীবনটা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ ছিল না । তবুও সে সময়ের কাছে জেদ ধরে ছিল । পেরেছিলো। পার্ক থেকে বেরিয়ে কুঁহিকে নিয়ে বাড়িতে গিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল । কুঁহি ব্যালকনির চেয়ারে একমনে বসে আছে :
: কি দেখছো কুঁহি ?
: মা আকাশটা ।
: ওই যে তারাগুলো দেখছো তার মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটা তোমার বাবা ।
: ওখানে কেন আছে মা ?
: পরীরা বাবাকে ডেকে নিয়ে গেছে ।
: আর আসবে না মা, পরীদের কাছ থেকে ।
: আসবে, আসবে । কেন আসবে না? তুমি একটু বড়ো হলেই চলে আসবে ।
: আমি সব সময় অপেক্ষায় থাকব বাবার জন্য ...
মণিকা কুঁহিকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় নিয়ে যায়। সে কুঁহিকে অনেক কথা বোঝানোর চেষ্টা করল। জীবনের সুখ দুঃখ কুঁহিকে বলে যায়। কুঁহি শুধু শুনে যায়। বুঝতে পারে না, না বোঝার কথা বয়সই বা কতো।
নন্দা দিদির বাড়ি এসেছে । ডিভোর্সের কথাগুলো ফাইনাল হয়েছে। শেষ পর্যায়ের কাজগুলো দিদির বাড়িতে থেকেই করবে । সে থাকলে মণিকারও সুবিধে হয়, কুঁহিরও সঙ্গি হয়। কিছু জোনাকি আসা যাওয়া করছে । কুঁহি মাকে জিজ্ঞেস করলো -
: মা, আকাশের তারাগুলো এমন করে নেমে আসে নাকি?
: হ্যা, এই ভাবে নেমে আসে আবার চলে যায়।
: তার মানে বাবাও এসেছে না আমার কাছে।
: হ্যা, মা ।
বাবা আমাকে ফাঁকি দেয়, আমার কাছে আসে না । দাঁড়াও আজকে ।
কুঁহি দৌড়ে ভেতরে যায়। ঘর থেকে একটা কাঁচের শিশি এনে তৎক্ষণাত উড়ে বেড়ানো জোনাকি একটা শিশিতে ভরে আটকে দিল। মণিকা জিজ্ঞেস করলো -
: কি করছো কুঁহি ?
: মা, বাবা কাছে না থাকলে আমার ভালো লাগে না । স্কুলের সব ফ্রেন্ডের বাবা আছে। আমারই নেই । সবাই বাবার সাথে থাকে। তাদের সাথে খেলে। আজ থেকে আমিও খেলবো।
মণিকা কুঁহিকে জড়িয়ে কেঁদে ওঠে । কুঁহি অনেক দিন পর প্রাণ খুলে হাসে বাবাকে কাছে পেয়ে । তার পরে অনেকক্ষণ জোনাকিটার সাথে খেলে। সেটা নিয়ে কুঁহির ব্যাস্ততার অন্ত নেই ।
চার
নন্দার ডিভোর্স হল অবশেষে। মণিকার সাথে আছে সে। আজও কুঁহি ব্যালকনিতে বসে একান্ত মনে রাতের আকাশটা দেখছে। হঠাৎ মাকে ডাকল সে -
: মা, বন্দি করা মানে কি?
: তুমি যদি নিজের মতো করে রাখো । তুমি তোমার কাছে রাখো, সেটাকে বন্দি করা বলে ।
: আজকে স্কুলে দিদি বলেছে বন্দি করে রাখলে সব প্রাণী কষ্ট পায় । তাই ?
: হ্যা, আবার সকলের নিজের নিজের জীবন থাকে । বন্দি করে রাখলে নিজের মতো করে চলতে পারে না ।
কুঁহি একটু সময় কিছু ভাবলো। দৌড়ে সোজা ঘরে গেল। কাঁচের শিশি নিয়ে চাঁদের দিকে দৌড়াল। পেছনে পেছনে মণিকা আর নন্দা । চাঁদের কাছে গিয়ে ঢাকনা খুলে জোনাকি পোকাটাকে ছেড়ে দিলো। শিশিটা আলো করে অসংখ্য জোনাকির সঙ্গে জোনাকিটা মিলে গেল । মণিকা অনুভব করলো কুঁহি বড়ো হয়েছে ।
একটা বাতাস ছুঁয়ে গেল তিনজনকে । এক আকাশ জোনাকি আলো করল তিনজনের মুখ । যদিও বাইরে অমাবস্যার অন্ধকার।।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন