সুড়ঙ্গ


নাভীর ছয় ইঞ্চি নিচে এক সুড়ঙ্গ রয়েছে,
সেই সুড়ঙ্গের অতল দেশে কত দেশ মহাদেশ 
নিরুদ্দেশ হয়েছে।
সুড়ঙ্গের গায়ে খাঁজকাটা, 
আছে এক অচিন তালা আঁটা।
কোন মুন্সী সেই তালার চাবি বানিয়েছে-
চাবি নিয়ে, চাবিওয়ালা থেকে থেকে দেয় ধোঁকা।
সুড়ঙ্গের কাঙাল এই দুনিয়া হয়েছে বোকা।
সুড়ঙ্গের গহব্বরে এক সুধার ফোয়ারা রয়েছে
সেই সুধারই সন্ধানে, কত বাউল ঘর ছেড়েছে।
সুড়ঙ্গের গায়ে আজব নকশা কাটা,
যেন কোনো শিল্পী তার তুলিতে রহস্য গড়েছে।
সেই সুড়ঙ্গে কত মহাজন, কূল-মান খুইয়েছে,
কত রাজা, প্রজা হয়ে সুড়ঙ্গের দুয়ারে
মাথা নুয়েছে।।
এই দুনিয়ায় আজব এক সুড়ঙ্গ রয়েছে,
সেই সুড়ঙ্গের জোরে এই সৃষ্টি খেলা নিত্য চলেছে।





হ্যালো,এটাকি 2441139?


ঘড়িতে ভোর পাঁচটা, আনন্দ কাঁথা মুড়ে ঘুমিয়ে আছে। এমন সময় আনন্দ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেলো। কড় কড় আওয়াজ তুলে কে যেন, দরজায় কড়া নাড়ছে মিনিট পাঁচেক পর আনন্দ শুনতে পেল, কে যেন আনন্দের নাম ধরে জোরে জোরে ডাকছে।গলার স্বর শুনে মনে হলো, তুষার।

তুষার: আনন্দদা ও আনন্দদা, আর কত ঘুমাও, দরজা খোল কথা আছে।
( আনন্দ আধোঘুমে চোখ রগড়াতে রগড়াতে দরজা খুললো, হঠাৎ সকালের সোনা রোদের ঝলকানিতে আনন্দর চোখদুটো যেন, ঝলসে গেলো। আনন্দ তাড়াতাড়ি দরজা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল)
আনন্দ: কিরে এতো সকালে কি?
তুষার: কোন কথা নয় দাদা, আজ তুমি ট্রীট দিবে। দেবু, আরিফ, আজিজ, শশী, নিতু, পিয়াল সবাই আসছে, আজ তোমার মেসে।( বলেই এক  স্নিগ্ধ হাসিতে তুষার ঘরটা ভরে তুলে)
আনন্দ: কেনো, এরা সবাই আমার কাছে কেনো? ( একটু পরেই মনে পড়ে আনন্দের এদের সবার কাছ থেকেই সে কিছু কিছু করে অনেক টাকাই ধার করেছে, যা দু বছরে একটাকাও পরিশোধ করা হয়নি)। আসন্ন বিপদের সংকেতে আনন্দর মুখ শুকিয়ে যায়।

তুষার : দাদা আজ আর কোন টাল বাহানা নয়, আগে বল, কাল দুপুর থেকে তোমার ফোন বন্ধ কেনো?
আমি, আজিজ, শশী সবাই কতশত বার চেষ্টা করেছি। সন্ধ্যায় চায়ের টঙ্গেও তোমার খোঁজ করেছে, না পেয়ে রাত ১০ টায় তোমার মেসে এসে দেখি তুমি নেই, ঘর তালা দেয়া। 
(আনন্দের মনে পড়ে কাল দুপুরে শশীর সাথে কথা কাটাকাটি করে মোবাইল অফ করে দেয় আনন্দ। তারপর আর মোবাইল  অন করা  হয়নি, আর টঙ্গের দোকানের মামা আনন্দের কাছে ১৭২৪ টাকা পায়, যার কারনে আর বাকিতে চা - সিগারেট আনন্দ আর খেতে পারবে না। তাই চায়ের টঙ্গে যাওয়া হয়নি।আর মেসের ৯ মাসের ভাড়া বাকি, তাই কেয়ারটেকারের ভয়ে রাত ১২ টার আগে আর বাড়ি ফিরে না আনন্দ)

আনন্দ : আচ্ছা বল, তোরা আজ সবাই কি আমাকে বলি দিবি নাকি( বলেই এক কৃত্রিম হাসি হাসে আনন্দ)
তুষার : দাদা, তোমার চাকরি হয়েছে, চাকরি, ( বলেই আনন্দকে বুকে জড়িয়ে ধরে তুষার)

আনন্দ : নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না।( আনন্দ তুষারকে বুকে নিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে, এমন সময়  আধভেজা দরজা ঠেলে বানের পানির মতো ঘরে ঢুকে শশী, আজিজ, নিতু, পিয়াল, আরিফ, সবাইকে আজ খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছে, বিশেষ করে শশী আজ একটু সেজেই এসেছে বলা যায়, শশীর পরনে টাঙ্গাইলের নীল রঙ্গের দামী তাঁতের শাড়ি, কপালে মেরুন রঙ্গের টিপ, লম্বা চুলগুলো বেনী করে পিঠে ঝোলানো, যেন চন্দন গাছে কোন কাল কেউটে ঝুলছে। শশী আনন্দের চৌকির উপর থেকে ময়লা কাঁথাটা সরিয়ে  বসার জায়গা করে দিলো। আজিজ, আরিফ চেয়ার টেনে বসল। শশী, নিতু, পিয়াল চৌকির উপর পা তুলে বসে পড়ল। এই ফাঁকে তুষার, সানকিপাড়া রেলক্রসিং এর সামনে থেকে গরম, গরম পরোটা, ডিম ভাজি ও চা নিয়ে এলো। নানা কথা হলো।
আজ আনন্দের মনে দূর্গাপুজার ঢাক বাজছে। আনন্দ তার মাকে কল দিলো। দুই বার কল কেটে যাওয়ার পর বিথী কল ধরল।

বিথী : হ্যালো দাদা, এতো সকালে কল দিলে যে?, তুমি কি কোন সমস্যায় আছো? কাল থেকে তোমার ফোন বন্ধ, মা কতোই না দুশ্চিন্তা করছে।

আনন্দ: নারে বনু, মা কোথায়রে? মাকে ফোনটা দে তো।
বিথী  : দাঁড়াও একটু( বিথী দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পুকুর ঘাটে গেলো) মা ও মা তাড়াতাড়ি আসো, দাদার ফোন এসেছে। বিথীর মা একতাল বাসন মেজে এক হাতের তালায় করে নিয়ে পুকুর ঘাট থেকে উঠে এলো।বাম হাতে বাসনের স্তূপ, ডান হাতে ফোন কানে ধরল।

আনন্দের মা: বাবা, কাল তোমার ফোন বন্ধ ছিলো কেনো? আমি কত চিন্তা করেছি, তুমি ভালো আছো?

আনন্দ: মা, আমি খুব ভালো আছি।  আনন্দ আবেগে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে, মা, মা আমার চাকরি হয়েছে, তোমার ছেলের চাকরি হয়েছে।(বলেই শিশুদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে আনন্দ।)
আনন্দের মায়ের হাত থেকে বাসনের স্তূপ গুলো পড়ে যায়। মোবাইলটাও হাত থেকে পড়ে যায়। আনন্দের মা দুই হাত জোড় করে উপরে তুলে বলতে থাকে।

আনন্দের মা : দয়াল হরি তুমি পরম মঙ্গল ময়, হরি তুমি আছো, তুমি আছো হরি তুমি আছো।
(আনন্দের মায়ের চোখে আজ আনন্দের অশ্রু।
বিকেলে, আনন্দ শশীকে নিয়ে বের হয়। আজ আনন্দের আনন্দের সীমা নেই, শশীকে হালকা জলপাই রঙ্গের একটি, জামদানী শাড়ী কিনে দেয় আনন্দ ৬০০০ টাকা দিয়ে। আজ আনন্দ প্রথম বেতন পেয়েছে, মায়ের জন্য দুটো শাড়ি, তিনটা ব্লাউজ, বোনের জন্য একটা থ্রী পিস, বাবার জন্য একটা লুঙ্গি একটা শার্ট কিনে আনন্দ।শশীকে আজ আরো বেশি সুন্দরী মনে হচ্ছে আনন্দের কাছে।
রাতে বাহিরে ডিনার সেরে শশী আর আনন্দ।রিক্সা করে দুজনে রাতের শহর দেখছে।)

শশী : এই শোন, তোমাকে কিন্তু আজ একটা কথা না বললেই নয়, বাবা কিন্তু আমাকে বিয়ের জন্য খুব চাপ দিচ্ছে। প্লীজ লক্ষ্মী, তুমি বাবার সাথে একটু দেখা করো। 
( বলেই আনন্দর ডান হাতটা টেনে শশী তার কোলে নিয়ে, তার অন্য হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রাখে)

আনন্দ: নিশ্চয়, দেখা করবো, রানী সাহেবা, তা বলুন কবে পয়গাম নিয়ে যেতে হবে( একথা বলে আনন্দ শশীর চোখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়, শশীও আনন্দর চোখ থেকে চোখ ফেরাতে পারে না)
শশীদের আমলাপাড়ার বাসার সামনে এসে রিক্সা থামে। আনন্দ শশীকে রিক্সা থেকে নামিয়ে নিজের মেসের দিকে যেতে বলে রিক্সাওয়ালাকে। শশীর বাবা, দোতলার জানালা দিয়ে সব দেখে। শশী গুনগুন করতে করতে ঘরে ঢুকে।অন্য সময় হলে নীরোদবাবু মেয়েকে এতো রাতে বাড়ি ফেরার জন্য শাসন করতেন, আজ আর তা করেনি। 

নীরোদবাবু: মা শশী, আনন্দ তোমাকে বাসায় দিয়ে গেলো বুঝি।
(শশী একটু ঘাভড়ে যায়)
নীরোদবাবু শশীকে সহজ করার জন্য একটু হাসেন।

নীরোদবাবু : তা মা এভাবে আর কতোদিন? আমারও তো সমাজ আছে, লোকে দু' চার কথা বলে। আনন্দকে বলতে রাতের খাবারটা এখানে খেয়ে যেতে।
( বাবার মুখে এমন কথা শুনে শশী কিছুটা সহজ হয়)

শশী : বাবা, আমরা বাহিরে খেয়ে নিয়েছি আর আনন্দকে বলেছি, যে তোমার সাথে দেখা করার কথা।আনন্দ  বলেছে নেক্সট উইকে আমাদের বাসায় আসবে।
( একথা শুনে নীরোদবাবু মনে মনে খুব খুশি হোন, আর যাই হোক, ছেলে সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার, হোক না বাবা কৃষক তাতে কি? ছেলে তো ব্যাংকার, এ বিয়ের বাজারে আজকাল ছেলে পাওয়া খুব কঠিন, তার উপর আনন্দের সরকারি চাকরি। আনন্দ দেখতেও অনেক ভালো, স্বভাব চরিত্রও অনেক ভালো।
আনন্দর বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে, ছেলে পুলিশে চাকরি করে। দেনা পাওনা তেমন কিছুই নেই। সামনের অগ্রহায়ণের ২৫ তারিখ বিয়ে।আনন্দের চাকরির আজ দুই বছর পূর্ণ হলো। এর মাঝেই, আনন্দের বাবার যক্ষার চিকিৎসা ও হয়ে গেছে।আনন্দের ফোন বন্ধ, বাড়িতে নেটওয়ার্ক নেই, আনন্দ শশীকে বাজারে এসে এসডি কল থেকে কল দিলো।

আনন্দ; হ্যালো, শশী সোনা, কেমন আছো তুমি?

শশী: কে?, তুমি! আমার কথা মনে পড়লো? আমি তো ভেবেছি গ্রামে কোন ডানা কাটা পরীকে পেয়ে আমাকে ভুলে গেছো।

আনন্দ: কি যে বলো তুমি, তুমি তো পরীদের রাণী। আমার পূর্ণিমার চাঁদ।

শশী: উহু, একদম মিথ্যা। যাও কোন কথা নেই,তোমার সাথে।
আনন্দ:  রাগ করে না লক্ষ্মীটি, আমি ২৬ তারিখ চলে আসবো। বিথীর বিয়ের ঝামেলাটা শেষ হোক।আচ্ছা সোনা, এখন রাখি।

(আনন্দ ফোন কেটে দিয়ে, বাজার থেকে ৩ বিড়া পান, ২৫ কেজি দই ও ২০ কেজি মিষ্টি নিয়ে ফিরলো।
কোন অবাঞ্ছিত ঘটনা ছাড়াই সুস্হভাবে বিথীর বিয়ে হয়ে গেলো।)

আনন্দ আজ আজিজ, পিয়াল, আরিফকে নিয়ে জয়নুল আবেদীন পার্কে আড্ডা দিচ্ছে।ফুচকার বিল দিতে এখন আর আনন্দের সমস্যা হয় না। কিন্তু এমন এক সময় ছিলো, যেদিন আনন্দকে এক কাপ চাও বাকিতে খেতে হয়েছে।আনন্দকে দেখে বন্ধুরা এড়িয়ে গিয়েছে। যে শশী আজ রাতের বেলাতেও আনন্দের হাতে হাত রেখে রিক্সায়, চড়ে বেড়ায়, সেই শশীও এক সময় আনন্দর কল কেটে দিয়ে ফোন বন্ধ রাখতো। আনন্দ দেখা করতে চাইলে বলতো। আমার বাবা খুব রেস্ট্রিকটেট। আমি দেখা করতে পারবোনা। যা বলার কলেজ আওয়ারে বলো।আজ আনন্দের চারপাশে এতো যে পরিবর্তন এতো আয়োজন সবই হয়েছে, শুধু মাত্র চাকরির বদৌলতে। যে মেসের কেয়ারটেকার আনন্দকে প্রতিদিন, বই - ট্রাংক রাস্তায় ছুড়ে ফেলার হুমকী দিতো। সেই কেয়ারটেকার চাচাও মাঝে মাঝে আনন্দর মেসরুমে এসে আনন্দর খোঁজ নেয়।

(আজ ১২ই ফাল্গুন, সোমাবার)  আনন্দমোহন পালের সাথে নিরোদবাবুর একমাত্র আদরণীয় কন্যা শশীবালা চন্দের শুভ বিবাহ।
চারদিকে সাজ সাজ রব। বাহিরে ব্যান্ড পার্টি বাজছে। আনন্দ তার ঘরে ধুতী পাঞ্জাবী পড়ছে। আনন্দের ঘরের দরজাটা ভিতর থেকে লাগানো। এমন সময় আনন্দ শুনতে পেলো, বাহিরে সব নিশ্চুপ। কে যেন আনন্দের ঘরের দরজায় জোরে জোরে কষাঘাত করছে।
জনৈক ব্যক্তি:  কি হলো, জমিদার পুত্র নাকি এখনো দরজা, খুলছেন না?  দরজা খুলুন বলছি, ( বাহিরে আরেকটি ২ য় কন্ঠ, কি হলো কথা কানে যায় না, নাকি দরজা ভাঙ্গবো? বাহিরের হট্টগোলে আনন্দের ঘুম ভেঙ্গে গেলো, ঘুম ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে,  ভেঙ্গে গেলো আনন্দের দীর্ঘদিনের লালায়িত স্বপ্ন, আনন্দ বুঝতে পারলো, সে এতোক্ষন স্বপ্ন দেখেছে। দরজায় পাওনা দারেরা ভীর করে আছে। কিছুক্ষণ পর মেসের কেয়ারটেকার এলেন।

কেয়ারটেকার:  বলি অনেক হলো, এবার আমার ঘর ছাড়ো।( বলেই ঘরে তালা দিতে যাবে এমন সময় আনন্দ বললো, আপনাকে অনুরোধ করছি, আমাকে ১০ দিনের সময় দিন, আমি সব টাকা পরিশোধ করে দিবো)

চাওয়ালা: আমার ১,৭২৪ টাকা বিল।সেটা কবে দিবেন শুনি? 

মুদি দোকানদার:  আমার বিল ১২,০৩৫ টাকা।

পিয়াল:  বড় ভাই আমার ৯৮০ টাকা।
আজিজ:  আমার টাকার খুব একটা প্রয়োজন না হলে, বলতাম না ভাই, আমার ২,৪০০ টাকা।

এমন সময় আনন্দের কাছে, ধানীখোলা থেকে একজন লোক এলো, উনার নাম সুধীর, উনার বাসা আনন্দদের বাসার পাশেই,
সুধীরবাবু: আনন্দ বাবা, তোমার ফোন বন্ধ, তাই আমাকেই আসতে হলো, তোমাকে যে একবার বাড়ি যেতে হবে।বাবা , তোমার বাবার শরীর টা মোটেও ভালো না।

আনন্দের বুকের ভিতরটা কেমন মুচড়ে  উঠল।আনন্দ কেমন করে বাড়ি যাবে। তারপকেটে একটা ছেঁড়া ১০ টাকার নোট ছাড়া আর কিছুই নেই। মহামারী করোনার কারনে সকল স্কুল কলেজ বন্ধ, চাকরির পরীক্ষা গুলোও স্হগিত, আগে টিউশনির টাকা দিয়ে আনন্দের মেসের খরচ, বাড়িতে বোনের পড়াশোনার খরচ, বাবার চিকিৎসার খরচ ভালো ভাবেই চলে যেতো।কিন্তু এই মহামারীর কারনে, আনন্দের হাতের সব গুলো টিউশনি চলে গেলো। আনন্দ একটি বেসরকারি চাকরিও নিয়ে ছিলো। লকডাউনে সেটিও চলে যায়।চারপাশের কারো কোন কথাই আনন্দের কানে ঢুকছে না।  বেকারত্ব, অভাব - অভিযোগ আনন্দকে বিপদের ঘূর্ণিপাকে ফেলে দিয়েছে। আনন্দ সুধীর কাকার সাথে গ্রামে আসে।
গ্রামের বাড়িতে ঢুকার আগেই অনেক দূর থেকেই আনন্দ তার  মায়ের আহাজারি শুনতে পায়। উঠানে আনন্দের বাবার নিথর শরীরটা সাদা থান দিয়ে ঢাকা, আনন্দ ধীর পায়ে কাছে যায়, বিথী লাশের উপর থেকে কাপড়টি আলতো করে সরিয়ে দেয়, আনন্দের বাবার জীর্ন শরীরটা নিষ্প্রাণ,  চোখ দুটো  তুলসীপাতা দিয়ে ঢাকা। আনন্দ বাবার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চুমু খায়। আনন্দের মা, আনন্দের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

আনন্দ আর কোনদিন তার সানকিপাড়ার মেসে যায়নি।  অনেকদিন চেষ্টা করেও আনন্দ শশীকে ফোনে পায়নি। শশী ফোন নাম্বার বদলেছে।
শুনেছি শশীর বিয়ে হয়ে গিয়েছে, স্বামী কৃষি কর্মকর্তা। বিথীর আজও বিয়ে হয়নি। আনন্দ বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। আনন্দের মা কাঁথা সেলাই করে।

এভাবেই বেকারত্ব, অনাকাঙ্ক্ষিত মহামারী, অসহিষ্ণু সমাজ ব্যবস্হা হাজার হাজার আনন্দের অশ্রুর কারন।





প্রতিবেশীর অপমৃত্যু


আমি অতুল্যপ্রসাদ রায়, আমার জন্ম বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলায়। আমার পিতা হরকিশোরপ্রসাদ রায়, স্হানীয় স্কুলে গণিতের শিক্ষক ছিলেন, বাবা গত হয়েছেন সে হবে ১৩ বছর। এখন আমার ৬৯ চলে, চাকরী থেকে অবসরের অনেক আগেই মাথার চুল গুলো অবসর নিয়ে নিয়েছে।মুখের দু,তিনটে দাঁতও তুলে ফেলেছি।চোখের জ্যোতিও কমে আসছে। আজকাল নিজেকে বড় একা একা লাগে, বড় ছেলেটি ডাক্তার ঢাকাতেই থাকে, সেখানেই প্র্যাকটিস করে। মেজো ছেলে খুলনায় আছে, প্রাণী সম্পদ অফিসার হিসেবে। ছোটটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রির লেকচারার। আমার সহধর্মিণী নিয়তিবালা দেবী, সে নেই এখন আর, শ্বাসকষ্ট ছিল, সেই জন্ম থেকেই, তার উপর হার্টের ব্যামো, তাই চাপ সইতে না পেরে চলে গেলো। আমার একটি মাত্র মেয়ে সুনয়না রায় সেন, বিয়ে দিলেম তা হবে ৬ বছর, স্বামী উপজেলা শিক্ষা অফিসার।এ হলো আমার পরিবার রায় পরিবার।
আমার কথা বলার জন্যেই আজ নড়েচড়ে বসা। তবে শুরু করি। আমি শৈশবে ডানপিটে ছিলাম খুব, বেপরোয়াও বলা যায়। এই প্রতিবেশীর আম বাগানে হামলা,  বন্ধুরা কজন মিলে কোন এক প্রতিবেশীর পাকা কলার ছড়ি সাবাড় করে ফেলা।একবার হলো কি, ডাঙ গুলি খেলছি সব বন্ধুরা মিলে, এমন সময় গুলি ছুটে এক প্রতিবেশীর কপালে লাগলো, আর যায় কোথায়, সঙ্গে সঙ্গে কপাল ফেটে ফিনকী দিয়ে রক্ত ছুটছে, গাল গড়িয়ে রক্তে বেচারার জামা পর্যন্ত মাখামাখি। না সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য, আমাদের জেল জরিমানা হয়নি, যা হলো ডাঙগুলি টা পুকুরের জলে বিসর্জন আর সন্ধ্যেবেলা মায়ের হাতে রামকেলানী খাওয়া। পৌষপার্বণে সকালে, বিকালে, দুপুরে এর বাড়ি ওর বাড়িতে পিঠা, পায়েশ খেয়ে পেট ঢোলের মতো ফুলিয়ে বড় গাছের নিচে বসে পরিকল্পনা করা, কার গাছের বেল বড় হচ্ছে, কার বাগানের বড়ইগুলো পেকে একেবারে টুপটুপ করছে।একবার বাবা স্কুলের কি কাজে সদরে গিয়েছেন, তখন গরুর গাড়ির চল ছিলো, তো স্বাভাবিকভাবেই বাবা সেদিন রাত্রে বাড়ি ফিরতে পারেননি। রাত আনুমানিক ১ টা হবে, শেয়াল ডাকা শুরু হয়ে গিয়েছে। এমন সময় আমার পেটটা মোচড় দিয়ে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে বমি আর পাতলা পায়খানা, মা ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন, মা কাঁদতে কাঁদতে দিশেহারা, এমন সময় আমার ছোট ভাই অমলপ্রসাদ, চট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, মা তখন দিশেহারা তাই বাঁধাও দিলেন না।মিনিট দুয়েকের মধ্যে নিধুকাকা, রবি দাদা, জামাল চাচা, মনিরমা কাকী, সুরেশের ঠাকুরমা সবাই চলে এলেন, হারিকেন হাতে। তখন ডায়রিয়ার তেমন কোন চিকিৎসা গ্রামে প্রচলিত ছিলো না, বেশির ভাগ সময়ই মানুষকে মরতে হতো ডায়রিয়া হলে। গোপাল জেঠু একটু পর এলেন তার মহিষের গাড়িটি নিয়ে, কিছুদিন আগে উনারই বড় ছেলের কপাল ফাটিয়ে ছিলাম, আমি ডাঙগুলি মেরে। আমাকে পাজাকোলা করে মহিষের গাড়িতে শুয়ে দিলেন। গাড়িতে মাও উঠে বসল, সাথে মনিরমা কাকী, যার সাধের কামরাঙা গাছের কামরাঙা গুলো একটিও আমার জন্য কখনো পাকতে পারেনি। নিধুকাকা, জামাল চাচা, সবাই চললেন, আমার সাথে সদরে, আমার চোখ দুটো বুজে আসছে। ধীরে ধীরে ক্লান্ত শরীরে ঘুম ঝেঁপে এলো। চোখের সামনে ভেসে উঠল কেমন করে রবিদার নাটাইটা ভেঙ্গে দিয়েছিলাম। হারুগোপালের এঁড়ে বাছুরটাকে কেমন করে বাঁধন খুলে দিতাম, যার জন্য হারুগোপালের হাতে কম কান মলা খাইনি।কানে ভেসে এলো, মেজখোঁড়ীর চিৎকার। কখন সদরে পৌঁছেছি মনে নেই। চোখ খুলে দেখি, বাবা বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার হাতে স্যালাইন খুলে গ্লুকোজ দেয়া হয়েছে।মা, মাথার পাশে বসে আছেন, জানালা দিয়ে দেখলাম, জামাল চাচা,নিধুকাকা,রবিদা, মনিরমা কাকী সবাই বারান্দায়। সুস্হ হয়ে দুদিন পর বাড়ি ফিরলাম।বাড়ি ফিরে শুনি, মেজখোঁড়ীমা যিনি আমাকে দিনে শতবার শাপশাপান্ত করতেন, তিনি আমার দীর্ঘায়ু কামনা করে মাকালীর নিকট জোড়াপাঁঠা বলি মানসিক করেছেন।সুরেশের ঠাকুরমা, যাকে তিনবার করে ছুঁয়ে দিতাম বলে, তিনবারই পুকুরের জলে গঙ্গা গঙ্গা ঝাঁপিয়ে পড়ে স্নান করতেন, আমাকে হতচ্ছাড়া বলে গালি দিতেন, সেই তিনিই আমাদের বাড়িতে সেই যে আমার খবর পেয়ে রাত্রে এসেছিলেন, এখনো বাড়ি ফেরেনি, উনার গোপাল ঠাকুর আজ তিন দিন ধরে না খেয়ে আছে।গোপাল ঠাকুরকে না খাইয়ে আমার জন্য দুধের সন্দেশ আঁচলে করে বেঁধে এনেছেন।আজ বহুকাল হলো বাবার সাথে সাথে গোপাল জেঠু, জামাল চাচা,, নিধূকাকা সবাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। রবিদার সাথে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়, উনি এখন কানেও খানিকটা কম শুনেন। তো এই ছিলো আমাদের প্রতিবেশী আমাদের আত্মার আত্মীয়। এখন আমার বড়ছেলের কথা বলি, গত ফেব্রুয়ারিতে বড় ছেলের বাসায় গেলাম, ছেলে, ছেলেবৌ দুজনই ডাক্তার, সেই সকালে বের হয়, রাতে ফিরে মাঝে মাঝে ফিরেও না, ঘরে তাদের একটি মাত্র সন্তান, টোটন, টোটনের বয়স ৯ বছর, ইংলিশ স্কুলে পড়ে।একদিন বিকালে টোটনকে নিয়ে বেড়িয়েছি, লনে হাঁটছি, এমন সময় টোটনের বয়সী এক ছেলেকে দেখি, লনের এককোনায় চুপচাপ বসে আছে, আমি হাতের ইশারায় কাছে ডাকি, ছেলেটি কাছে আসে, অনেক কথা হয়, টোটনসোনা সম বয়সী ছেলেটিকে পেয়ে ভীষণ খুশি। তারা দুজনে বল খেলছে, আমি খেয়াল করলাম, টোটনের চেয়ে ছেলেটির শারীরিক শক্তি বেশি।খেলা শেষে আমারা রুমে ফিরে এলাম। রাতে বসে খাচ্ছি এমন সময়, এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ কানে এলো, জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম, দেখি আমাদের বিল্ডিং এর সামনেই এসে থেমেছে। ছেলেকে জিঙ্গেস করলাম, কিরে কার কি হলো তুই কি কিছু জানিস? ছেলে খানিকটা অবাক হলো, বললো, বাবা কি যে বলো না তুমি! আমি কেমন করে জানবো? আমার কি অতো সময় আছে? আমি তো কাউকে চিনিই না। আমি ভূত দেখার মতো বিস্মিত নেত্রে আমার ছেলের দিকে তাকিয়ে আছি, ছেলে আপন মনে ডিনার সারছে।  সেদিন রাতে আমার একেবারেই ঘুম হলো না। সকালে লনে অনেকের কাছে জিঙ্গেস করলাম, কেউ বলতে পারলেন না, এ্যাম্বুলেন্স কার জন্য এসেছে। সবাই নাকি বিজি। নিজে দারোয়ানকে জিঙ্গেস করলাম, সেও বলতে পারলেন না, অবশেষে আমার চাপাচাপিতে রেজিস্টারে এন্ট্রি দেখে বললেন, ২ নাম্বার বিল্ডিং এর সি ব্লকের এ নাম্বার ফ্ল্যাটের রশিদ সাহেবকে এ্যাম্বুলেন্স করে নিয়ে যাওয়া হয়। আজ টোটনের জন্মদিন, কয়কজন বেশ ভদ্রস্থ লোকজন এলেন, হাতে দামী গিফটের প্যাকেট, তেমন কোন ছোট ছোট বাচ্চা দেখলাম না। জানালা দিয়ে নিচে চোখ পড়লো। দেখলাম সেদিনকার সেই ছোট বাচ্চা ছেলেটি, লনে একা দাঁড়িয়ে আছে, একবার ভাবলাম ডেকে উপরে নিয়ে আসি টোটনসোনা হয়তো খুশি হবে, কিন্তু সাহস পেলাম না, এতো আমাদের অজপাড়াগাঁ নয়, যে চাইলেই এক চাঁটাইয়ে ৫/৬ জনকে বসিয়ে পিঠা,পায়েস খেতে দিতে পারবো, এ যে শহর, আধুনিকার ছোঁয়ায়, আন্তরিকতা, মমতা, মায়া, সৌহার্দ দম বন্ধ হয়ে মরে গেছে হবে হয়তো, কোন কালে।যাই হোক আমাকে টোটনের জন্মদিনে যে খাবারের প্লেটটি দিয়েছিল, সেটি নিয়ে গোপনে নিচে নেমে ছেলেটিকে নিজ হাতে খাওয়ালাম।।আসার সময় দেখলাম, নিচে একটি লাশবাহী গাড়ী, বুঝতে কষ্ট হলো না,  হয়তো এ গাড়ীতেই শুয়ে আছে রশিদ সাহেবের নিথর দেহ। না আশে, পাশে স্বজনদের ভীর নেই, আহাজারি নেই। কোন প্রতিবেশীর উদ্বেগ নেই, ঘরে ফিরে এলাম।এসে দেখি, আমার ছেলে তার গেস্টদের সাথে তার সাফল্যের গল্পে মশগুল,  একবার ভাবলাম ছেলের কানে কানে বলি,, রশীদ সাহেবের মৃত্যু সংবাদটা।কিন্তু নাহ,  ভিতর থেকে কোন সাড়া এলো না, হয়তো বা টোটনের মা ও গেস্টরা বিরক্তই হবেন। বুকের ভিতরটা এ অজানা কষ্টে কচকচ করছে, না এ কোন রশিদ সাহেবের মৃত্যু নয়, এ অত্যাধুনিক সমাজের প্রতিবেশীর অপমৃত্যু,  এ এমন এক অপমৃত্যু যা এখনি ঠেকাতে হবে, নয়তো ধ্বংসের আর দেরী নেই।

















সোমা ঘোষ মনিকা


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন