কবিতা

ওআমি এসো আমায় সম্পূর্ণ আমি করো

গর্ভের বাইরে চিপকে যাওয়া ভ্রূণের পোড়া চুলের গন্ধ। বদবু-কুসুম।  কী ঘেণ্ণা কী ঘেণ্ণা। কীইযে ঝামেলি।  অ্যাক্সিডেন্ট নাকি মার্ডার। তছনছ জন্মস্থান-আস্তরণ। থেঁতো ঘাসেদের স্বপ্ন। সাঁওতাল গুয়েভারা ভগবানদের চোলাইয়ের ঠেকে চিৎ হয়ে মহম্মদ আর যীশুর ঘ্রাণে বিভোর আকাশের তারাদের চেনবার জন্যে মাঝেমধ্যেই ভেঙেপড়া চলমান ফ্লাইওভার খোঁজে। জেহাদের জিগির তোলা একটা সুজন গাছও যদি এই সময়ে পাওয়া যেতো। আহা লক গেট। ওহো নীরব কণ্ঠস্বর-লকগেট। মেরুদণ্ডে দাবাখেলা... পাথরের শতরঞ্চ-আঁকা গন্ধ...  এক ধূসর গন্ধ...

ভূ-গর্ভস্থ ঢাকনা খোলা নর্দমা। একে অপরকে কামড়াতে উদ্যত। খুলিতে একটা তারা ছুটে আসছিল। বিদ্ধ হলো। তারা নাকি গুলি। কী বেরোচ্ছিল। আত্মা প্রাণ নাকি রক্ত। তাহলে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠলোটা কে। কে কার বুকে কী বসিয়ে দিল। 

ইসবকথা শুনাইতে শুনাইতে ঘুমাইয়া পড়সিলাম। জাইগা উইঠা দেহি বেবাক ভুইল্যাগেসি। নিজেরেই শুধাই--
হেই এতডাকাল তুই কইসিলি। তুর তীর ধনুক গেলডা কমনে। 

আমি সরে যাচ্ছি আমার এতো দিনের পাড় থেকে। ফাটা চিহ্ণ বাড়ছে। গালে মাথায় কপালে নেশাতুর ছায়া। কালো পিঁপড়েরা শাদা শাদা ডিম নিয়ে ছুটছে। উলঙ্গ ছুরি নিজেকে ভেতরে টেনে নিতে চাইল। নিজেকে নিজে তৃপ্ত করার রক্ত আরও জেদি। সওদাগরি নৌকো দাঁত কিড়মিড় করছে। খেলার মাঠে অপুষ্ট ভ্রূণ সনাক্ত করার কেউ নেই। টলটল করছে বে-সনাক্ত বড় হয়ে ওঠা অন্ধকার। 

একটা ধর্ষণ কতকিছু দেখে নেয়। বুকের স্পষ্ট খাঁজ। উন্মাদ-দংশন। বর্ডারে চেকপোস্ট পেরিয়ে রাস্তা মাড়িয়ে মোটর ছুটছে।  এখন কোথায়। কটা বাজে। কিছু জানা নেই। কেবল সময় জানে-- শরীরের আর এক নাম ধর্ষণ।  ধর্ষণের আর এক নাম জীবন। তবু এ এক জীবন-বিহ্বল অন্তহীন খেলা। সোনালিজীবনলেখা পথ মাড়িয়ে ধর্ষণ ছুটছে। ধর্ষণ করো। অথবা ধর্ষিত হও। 

এই সব লেখাগুলো খুব চেঁচাচ্ছে।  আর একটু কম চোখ কান খুলে রক্তের রোদে একটা ছোট্ট রোদ-চশমা পরিয়ে নিজস্ব নৌকোকে কুঁকড়ে যাওয়া ফসিল করে... তারপর লিখলেই ভালো হতো। বেঁচে বর্তে শূন্যতায় থাকা যেত। 

তাহলে যে পাখিদের ঘামে-ভেজা-গান সাদা ডিমের ভেতর গড়ে ওঠা কালো পিঁপড়েদের কবিতা-ঘর চারপাশে ধীরলয়ে হাঁটতে থাকা ভ্রূণেদের ভোরের পরাগ-ঘর কাদামাটিতে বাজতে থাকা জীবনের সবুজদানার নিটোল কোরাস-মিছিল... এইসব এই পৃথিবী এই কিশোরী-ভুবনের নতুন দেখা খোলা-না-খোলা পাপড়ি-আলো-চোখ... আহা আগাছায়ও ফুল...  কীইযে লম্বা ঢেউরং...  আম-আঁটির ভেঁপু... একটা কেটে যাওয়া ঘুড়ি নামছে নামছে... পেছন পেছন তুলতুল আনন্দ তুলতুল হইহই স্বাদ... আহা কীইযে স্বাদ শব্দ... এখন খেতে পাই না...  চোখে চালসে... কানে কান নেই... তবু... তবু রক্তে ভাসছে এখনও লাল... এখনও খোঁজা... আমি নামে একটা সবখানি আমি...







একটি সর্বদলীয় গন্ধ অথবা বনসাই হতে থাকা ভগবান

বৃষ্টি। আমি । ছুটছি। না না ভিজে যাব বলে নয়। তাহলে কি জন্য? ঠিক আছে। বলছি বলছি। তার আগে আপনাদের মধ্যে যে কেউ বলুন তো, একটা বৃষ্টির ফোঁটা থেকে আর একটা বৃষ্টির ফোঁটা সাদা চোখে আলাদা ভাবে চেনা যায়? আসলে অনেকগুলো চেনা-অচেনা একক অনেক সমীকরণ হলো বৃষ্টি। পেছনে সামনে পাশে অনেক অনেক নিয়েও একটা একক তৈরি হয়, সহজ আনন্দে কে জানে সেই কবে থেকে আমরা যার নাম দিয়ে ফেলেছি বৃষ্টি। বৃষ্টি কিন্তু নিজে ভেজে না অপরকে ভেজায়। এটুকু লিখতে লিখতেই একটা আমির শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ‘একটা আমি’ - এর’ম একটা শব্দ উচ্চারণ করছি কেন? ঠিক আছে। বলছি বলছি। তার আগে বলুন তো আপনি বেকার না সাকার? আরে বলুন বলুন তাড়াতাড়ি করুন। যে আমি আপনার সাথে কথা চালাচ্ছে তার সময়ের দাম আছে। ফালতু বাতেলা করার একদম সময় নেই। ঘণ্টা বাজাতে বাজতে ছুটছি। ঠাণ্ডা আইসক্রিম’। ‘বরফ আইসক্রিম’। এর ছোঁয়ায় এক ধাক্কায় কঠোর গরম এত যে তেজ বিধ্বস্ত হয়ে রাজপাট ছেড়ে বিদায় নেবে। এ একেবারে বরফজলের কোয়াভাঙা এক্কেবারে আসলি রং। কোনো নকল রঙের কারিগরি নেই। এই যে দাদা, এই যে দিদি বাইকটি থামিয়ে একবারটি হাত বাড়িয়ে একটি কিনলেই আমাদের যে পেটের আগুনের হাজার ফণার পর ফণা মাথা তুলেই চলেছে একটুক্ষণের জন্যে হলেও তো ফণা মাথা তুলতে গিয়েও মিলিয়ে যাবে। কি বলছেন? জানতে চাইছেন এতসব শব্দের প্রসাধন বাচ্চা বয়সে শিখলাম কিভাবে? বাঁধাগৎ। লকগেট খুললেই বেরিয়ে আসে। সমর মাস্টার শ্যামলদা তহমিনাচাচি কুশলকাকু হাত ধরে বার বার করে শিখিয়েছে মুখস্থ করিয়েছে, বুঝিয়েছে। আমি/আমরাও বুঝে গেছি জেনে গেছি –বাচ্চা হলেও আমি আর এখন বাচ্চা নই ঝুরো সবুজ, কেবল বাচ্চা নামের একটা কৌতুক উড়ছে। তাই যাই উড়ুক, এইভাবে ফোঁটা ফোঁটা রোজগারে স্কুলে পড়তে পড়তেও পরিবারের অভাবের সৎকারের কিছুটা হলেও তো হবে। আর বাচ্চা বয়সের সৎকার সে তো কবেই হয়ে গেছে।

আরে এই ছোঁড়া তুই তো দিব্যি তোর খিদে বোঝাই নৌকো এই ওই সেই এর কাছে খালাস করতে করতে লাব্‌ডুব লাব্‌ডুব একান্ত বেল বাজাতে বাজাতে ‘বরফজল’ ‘বরফ আইসক্রিম’ সাইকেল ছুটোচ্ছিস আর এদিকে আমি ছলকে উঠছি। তুইটাই আমি হয়ে ফুটছি। তোর দেহটাই মনটাই খিদেটাই নিজস্ব নির্মাণ হয়ে আমিতে বইছি। আমার আমিটাই অতল থেকে সাফ হয়ে হয়ে যাচ্ছি তুই নামে বাচ্চাটা।

কি তাও এই কুহকটা বোঝা যাচ্ছে না? আরে বাবা, আমি এখন কোথাও নেই। আমার ঘর দেহ কোথায় যেন যাওয়ার কথা ছিল ... বৃষ্টিভেজা জানালা ... মরা আলো রাস্তা ...। না! আমি ঠিক বোধহয় বোঝাতে পারছি না। ঠিক আছে একটা ধরতাই দিই। আমি এখন ওই আইসক্রিম বেচা বাচ্চাটা। কিন্তু তারই মধ্যে ঠিক কি করে যেন
একটা আপন ভাষার ইশারা আছে যে আমি ওই বাচ্চাটা নই। কারণ কারণ ভিতশুদ্ধু মাংসখোসা নাড়িয়ে (না কি মর্ম খোসা বলব) খানিক আগেই

মানে তখন ফজরের নামাজের আজানের ডাক পড়েনি। ভোর অথচ ঠিক ভোর নয় মানে তখনও ঠিক আলোর দোকান খোলেনি তখন আমাতে ধাতুপাতের ধাতুপাত সারিবদ্ধভাবে নিস্বতা রোপন শূন্য রোপনের মহতি চাষের কাজ চলছিল আমি ধর্ষিত হচ্ছিলাম। যাঁরা এই চাষের কাজ করছিলেন তাঁদের দেশ জাত কাল ধর্ম বয়স ঠিকানা কিছুই জানিনা। কিন্তু এটুকু জানি এটুকু বুঝছি ওই ওই চাষি ওই ওই শিকারি ওই ওই আদ্যোপান্ত ধর্ষণ ফুটিফুটি সবকিছু ছিঁড়ে ফেলে গাঢ় রক্ত আছড়ে পড়া ধর্ষিতার জ্যাস্তব আনন্দ গন্ধ-উপভোক্তাও আমি। আমি চামড়াভেদ করা যন্ত্রণায় খসে পড়ছি। শেষ পৃথিবীর চৌকাঠ ডিঙিয়ে আমাকে যেখানে ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে, সেখানে রাখা আছে শুধু একটা ফুটোপাত্র, জল দরজা-উপড়ানো আগুন আর দুদিন আগেকার (একদিন আগেরও হতে পারে) স্কুলের কলেজের মেসবাড়ির কাজের থেকে ফিরে এসে ছেড়ে রাখা ঘামনুন-আকাশ ভরা বাসি টক গন্ধ, খিদে তেষ্টা রং পোশাক (বলতে দ্বিধা নেই আমি ভদ্দরলোকের বাচ্চা এবং অত্যন্ত হারামি)। সম্পর্কের শাঁস নেই। এ ঢোঁড়া সাপের বাসনা ছাড়া কোনো একটা আলো বীজ ঘর নেই মুখোশের মুখ ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই রে....

মনে হচ্ছে ওই ওই লোকটা আমিই। এ বিষাদ জড়িয়ে আছে আমাতেই। আরশির দিকে তাকাই। হ্যাঁ হ্যাঁ ওই শরীরের প্রতিটা কোষতো আমিই। একটাও কি লাইটহাউস নেই যার আলোতে আমি পথের দিশা পাব? অমনি প্রতিধ্বনি...

তুই তো ক্রমেই ভগবান হয়ে যাচ্ছিস। শিকার শিকারি নিজেতেই গড়ছিস। শিকারের ভেতর শিকারি, শিকারির ভেতর শিকার ... ফোঁটা ফোঁটা একা একা উদাস। সোহাগ মহার্ঘ। আলোধুন দেহাতি মরশুম দূর গড়ানো আকাশ এবং লালসা অবশ শেষতম সুতো খসে যাওয়া মায়া সেও যখন তুই, তখন তুইই তো লুটমার ভগবান। সক্কলে শিরাউপশিরায় ছুরির ফলায় চিৎকার ঝরাতে থাকে – তুই ভগবান।

সব্বাইয়ের (কারণ যে কোনো ভাবেই বা অজানিত করণে বা অকারণে হোক হলে (এর 'ম সব্বাই বলে না কেন, আমিই সব্বাই বা সব্বাই আমি হয়ে যাচ্ছি কালপূর্ণ ব্যাপারটা আমার বোধগম্যের বাইরে) নিখোঁজ হওয়াটা কি আমাতেই নাকি আমি ক্রমাগত না নেভা শূন্যে অর্থাৎ সব্বাইতে... কী কী হয়ে চলেছি আমি? আচ্ছা এসব ছাড়ো তোমাদের ভাষায় আমিই যদি ক্রমাগত বিন্দু বিন্দু একায় ফোঁটা ফোঁটায় সবে ভগবান, তাহলে ভগবানের পাঁজরের সুঘ্রাণ কই আমি কেন ইচ্ছে মতো সাজাতে পারিনা যন্ত্রণায় যন্ত্রণায় স্থবির দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া দগদগে ক্ষত দলা দলা মাংস ধুয়ে মুছে সুস্বাদু রসনা খাদ্য তালিকায় রসময় ভালো লাগা বাসস্থানে মন দিয়ে মনকুসুম কেকাডাকা একতারা শরীরে, পল অনুপলে নিজেকে খুলে খুলে সবুজ ভোর গন্ধে ভাতফোটা বৃষ্টির খেলায়, ঘরে ফেরার সুগন্ধিশাদা আনন্দে ...। না। এসব আমি কিছুই করতে পারি না। শুধু আগুন আগুন চাওয়া। আর পেতে গেলেই সাঁকো নেই পোশাক নেই মেরুদণ্ড নেই

পাঁজর নেই। কাজেই পাঁজরে পাখি ডাকাও নেই। কেবল দাহ হয়ে যাওয়া পাখিদের উহ্য হয়ে যাওয়াটুকু আছে।

তবুও নাকি আমি ভগবান।

আসলে কেটে কুটে আকাশ-রং-পোড়া গন্ধ মাখা বনসাই ভগবান। আহা কাটাকুটি যুদ্ধ বিভাজনোক্ষম ছাপোষা ভগবান একটি ভিক্ষাপাত্র হয়ে ভিক্ষা আশা নিয়ে ঘুরছেন –ও নোলকপরা কিশোরী মেয়ে, আমি কী যেন তোমায় বলতে চেয়েছিলাম ওই কয়েকটা পাতা যে কেমন করে খাঁচায় বন্দি হয়ে রইলো ... ওগো মেয়ে বলোনা যখন পাড় ভাঙে ভগবানও কি যন্ত্রণা পায় ?

ভাঙা বাড়িটার সাথে একটা পা ভাঙা কুকুর ছাড়া কেউ খুনসুটি করে না, যথারীতি বড়শি জলে নড়তেই থাকে কোনো আমের মুকুল নেই ... আমি কুহু ডাকতে থাকি ... একটা ক্রমশ শব্দ ভগবানের বনসাই পর্বটা ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা দেখতে থাকে ... শরীরের পংক্তির ভেতর রক্ত আদিম শিকার-সন্ধানী বীজ ফুল ফোটার শব্দ শুনছে ... গ্যালারিতে টাঙানো ছবি— দর্শক ... মুগ্ধপাত ... ধাতুপাত ... মৃগয়াপাত .. একটি হ্রেষা মাখামাখি হেয়া ... ছাড়ো ছাড়ো... তুমি জানো না তোমার মুখে অমৃত আছে ... আ! কত ঘুম ... একমুঠো ধুলো। ঘোমটা নেই সংকোচ নেই – আদালত থেকে বনসাই ভগবান (ভগবানের পুং/স্ত্রী নেই) অনন্ত চিৎকার । না হ্যাঁ না এবং তারপর বিধ্বস্ত বিহ্বল কাঙাল দৃষ্টি। অভিব্যক্তিহীন কলম ফাঁসিকাঠে ঝোলাবার রায় লিখে চলেছে —কড়িকাঠের কাছে রুদ্ধশ্বাস দুনিয়া...






স্বপ্নের ফেরিওয়ালা 
(স্বপন দত্ত)


পরিচয়:

জন্ম থেকেই বিশ্বাস নেই যে মানুষের পক্ষে কোনো কিছুই করা অসম্ভব, তাই নানান বিষয়ে এমএ, তাছাড়া এলএলবি, হোমিওপ্যাথি ডিগ্রি, আবৃতি,  নাটক, গান, অঙ্কন, শর্ট ফিল্ম,  কবিতা, গল্প, উপন্যাস লেখা।  সব স্পেসেই চারণ করেছে অর্থাৎ বোঝাতে চেয়েছে তুমিও পারবে, তুমিও পারো। হারা-জেতার ব্যাপার নয়, আনন্দকে সঙ্গে নিয়ে হাসির দিকে এগিয়ে যাওয়াই হল জীবন। জ্ঞানত বা ভাবনায় কারুর ক্ষতি করা একমাত্র পাপ। আর সবাইকে, সবকিছুকে ভালোবাসাই হলো ধর্ম। এটাই এই স্বপ্নের ফেরিওয়ালার বিশ্বাস।  তাই স্বপ্নহৃদয় সৃজনে ঝুড়ি ভরে নেওয়াই তার নিরন্তর অধ্যাবসায়....


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন