নীলিম কুমার-এর ২টি কবিতা 

(মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস)



ইউক্রেইন


মেটারনিটি ওয়ার্ড ধ্বংস করার আগের মুহূর্তে
রাশিয়ান সৈনিকটি 
ইউক্রেইনের গর্ভবতী মহিলাটিকে বলেছিল-
আমাদের গর্ভবতী মহিলারা
গর্ভে বোমা আর গ্ৰেনেড নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
আমাদের দেশের ছেলেদের নাম বোমা
মেয়েদের নাম গ্রেনেড

ইউক্রেইনের গর্ভবতী মহিলাটি 
সবার অজান্তে
গর্ভে থাকা শিশুটিকে বলছে– 
একটু অপেক্ষা কর বাছা,
বোমাবর্ষণ হতে দে।
ঠিক বোমাবর্ষণের মধ্যেই তুই আসবি
তোর নাম রাখব আমি বৃষ্টি

মহিলাটি রাশিয়ান সৈনিকটিকে বলল–
ইউক্রেইনের মেয়েদের নাম–
বৃষ্টি।
ছেলেদের নাম–
রোদ।





কবিতা বিষয়ক

পড়ার আগেই কবিতাটা নাই হয়ে গেল।
এখন আপনি যা পড়ছেন তা হারিয়ে যাওয়া কবিতাটার কিছু চিহ্ন
তাতে যে একটা কবিতা ছিল সেকথা বলার জন্য
কবিতাটা কিছু জিনিস ফেলে রেখে গেছে ,যাতে 
আপনি কবিতাটাকে সনাক্ত করতে পারেন
কবিতাটা পরা পোশাক-আশাক বা স্যাণ্ডেলের দ্বারা
আপনার পোশাক-আশাক, স্যান্ডেল বা জোতাজোড়া কি
আপনার পরিচয়? না? তাহলে কবিতার প্রতি কেন অবিচার করবেন?
কবিতাকে আমাদের ছেড়ে দিতেই হবে
হাজার হাজার বছর ধরে কবিতাকে দাসী করার জন্য
কবির চেষ্টার ওপরে জল ঢেলে দিয়ে কবিতা পার হয়ে গেছে
স্বপ্নের পরে স্বপ্নের বারান্দা 
ক্ষীণ আলোতে আমরা কখনও দেখা না দেখা করে আমরা কখনও
দেখেছি কবিতাকে ,পড়ার আগেই নাই হয়ে যেতে 
আর কেউ যদি নিজেকে একজন কবিতার পাঠক বলে ভেবেছে,
বা নিজেকে কবি বলে যে একদিন সামবেদ লিখেছিল
সেই সমস্ত কিছুর প্রতি তিলমাত্র আস্থা না রেখে কবিতা
নাই হয়ে গেছে লেখা বা পড়ার আগেই,এবং
কোনো কাব্য সমালোচকের বাগানে (অবশ্য তাদের বাগান থাকে না
ঘুরে বেড়ায় অন্যের বাগানে) হাসছে হাসছে হাসছে








ফণীন্দ্রকুমার দেব চৌধুরী-র ২টি কবিতা

(মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস)






কাশ্মীর ফাইলস

কাঠচেরা করাতে 
মেয়েটিকে  দৈর্ঘ্যে
দু টুকরো করা হল
আমার কোনো যন্ত্রণা হল না
কেন হবে
সেটা আমার শরীর নয়
মনটাও আমার মতো নয়
তাকে কখনও শপথ নিতেও দেখিনি
আমি পড়া পুঁথিতে হাত রেখে

সিঁদুরের ফোঁটাটা 
রক্ত হয়ে ছিটকে ছিটকে পড়ল
যত্ম করে রাখা চালে

রক্তমাখা চাল খা
বেঁচে থাকবে তোর সোনামনি
মেয়েটি খেল সোনামনির মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে

রোদ পড়া সবুজ লনে
এক ঢোক ভডকা খেয়ে  ভাবলাম
বিপ্লব এত সুন্দর
পুস্তক লিখেই ফরেন ট্রিপ
ফাইভস্টার লাঞ্চ
বিদেশে স্বীকৃতি
সেমিনার ওয়েবনার পাদপ্রদীপে
মসৃণ মুখের ঝলকানি

দেশের উপত্যকায় কীভাবে ফোটাবি ফুল
বিদেশে মগজ বন্ধক রেখে

যন্ত্রণা রক্তের মতো
একই রং যারই শরীর হোক না কেন
যন্ত্রণার কাছে পথ দেখানোর জন্য
আজানও চাইনা ক্রসও চাইনা 
চাইনা পবিত্র ঘণ্টার ধ্বনি
উপলব্ধির  পথ হৃদয়ের ছায়াপথ

একটু কাঁদতে শিখ
সিঁদুরের রক্তলাগা চালের স্বাদ জিহ্বায় নেওয়া 
মেয়েটির কথা ভেবে

এসো , এদিকে এসো
করাতে দু-টুকরো করা জীবিত মেয়েটির জন্য
মৌন হয়ে কিছুক্ষণ প্রার্থনা করি





জন্মদিন

কাল মধ্যরাতে কেক কাটতে তখনও বাকি  
আধ ডজন বন্ধুর সঙ্গে
একটা অর্ধবৃত্ত এঁকে
মোমবাতিগুলি কেবল জ্বালিয়েছি
পুরো সাদা বায়বীয় অবয়ব একটার মতো অকষ্মাৎ সামনে ঈশ্বর হাজির
এত ভাগ্য আমার
আজ আমার জন্মদিন
কেকের উপরে গুঁজে রাখা
মোমবাতি গুলি নিঃশব্দে নিভিয়ে দিলেন তিনি
বন্ধ করে দিলেন শুভাকাঙ্খীর হাততালি
ঢাকের শব্দের মতো দৈব-বাণী
' আমার জন্মদিন নয়
উদযাপন কর 'জন্ম' দিন তাদের
যাদের জন্ম নেবার কোনো সম্ভাবনা নেই'
কথাগুলি বলে বাতাসে মিলিয়ে গেলেন ঈশ্বর   

আচম্বিতে দক্ষিণের জানালাটা খুলে গেল কিছুতে ধাক্কা খেয়ে
নিশাচর অপরিচিত একটি প্রাণী দ্রুত পার হয়ে যায়
বুকটা ধড়াস করে উঠল
বিড়বিড় করে কী বলল প্রাণীটা

'মানুষ এক অনাকাঙ্ক্ষিত অপ্রয়োজনীয় ভাইরাস'

অচিন প্রাণীটার চোখ দুটো বহুদূর পর্যন্ত জ্বলজ্বল করতে লাগল
শব্দগুলি আমার বুকে শেল হয় বিদ্ধ হয়ে রইল

পদুলি  মুখের প্রাচীন গাছটির ডালে একটি পেঁচা
অলৌকিক  নাচের সঙ্গে কী একটা গান জুড়ে দিল
পাতাগুলি হাততালি দিল

' প্রকৃতিতে কেউ মানুষের মতো বিশ্বাস ভঙ্গ করে না
প্রকৃতিতে মানুষের মতো নেই কারও কুটিল হৃদয়
প্রকৃতিতে মানুষের মতো কেউ কাউকে ছলনা করেনা
পৃথিবীতে না থাকাটাই মঙ্গল
জীব
মানুষের মতো'
গীতের তালে তালে ডাল গুলি কে যেন ঝাঁকিয়ে  দিল
শব্দগুলি খসে পড়ল শিলের মতো থল থল করে 
মাথার ওপরে
 
'মানুষ নিজের বাইরে
কখনও কারও জন্য কিছুই করেনি
পৃথিবীর অসুখের কারণ মানুষ মৃত্যুর কারণ প্রত্যেকেরই এমনকি মানুষের ও'

ভয়ে জানলাটা সশব্দে বন্ধ করে দিলাম
পুনরায় ঘরের ভেতরে ঈশ্বর
দৈববাণী বজ্রের মতো
' মানুষের জন্মে পৃথিবী চোখের জল ফেলে
আমি তৈরি করব একটি নতুন পৃথিবী যেখানে কোনো মানুষ থাকবে না'
অনেকক্ষণ বাতাসে
একটা গান বাজতে থাকল আশা এবং বেদনার মতো
' থাকবেনা পৃথিবীতে পরমাণু বোমা অথবা রাফেল  বিমান
মানুষ না থাকলে
ফুলগুলি খিলখিল করে হাসবে
মানুষ না থাকলে
পৃথিবী অধিক সবুজ হবে
মানুষ না থাকলে
প্রজাপতিগুলি  লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে বেড়াবে
আকাশ আর সমুদ্র হবে অধিক নীল
মানুষ না থাকলে'

কেকটার চারপাশে বৃত্তাকার মানুষগুলি ডুবে গেল
হিমশীতল নীরবতায়
ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখগুলি সাদা কাগজের মতো

কেকটা ঈশ্বরের হাতে ভয়ে ভয়ে তুলে দিলাম

কেকটা নিয়ে যেও ঈশ্বর তাদের জন্য যাদের
কখনও জন্ম হবে না
মানুষের জন্ম এখন উদযাপনের জন্য  যোগ্য নয়

কেকটা হাতে নিয়ে সেই যে ঈশ্বর গেল
তারপরে আর দেখা- দেখি নেই
মানুষ এখন ঈশ্বরবিহীন নিঃসঙ্গ মদমত্ত দানব
মানুষের জন্মদিনটা পৃথিবীর জন্য আনন্দের নয় আতঙ্কের দিন
উদযাপন করবেন না
দুঃখী হবে পৃথিবী

হে পৃথিবী পার যদি আমার জন্মদিনে
দিও কিছু ক্ষমা আর কিছু 
অনুচ্চারিত স্নেহ
আর কিছুই তোমার কাছ থেকে চাই না










প্রতীম বরুয়া-র ২টি কবিতা 

(মূল অসমিয়া  থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস)





উপল দেবকে

কখন ও সকালবেলা
জেগে উঠেই 
চোখ দুটি কচলাতে কচলাতে ভাবি
কেন জেগে উঠলাম?

শুয়ে থাকা
জেগে ওঠা
শুয়ে থাকা
কী- ইবা  অর্থ-এই নিত্য-নৈমিত্তিকতার !

তবুও তো আছে

আর কান পেতে শুনছি

একসঙ্গে দুজনেই
তুমি এবং আমি
আমি এবং তুমি

কঠিন কর্কশ সেই শব্দগুলি
ভালোবাসা আর ঘৃণার কথাগুলি
শেষ হয়ে আসতে চলা একটি গানের সুর
তেল শেষ হয়ে আসা সলতেটা
শিখার ধপধপানিগুলি 

আর একসঙ্গে
দুজনেই বলছি–
খেদ নেই 
খেদ নেই
খেদ নেই

হাতের মুঠি খুলে দিয়েছি
কী পেলাম?
পেলামইনা বা কী!
বেহিসাবির কিসের হিসাব?

আরও একটি গান
আমরা গুনগুন করলাম
সেতারে তুললাম আরও  একটি সুর 
 
কতবার একসঙ্গে ছুঁয়ে  দেখলাম
আর বললাম–
খেদ নেই
খেদ নেই
খেদ নেই

কত কথা বললাম
কোথায় লুকোলাম?
এস এখন সব মনে করি একসঙ্গে।
এস এখন সব ভুলে যাই একসঙ্গে।

বালিশের ওয়াড়   ঢেকে রাখা দাগের মতো 
আমরা ঢেকে রাখলাম অনেক কিছু
আর এক সঙ্গে বারবার বললাম-
খেদ নেই
খেদ নেই
খেদ নেই





কেন লিখি

চায়ের আড্ডায় মজা করে
বন্ধুরা জিজ্ঞেস করে
কেন লিখি?
নির্জনে নিজেকে
মাঝেমধ্যে আমিও আমাকে জিজ্ঞেস করি
কেন লিখি?

নদীর তীরে বসে
জলের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়
ঢেউগুলি উঠে
আর মিলিয়ে যায়।
কানের কাছে এসে বাতাস বিড়বিড় করে।
তুফানে বাসাগুলি ভেঙ্গে যাওয়া
পাখিগুলির করুণ কাতর কণ্ঠস্বর শুনি।
কোনো কিছুই তো করতে পারিনা।

তাই লিখি।

ঘাসগুলি জন্মায়।
পাখি বাসা তৈরি করে।
নদীগুলি জলে ভরে  এবং শুকিয়ে যায়।
মৌমাছিরা গুণগুণ করে।
মানুষগুলি মাঝেমধ্যে বেঁচে ওঠে।
মেঘেরা আসে আর চলে যায়।
বৃষ্টি হয়ে খসে পড়ে চোখের জল।
স্বপ্নগুলি ভেঙ্গে যায়।
একটি একটি স্বপ্নের পিঠে গজিয়ে উঠে
আরও অজস্র স্বপ্ন।

তাই লিখি।

কাদায় ডুবে যেতে  থাকা
গন্ডারের বাচ্চা একটা  চিৎকার করে।
শিলের নিচ থেকে ভেসে আসে
করুণ কাতর একটি আর্তনাদ।
কোনো কিছুই তো করতে পারিনা।

তাই লিখি।

লিখে লিখে দুঃখগুলি ভাঙ্গি।
বাতাসের ঘন্টিটা বাজে
জানালায় এসে ঝুলে থাকে
চাঁদটা।
পাহাড়গুলি গান গায়।
শিলগুলি নিঃশ্বাস নেয়।
 হেঁটুলুকা পাখিটা সারাদিন 
হেঁটুলুক হেঁটুলুক করতে থাকে।

তাই লিখি।

গৃহহীন মানুষগুলিকে দেখি।
সন্তানহারা মায়েদের দেখি।
শহরের ভগ্নস্তূপ গুলি দেখি।
মাড়িয়ে যাওয়া  গাছগুলিকে মরে যেতে দেখি।
কিছুই তো করতে পারিনা।

তাই লিখি।

নদী এবং নক্ষত্ররা আছে।
সোনালি ধান গুলি আছে।
শঙ্খের মালাগুলি আছে।
হিজল গাছের ছায়াগুলি আছে।
মর্মর সন্ধ‍্যাগুলি আছে।
নুনীর পাতা এবং ফলগুলি আছে।
কামরাঙ্গা ঠোঁট দুটি আছে।
তোমার বুকে দুটো মৌচাকের  বাসা আছে।

তাই লিখি।

দেশগুলি  আছে।
দেশ গুলি থাকবে কি?
রূপ আছে রূপকার আছে।
রূপের আলো আছে।
আছে রূপকারের বুকের অন্ধকার।

রূপক আছে ।বক্রোক্তি আছে।
বৈপরীত্য আছে।
আছে শব্দ এবং বুদ্ধির মায়াজাল।

তাই লিখি।

মাঝরাতের চিৎকার গুলি আছে।
আর আছে রাতের অদেখা অন্ধকার!
সেই অন্ধকারে ঝুলে আছে
দেও-ডরিকের শ্বাস প্রশ্বাস।
 আমরাও আছি তারমধ্যেই কোথাও!
আগুন হয়ে জলে উঠা জীবনগুলি আছে।
ধোঁয়া আর ধুলো হয়ে মিশে থাকা 
জীবনগুলি আছে ।
ফড়িং গুলি আছে ।
ঝিঁঝিঁ পোকাগুলি আছে। 
মনের মধ্যে আরও আছে
শান্ত সমাহিত
অকুল উন্মুখ কিছু একটা। 

আর আছে বুকের মধ্যে
 ভিজে একটা বাঁশির সুর।
দেখেশুনে গন্ধ নিয়ে স্বাদ নিয়ে উষ্ণতা নিয়ে
যে বাঁশি বাজিয়ে ছিল বরুয়া!

তাই লিখি।

আমি আছি
তাই লিখি।
আমি থাকব না
তাই লিখি।
—---
টীকা –বরুয়া
হেঁটুলুক– লাল ঠোঁট এবং সবুজ ডানা থাকা এক ধরনের ছোট পাখি।
দেও- অপদেবতা
ডরিক– এক ধরনের বন‍্য পাখি







নীলকান্ত শইকীয়া-র ২টি কবিতা 

(মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস)






হাজার প্রাণের কবিতা

আমি আমাকে রেখে যাবার জন্য কোনো পাত্রের প্রয়োজন নেই
আমি ভারীও নই হালকাও নই
নই কঠিন বা কোমল
শক্ত অথবা জলীয়
আমার অস্তিত্ব ব্যাপ্ত নয়, নয় অপর্যাপ্ত
আমি কান্নাও নই হাসিও নই।

আমি চিন্তিত নই কোথা থেকে এলাম
কোথায় যাব
স্বর্গ কিম্বা নরক বা পুনরায় জন্ম বিশ্বাসের বাইরে
জন্ম-মৃত্যুর সীমা দিয়ে আমি আঁকতে  চাইনা আমার ভবিষ্যৎ।

আমি আমাকে আমাতেই শেষ করতে চাই
বিনয়ের কাঁধে উঠে গিয়ে প্রতিদিন দাহ করি
অহংকারকে
আমার সময় দিয়ে গড়তে চাই না মানুষের ভবিষ্যৎ
পৃথিবী গড়ে উঠুক নতুন চিন্তায়,নতুন নতুন
ধারণায়,নব উদ্দীপনায়।

আমার বিষাদের দিনলিপি পড়াতে চাই না অন্যকে
আমার যন্ত্রণার সাক্ষী কেবল আমি
আমি লিখে যেতে চাই প্রাণের কবিতা
হাজার প্রাণের সৌহার্দ‍্যে।

আমি শুনতে চাই আরম্ভের অভয় সঙ্গীত
আমি দেখে যেতে চাই পৃথিবীর নতুন আলোড়ন।

শেষ উঁকি মেরে জীবন থেমে যাওয়ার আগে।।






আধ খাওয়া একটি কুলের জন্যই

আধখাওয়া একটি কুলের জন্যই সমস্ত সম্ভব হয়
ফুল ফোটে জ্যোৎস্না হাসে
নির্জনে ফোঁটা ফোঁটা খসে পড়ে শিশির

ভালোবাসা কারও হৃদয়ের দিকে লাফায়
পাওয়া না পাওয়ার হিসাব না করে
সহজভাবে মেনে নেয় প্রেমের সমস্ত কথা– নীতিগত বা বিরুদ্ধ।
আধখাওয়া একটি কুলের জন্যই কৃষক চাষ করে
শ্রমিক  পাথর ভাঙ্গে
কবি কুলটার বাকি আধা নিয়ে লেখে কবিতা।

যুদ্ধের মধ্যেও বেঁচে থাকে সুন্দর পৃথিবী
ধ্বংসের বালুচরে পুনরায় গড়ে উঠে সভ্যতা।

যান্ত্রিক পোশাকের আড়ালেও জেগে উঠে ভেতরের মানুষটা
বুদ্ধ বেরিয়ে যায় চুপি চুপি
মৃত্যুর মধ্যেও  ব্যাপ্ত হয় মৃত্যুহীন জীবন।

আধখাওয়া একটি কুলের জন্যই সমস্ত সম্ভব হয়
বিদ্রোহ বিপ্লব ভাঙ্গা –গড়া
কলজে  ভেদ করে আসে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া

ঘর একটা ঘর হয়েই থাকে
বিচ্ছেদের অন্তিম সইটা না করে হাসে 
স্বামী-স্ত্রী।

কুলটির আধা সারা জীবন বুকে নিয়েআই full
খুঁজে বেড়ায় কোথায় বা রইল
সেই কামড়ের অবশেষ।



























ভাস্কর জে নাথ-এর কবিতা

(মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস)






জ্যামিতিক রুটি

'রুটি  সব সময় একটি বৃত্তের মতো হওয়া উচিত'

কথাটা আমি সহজে মানতে পারিনা

তিনি একটি বৃত্ত আঁকার খুব যত্ন  করেন
ত্রিভুজ অথবা চতুর্ভুজ হতেই পারে না

হলে না জানি কত লেঠা কী বিপদ 

আমি রুটির নামে বৃত্ত আঁকার কথা কখন ও ভাবিনা
তিনি আমাকে দেখে হাসেন, কোন দেশের মানচিত্র আঁকলে
 
কোনো দেশের মানচিত্র বৃত্ত হতে পারে না
কথাগুলি একটি বিন্দু থেকে গিয়ে গিয়ে শেষ বিন্দু ছুঁতে পারে না
কথাগুলি রুটির মতো গোলাকার হতে পারেনা
দেশের কথাগুলি বৃত্ত হতে পারে না
রুটির জন্যই উঠা
রুটির জন্যই বসা
উঠা বসা
বসা উঠা

প্রতিটি গ্রহ বৃত্ত
পৃথিবী আঁকে
ক্ষুধার পৃথিবী

আর ক্ষুধার দাঁতেই চিবোচ্ছি পোড়া পৃথিবী।।





কবিতা

এসো আমরা আঙ্গুলকেই চুষে খাই
চেটে দেখি নিরন্ন বিকেলের প্রোটিন

সেদিন বলেছিলে
আমাদের জীবন শামুকের
কেন বলেছিলে
স্বপ্নে দেখা লাল ঘোড়াটার কথা

কি দিয়েছিলে আমার হাতে?
যে আগ্রহের তুলে নিলাম
ক্ষীণ চারটি সূর্য!
লালা বইয়ে চুষেছিলাম যা

এমনকি আঙ্গুল উপহার দিলে তোমরা
যা আঁকতে পারে না দেশের মানচিত্র
আঁকতে পারেনা ভাতের ছবি
আঁকতে পারেনা জলের  ছবি

সেরকম আঙ্গুল উপহার না উপহাস!

আমার কাছে উজাগর আর অজগর একই কথা
দুটোই গিলে খায়

এখানে একটি কথার পাহাড় আছে
অতিক্রম করাটাই আসল কথা


















































রবীন ভূঞা-র ২টি কবিতা 

(মূল অসমিয়া  থেকে বাংলা অনুবাদ- বাসুদেব দাস)





বাবা

বাবাকে নিয়ে লিখতে পারিনি
কবিতা অথবা গদ্য
কখন ও দুটো স্তবক
ভাবের উত্তোলন
ব্যর্থতার দোলন
বাবাকে নিয়ে একটি কবিতা
এত সহজ নয়
বাবা একটি কবিতা নয়
একটি মহাকাব্য

ক্যানভাসে রং ছিঁটোই
হলে হোক একটি এবসার্ড পেন্টিং
বাবা একটি অরণ্য হয়ে পড়ে
উপচে পড়ে রোদ জ‍্যোৎস্না 

উঁচু গাছ, সাগরে করুণা
বাবা গাছের চেয়ে উঁচু
সাগরের চেয়েও গভীর
বাবা আকাশের মতো
দুঃখের শোকাকুল মেঘ
বৃষ্টির ছন্দ
সুখে জ্যোৎস্না
রোদ রোদ গন্ধ
বাবারা একই
ঘুটঘুটে অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করে তারা
তুফানের সঙ্গে কত সময় লড়াই
বাবা ক্লান্ত হন না

কোলের শিশু
মায়ের ঘুম পাড়ানি গান
বাবার হাসি
একই পুরোনোকালীন  বিশ্বাস
বাবার বীজধান
নাই অসম্পূর্ণতার  লেশ

দিন পার হয়ে যায়
শোভমান কোলের শস্য
অনুকূল আবহাওয়ায় বাবা স্বপ্নবিভোর
ক্রমশ বাবারা অবশ হয়ে পড়ে

ভাটিয়ালি সুর
ঢাক কাসির শব্দ
বাবাকে আকুল  করে
একই  বিশ্বাস 
বাবার বীজধান 
নেই অসম্পূর্ণতার লেশ 

আশ্চর্য!
বাবার কান্না
বাবাকে হারিয়েছে
মেঘ-বৃষ্টির যুগলবন্দী
অনন্ত আকাশে
একটি নিঃসঙ্গ তারা

বাবা শিশু হয়ে পড়ে
স্নেহের পুত্র!
বাবার অস্ফুট কথা
সুখ বিলিয়ে বিলিয়ে
বাবারা একদিন অচল হয়ে পড়ে

বাবার কোনোদিনই হয়না
একটি স্থায়ী বাড়ি
দুঃখের পুকুর পুতে পুতে
বাবা সঙ্গোপনে চলে যায়
একটি স্বর্গ হারায়
থেকে যায় ইতিহাস ধারাভাষ্য

বাবার পরে বাবা
ক্রমশ চলতে থাকে
একটি মহাকাব্য
এটা সহজ সত্য
মায়েরর মতো বাবাও…

বাবাকে উপহাস,
কী উদ্ভট অহমিকা




চোখ

চোখ না থাকলে
কার দিকে তাকিয়ে ছুঁড়তে 
ঈর্ষার তীর 
পরশ্রীকাতর
আলো-আধাঁরির বিকেলের হাটে
শত্রু ফড়িং উড়ে
চোখ কুঁচকে
পার হয়ে যায়
একঝাঁক শ‍্যেন
চোখ ফোঁটা মানেই  নয়
বোধের প্রার্থনা
বড় জটিল এই জীবনের পথ

চোখ কথা সমুদ্র
চোখ বর্ণ বাক
চোখ বুদ্ধ
চোখ ছলনা
চোখ অভিশপ্ত ধৃতরাষ্ট্র
অথবা গান্ধারী
চোখ সত্য শিব  সুন্দর
ওম তমসো মা জ্যোতির্গময়

চোখ প্রেমের তোরণ
ঈর্ষার আগুন
মমতার মাতৃ
চোখ ধারাভাষ্যকার
শকুনি হাসি
দুর্যোধনের ও গোলাম
চোখ খেয়ালি কৃষ্ণের চতুরালি

চোখে চোখ রাখলেই প্রেম
না রাখলেই ঘৃণা
বিদ্রোহের দাবানল
চোখ প্রার্থনার হিমালয়
যুদ্ধের বিভীষিকা
চোখ কথা সমুদ্র
অহরহ সম্মোহন
অহরহ গর্জন
চোখের পাকে  সরীসৃপ নৃত্য
কামনার আগুন

চোখ লুকিয়ে রাখে
সিয়াচেন গ্লেসিয়ার অথবা প্যালেস্টাইনের হাহাকার
চোখের দিকে তাকিয়ে চেনা যায়  মানুষ
মহাশয়ের ধূর্তামি  
মহাশয়ের মুখ দেখে
চোখ হাসে বিদ্রূপের হাসি





















বাসুদেব দাস
অনুবাদক


১৯৫৮ সনে অসমের নগাঁও জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব কেটেছে গুয়াহাটি শহরে। ১৯৮২ সনে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্বে এম এ করেন। তিনি একজন নিয়মিত অসমিয়া সাহিত্যের অনুবাদক। NEINAD এর পক্ষ থেকে অসমিয়া ভাষা- সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য Distinguished Life Membership দ্বারা তাকে সম্মানিত করা হয়।
তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৯ টি।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন