সৌরভ শইকীয়া




রোনাল্ডিনহো 

একজন নারীর মতোই ব্যবহার করে।
একজন সুন্দরী রজস্বলা রমণীর মতোই সে 
ফুটবলটাকে নিয়ে খেলা খেলে 
গ্লাসে বিয়ার ঢেলে ঢেলে,ওহো না 
ডিস্কো থেকে জাজওয়েভ শুনে শুনে,ওহো না 
ব্রাজিলের সাওপাওলো থেকে এই হীরা খচিত রত্নটি সঙ্গে নিয়ে 
হুঁশ করে সে উড়ে যায় ইউরোপে 
আর ফুটবলটা ভাবে –হনিমুন
সে চুমো খায় শব্দ করে করে 
প্রবল জোয়ারে আলিঙ্গণ করে 
উপচে দেয় সে গলের ঠিকানা লিখে,রোনা...রোনা 
ইস!
শাসন করার বদলে মন ভোলানোর যত্ন করে 
কেন না সে জানে 
এই দু পা থেকেই নিক্ষেপিত হবে সেই ত্রাস সঞ্চা্রী মিসাইল
যেখানে বলটা আঁকাবাঁকা মেঘে সাজাবে বিপক্ষকে 
তাই,
ফুসলাতে যত্ন করে 
অন্য মন ভুলানো সামগ্রীর মতো একপদ থেকে আরেক পদে 
কারণ,বলটাতো জানে না 
সে যে তার সঙ্গে নারীর মতোই ব্যবহার করে… 






শুভ্র নিয়তি

ঝনঝনানি থেকে মুক্তি চাই 
বাতাসের শুকনো,মুগারঙের বিননি থেকে আমার মুক্তি চাই 
ঝরাপাতার সাইরেন থেকে মুক্তি চাই 
কোলাহলের কালো উপত্যকা থেকে আমার মুক্তি চাই 
মুক্তি চাই আমার মূর্ছনা থেকে 
প্রবল গ্রীষ্মে গোলমাল থেকে আমি মুক্তি চাই 
যন্ত্রঘর্ঘর ক্লিষ্ট পৃথিবী থেকে আমার মুক্তি চাই 
মুক্তি চাই হানাহানি থেকে 

মিরাকল থেকে আমার মুক্তি চাই 
দিবাস্বপ্ন থেকে আমার মুক্তি চাই 
নিসঙ্গতার নিপীড়ন… 
শুভ্র নিয়তির শী্তল থাবা থেকে আমার মুক্তি চাই 
ব্যথাঘন দীর্ঘশ্বাস থেকে আমার মুক্তি চাই 
মরুভূমি থেকে আমার মুক্তি চাই 

উন্মাদনা থেকে মুক্তি চাই 
কৃ্ত্রিম অভাব থেকে আমার মুক্তি চাই 
লোড শেডিং থেকে...হঠাৎ অন্ধকার এবং অন্ধকার 
তিক্ত অশ্রু থেকে মুক্তি চাই 
বিচ্ছেদ থেকে আমার মুক্তি চাই

চার দুই সমান ছয় থেকে আমার মুক্তি চাই 
অবসেশন থেকে আমার মুক্তি চাই 
ডেগারের বৃষ্টি আর সেই তুফানের থ্রী-নট 
সেক্স থেকে আমার মুক্তি চাই 
তীক্ষ্ন দংশন থেকে আমার মুক্তি চাই 
দুর্বিষহ জীবন থেকে 
চির বিষাদের চূড়ান্ত বসন্তে আমার মুক্তি চাই,
মুক্তি চাই আমার ভীষণ আধুনিক স্তব্ধতা থেকে 










মনজিৎ সিং




গণ  কবি

তাদের জিজ্ঞেস করলাম
কেমন লাগল তাদের কবিতা
তাঁরা বলল 
তাঁরা কবিদের কবি
আমরা কবি নই
তুমি আমাদের কবি হবে কি?

দাবাগ্নিতে  দগ্ধ হল বচনাতীতের  আস্বাদ

তাদের গভীর দীর্ঘশ্বাস

পাথর হয়ে আঘাত করত 
উপলব্ধির আকাশ।






আত্মমগ্ন

আমিতো কিছু না কিছু বলছিলাম
তুমিই তো দেখছি কিছুই বললে না
তুমি শুনলে কিনা জানিনা
এমনকি কিছুই জিজ্ঞেস করলে না

একটু একটু করে গড়ে উঠছে
মৌনতার  একটি  প্রাচীর
যেন পাঠোদ্ধার করতে না পারা
কোনো প্রাচীন শিলাস্তম্ভ

তুমি হয়তো নিজের অজান্তে
আত্মমগ্ন হলে অজ্ঞাত বনে

এখন কোনো জলতরঙ্গের ছায়ার মতো
দুলছ আমার চোখের পাতায়
ক্রমে
ক্রমে
আমি ডুবে যাই তোমার মৌনতার সাগরে
তার অনন্ত তলায় যে কোনো সময়ে
হারিয়ে যেতে পারে আনন্দপূর্ণ স্থিতি

পরে আবার অভিমান কর না
কিছুই না বলে
হঠাৎ চলে গেলাম  বলে!









জোনমণি দাস




অন্ধ এবং আয়না

আয়নার অবিহনে হয়তো
মানুষ অন্য কোথাও নিজেকে সঠিকভাবে দেখেনা,
নিজেকে দেখার জন্য তাই হয়তো দেখতে হয় আয়নার চোখের দিকে–
মানুষকে নিজের সঙ্গে মুখোমুখি করানো আয়না কিন্তু
নিজেকে দেখে না।
নিজেকে না দেখে অন্যকে দেখানোর জন্য চোখ মেলে থাকাটা 
আয়নার অলিখিত নিয়ম…
আয়না দেখে একা উলঙ্গ হতে
আমাদের লজ্জা লাগেনা, কারণ আমাদের বদনাম গাওয়ার জন্য
আয়না কথা বলতে পারেনা।

সমস্ত অন্ধ আয়না দেখে কি দেখে না
আমরা রাতকানা কবিরা জানিনা।
অথচ আয়না দেখে সেলুনে চুল কাটানো একজন অন্ধকে
প্রতি রবিবার দেখি।

আয়নার অন্য প্রান্তে কী আছে?
আছে কি অন্য প্রান্তে একটি ব্রহ্মান্ডের বিশ্বরূপ !
নিজেকে দেখার জন্য আয়নার কাছাকাছি যেতে
এ কথা প্রায়ই ভাবি। আর আয়নায় দেখা
অবিকল আমার মতোই ' 'আমি'টাকে আমি চিনতে পারিনা…

আয়না দেখে সেলুনে চুল কাটানো অন্ধটিকে 
একদিন জিজ্ঞেস করলামঃ আয়নায় আপনি নিজেকে দেখেন কি?
আমার কাঁধে হাত রেখে অন্ধ বললঃ
নিজেকে দেখার জন্য আয়না  লাগে না।
নিজের ভেতরে উঁকি মারতে হয়।
সব মানুষের বুকে একটি স্বচ্ছ আয়না আছে,
কাচের মতো যা কখনও ভাঙ্গে না…





আমার একটি আপেল ছিল

আমার একটি আপেল ছিল।
খাব বলে যত্ন করে রেখে দিতেই একটি আরশোলা খেয়েছিল।
' আপেলটা ' আপেল' ছিল কি ছিল না?'– সে জিজ্ঞেস করেছিল।
সে ছিল আমার স্মৃতিতে বিস্মৃতির লতা।…

আমার একটা আপেল ছিল।
মৃত সূর্য বলে ভেবে যাকে আমি সযত্নে সাজিয়ে রেখেছিলাম
ডাইনিং টেবিলে।
যারা আপেলটা দেখেছিল, তারা ছিল আমার
স্মৃতির পালক।

' আপেলটা ' আপেল' ছিল কি ছিল না?'
প্রশ্নবোধক চোখে আমি তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম–
আমার চোখে তাদের চোখগুলি হয়ে পড়েছিল এক একটি আপেল,
রক্তের মতোই যা টকটকে লাল…

আমি জানতাম–
আমার একটি আপেল ছিল, যা আরশোলা খেয়েছিল।
রাতগুলি লাল হয়ে জ্বলে উঠার পরে 
আপেলটা খুঁজে বেড়ানোর সময়
আমার স্মৃতিতে কথক হয়ে উঠেছিল
বিস্মৃতির লতা…











প্রকল্পৰঞ্জন ভাগবতী 




গান্ধীজির আত্মজীবনী থেকে কী শিখলাম

গান্ধীজির আত্মজীবনীতে –
খুঁজে বেড়ালাম জাতির পিতাকে,
                                 পেলাম মোহনকে।
খুঁজে বেড়ালাম উলঙ্গ ফকিরকে,
                                 পেলাম মোহনকে।
খুঁজে বেড়ালাম গান্ধী-রাজাকে 
                                পেলাম মোহনকে।
খুঁজে বেড়ালাম মহাত্মাকে ,
                   পেলাম মোহনকে।
খুঁজে বেড়ালাম নিজেকে,
                  পেলাম মোহনকে।
কেননা মোহন আমার মধ্যে ছিল না।
যিনি আমাকে আত্মজীবনীটা পড়তে দিয়েছিলেন
তিনি পুনরায় পড়তে বললেন; পড়লাম–
খুঁজে বেড়ালাম মোহনকে,
পেলাম জাতির পিতাকে, উলঙ্গ ফকিরকে, মহাত্মাকে আর নিজেকেও।
কেননা ততদিনে মোহন আমার মধ্যে ঘর বেঁধেছিল।





যাত্রা

যে বাসটা  আসার কথা ছিল তা আজও এল না।
অনলাইনে বুক করা টিকেটের প্রিন্ট আউটটা দিয়ে
একটি কাগজের নৌকা বানালাম
এবং কাছেই প্রবহমান নালাটিতে
ভাসিয়ে দিলাম।

বুকে একটা কান্নার রোল উঠল,
নদী হয়ে বওয়ার জন্য চোখের জল বের হল না,
ভালোই হল,
ছেড়ে আসা ঘরটা নদী থেকে বহুদূরে।








প্রয়াগ শইকীয়া




টাইম মেশিন

নাকের নিচে অল্প গোঁফ নিয়ে
হিটলার এসেছে
অন্য দিক থেকে
মাথায় টুপি নিয়ে
হাতে গোলাকার গলার একটা লাঠি নিয়ে
একই গোঁফ নিয়ে এসেছে
চার্লি চ্যাপলিন

চার্লি বলছে– হিটলার আমাকে নকল করেছে
হিটলার বলছে– কে চার্লি, আমি চিনি না

একটি যন্ত্রের মধ্যে চার্লি ঢুকে পড়েছে
বেরিয়ে আসতে মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে এনেছে
একটি যান্ত্রিক কীট

একঝাঁক ব্যতিব্যস্ত মানুষ
দৌড়াতে শুরু করেছে যান্ত্রিক চার্লির আগে আগে

অনুশাসনের  জন্য হিটলার সৃষ্টি করেছে
একটি নৃশংস দানব

সে যন্ত্রগুলির ওপরে গুলিবর্ষণ আরম্ভ করেছিল
টুং টাং শব্দে ছিটকে পড়ছে গুলির সঙ্গে
ছিটকে পড়ছে পেট্রোল
একটি মানুষ একটি অর্ধেক জ্বলন্ত সিগারেট
ছুঁড়ে দিয়েছে

হিটলার এবং চার্লির মধ্যে
এক বিরাট আগুন
ক্যামেরায় ধরে রাখছে একজন মানুষ
এই জীবন্ত মন্তাজ 

সময় মেশিনে আঙ্গুল বুলিয়ে
এইচ জি ওয়েলস মন্তব্য দিয়েছেন
সত্যিই বিচিত্র এই এলিসের দেশ



এপিটাফ

ট্রিগারে আঙ্গুল রাখতে ইচ্ছে করছে যদি
জলপাই পাতার মুকুটের জন্য রাখবে
জীবন বিনাশ করার জন্য নয়

ফুল ছেঁড়াটা যেমন সহজ
শিশুকে যিশু সাজিয়ে ক্রুশবিদ্ধ করাটা
ঠিক তেমনই সহজ

পাগলা অগ্নির আবেগে
নিরোর আদিম বেহালাটা
বার বার বাজিও না
জন্মভূমি মানেই ভাস্কর্যের নগর
আর আমার মৃত্যু মানেই
যুগে যুগে তোমরা শিকড়বিহীন










অনুপমা বসুমতারী





প্রেমের জন্য

আমাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে
নির্বাসিতের মতো
যদিও আমি কোনো
অপরাধ করিনি

নিঃসঙ্গতাকে আমি ধীরে ধীরে
খেয়ে ফেলতে  শুরু করেছি

এখানে এত নির্জনতা!
পাখির ডাক শোনার জন্যও
অপেক্ষা করতে হয় স্বপ্ন দেখা পর্যন্ত
স্বপ্ন দেখার মতো
ঘুমও হয় না অনেকদিন ধরে

রাত গুলিও জেগে থাকে
সাগরের চিৎকারে

যার জন্য আমি বন্দি এই নির্জন দ্বীপে
কেবল সেই প্রেমের জন্যই আমি অপেক্ষা করে রয়েছি
কে জানে সে হয়তো আসবে পালতোলা নৌকা মেলে

আর আমাকে নিয়ে যাবে
কোলাহলপূর্ণ কোনো মানুষের বন্দরে।




ধোঁয়া

মানুষ বলে
আমি ধোঁয়ার মতো

শীতে কুয়াশা হয়ে
ঢেকে রাখি আকাশ

বর্ষার গুমোট আবহাওয়ায়
উড়ে বেড়াই মেঘ হয়ে

দুঃখের দিন গুলিতে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকি
তোমার সিগারেটের সামনে

নিজের ভেতরটা জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে










অনুবাদক – বাসুদেব দাস

(মূল অসমিয়া থেকে বাংলা)


বাসুদেব দাস

১৯৫৮ সনে অসমের নঁগাও জেলার যমুনামুখে বাসুদেব দাসের জন্ম হয়। শৈশব কেটেছে গুয়াহাটি শহরে । ১৯৮২ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও ভাষাতত্তে এম এ করেন। আজ পর্যন্ত অসমিয়া অনুদিত গল্পের সংখ্যা চারশো আশিটিরও বেশি । সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নিয়মিতভাবে অসমিয়া গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এবং উপন্যাস অনুবাদ করে চলেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে সাহিত্য এবং অনুবাদ সম্পর্কে গবেষণাপত্র পাঠ করেছেন। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিচিত সংস্থা NEINAD-এর পক্ষ থেকে অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য Life Long Membeship এর দ্বারা সম্মানিত করা হয়। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পঁচিশটি।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন