রথীন বন্দ্যোপাধ্যায়
শিল্প প্রদর্শনী
ভূমিকা:
শিল্পের মাধ্যমে আমি আমার ' আমি ' কে দিই। যিনি
গ্রহণ করেন তিনি আমাকে পান। সুতরাং শিল্পী এবং
দর্শকের ভিতরে একটা দাতা এবং গ্রহীতার সম্পর্ক
রয়েছে। শিল্পী রসের আধার। সেই রস দর্শকের অন্তরে
মনে কীভাবে সঞ্চালিত হবে? তাই শিল্পীকে তার সেই
নিজস্ব রসের রপদান করতে হয়। রসের এই রুপান্তরিত
রুপ থেকে দর্শক তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা, রুচিবোধ,
রসাস্বাদন ক্ষমতা অনুযায়ী রসটিকে নিঙরে নেন।
'শিল্প' একটি মাধ্যম যা শিল্পীর রস দর্শকের ভিতর
সঞ্চালিত হতে সাহায্য করে।
নিরাকার পরমব্রহ্ম রসস্বরুপ। তিনি নিজেকে প্রকাশের
উদ্দেশ্যে সাকার-এ বহুধা বিভক্ত হলেন। জীব থেকে
জড়, পরমাণু থেকে পর্বত সর্বত্রই তাঁর সেই সাকার
রুপ ব্যক্ত। সবকিছুই তাঁর সেই আনন্দঘন রসের
রুপান্তরিত রুপ।
ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, এ কথা যদি মেনে নেওয়া হয় এবং
তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিরুপ-এ এই সত্য প্রতিষ্ঠিত, এই
স্বীকার্যটি যদি গ্রহণ করা যায়, তবে নিশ্চিত বলা
যেতে পারে, যেখানে সত্য প্রকাশিত,যেখানে নির্মল
আনন্দের সর্বোত্তম ও স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ, সেখানেই শিল্প। সুতরাং সচ্চিদানন্দ ব্যতিরেকে, অস্বীকার করে কিংবা
উপেক্ষা করে কোনও কিছুই শিল্প নয়। পরমুহূর্তেই এই
পরস্পর বিরোধী কথাটি বলতে হয় যে, সবকিছুই
শিল্প এবং সবকিছুতেই শিল্প। কেননা পরবর্তীতে
এই সূত্রটি প্রাসঙ্গিক হয়—গ্রহীতাভিত্তিক আধার
বিশেষে রসের তারতম্য ঘটে, সত্যের হেরফের হয়,
আনন্দের প্রকাশও কম বেশি হয়।
শিল্পী শুধুমাত্র রসের আধার—এই লাইনটির মধ্যে
একটা সুক্ষ ফাঁকিবাজি লুকিয়ে আছে। প্রকৃতপক্ষে
শিল্পীকে অরুপ রতনের খোঁজে অনবরতই রুপ
সাগরে ডুব দিতে হয় এবং রীতিমতো হাবুডুবুও
খেতে হয়। ঠিক এই জায়গাতেই প্রয়োজন হয় কিছু
টেকনিক্যাল পদ্ধতিকে রপ্ত করার কৌশল, নয়তো
শিল্পী কখনই শিল্পী তার রসকে রুপে রুপান্তরিত
করতে পারবে না। শিল্প দর্শকের অনুভূতির সাথে
একাত্ম হতে চায়। দর্শক তো আর রসটুকু দেখতে
পায় না, সে চায় রসের রুপান্তরিত রুপ, যে রুপ
থেকে তিনি তার আধার সাপেক্ষে রসাস্বাদন
করতে পারবেন।
আগে বলেছিলাম, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। কিন্তু সেই
ব্রহ্মের অসংখ্য প্রকাশ মাধ্যম তথা রুপপরিগ্রহণ
অর্থাৎ নিরাকার থেকে সাকার ধারণ, এ সব
উদ্দেশ্যই তাঁর বিফল হবে যদি না সেই রুপের
রসে হাবুডুবু খাওয়া যায়, সেই পরম আনন্দঘন
রসের স্বাদ গ্রহণ না করা হয়। যে শিল্পী এবং
যে দর্শক সে রসের স্বাদ বিভিন্ন ভাব-এ, বিভিন্ন
মেজাজে, বিভিন্ন মানসিকতায় ও অভিজ্ঞতায়
যথার্থই গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছেন, তার কাছে
ব্রহ্ম এবং জগৎ দুইই সত্য।
জগতের এই রুপ চূড়ান্ত সত্য, পরমানন্দময়।
এ জগৎ যদি সেই পরম পুরুষেরই রুপপ্রকাশ হয়
এবং সে রুপের অন্তঃস্থলে থাকা রসটুকুর যদি
আস্বাদনযোগ্যতা থাকে, তাহলে এ জগৎ যেমন
সত্য, তেমনই জগতের প্রতিটি রুপই শিল্প।
শিল্পীর কাজ শুধুমাত্র পরম পুরুষ সৃষ্ট
অসংখ্য রুপাবলীকে তার নিজস্ব রসে সিক্ত করে
পুনরায় রুপ দান করা, অর্থাৎ, পুনর্নির্মাণ মাত্র।
মহাবিশ্বের প্রতিটি পরমাণু থেকে গ্রহ নক্ষত্র সমূহ
এবং গ্যালাক্সিগুলিকে সৃষ্টি মুহূর্তেই স্রষ্টা সুনির্দিষ্ট ভাবে
সুরক্ষিত ও সুসামঞ্জস্য বিন্যাস করেছেন। এই
বিন্যাসই ব্রহ্মাণ্ডকে স্থিতাবস্থা দিয়েছে এবং সামগ্রিক
ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করেছে। যেখানেই উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভাবে এই ভারসাম্যকে নষ্ট করার
প্রবণতা দেখা দিয়েছে, সেখানেই সবকিছু অসুরক্ষিত
হয়ে পড়েছে, চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে।
এর থেকেই বোঝা যায়, যেখানেই ভারসাম্যের
প্রতিষ্ঠা, সেখানেই সুরক্ষা এবং সেখানেই শিল্প।
অসামঞ্জস্য বিন্যাস, ভারসাম্যহীনতা যেকোনও
পরিসরকেই অসুরক্ষিত করে। শিল্পীর কাজ ভিন্ন
ভিন্ন ভরকে সুরক্ষিত করা—
অর্থাৎ, ভরগুলিকে তাদের নিজস্ব ভরকেন্দ্রে
সুপ্রতিষ্ঠিত করা এবং ভারসাম্য বজায় রেখে তাদের সুসামঞ্জস্যরুপে বিন্যস্ত করা। একটি বিন্দুরও
যেমন নিজস্ব ভর আছে, তেমনই অসংখ্য
বিন্দুর পাশাপাশি অবস্থানে গঠিত রেখারও নিজস্ব
ভর আছে, অসংখ্য রেখার ঘন সহাবস্থানে গঠিত
তল সমূহেরও ভিন্ন ভিন্ন নির্দিষ্ট ভর রয়েছে।
প্রতিটি রঙের ভরও নির্দিষ্ট। ভরের বিভিন্নতা
অনুভব করে, তাদের সুনির্দিষ্ট ভরকেন্দ্রগুলিকে
চিহ্নিত করে, কোনও পরিসরে সেই সমস্ত ভরের
ভারসাম্য বজায় রেখে সুচারু বিন্যাসই সেই
পরিসরটিকে সুরক্ষিত করতে পারে। রুপদানের
ক্ষেত্রে যেকোনও শিল্পীরই মুখ্য উদ্দেশ্য একটি নির্দিষ্ট
পরিসরকে বিভিন্ন ভরের সাপেক্ষে সুরক্ষিত করা।
আরও বিশদে বললে, সুরক্ষিত সামঞ্জস্যপূর্ণ সুষম
পরিসর পুনর্নির্মাণের স্বার্থে নির্দিষ্ট স্থান ও স্থানসমূহকে
চিহ্নিত করার লক্ষ্যেই সেই আদিমকাল থেকে সুদূর ভবিষ্যৎপ্রসারী বিরতিহীন অনিবার্য যাত্রা প্রতিটি
শিল্পীর। সেই নির্দিষ্ট স্থান অথবা স্থানসমূকে যে মুহূর্তে
শিল্পী পুনরাবিষ্কার করেন, সেই মুহূর্তে তিনি ঈশ্বরের
সমকক্ষ—" বিশ্ব সাথে যোগে যেথায় বিহারো,
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও...." ।
পরমেশ্বর সত্যস্বরুপ। তাঁর সেই নিরাকার থেকে
সাকার হওয়াও সত্য। এই সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করার ধারাবাহিকতা থেকেই একজন শিল্পী ঈশ্বরের মতনই
অমৃত পান করে অমরত্ব লাভ করেন। কেননা,
যা সত্য তাইই সুন্দর, যা সুন্দর তাইই শিল্প।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন