বিপ্লব দত্ত
স্মৃতি কথা
পর্ব: ১
যামিনী পালের পাঁচ আঙুলের স্পর্শে হয়ে উঠত প্রাণবন্ত।
আদ্যিকাল থেকেই মানুষের দেশ ভাগের মতো জাতি ভাগের খেলা। এই সময়ে আর নেই। যা কিছু আগের ঘটনা। এখন জাতপাতের উর্ধ্বে উঠে যারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ তারাই অন্য জাতের। মানুষ শিক্ষা আর সংস্কৃতি দিয়ে বুঝতে শিখছে পৃথিবীর সৃষ্টি আর জীবজগতের জন্ম। রক্তের রং এক। কিন্তু একসময় বুদ্ধিমান প্রাণীর দ্বারা জাত আলাদাকরণ। আমি আর তুমি। রূপ নিয়েছে ধর্মের। বক্তব্য এক। রিপুহৰণ। আর এই শুদ্ধি করণেই সৃষ্টি আলাদা আলাদা জাতপাতের আর ধর্মের। সৃষ্টি এক একটি দেবতার। কেও মূর্তি আবার কেও নিরাকারের। লুকায়িত হিংসা, ক্রোধ আর লোলুপ বাসনা নেই বললে ভুল হবে। কামনা বাসনায় পোশাক পরিহিতা বুদ্ধিমান জীব। লেখা আছে সারাদিন পাপ কর্ম করে রাত্রে তিঁনাকে স্মরণ করলেই নাকি সব পাপে মুক্তি। এই অপরাধ স্বীকারেই সেদিনের রূপান্তর আগামীকাল অপরাধের আবার সূর্যোদয়। যুক্তিবাদীদের কাছে এই যুক্তি নিছকই অনাচার। আস্তিক আর নাস্তিক শব্দ দুটো ভূমণ্ডলে ঘুরছে চিরকাল। চলবেও। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলে মানুষ যখন হাসপাতালে এক চিকিৎসকের কাছে শোনে ঈশ্বরকে ডাকুন। আমার কোনও হাত নেই। তখন মনে হয় আস্তিক কী আর নাস্তিকই বা কী? মানুষ জন্মায় মৃত্যু তার অবধারিত। রেল গাড়ির লাইন পাতা। মাঝে মাঝে স্টেশনে থামা আর তারপর গন্তব্যে।
অনেক নাস্তিকবাদ বাবা বা মায়ের মৃত্যুর পর সাদা থান কাপড় পড়ে (হিন্দু ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী) আর দেখা হলেই প্রথমে বলে সমাজের জন্য। সেদিন দশকর্মার দোকানে পাড়ার এক মাসিমার সঙ্গে দেখা। উনি নাতির হাতে খড়ির জন্য কেনাকাটা করছিলেন। উনিও নাস্তিক। আচ্ছা যদি এভাবে ভাবা যায় - অনন্তকাল থেকে যে রক্ত আমাদের শরীরে বইছে তার মধ্যে ঢুকে আছে এক ঈশ্বরের প্রতিধ্বনি? যাঁরা লিখেছেন আর তারপর রূপ দিয়েছেন শিল্পীরা তাঁদের জন্য অকুন্ঠ শ্রদ্ধা।
মুর্শিদাবাদের খাগড়ায় যামিনী পালের ঠাকুর বানানোর কারখানা। প্রথমে ছোট। তারপর নামডাক আর চাহিদার গুনে বাড়ি ছেড়ে স্বর্গধাম সেবক সংঘের (সংগীত শিল্পী অরুন কুমার ভাদুড়ির ঠিক উল্টো দিকে) দুর্গা পুজোর মাঠে। আর তারপর বাড়ি ছাড়িয়ে এক গলিতে বড় জায়গাতে। যেমন দেখতে সুন্দর আর তেমনি তার আচরণ। সুপুরুষ বলতে যা বোঝায় সে হল যামিনী রঞ্জন পাল। সৃষ্টি আর সৃষ্টিকারীর পার্থক্য একটাই একজন মানুষ আর এক প্রাণহীন সৌন্দর্যের রূপ। সৃষ্টি সুন্দর হলেই শিল্পী দেখতে সুন্দর হবে এই ধারণা মানুষের। যামিনী পাল ছিলেন ঠিক তাই। উল্টানো কোঁকড়ানো চুল। গায়ের রং ফর্সা। আভিজাত্য বর্তমান। হাঁটলেই মনে হত চলমান শিল্প। পোশাক বলতে দেশজ ধুতি, পাঞ্জাবি আর শীতে শাল। গায়ের রং ফর্সা। ক্লান্তি নেই। উনার ভাইরাও মৃৎশিল্পী। কিন্তু উনার কাজ তাঁদের থেকে আলাদা আর সে কারণেই তিনি যামিনী পাল। এক সময় কৃষ্ণনগরে বেশ কয়েক বছর কাজ শিখেছিলেন। যার দৌলতে উনার মূর্তিগুলো একটু অন্য মাত্রার। উনি বুঝেছিলেন মূর্তি শিল্প বংশ পরম্পরার কাজ হলেও সেটাকে আরো উন্নত করা দরকার। মন দিয়ে কাজ আর সেই কাজের প্রতিফলন এক অন্যমাত্রার। কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর মনে হতো না সেটা মাটির মূর্তি। যেন গায়ে হাত দিলেই আঙ্গুল বসে যাবে। কাছাকাছি বাড়ির সুবাদে স্কুল ছুটির পর আর ছুটির দিনে ওখানে যেতাম। কাঠের পাটাতন থেকে খড় বেঁধে এক মাটি থেকে দু মাটি আর তারপর মাটির ঘোলা দেওয়া। ফেটে যাওয়া অংশগুলো ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো গোলা মাটিতে ডুবিয়ে নিয়ে লাগানো পর্যন্ত। সহশিল্পীদের কাজ এক সময় বেড়ে গিয়েছিল। উনি দূর থেকে নির্দেশ দিতেন।
পরবর্তীতে দূর থেকে নির্দেশ দিলেও হাতের চিয়ারি তাঁর নিশপিশ। একরাশ গালাগাল। তারপর নিজেই মূর্তি ঠিক করে বলতেন - তোদের ঘাস গরুতে খাবে। বলে নেওয়া দরকার লেখার মধ্যে উনার কিছু উচ্ছিষ্ট ভাষা না রাখলে বোধহয় পরিপূর্ণতা পাবে না। নীরদ মজুমদারকে দেখেছি উনার গালিগালাজ যা উনার বোন শানুদি (লাহিড়ী) মুখে রুমাল চাপা দিয়ে হাসতেন আর বলতেন দাদাটা যেন কী। এভাবেই যাওয়া খাগড়ার কমার্শিয়াল কালিদার (দাস) হাত ধরে। আমি বড় হচ্ছি। কালিদার কাছে ছবি আঁকার লোভে যাতায়াত। সে সময় যাত্রার চল। সত্তরের কাছাকাছি। বহরমপুরে যাত্রা নাটকের দর্শকে জায়গা মেলা ভার। এখনকার মতো নয়। নারী বর্জিত নাটকে এক পুরুষ (যার নাম আমার স্মৃতিতে নেই) তাকে অনেক আগে থেকেই বায়না করতে হতো। মাফ - আমি লুকিয়ে তার ড্রেস পড়া দেখতাম। চলন বলোন নারীসুলভ। সবসময় দাড়িগোঁফ চাঁচা। কথাবার্তা মেয়েদের গলায়। দুর্গা পুজোর পর অনেক ক্লাবেই নাটক বা যাত্রা। কালিকা যাত্রা সমাজ ফিবছর যাত্রা প্রতিযোগিতা আর তার সুবাদেই রাত্রে বাড়ির প্রাচীর টপকে রাতভর যাত্রা দেখে ভোর আলোর আগেই আমার ঘরে। হাঁ, বদল হয় সময়কেন্দ্রিক। যাত্রা রূপ নেয় আধুনিকতায়। কালিদার কাছে বড় বড় ব্যানারের অর্ডার। আমি সহযোগী। আট ফুট বাই ষোলো ফুটের কাজ। মইয়ে উঠে জুতোর ব্রাশে রং লাগাতাম। এখনো মনে পরে হেলেন অফ ট্রয় ব্যানারের স্মৃতি। কালিদার বাড়ির মানুষ সরল সাদাসিধে। কালিদার দুস্টুমির এক অধ্যায় জ্যেঠিমার কাছে শোনা। দুরন্তপনার জন্য কালিদার বাবা ছেলেবেলায় জেলখানাতে রেখে এসেছিলেন। কিন্তু তার ছবি আঁকার কর্মকান্ডে আবার বাড়িতে স্বহস্তে জেলার। ভালো তবলা বাজানোর হাত তাকে গুণীমহলে স্থান। আমার মনে আছে এক মেলাতে গেছি তখন টেলিভিশন শুরু হয়নি। কিন্তু ওই মেলায় দেখি একটা বক্সের মধ্যে কালিদাকে তবলা বাজাতে। জিজ্ঞাস্য - কী করে সম্ভব? পরদিন উনার বাড়িতে। শুনলাম ওটা টেলিভিশন। লাইভ টেলিকাস্ট। সালটা মনে নেই তবে ছোটবেলায় মায়ের কাছে শোনা সামনের দিনে নাকি বাড়িতে বসে সিনেমা দেখা যাবে। আমাদের দেশে পরীক্ষামূলক ভাবে ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯ এ শুরু হয়েছিল মেক শিফট স্টুডিওর মাধ্যমে তারপর ১৯৬৫ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওর মাধ্যমে ডেইলি ট্রান্সমিশনে একটি অধ্যায় হিসেবে চালু হয়। পাকাপাকি ১০৮০ মানুষের চোখে। আর এখন মানুষের লাইব্রেরিতে যাতায়াত নেই। ওই এক মাধ্যম মানুষের বই পড়া নিঃশেষ। মনে পড়ে পাড়ার জ্যেঠিমা,কাকিমা ডেকে এক চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বলতেন - এই বইটা লাইব্রেরি থেকে আমাকে এনে দে তো। বদলে আচার বা লজেন্স। কী খুশি। সময় পাল্টায় আর আমরা নতুন আহ্বানে ভেসে উঠি। এক বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় আবার যখন খুঁজতে থাকি তখন শেষ লগ্ন। এ নিয়ে মাথা ব্যাথা না থাকাই ভালো। কালিদা কেমন মানুষ আর তার জীবনটাই বা কেমন? সাইনবোর্ড আঁকা আর নতুনের সন্ধান। অবাক হয়ে দেখতে হতো তার লেটারিং। রঙের উজ্জ্বলতা। বাবা আর ছেলে মিলে এক দক্ষ কমার্সিয়াল কারিগর। যা সেই সময়ে মুর্শিদাবাদের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। যামিনী পালের ঠাকুরের মাটির কাপড়ে অলংকরণ আর রিলিফ কাজের ব্যাকগ্রাউন্ড এক অনবদ্য রূপ যা আমার চোখে এখনো জ্বলজ্বল উদাহরণ। আমি কালিদার হাত ধরে রাতের পর রাত জেগে সরস্বতী ঠাকুরের কাপড়ে অলংকরণের কাজে নিয়োজিত।
সন্ধেয় চপ মুড়ি চা। আড্ডা কিছুক্ষন। সেদিন যামিনীদা মুড়ি চিবোতে চিবোতে বললেন - আচ্ছা, বলতো এখন দেশের পরিস্থিতি কী? আমি ছোট সে কারণেই চুপচাপ। বুঝতে অসুবিধা হয় নি। কিছু একটা খারাপ ইঙ্গিত তার কাছ থেকে নিশ্চিত আসবে। এলোও। সারা না পাওয়ায় উনি বললেন - কাঁসারি পাড়ার বিমল পালের বড় শিবখান দেখেছিস? এক বাক্যে সকলে - হাঁ। ওর বিশেষত্ব কি জানিস? না তো। ষাঁড়ের অন্ডকোষটা দেখেছিস? হাঁ। যখন প্রসেশন বেরোয় তখন কী হয়? কী আবার ওটা দোলে। হাঁ ঠিক, এই রকম এখন ভারতবর্ষের অবস্থা। সালটা ১৯৬৭ আর সে সময় উনার এই উক্তি এখনো একইরকম। দুলছে ভারতবর্ষ। স্থিতিশীলতা কোথায়? শেষই বা নেই কেন? রসিকতা করলেও উনি বাস্তব অবস্থান থেকে অনড়। এই হলো যামিনী পাল।
অনেক গল্প, অনেক কথা যা বললেও আজ শিহরণ জাগে। তবে উনার মৃৎশিল্প ছাড়াও আর এক গুণ ছিল। সময় অবসরে উনি বিভিন্ন মনীষীর সিমেন্টের স্ট্যাচু বানাতেন। পরবর্তীকালে অর্ডার মাফিক সেগুলো করলেও কালোতীর্ণ হয়নি। কেমন যেন মাটির ঠাকুর ঠাকুর ভাব। ১৯৮৪ সালে আমার একাডেমিতে হোম সার্কাস সিরিজের জন্য বাসব ঠাকুরের (রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ভাইপো) কাছে এক্সিবিশন উদ্বোধনের জন্য গিয়েছিলাম। বাসব ঠাকুর ভাস্কর্যের এক পরিচিত নাম। উনার বাড়ি ছিল ওয়েলিংটন পার্কের (এখন সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার) ঠিক পিছনে। সুন্দর চেহারা। ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। বাড়িতে অনেক ভাস্কর্য। উনি উদ্বোধনে রাজি। সঙ্গে অনেক কথা। কলকাতার ভাস্কর্যের কথা প্রসঙ্গে উঠে এলো সে সময় শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর ভাস্কর্যের কথা। যা যামিনী পালকে দিয়ে করানো ওয়েলিংটন স্কোয়ারে (এখন আছে কিনা জানি না)। বেশ বড় মাপের। উনাকে বলতেই এক গাল হেসে বললেন - আরে, ওটাতো পুতুল আর দেখতে বড়বাজারের কোনো এক মানুষের মতো । তার অনেক আগে পূর্ণেন্দু পত্রী শান্তিনিকেতন থেকে রামকিঙ্কর বেইজ কে দিয়ে কলকাতা ভাস্কর্য প্রদক্ষিণ করিয়েছিলেন। রামকিঙ্কর কলকাতার একটি ভাস্কর্যকে প্রশংসা করেছিলেন সেটা তাপস দত্তের করা ক্ষুদিরামের। তার কথা তুলতেই উনি স্তব্ধ। হাঁ, তাপস আমার কাছে ছাত্রবস্থায় আসত। ছেলেটির কাজ বেশ ভালো। কিন্তু যামিনী পালের পুতুলমুখী ভাস্কর্যে বিমুখ।
মৃৎশিল্পে যামিনী পালের অবদান বহরমপুরে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা যা আপামর মানুষকে আনন্দ দিত। নিজে হাতে উনি স্বর্গধাম সেবক সংঘের মূর্তিটি প্রতি বছর করতেন। সমস্ত ঠাকুর নিয়ে যাওয়ার পর পঞ্চমীর রাত্রে ভোর পর্যন্ত তুলির টানে ব্যস্ত থাকতেন। আর নতুন নতুন কল্পনা বাস্তবায়িত করার কারিগর আর কেও ওখানে আছেন কিনা আমার জানা নেই। রঙের উজ্জ্বলতা আর শরীরের মাপজোপ অনন্যসাধারণ। পরবর্তীতে উনার পুত্র চন্দন পাল (আমার বন্ধু) সেরকম এগোতে পারেনি কারণ যে আসে সে একজনই আসে। সৃষ্টি আর ধ্বংস হিন্দু ধর্মে। মূর্তি বানানো আর তাকে জলে নিমজ্জিত। সে সময় খাগড়া ঘাটে নৌকায় করে ঠাকুরের বাইচ হত রাত অব্দি। গঙ্গার এপার ওপার মানুষজন দাঁড়িয়ে থাকত। অনেকে মাদুর বিছিয়ে গঙ্গার পাড়ে বসে বাজি ফাটাতো। যামিনীদা স্বর্গধামের ঠাকুরের পিছনে পিছনে ঘাট পর্যন্ত যেতেন আর তার পরেই পিছন ফিরে বাড়ি রওনা। একবার চোখে জলও দেখেছি। কালিদাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম উনি চলে আসেন কেন।
কালিদার উক্তি - সৃষ্টিকর্তা কি কখনো ধ্বংসের রূপ দ্যাখে?
ধ্রুব সত্য। মানব জীবনে কি কোনো পিতামাতা সন্তানের মৃত্যু কামনা করে ?
মৃৎশিল্পের আধুনিকতা আর সাইনবোর্ডের লেটারিং মুর্শিদাবাদের এক অনন্য অধ্যায় যা আজও স্মৃতি বিজড়িত অন্তরীক্ষে। সময় বদলায়। যে যায় সে আসে না। অনুকরণে কিছু মানুষের চেষ্টা থাকলেও হয় বিকৃতিকরণ না হলে নিজস্বতা। রূপ নেয় অন্য ধারার। আমি বারবার খুঁজি আর এই খোঁজা হয়তো অনন্তকাল।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন