পোস্টমডার্ন ভাবনা ও কিছু কবিতা:

পর্ব: ৯


প্রতীচ্যের এই তথ্য ভাবনাটি বাংলার সাহিত্য সাংস্কৃতিক মননেও ঢেউ তুলেছে গুরুত্বপূর্ণ পরিধি ঘিরেই। ১৯৯৪ সালের 'যোগসূত্র' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল কবি উৎপল কুমার বসুর একটি সাক্ষাৎকার। ওই সাক্ষাৎকারের কিয়দংশ তুলে ধরলে কিছু ধারনা ভেসে উঠে জানিয়ে দেবে হয়তো, বাংলা কবিতায় পোস্টমডার্ন বৈশিষ্ট্য তার কোন বিশেষ অবস্থানে কবির মনে এবং সংলাপের চিহ্নিত হয়ে আছে অথবা হয়ে থাকতে চেয়েছে। কি করে বানায় সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন: অজিত চৌধুরী, উৎপল দত্ত গুপ্ত, বিনয় ঘোষ, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়, সঞ্জয় চক্রবর্তী, মানস বসু, অসীম রক্ষিত, কল্যাণ ভট্টাচার্য, শ্যামলী সুর এবং ভাস্কর রায়।

বিনয়: যেখান থেকে তুমি উৎপল কুমার বসু কে দ্বিতীয় পোস্টমর্ডানিস্ট কবি বলেছ?
অজিত:  সেটা সম্পূর্ণ আমার নিজের কাছে -- 
উৎপল: দ্বিতীয় বলার একটা সুবিধে হচ্ছে প্রথমটা কে সেটা --
অজিত: প্রথম জীবনানন্দ দাশ। আর কে হবেন। কিছু কিছু লেখকের থাকে নারা সব সময় যেমন সাঁতরে লিখেছেন মালার্মে নিয়ে, দেরিদা লিখেছেন মালার্মে নিয়ে মালার্মে আধুনিকতা এবং উত্তরাধুনিকতার একটা বর্ডার লাইন। যারা পড়াশোনা করছে তারাও কিন্তু আপনাকে ওইভাবে সিরিয়াসলি নেয় --  যে এর থেকে আমাদের ড্র করতে হবে, এর থেকে আমাকে বুঝতে হবে ,এর লিখন ভঙ্গিমার চার্ম - এ আমি পড়ে যাব না, তাহলে সেটা আমাকে গিলে খাবে, আমি মরে যাব --

উৎপল: সাহিত্য তো তৃতীয় শ্রেণীর সোর্স, সত্যি বলতে কি কোন লেখক সাহিত্যের কাছে কিছু জানতে বা শিখতে যায় না। পরে বুড়ো হয়ে বলে, বঙ্কিম ভালো রবীন্দ্রনাথ ভালো ইত্যাদি সে কিন্তু আসলে খোঁজে পাড়া-প্রতিবেশীর ভাষা, গালাগাল হেন তেন, বাজারে কে কিভাবে কথা বলছে --  এই সব থেকে সৃষ্টি করে। মানব সম্পর্ক অনুধাবন করে।

রাঘব: উৎপল দা, ফর্ম আর কনটেন্ট নিয়ে সাহিত্যে যে বিতর্ক, পুরনো এই ব্যাপারটা নিয়ে আপনার মুখে শুনতে চাই।

উৎপল: বেশি কিছু বলার নেই এটা নিয়ে। এটা সুবিধামতো তৈরি হয়েছে। যখন কাজে লাগে তখন শব্দ দুটোকে আমরা ব্যবহার করি আবার কাজে যখন লাগেনা তখন বলি ফর্ম আর কনটেন্ট একই জিনিস। এরকম বহু সমান্তরাল জিনিস আমি খুঁজে বার করতে পারি। একসময় , গার্ট্রুড স্টাইন বলেছিলেন, the composition is the only explanation -- ছবির ক্ষেত্রে বিশেষ করে। এই ধরনের এক্সপ্লানেশন হয় কিনা ফর্ম ধরে রাখা ব্যাখ্যা করা যায় কিনা ,এই সমস্ত ব্যাপারে আমি নিজে তেমন উৎসাহী নই। এগুলো আমার কনসার্ন নয়, সংশ্লেষ নয়। আমার সংশ্লেষ হচ্ছে একটা মনোজগৎ তার সঙ্গে ভাষা জগত এবং ভাষা জগতের সঙ্গে ত্রিভুজ হিসাবে একটা যৌনতার জগত আছে এইযে যৌন সচেতনতা আজ প্রমাণিত এটা জন্ম মুহূর্ত থেকেই থাকে আমৃত্যু একজন ব্যক্তি এই যে একটা জিনিস বহন করে চলেছে সেক্সুয়ালিটি এত বড় একটা ডমিনেটিং ফ্যাক্টর, আমাদের জীবনে একটা কন্ট্রোলিং ফ্যাক্টর ,এর সঙ্গে ভাষার একটা সম্পর্ক আছে ।এখন ভাষা বা যৌনতা কিভাবে উদ্রেক হয় কোনটা কিভাবে প্রভাবিত করে বাইরের লেখকদের ক্ষেত্রে তার বিশ্লেষণ করতে আমি রাজি নই; কিন্তু আমার নিজের লেখা বারবার এগুলো ভয়ঙ্কর ভাবে ফিরে এসেছে।

অজিত: আপনার লেখা '  প্রাণের দিকে চেয়ে দেখি ' ' ওইখানে অদিতির কণ্ঠস্বর শুনি আমি ',' হে যুবক নষ্ট কোরোনা বীজ ' এগুলো আমার অসম্ভব প্রিয় কবিতার লাইন। বেশকিছু কবিতায় পুরো অ্যাসোসিয়েশন টা পাই -- সবজির কাজে ব্যস্ত, গোয়াল ঘরের মেয়েরা -- যায় দিন, গ্রীষ্মের দিন যায়, যায় সূর্য,যায় দুর্ঘটনা, সময় বীজ নষ্ট করো না বলছে, ওদিকে অদিতি, আদিমাতা এবং তার আগে বোনের মধ্যে উদ্দেশ্যবিহীন দমকলের ঘুরে বেড়ানো-- সম্পূর্ণটা নিয়ে একটা রিভিলেশন এর কবিতা হয়ে আসে। কবিতার মধ্যে রাইটিং এর লেভেলে একটা রিভিলেশন হলো।… রাইটিং টাই তখন ফর্ম হয়ে উঠছে।

উৎপল: এটাকে বলা চলে it's এ ক্রনিকেল। ডায়েরি বা ক্রনিকেলের মত সে লিখে যাচ্ছে ,এগুলো হয়তো বস্তুত কোন সাহিত্য নয়।

অজিত: এটাই একটা অনুভূতি যা আজকের ছেলেমেয়েরা ভীষণ ভাবে শেয়ার করছে।

রাঘব: তাহলে উৎপল কুমার একটা নামমাত্র যে এই প্রক্রিয়া একজন অংশগ্রহণকারী। যে একজন ক্রনিকল রাইটার, পুরনো দিনের গির্জার ক্রনিকল রাইটারের মতই প্রায়। যতই যে নিজেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে নিজস্ব কালচারাল লেয়ারগুলোকে ঝরিয়ে ফেলবে ততই আরও ভালো ক্রনিকল রাইটার হয়ে উঠবে, ক্লিনিকাল অপারেশন এর মত ক্রিম টুকু তুলে সাজিয়ে দিতে পারবে। এটা ভয়ঙ্কর রকমের আধুনিকতার লক্ষণ। গুহাচিত্র যেমন কে এঁকেছে জানার মানে হয় না। যে দেখে সেই স্রষ্টা, আবিষ্কর্তা।

অজিত: আর একটু কোয়ালিফাই করে একে উত্তরাধুনিকতা বলি। আধুনিকতা তো নামটা রাখছে, সেখানে উত্তরাধুনিকতার এলিমেন্ট গুলো থাকছে।

উৎপল: এখানে আর একটা কথা বলি। যারা এই রকম কাজ করবে তাদের পাঠকের ওপরে গভীর বিশ্বাস রাখতে হয়, বিশ্বাস এই যে লোকে একদিন সমস্ত বুঝতে পারবে, আমার সবকিছু বলে দেবার দরকার নেই। যারা ন্যারেটিভ গল্প লেখে তারা ভাবে, রাম বসলো ,রাম ভাত খেলো, রাম ভাত খেয়ে জল খেলো এভাবে না লিখলে বুঝতে পারবে না । পাঠকের ওপরে বিশ্বাস হারানোর চেয়ে বড় আত্মপ্রবঞ্চনা ক্রিয়েটিভ লোকের পক্ষে আর কিছু হতে পারে না। শুধু তাই নয়, এই ধরনের লেখা পড়তে গেলে অপমানিত বোধ করি। লেখক কেন আমাকে এভাবে কথাগুলো বলছেন? আমি কি বুঝতে পারব না?

মন্তব্য আরোপিত সত্যে না গিয়েও একথা বলা যেতে পারে সাক্ষাৎকারটি থেকে  চিন্তনের এক অভিমুখ বৈশিষ্ট্য নির্দিষ্ট হয়ে ওঠে।

ব্রিটিশ আমেরিকান কবি Denise Levertov (১৯২৩-- ১৯৯৭) এর একটি অনুবাদ কবিতা দিলাম। মূল কবিতা " Overland to Islandas " 
অনুবাদে করা হয়েছে:

স্থলপথ ঘুরে দ্বীপে

চলো যাই -- কুকুরের মতই
নিবিড়তায় উদ্দেশ্যহীন এলোমেলো ঘুরি,
মেক্সিকান আলোর মত দিনটিতে
কানেকটিকাটের শরতের  গন্ধে
ঢেউ খেলে আইরিশ পশমের কালো উজ্জ্বলতা -- 
এবং এটিও কামনা স্পৃহায় অভিলাষে -- সঙ্গী হয় সেই নৃত্যের প্রতিভাস বিকিরণে

      --- তার পায়ের নিচে
পাথর কাদা এবং কল্লপনা ঘ্রাণে
সংসক্ত হয় বেদন  বিভাব -- নাচনের কিছুই থাকে না কুকুরের, মৃত্যুময় প্রান্তপথের তাচ্ছিল্য অনাদরে

চলার পন্থায় পাল্টায় গতির চলন বাঁকে -- কিন্তু নির্নয় নয় অভিমুখে -- প্রতি পদচিহ্ন লেখে আগমনে।

(চলবে)















তাপস গুপ্ত 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন