অ-দীক্ষা 


আবহসংগীতে ঝমঝম করছে রোগা-নদীর চোরাবালি 
মানবজমিন মানে কি শুধুই রাগ ও রোগের হিসেব 
পিকনিক-কন্যার সঙ্গে ক-মুঠো ঝালমুড়ি বিনিময় করলে 
অসতর্ক গুরুপত্নীর উতলা ঋতুর সঙ্গে দেখা হয় 
চাল-ডাল লালিত জৈব-জ্যোৎস্নার কাছে সেটাই জানতে চাইছিলাম
  
হলুদ প্রজাপতিদের ইস্তেহার হাঁটকে অবগত হলাম  
দুটো ধূসর ডিগবাজি তিনটে পিংপং চড়ুইভাতি 
           আর আধখানা ডুবুডুবু জাপ্টে-ধরা 
            এই নিয়ে তৈরি হয়েছে আমার ভিজে ফুলপ্যান্ট
 
ভাবছিলাম ঈশ্বরের হিংচাষ নিয়ে একটা অ-কবিতা লিখি  
     আমার কাঁধে বসা ফিঙেপাখিটা বলল 
     জানো কত্তা, মুড়োঝাঁটার ঢলঢল দেহতত্ত্ব 
                  প্যাঁকালমাছেদের পছন্দ হয়নি
তাই গোঁফ-খেজুরে মানুষের এই উপনিবেশ 
               মৌরীফুলের কাছে এত অ-দীক্ষা নিয়েছে 





অথ তালতাড়ি-কথা 


তালতাড়ি খাওয়া মানুষেরাই জানে তালরসের কত মহিমা 
গ্রীষ্মের দুপুর সাদা ফেলায় ভরা গেঁজে ওঠা রস
গলায় ঢাললেই আহা কী আরাম চোখ বুজে আসে

আগের দিনের মুনি-ঋষিরা সোমরস পান করতেন 
            তাঁরা ছিলেন কত জ্ঞানী কত বিদ্বান
তাঁরা সোমকে দেবতা বলে মানত পুজো করতেন  
      তাঁরা সোমলতা ছ্যাঁচা পাথরকেও গড় করতেন 
  
গাঁয়ের চাষাভূষো মানুষেরা পুঁথি-টুঁথির ধার ধারে না
তালকে দেবতা বলে মানে না, পুজো তো দূরের কথা
                তারা ফাঁকি-চালাকি জানে না 

তারা শুধু জানে তালগাছে ওঠার জন্যে 
গাছে একটা খোঁচওলা বাঁশ লাগাতে হয় 
তালমুচি কেটে হাঁড়ি টাঙাতে হয় 
হাঁড়ি ভর্তি হলে গলায় লম্বা দড়ি বেঁধে 
রসের ভাঁড় গাছ থেকে নামিয়ে দিতে হয় 

এসব জ্ঞান কবে কে তাদের শিখিয়েছিল 
                    সেটা তারা মনে রাখেনি
বছরের পর বছর বংশপরম্পরায় হাতেকলমে 
তারা এটা পালন করে আসছে, এ তাদের আদিম-বিদ্যা 

গতর-খাটানো মানুষদের কাছে এই রস তো মৃতসঞ্জিবনী 
বোশেখ-জষ্টির গরমে শরীরে বল-ক্ষমতা আসে 
                          পেটও ভরে যায় 

তালতাড়ি, কেউ কেউ আদর করে বলে ফলের-রস
কোনো বৈদিক-সংহিতায় তার উপাসনা-মন্ত্র নেই 


রবিঠাকুর দেখেছিলেন তালগাছকে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে 
ভেবেছিলেন, সে বুঝি আকাশের তারাদের দিকে ডানা মেলে উড়ে যাবে 
শুকনো খটখটে তালগাছের ভেতর দিয়ে যে এত রসের প্রবাহ
            সেই বার্তা বিশ্বকবির তুখোড় অ্যান্টেনায় ধরা পড়েনি

তালগাছের রসে মানুষের স্বপ্ন-সাধ-বিষণ্ণতা-যন্ত্রণা  
                      সবাই মাথা ডোবায়, হাবুডুবু খায়  
                   মুনি-ঋষিদের সোমরস বেশিদিন 
                   ধোপে টেকেনি, কবেই গল্পকথা হয়ে গেছে 
              খেটে-খাওয়া জনতার তালরসের রাজ্যপাট
                        আজও টিকে আছে, বহাল তবিয়তে 






পুতুলনাচ

 
নাছ-দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা পুতুলনাচের ছোবল থেকে
                 নিজেকে বাঁচাবার জন্যে 
আমি হারিয়ে গেছি বলে একটা মিসিং ডায়েরি করি 

কুন্তিরানিকে খুন্তি-ধরা শেখাতে গিয়ে দেখি
একটা আবাদহীন রাত কামড়ে ধরেছে হৃদপিণ্ড 
                   দেখি, কখন যেন 
ভাতের সঙ্গে মিশে গেছে ঝোড়বনের রূপকথা 

আমি তো শিশুর চেয়ে সরল 
তাই পেঁচোয় পাওয়া গতর থেকে 
     সেরটাক ঘাসবীজ বের করে
           ছড়িয়ে দিচ্ছি বুড়ির-পুকুরের পাড়ে
তার উপর ছড়িয়ে দিচ্ছি উপোস-ধোয়া জল

কিছু পুনর্জন্ম থেকে আঁকুর বের হচ্ছে, 
কিছু পুনর্জন্ম শুকিয়ে মরছে  
পাকাগিন্নির মতো কিছু পুনর্জন্ম বলছে
             ও আধবুড়ো মিনসে চল 
              আবার তোর সঙ্গেই ঘর বাঁধব   






সিঁদুর-পরা একটা মেয়ে 


দূরের মাঠে অস্পষ্ট মানুষ
দু-পাশে ধানক্ষেত মাঝখানে আলপথ 
এগিয়ে আসে এক সিঁদুর-পরা মেয়ে
            মাথায় কাটা-ঘাসের বোঝা 
            উদাসী চোখ চেয়ে দেখে
            বেলাশেষের নিভে আসা আলো 
              দেখে, ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায় পানকৌড়ি 
                 
পুকুরপাড়ে কচুবনের ভিতর থেকে 
                হাঁক দেয় ডাক-পাখিরা 
       ঝোপঝাড়ের ভিতর ডাক-পাখিরা ডিম পাড়ে 
                           ডিম পাহারা দেয় 
মানুষের চালানো ডিজের শব্দে তারা ভয় পায় 
                     তাদের আছে নিজস্ব গণসংগীত 
তাই দিয়ে পহরে পহরে তারা ঘোষণা করে 
                      আমরাও আছি গো মানুষ
তোমাদের ভাত-মুড়ি কাঁচা-লঙ্কা 
           আর ছাঁচি-পেঁয়াজ খাওয়া বাসভূমির পাশে 
আমরা চৌপোদিন জেগে থাকি, মাঝে মাঝে জানিয়ে দিই  
ডানা-ভাঙা পক্ষীরাজের পিঠে চেপে চলে যাচ্ছে সময় 
বলে, তোমরা ছেলেমেয়েদের নিয়ে মেলা দেখতে যাবে না  
                            গাজন-পরবের মেলা 
 
যুবতি মাঠের ভেতর দিয়ে ঘোর অবেলায়
       একটা মেয়ে হেঁটে আসে, কানে ঢেঁড়ি-ঝুমকো
                তার পায়ে পায়ে ঘরে-ফেরার ছন্দ 
                 তার ডাঁটোপুরু গতর জুড়ে তিস্তানদীর ঢেউ 
 সিঁদুর-পরা একটা মেয়ে হেঁটে আসছে, হাঁটছে 






অনাসৃষ্টি


ঝিনুকের পেটে জমে থাকা মাধ্যাকর্ষণ 
সোনা-ধোপানির ছোটো বিটিকে 
একজন উথালপাতাল কোরিওগ্রাফার বানিয়েছে
 
শতভিষা নক্ষত্র থেকে জল তুলে এনে 
    ছৌনাচের কুমারী মাটিতে 
        এখন শুরু হবে তার চাষাবাদ 

সর্ষেফুলের গন্ধ শুঁকে
পানকৌড়ি-জীবনের ই-কার-ঈ-কারেরাও 
             কিছু নতুন অনাসৃষ্টি খুঁজছে 

















মুরারি সিংহ

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন