তাপস গুপ্ত

পোস্টমডার্ন ভাবনা ও কিছু কবিতা:

পর্ব:৮


গত পর্বের আলোচনার শেষের দিকে বলেছিলাম, আধুনিকতা তৈরি করা ধারণার অচলায়তন এবং তার নির্মাণ স্বয়ম্ভু নয়, সত্য নয়, ধ্রুব নয়, শাশ্বত নয়, প্রতিটি ধারণাই ধ্বংস যোগ্য। অতএব এই নির্মাণের বদল প্রয়োজন, প্রয়োজন বিনির্মাণ। এই মতবাদে বিনির্মাণবাদী দার্শনিকেরা উৎসাহিত হলেও অবশিষ্টগণও যে সমভাবে উচ্ছ্বসিত হবেন এমনটা ধারণা সংশয়াতীত ভাবে করা যায় না। কারণ অন্যরা বলতেই পারেন, পৃথিবীর আরো অন্যান্য যে সমস্যা রয়েছে তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার জন্য এই ইজম একটা তত্বের খেলা বা কৌশল মাত্র। পরিষ্কার করে বললে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে , ইজম যুক্ত হলেই কি সৃষ্টির উপযোগ্যতা অর্থাৎ উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পাবে? এই সরলচিত্ত প্রশ্ন কাঁটা নাছোড় হয়ে বিঁধেই থাকে। আবার একটু দূরত্বে সরে যদি এভাবে বলা যায়, শিল্পসৃষ্টির লক্ষ্য একটা রাস্তা একটা গন্তব্যে পৌঁছানোর উপায়। তাহলে? উত্তরে post-modernist রা বলবেন, আমরা তো শিল্পের শিল্পত্বই মানিনা তার আবার ভালো-মন্দ বা উদ্দেশ্য বিধেয় কী।
The cambridge dictionary of philosophy তে বলা হয়েছে, "postmodern philosophy typically opposes foundationlism, essentialism,and realism." ফ্রাঁসোয়া লিয়োতার এই পোস্ট মডার্নের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে, অনির্ণেয়তা, আপেক্ষিকতা, সংকরত্ব ও মহাআখ্যানের বিরূপতর কথা বলেছেন। এই মহা আখ্যান কি?,জীবন শিল্প ইতিহাসের সার্বিক বা প্রচলিত তত্বকেই এখানে মহাআখ্যান বলা হয়েছে। এই মহাআখ্যানের বিপরীতে প্রাধান্য পাবে ছোট ছোট আখ্যান বা খণ্ডাংশ। এই পোস্ট মডার্ন নন্দনের অন্যতম ভিত্তি হল আপেক্ষিকতা, বাস্তব এবং অনুকৃতির বিভেদলুপ্তি, স্থান-কাল সত্তার সংরূপগত পার্থক্য  ভেঙে ফেলা। 
বেকেট এর মলি তে কাহিনী শুরু হয়" it is midnight. The rain is beating on the windows. আর কাহিনী শেষ হতে দেখি এই ভাবে, It was not midnight.It was not raining.  অর্থাৎ  দেখা যাচ্ছে, আখ্যানের পূর্ণাঙ্গ সত্বাকে সচেতন ভাবেই ভেঙে দেওয়া হল।কারণ পোস্ট মডার্ন মনে করে, সত্য বাস্তব যুক্তিবাদী বিশ্বাস মানুষের ইতিহাস আলোচনায় নিপীড়নের সহায়ক হয়েছে।
হারুকি মুরাকামির A Wild Sheep Chase পোস্টমডার্ন  সাহিত্যে ক্লাসিকের মর্যাদা অর্জন করেছে। বইটির পরিচিতি সম্পর্কে জানানো হয়েছে," A postmodern detective novel in which dreams, hallucinations and wild imagination are more important than clues."
উপন্যাসটির নায়ক হলো একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার মালিকানার অংশীদার। দক্ষিণপন্থী কোন এক সেক্রেটারি চাপে বাধ্য হয় মালিকানা ছেড়ে দিতে এবং একটি ভেড়ার সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে। পিঠে এক তারার মত জন্ম চিহ্ন থাকা ভেড়া টির ছবি সে ব্যবহার করেছিল একটি বীমা কোম্পানির বিজ্ঞাপনে। ছবিটি তোলা যে বন্ধুর সে আবার বহুদিন আগে নিখোঁজ হয়েছে,তবে খবর মিলেছে সে এখন হোক্কাইডোর রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। নায়ক( বোকু অর্থাৎ আমি) হোক্কাইডো গিয়ে পৌঁছোয় এবং অদ্ভুত কিছু চরিত্রের মুখোমুখি হয়। চরিত্রগুলি তাকে জানায় তারকা চিহ্নিত ভেড়া টির আত্মা  অনেক মানুষের মধ্যে প্রবেশ করেছে যার মধ্যে রয়েছে সেই দক্ষিণপন্থী নেতা এবং তার সেই বন্ধুও। গোটা আখ্যানের পদ্ধতিকে বিধ্বস্ত করে ভেঙে ফেলা হয়েছে। উপন্যাসটির অনুসরণ করলে দেখা যায় প্রথম অধ্যায়ের বিষয় বস্তুর সঙ্গে মূল কাহিনীর কোন যোগাযোগই নেই। অধ্যায়টিতে বর্ণিত হয়েছে নায়ক এর এক কলেজ জীবনের মহিলার সঙ্গে সম্পর্কের কথা যার অন্ত্যেষ্টি তে কয়েকদিন আগেই অংশ নিয়েছে নায়ক। সব মিলিয়ে এই কাহিনী কোন নির্ণেয় তাৎপর্য আবিষ্কার করা সম্ভব হয় না। কেন যে ভেড়াটির আত্মা সেই দক্ষিণপন্থী নেতার মধ্যে ঢুকে পড়ে, কেন সেই নেতার সচিব জাপানে আমদানির ইতিহাস বর্ণনা করে, কেন সেই আত্মা নেতার মৃত্যুর আগে সেই বন্ধুর মধ্যে আশ্রয় নেয় -- এসব প্রশ্নের কোন নিশ্চিত উত্তর উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। অর্থাৎ কাহিনীতে এক ধরণের ব্যর্থ নির্মাণ অথবা অর্থসম্ভবনাশূন্য অন্যার্থ সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে চরিত্র বা কাহিনীর সার্বিক যুক্তি গ্রাহ্যতা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এবং চরিত্র গুলির বাচনেও তাই অর্থহীন নিরর্থকতাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে। যদিও মুরাকামি নিজে,এই ব্যাপারটিকে একটি নান্দনিক নিরীক্ষার তাগিদ হিসেবে স্বীকার করে বলেছেন, ভেড়া টিকে এই কাহিনীর চাবিকাঠি হিসেবে কোনো গভীর তাৎপর্য ছিল না। অথচ মিৎসুও সেক্কি এটিকে অন্য তাৎপর্যের নিরিখে ব্যাখ্যা করেছেন।তিনি বলছেন, ভেড়া টি খ্রিস্টীয় প্রতীচ্য সমাজের প্রতীক,জাপান যাকে আত্মস্থ করতে চেয়েছে আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টায়। ভেড়া টির মৃত্যু আসলে আধুনিকতার মৃত্যুরই প্রতীক।

চলবে..
( গ্রন্থ ঋণ রয়েছে প্রচুর…পরে একত্রে লিপি বদ্ধ করা হবে)

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন