আলোচক: উমাশংকর রায়






কাব্যগ্রন্থ: অন্ধকার লাবণ্য
             আমিনুল ইসলাম 

প্রচ্ছদ: স্বরূপেন্দ্র রায়
সম্পাদনা: সমরেন্দ্র রায় 
প্রকাশক: সমিধ, বহরমপুর। 
                                                                     মূল্য: ৩৫/-




'ন্ধকার লাবণ্য'। বহরমপুরের 'সমিধ' থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটি কবি আমিনুল ইসলামের তৃতীয় প্রয়াস। ২৭ টি কবিতা সংকলিত হয়েছে এই কাব্যগ্রন্থে। আকারে ছোটো। কিন্তু অসাধারণ এর সম্ভার। মননের উৎকর্ষে, নির্মাণের সৌকর্যে  আর অনুভবের গভীরতায় এ এক অনন্য  সৃষ্টি নিঃসন্দেহে । এর বিন্যাস ও চলমান শব্দ-শরীরে দ্যুতি আছে, কিন্তু ক্ষিপ্রতা নেই। স্বপ্ন আছে, মোহ নেই। নিগূঢ় বাস্তব আছে - অনুভবে, কিন্তু শোক নেই। প্রেম আছে, বন্ধন নেই। কৌতূহল আছে, দোলাচল নেই।তাই এর আবেদন যেন সময়কে ছুঁয়ে থেকেও অসীমকে স্পর্শ করেছে বারবার। তবুও 'অন্ধকার লাবণ্য' যেন সময়ের গর্ভে জেগে থাকা এক প্রলম্বিত সন্দীপন। ওই প্রলম্বিত পথের অতীত কেমন? বাস্তব আর ভবিষ্যতের রূপ-ই বা কী? এদের মধ্যে কি আছে কোনও সংযোগ? জানতে ইচ্ছে হয়। তাই পাতা উল্টাতে হয় অন্ধকার লাবণ্যের।
প্রত্যাশার বিস্তৃর্ণ অনুর্বর ভূমিতে দাঁড়িয়ে কবি তার 'জেগে ওঠার সমূহ লিঙ্ক' কবিতায় লিখছেন, "চোখ, বন্দি থাকতে চায় না চশমায়।" কারণ, বাস্তব বলছে -

"ধানের শিষ ফুটছে অবিকল 

সহসা চাষি হয়ে যায় হাতের মুঠো... "

আর তাই সেখান থেকেই দিশা ঠিক হয়ে যায়। নিশানা স্পষ্ট। তাই মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষায় সোচ্চার লেখনীর স্পষ্ট ঘোষণা -"জাগো সভ্যতা, জেগে ওঠো, তোমার উইন্ডোজে বাজেয়াপ্ত ফাইল খুলছে - জাগো! চারিদিকে আতঙ্ক, বৃষ্টি ঝরছে।"







কবিতার হাত ধরে একটু পথ এগিয়ে যেতেই পাঠক জানতে পারেন এর কারণ 'তন্নিষ্ঠার গভীরে'- "ঝাপসা হয়ে আসে দূরের আলো, ঘাম জমে চশমায়।"
গভীর এক অনুসন্ধিৎসু মনের যাপনকাল মূর্ত হয়ে আছে প্রতিটি কবিতায়। যার মধ্যে আছে ভাঙা-গড়া আর ওঠা-পড়ার এক অপূর্ব অনায়াস মিশেল। তবুও জীবন থেকে পলায়ন নয়। নীরবতা নয়। আছে কন্ঠ। ভেঙে পড়া নয়, আছে উত্থান। দিশাহীনতা নয়, আছে লক্ষ্য। আছে প্রতিবাদ, শ্লেষ, বিচার, চর্যা আর চর্চা। যার অনিবার্য পরিনতিতে ছেঁদো আয়োজনের পর্দা উন্মোচিত হয়ে যায় সহসা। সেখানে দাঁড়িয়ে দৃপ্ত কন্ঠে কবি ঘোষণা করতে পারেন -
"এসো বুভুক্ষু ঈশ্বর, স্পর্শ করো কামরস
খিধে পেটের প্রোটিন ভেঙে বিকলাঙ্গ আলপিনে
গেঁথে দাও দিকচক্রবাল
যারা গৃহহীন, তাদের জন্য মালা-জপে কী হবে?
এসো মৃদঙ্গ বাজাই
এসো ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিই ধুলো
আর একটি স্বচ্ছ অভিযানে মুছে ফেলি
ইঁদুরের সাজানো সংসার! " (পাখির ঘর) 
পরিপার্শ্বে এমনি আরও অনেক প্রবাহ। ওই প্রবাহের মৃদু হাওয়া গায়ে লাগলেই পাঠক দেখতে পান 'ড্রেসকোড থেকে বৃষ্টিপাত'। যদি অস্তিত্ব ভিজে যায় বৃষ্টিতে নজরে আসে - "পোশাক থেকে ঝরে পড়ছে অন্যের নির্দেশ।" বহিরঙ্গের কায়দা আর ব্যস্ততাকে কী অসাধারণ দক্ষতায় খোলসা করে দিলেন কবি গুনে গুনে মাত্র কয়েকটি শব্দে!
জীবন, যাপন আর বোধের ঘরে কি আছে কোনও জটিলতা? নিয়মের আবর্তে কি হারিয়ে যাচ্ছে কিছু? না কি চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে অমূল্য কিছু? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাঠক হয়তো এখানে দাঁড়াবেন দু-দণ্ড। যেখানে কবি লিখছেন -
" স্বাধীনতা সে তো শুধু সংবিধানের নিছক শব্দ মাত্র।
অতঃপর এখানে জট ও জোট দুটো শব্দই
অগণতান্ত্রিক নয়। "(ধূসর ধোঁয়াশাগুলো)
এই সত্যটুকু জানার পর পাঠক হয়তো আবার জানতে চাইবেন 'অ-কবিতার বিষয়বস্তু' -
" পুড়ে যেতে যেতে উড়িয়ে দিই ছাই-ভস্ম
সূত্রের সুতো ফিরিয়ে নিয়ে আসে হামাগুড়ি
ঘুড়ি তো উড়ে গেছে শূন্য লাটাই হাতে
শুধু বসে থাকে ছেলেবেলা। "
কবিতার সার্থকতা তো ওইখানেই। কিছু কথা, কিছু অনুভব জেগে থাকে সবসময়। বারবার নাড়িয়ে দেয় মনকে। একাধিক অর্থ ও রূপে প্রকাশ পায় সে। মুহূর্তের ব্যবধানে ধরা দেয় অন্য রূপে। তাই কোনো এক মুহূর্তে সেই চিরন্তন কথাটিই হয়তো বিশেষ অর্থ বয়ে নিয়ে আসে -
"শরীর তো মাটির কাপ না,
যে ব্যবহারের পর ফেলে দেবে। এক নিস্পাপ
আত্মার খোলসমাত্র। একাধিকবার শুদ্ধ হয়ে
অনন্তের পথে যাত্রা করে।" (মনের রং থেকে)

সময় তো থেমে নেই কোথাও। নিরন্তর বয়ে চলেছে সে। সফলতা ও ব্যর্থতার হিসাব সেখানে নশ্বর প্রলেপ মাত্র। তবুও এত শতছিদ্র আর মলিনতাকে আবরণে ঢেকে দেওয়াই যেন দস্তুর। সেই দস্তুরে ভেসে যাওয়া খড়কুটো জানতেও পারে না স্রোতের গভীরে কী আছে? কী কথা তার? কী ব্যথা বয়ে যাচ্ছে সে? সেই অনবধানই কি তৈরি করে বুদবুদের মতো কিছু শূন্য বলয়?
'শূন্য বিষয়ক' কবিতায় কবি লিখছেন -
"চারটে অবুঝ চোখ শুধু
এই মরশুমেও ভালোবাসায় মশগুল।
ক্ষুধার্ত চিতা বসে আছে ওত পেতে,
আনমনে ভাগীরথী বয়ে যায়।
থামতে নেই, দুঃখ নিয়েও বয়ে যেতে হবে তাকে।"

এভাবেই অনেক কিছু বলা হয়ে গেলেও শেষ হয় না আরও অনেক বলার কথা! তাই শেষ বেলাতেও রয়েছে কবির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত -
পাঠক হিসেবে ভালো লাগে পরপর এগুলো এভাবে সাজিয়ে রাখতে :
"জমাট আস্তরণের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সময়" (কার্বন ফিউশন)
"তবুও গাছ হতে থাকি নিজের সীমানায়
পাতা ও ফুলের বাহারে পতঙ্গ আসে পাখি বাসা বাঁধে
আনন্দে অঙ্কুরিত হই বারবার... " (নেটিভ অঙ্কুরোদগম)
"... ডুবতে না জানায় ঘটি ঘটি জল ঢালি মাথায়
এভাবেই জানাশোনা ভাগীরথীর জল চরাচর
মালতীর ইন্ট্রোভার্টে ঢুকিয়ে রাখি চেতনার ধারাপাত।"
(মালতীর ইন্ট্রোভার্টে পলাশ রং)

 
এমন ধারার এক 'অন্ধকার লাবণ্য'র জন্য কবিকে এসময় এক স্ফটিকস্বচ্ছ স্যালুট। সেই সঙ্গে পাঠককে জানিয়ে রাখি কবির আরও কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের কথা- 'রক্তক্ষয়ী চুম্বন' (গুপিযন্ত্র), 'গণতান্ত্রিক আলো' (কবিতা পাক্ষিক) 'বৃশ্চিকমিথুন' (ভুবনডাঙা)।






Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন