সুজিত কুসুম পাল




মস্কোফেরৎ রবীন্দ্রনাথের তেরো নম্বর চিঠি

না, মানুষের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট রবীন্দ্রনাথ কখনোই মস্কোপন্থী ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বলশেভিক আন্দোলনের নেতা ভ্লাদিমির লেনিনের কোনোরকম ভাবনা ছিলো কিনা তা কখনো জানা যায় নি। সোভিয়েত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ঠিক একবছর পর ১৯১৮ সালে ক্রেমলিন প্রাসাদে লেনিনের ব্যক্তিগত পাঠাগারে রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি প্রবন্ধ ‘পারসোনালিটি’ ও ‘ন্যাশনালিজম’ এবং ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের রাশিয়ান অনুবাদ পাওয়া যায়। লেনিন এই গ্রন্থগুলো পাঠ করেছিলেন কি না, কিংবা পাঠশেষে কোনো মন্তব্য করেছিলেন কি না, তার কোনো রেকর্ড এখনো জানা যায় নি। তবে তিনি তলস্তয় পড়েছিলেন। রুশ সাহিত্যিক তলস্তয় সশস্ত্র বিপ্লবকে কখনো সমর্থন না করলেও, লেনিন তলস্তয়ের সাহিত্যকে ‘রুশ বিপ্লবের দর্পণ’ হিসেব অভিষিক্ত করেছেন। শেক্সপিয়রীয় সাহিত্যে তো শ্রেণি সংগ্রামের অস্তিত্ব-ই নেই; তারপরও তো কার্ল মার্কস তাঁকে ‘গ্রেট’ বলেছেন। আবার, জার্মানির গ্যেটে তো ফরাসি বিপ্লবের-ই বিপক্ষে ছিলেন। অথচ মার্কস তাঁর বেশ কিছু রাজনৈতিক রচনায় গ্যেটের সাহিত্য থেকে রেফারেন্স টেনেছেন। রাজনীতিকরা সাহিত্যের বর্ণমালাকে নিজেদের প্রয়োজনে উদ্ধৃত করতেই পারেন। বেনিতো মুসোলিনি ১৯২৫ ও ১৯২৬ সালে নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ইটালিতে নিয়ে গিয়ে সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিলো রবির ইমেজকে ব্যবহার করে তাঁদের রাজনৈতিক কলংক কিছুটা মোচনের চেষ্টা করা। অথচ সোজা সরল রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন ইতালি মানে দান্তে, দা ভিঞ্চি, ওভিদ, মিশেলেঞ্জেলোর দেশ। রবির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফরাসি সাহিত্যিক রোম্যাঁ রোলাঁ ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝিয়ে বললে রবীন্দ্রনাথ শাসকচরিত্র সম্পর্কে সতর্ক হয়ে যান। পরবর্তীকালে রাশিয়া সফরে গেলে রবীন্দ্রনাথ প্রলেতারিয়েত সমাজের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছেন। পাশাপাশি উন্মোচন করেছেন রাজমহলের কালোশাসন তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’ গ্রন্থে। 
বাংলাদেশের চট্টগ্রামস্থ সোভিয়েত দূতাবাসে ১৯৭৮ সালের ২২ এপ্রিল ভ্লাদিমির ই লেনিনের (১৮৭০-১৯২৪) ১০৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র বার্তাজীবীরাই আমন্ত্রিত ছিলেন। আমরা জানতাম, দৈনিক স্বাধীনতার পক্ষ থেকে সিনিয়র হিসেবে বার্তা সম্পাদক মোদাব্বের হোসেন এবং চীফ রিপোর্টার ওসমান গনি মনসুর (বর্তমানে এডিটর, মর্নিং নিউজ) এই অনুষ্ঠানে যোগদান করবেন।  সন্ধ্যে সাতটার দিকে সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল হারুন  জানালেন, দূতাবাসের অনুষ্ঠানে মনসুরভাই আমাকে নিয়ে যাবেন। পরে অনুমান করেছিলাম, চীনপন্থী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততার কারণে হারুনভাই সেদিন মোদাব্বেরভাইকে পাঠান নি। এটাও জেনেছিলাম, হারুনভাই বললেও কট্টর চীনপন্থী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মোদাব্বের ভাই সেদিনের সোভিয়েত অনুষ্ঠান বর্জন করতেন। আমি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের একজন ফুলটাইম ছাত্র হয়েও সাবএডিটর-কাম ফিচার এডিটর হিসেবে দৈনিক স্বাধীনতার একজন ফুলটাইম কর্মচারী। সৌভাগ্য, পত্রিকার জুনিয়রমোস্ট সাংবাদিক হয়েও সেদিন আমি লেনিনের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, যেখানে গিয়ে প্রথম জানতে পারি রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া সম্পৃক্ততার কথা। 
অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সাংবাদিকদের সৌজন্যে প্রদর্শিত হলো লেনিন রেট্রোস্পেক্টিভ। একটি প্রামাণ্য চিত্র। জার সরকারের স্বৈরশাসন বিরোধী বলশেভিক আন্দোলন এবং সোভিয়েত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় লেনিনের ভূমিকাভিত্তিক এই ডকুমেন্টারিটা দেখে তাঁর প্রতি কুর্ণিশ জানিয়েছিলাম। দূতাবাস পাঠাগারে সেদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাশিয়া সফরের ওপর একটা ইংরেজি বই দেখে গর্ব বোধ করেছিলাম। অনুষ্ঠানশেষে ছিলো পানচক্র। ভতকার সাথে ছিলো কাস্পিয়ান সাগরের মাছ দিয়ে তৈরি স্যান্ডুইচ। পানচক্র চলাকালিন একটা জটলা চোখে পড়েছিলো সেদিন। কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকের মধ্যকার আলাপচারিতা শুনে মনে হলো রবীন্দ্রনাথ মস্কোপন্থী ছিলেন। তাঁদের কথাবার্তা থেকে আমি এমন একটা ধারণা পেলাম, কমরেড মনি সিং কিংবা ন্যাপের খান ওয়ালী খানের মতো রবীন্দ্রনাথও একজন মস্কোপন্থী ছিলেন। পরবর্তীকালে, এই কৌতূহলকে মাথায় রেখেই রবীন্দ্রনাথকে জানার চেষ্টা করলাম, এবং জানার এই প্রকল্পকর্মে সফলকাম হলাম। অনুসন্ধানশেষে বুঝলাম, সোভিয়েত দূতাবাসের সেদিনের জটলায় অংশগ্রহণকারীদের সবাই ছিলেন মস্কোপন্থী সাংবাদিক। সিনিয়র হয়েও, হয় তাঁরা সবটুকু জানতেন না, নয় তো সঠিক তথ্যকে আড়াল করে রবীন্দ্রনাথের ইমেজকে ব্যবহার করে তাঁরা সাধারণ মানুষকে নিজেদের আদর্শের অনুসারী বানাতে চেয়েছেন। প্রমাণ হিসেবে তাঁরা রবির ‘রাশিয়ার চিঠি’ গ্রন্থকে সামনে নিয়ে আসতেন। 
উল্লেখ্য, ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির পরপরই একই সালের নভেম্বর মাসেই সেন্ট পিটার্সবার্গের মাসিক ‘সেভার্নিয়ে যাপিস্কি’ জার্নালে গীতাঞ্জলি’র সম্পূর্ণ অনুবাদ প্রকাশিত হয়। রাশিয়ান ভাষায় গীতাঞ্জলি অনুবাদের পর থেকে সেখানে রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত রবির সমস্ত প্রকাশনা রুশ ভাষায় অনুদিত হয়। কিন্তু জোসেফ স্ট্যালিন সরকারের ‘থার্ড রিভলুশন’ শুরু হলে ১৯২৯ সাল থেকে রবীন্দ্রগ্রন্থের রাশিয়ান প্রকাশনা প্রায় সম্পূর্ণরূপেই বন্ধ হয়ে যায়। তৎকালিন সোভিয়েত সরকারের বৈদেশিক সাংস্কৃতিক যোগাযোগ সংস্থার আমন্ত্রণে  রবীন্দ্রনাথ ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৩০ রাশিয়া ভ্রমণে যান। এই সফরে তাঁর সাথে ছিলেন রবির বিজ্ঞানীবন্ধু আইন্স্টাইনের কন্যা মার্গারিটা আইন্সটাইন ও কবি অমিয় চক্রবর্তী। নোবেল প্রাপ্তির (১৯১৩) সতের বছর পর তথা সোভিয়েত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার (১৯১৭) তেরো বছর পর তিনি এই সফরে যান। ফ্যাসিস্ট জার সরকারকে হটিয়ে অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত এই সোভিয়েত শাসন ব্যবস্থা কবিকে নানানভাবে অভিভুত করেছিলো। শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্নয়নে গৃহীত সরকারের পর্যায়ক্রমিক পদক্ষেপ এবং নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র তেরো বছরের মধ্যে কল্পনাতীত সফলতা দর্শন করে তিনি উল্লসিত হন। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে সোভিয়েত অর্জন তাঁকে বিমোহিত করে। জেনেভা থেকে তিনি রাশিয়া, এবং পরে রাশিয়া থেকে আমেরিকা হয়ে দেশে ফেরেন। রাশিয়া সফরের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি রাশিয়া এবং আমেরিকা থেকে চিঠি লিখেন তাঁর বিভিন্ন নিকট আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধবের কাছে। এই চিঠিগুলোই ১৯৩১ সালে ‘রাশিয়ার চিঠি’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এক চিঠিতে তিনি লিখেন, “আমি নিজের চোখে না দেখলে কোনোমতেই বিশ্বাস করতে পারতুম না যে, অশিক্ষা ও অবমাননার নিম্নতম তল থেকে আজ কেবলমাত্র দশ বৎসরের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে এরা শুধু ক খ গ ঘ শেখায় নি, মনুষ্যত্বে সম্মানিত করেছে। শুধু নিজের জাতকে নয়, অন্য জাতের জন্যেও এদের সমান চেষ্টা। অথচ সাম্প্রদায়িক ধর্মের মানুষেরা এদের অধার্মিক বলে নিন্দা করে। ধর্ম কি কেবল পুঁথির মন্ত্রে, দেবতা কি কেবল মন্দিরের প্রাঙ্গণে, মানুষকে যারা কেবলি ফাঁকি দেয় দেবতা কি তাদের কোনোখানে আছে?” তবে সমস্ত সম্পদের মালিকানা রাষ্ট্রের অধীনে থাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরণের নির্ধনতাবোধের আবাসন, তাঁর এই সফর সংক্ষিপ্ত হলেও, তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি লিখেন, “মস্কোতে কয়দিন যে হোটেলে ছিলুম, তার নাম গ্র্যাণ্ড হোটেল। বাড়িটা মস্ত, কিন্তু অবস্থা অতি দরিদ্র। যেন ধনীর ছেলে দেউলে হয়ে গেছে। সাবেক কালের সাজসজ্জা কতক গেছে বিকিয়ে, কতক গেছে ছিঁড়ে, তালি দেওয়ারও সংগতি নেই, ময়লা হয়ে আছে, ধোপার বাড়ির সাথে সম্পর্ক বন্ধ। সমস্ত শহরেরই অবশ্য এক রকম—একান্ত অপরিচ্ছন্নতার ভিতর দিয়েও নবাবী আমলের চেহারা দেখা যায়, ছেঁড়া জামাতেও সোনার বোতাম লাগানো, যেন ঢাকাই ধুতি রিফু-করা। আহারে ব্যবহারে এমন সর্বব্যাপী নির্ধনতা ইউরোপের আর কোথাও দেখা যায় না।” তবে, এমন নির্ধনতাবোধকে লালিত করার পরও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে সাধারণ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির জাগরণ দেখে তিনি নিজেই উদ্ভাসিত হন। আর্ট গ্যালারি, জাদুঘর ও থিয়েটারগুলোতে দর্শকদের ভিড় তাঁকে ঋদ্ধ করে। অথচ বলশেভিক আন্দোলনের আগ পর্যন্ত নিম্নবর্গের এই দর্শকরাই থাকতেন ছেঁড়া বসনে নগ্ন পায়ে রুগ্ন শরীর নিয়ে অনাহারে আর অর্ধাহারে। তাঁরা ছিলেন ঈশ্বরের ভয়ে ভীত, চিন্তা ছিলো মৃত্যুর পর আত্মার নির্বাণ কীভাবে হবে, এবং এই নির্বাণ লাভের আশায় আহারের বাজেট কমিয়ে ক্রিশ্চান যাজকদের কীভাবে উৎকোচ দিয়ে প্রসন্ন রাখা যায়। তাই তিনি অপলক নয়নে প্রত্যক্ষ করেছেন কীভাবে সোভিয়েটরা রুশসম্রাটকৃত অপমান এবং আত্মকৃত অপমানের হাত থেকে দেশকে বাঁচিয়েছে। তাঁর মতে ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো। রাশিয়ার বুকের ওপর থেকে ধর্ম ও অত্যাচারী জার শাসনের চেপে দেয়া পাথর সরে যাওয়ায় তিনি আনন্দে আত্মহারা হন। 
চট্টগ্রামস্থ সোভিয়েত দূতাবাসে সেদিন যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে জটলা পাকিয়েছিলেন, তাঁরা কখনো প্রকাশ করতেন না, সোভিয়েত রাষ্ট্র নিয়ে রবীন্দ্রমানসের এতো এতো পজিটিভ পর্যবেক্ষণ সত্বেও কেনো তখনকার সোভিয়েত শাসক জোসেফ স্ট্যালিন ‘রাশিয়ার চিঠি’ গ্রন্থটি রাশিয়ান ভাষায় অনুবাদ এবং প্রকাশ নিষিদ্ধ করেন। কিংবা ১৯৫৩ সালে স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর নিকিতা ক্রুশ্চেভের সরকার ১৯৫৫ সালে রাশিয়ান ভাষায় গ্রন্থটির অনুবাদ ও প্রকাশের অনুমতি দিলেও কবির তেরো নম্বর চিঠিটি তাতে অন্তর্ভুক্ত করার অনুমতি কেনো দেন নি। শুধু তাই নয়, আরো আছে। ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩০ রবীন্দ্রনাথ নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে মস্কো ত্যাগের প্রাক্কালে দৈনিক ইজভেস্তিয়া (১৯১৭-১৯৯১) পত্রিকাকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, 
There must be disagreement where minds are allowed to be free. It would not only be an uninteresting but a sterile world of mechanical regularity if all of our opinions were forcibly made alike. If you have a mission which includes all humanity, you must, for the sake of that living humanity, acknowledge the existence of differences of opinion. Opinions are constantly changed and rechanged only through the free circulation of intellectual forces and moral persuasion. Violence begets violence and blind stupidity. Freedom of mind is needed for the reception of truth; terror hopelessly kills it.    
লৌহ শাসক স্ট্যালিনের কড়া নির্দেশে ইজভেস্তিয়া কর্তৃপক্ষ সেদিন ইন্টার্ভিউটি প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন। স্ট্যালিন সেদিন রবীন্দ্রনাথকে সোভিয়েত রাষ্ট্রের ভয়ানক একজন বিরুদ্ধবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। মস্কোপন্থী সাংবাদিক বন্ধুরা এই বিষয়টিও কখনো বাংলাদেশের প্রলেতারিয়েত সমাজের সামনে তুলে ধরেন নি। লেনিনের সহকর্মী প্রথম সোভিয়েত শিক্ষামন্ত্রী সাহিত্যিক আনাতলি লুনাচারস্কি (১৮৭৫-১৯৩৩) প্রতিভার পরিধি ও উচ্চতার নিরিখে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ‘দ্য ইন্ডিয়ান তলস্তয়’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ রচনা করলেও বাংলাদেশের কিছু ‘কমরেড’ তাঁকে ‘রাশান রবীন্দ্রনাথ’ হিসেবে তুলে ধরতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। জ্ঞানের অভাবে আমি নিজেও এই ধারণা নিয়েই ছিলাম। 


১৯৮০ সালে মার্কিন বহুজাতিক ফাইজার কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে রাজশাহী শহরে বসবাস শুরু করার পর থেকে দীর্ঘদিন সাহিত্য চর্চা থেকে দূরেই ছিলাম। রাজশাহী শহরে অবস্থানকালে রোটারি ক্লাব, হার্ট ফাউন্ডেশন, ক্যান্সার সোসাইটিসহ নানান সংগঠন নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটিয়েছি। রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮০-এর অধীনে ১৯৯২-৯৩ সালে আমি রাজশাহি রোটারি ক্লাবের সেক্রেটারি এবং ১৯৯৫-৯৬ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ১৯৯২ সালের জুলাই মাসে সদ্য ভেঙে পড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের ঢাকা দূতাবাসের অস্থায়ী প্রধান আইগর সেপ্রিকিন রাজশাহী রোটারি ক্লাব পরিদর্শনে আসেন। রাজশাহি কলেজিয়েট স্কুলের টিচার্স রুমে প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আমাদের উইক্লি মিটিং হতো। সেপ্রিকিন সেদিন ক্লাবের সাপ্তাহিক সভায় অতিথি বক্তা হিসেবে বক্তব্য প্রদানকালে জানান, গনতান্ত্রিক রাশিয়ায় রোটারি ক্লাবের কার্যক্রম অনুমোদনের আগে তাঁরা জরিপ চালাতে চান, জানতে চান ক্লাবের নানান কর্মসূচি সম্পর্কে। সেই জরীপ কাজের অংশ হিসেবে তিনি রাজশাহী রোটারি ক্লাব পরিদর্শনে এসেছেন। সভাশেষে আমি তাঁকে আমাদের বাসায় নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানালে তিনি সম্মতি প্রকাশ করেন। 
রাতে খাওয়ার টেবিলে বিভিন্ন আলাপচারিতার এক ফাঁকে আমি তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, বাংলাভাষী কোনো সাহিত্যিক সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন কিনা। জবাব শুনে আমি পুলকিত হলাম ভীষণ। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সত্যজিত রায়ের নাম বললেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া ভ্রমণের কথাও জানতেন। কিন্তু ‘ইজভেস্তিয়া’ পত্রিকায় তাঁর ইন্টার্ভিউ প্রকাশিত না হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি অবগত নন। উপরোল্লিখিত তেরো নম্বর চিঠি সম্পর্কেও তিনি কিছু বলতে পারলেন না। তাৎক্ষণিকভাবে আমি তাই হতাশ হয়ে পড়ি। সপ্তাহখানেক পর, সেপ্রিকিন ঢাকা ফিরে আমাকে একটি চিঠি লিখেন। চিঠিতে একটি হতাশার খবর, আরেকটি চমকানো খবর। হতাশার খবর হচ্ছে, তিনি তাঁর ক্যামেরায় আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের সাথে যতোগুলো ছবি তুলেছিলেন, সব ক’টি ছবি (তখনকার দিনে ফুজি ফিল্ম দিয়ে তোলা) নষ্ট হয়ে গেছে। চমকানো খবর হচ্ছে, গর্বাচেভের পেরেস্ত্রয়কা (পুনর্গঠন) নীতি চালু হলে রবীন্দ্রনাথের দেয়া ১৯৩০ সালের নিষিদ্ধ ইন্টার্ভিউটি ১৯৮৮ সালে ‘ইজভেস্তিয়া’ পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছে। ১৩ নম্বর চিঠির কোনো খবর তিনি দিতে পারেন নি। তবে তাঁর বিশ্বাস, পেরেস্ত্রয়কা ও গ্লাসনস্ট (খোলা মন) নীতির অধীনে রবীন্দ্রনাথের কোনো লেখা প্রকাশে কোনো আইনি বাধা থাকার কথা নয়। 
সেই তেরো নম্বর চিঠি এবং ইন্টার্ভিউতে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত কঠোর ভাষায় তৎকালীন সোভিয়েত সরকারের মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের সমালোচনা করেন। গর্বাচেভের পৌরোহিত্যে সোভিয়েত সাম্রাজ্য খণ্ডিত হয়ে ১৯১৭ সালের পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সময় লাগলেও, তিনি এই সাম্রাজ্য ভেঙে যাবার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন সেই ১৯৩০ সালে। চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন, “‘ল অ্যাণ্ড অর্ডার’ কী পরিমাণে রক্ষিত হচ্ছে বা না হচ্ছে তার তদন্ত করবার যথেষ্ট সময় পাই নি—শোনা যায়, যথেষ্ট জবরদস্তি আছে; বিনাবিচারে দ্রুতপদ্ধতিতে শাস্তি, সেও চলে; আর-সব বিষয়ে স্বাধীনতা আছে কিন্তু কর্তৃপক্ষের বিধানের বিরুদ্ধে নেই। … এখানে জবরদস্ত লোকের একনায়কত্ব চলছে। এই রকম একের হাতে দেশের চালনা দৈবাৎ কিছুদিনের মতো ভালো ফল দিতেও পারে, কিন্তু কখনোই চিরদিন পারে না। উপযুক্তমতে নায়ক পরম্পরাক্রমে পাওয়া কখনোই সম্ভব নয়। …  তা ছাড়া অবাধ ক্ষমতার লোভ মানুষের বুদ্ধিবিকার ঘটায়।” ‘ইজভেস্তিয়া’র সাথে কথা বলার সময় ‘দ্য ইন্ডিয়ান তলস্তয়’ তাঁর নবুয়ত প্রকাশ করে বলেছিলেন, বলশেভিজমের পতন আসন্ন হয়ে উঠতে পারে। বর্তমান চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে রোগী সুস্থ হলেও ভবিষ্যতে নতুন চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে রোগী উল্লসিত হয়ে উৎসবে মেতে উঠতে পারে। 
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, রবীন্দ্রনাথের পথ ধরে গর্বাচেভ হাঁটতে শুরু করেছিলেন একেবারে শুরু থেকেই। জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে ক্ষমতায় এসেই ১৭ মে ১৯৮৫ লেনিনগ্রাদস্থ কমিউনিস্ট পার্টি হেডকোয়ার্টার থেকে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া টেলিভিশন ভাষণে তিনি বলেছিলেন, “সোভিয়েটদের জীবনযাত্রার মান ক্রমশ নিম্নগামি হচ্ছে। অর্থনীতির সূচক বিপজ্জনক স্তরে। অতীতে আমাদের অনেক ভুলভ্রান্তি হয়ে গেছে, সব শোধরাতে হবে। যেতে হবে অনেক দূর, পৌঁছতে হবে অনেক কম সময়ে। ” অতীতে কোনো নেতা বা কর্মীর এই ধরনের বক্তব্য ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো। গর্বাচেভের এই ভাষণ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে পত্রিকার সব কপি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সোল্ড আউট হয়ে যায়। ১৯৮৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের ৭০তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে ক্রেমলিন প্রাসাদে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় অন্তিম সত্য কথাটি বলে ফেলেন গর্বাচেভ। “অক্টোবর অ্যান্ড পেরেস্ত্রয়কাঃ দ্য রিভলুশন কন্টিনিউজ” শীর্ষক এই ভাষণে তিনি লেনিনের প্রশংসা করেন। কিন্তু তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে স্ট্যালিনকে অভিযুক্ত করেন। পরিশেষে, রবীন্দ্রনাথের ১৯৩০ সালের ভবিষ্যৎবাণী সত্যি হলো ১৯৯১ সালে। চিকিৎসকের পরিবর্তন হলো। নতুন প্রেসক্রিপশন এলো। লেনিনগ্রাদের নাম পরিবর্তিত হয়ে পূর্বের সেন্ট পিটার্সবার্গ হলো। ঢাকার সোভিয়েত দূতাবাস হয়ে গেলো রুশ দূতাবাস। হোয়াট ট্যাগোর থিংস টুডে গর্বাচেভ থিংস টুমোরো।



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন