ভাষান্তর: সুজিত কুসুম পাল
পার্সি বিশ শেলী (১৭৯২-১৮২২)
আমি ওজিম্যান্ডিয়াস
মরু্দেশ ফেরত পর্যটকের নিরীক্ষিত সুবচন,
“বহাল তবিয়তে দণ্ডায়মান মরুভূমির ‘পরে
ধড়বিহীন বিশাল দুটি পাথুরে চরণ,
ছিন্নভিন্ন আনন অর্ধপোঁতা বালির উদরে,
যাঁর আবেগকে করেছে অবরুদ্ধ ভাস্করের বীক্ষণ;
হিমেল হুকুমের উপহাস আকুঁচিত অধরের কুঞ্চনে
প্রাণের আবেগ আছে উৎকীর্ণ প্রাণহীন সম্ভারে
কারিগরি হাতের ব্যঙ্গকর্ম কুঁদিত আবেগের উদ্বর্তনে।
সদয় পাদবেদীতে নির্দয় হৃদয় তার বাণী করে ফাঁসঃ
‘আমার নাম ওজিম্যান্ডিয়াস, রাজার রাজা দরবারেঃ
আমার কীর্তি দেখে আগামির রাজাও হবে হতাশ।’
পাশে শুধুই পাথুরে উচ্ছিষ্ট অতিকায় গতরের আঙিনায়;
অনুভূমিক সমতলে অন্তহীন বালির ব্যাপিত অধিবাস
ঊষর উচ্চতা অতিদূর অবিরাম সীমাহীন সীমানায়।“
Original: Ozymandias by Percy Bysshe Shelley
I met a traveller from an antique land,
Who said—“Two vast and trunkless legs of stone
Stand in the desert. . . . Near them, on the sand,
Half sunk a shattered visage lies, whose frown,
And wrinkled lip, and sneer of cold command,
Tell that its sculptor well those passions read
Which yet survive, stamped on these lifeless things,
The hand that mocked them, and the heart that fed;
And on the pedestal, these words appear:
My name is Ozymandias, King of Kings;
Look on my Works, ye Mighty, and despair!
Nothing beside remains. Round the decay
Of that colossal Wreck, boundless and bare
The lone and level sands stretch far away.”
কায়রোতে ২০১৭ সালে প্রাপ্ত র্যামসেসের আরেকটি মূর্তি উদ্ধারের খননকার্য। ছবি-এএফপি
রোম্যান্টিক পিরিয়ড (১৭৯৮-১৮৩২)-এর একটু ভিন্ন মেজাজের কবি হিসেবে পরিচিত পার্সি বিশ শেলী (১৭৯২-১৮২২)-র অন্যতম একটি বিখ্যাত কবিতা ‘ওজিম্যান্ডিয়াস’। কবির অনুসৃত রাইম স্কিম (ABABACDC EDEFEF) অক্ষুণ্ণ রেখে, সময়ের নির্দয়তা আর ইতিহাসের অনিবার্যতা অন্বেষণে নিবেদিত ১৪ লাইনের এই সনেটটিকে আমি ১৪ লাইনের মধ্যে সীমিত রেখেই বাংলা সনেটে রূপান্তরিত করার প্রয়াস চালিয়েছি। অনুবাদকালে, কবিতার মৌলিক ভাব ও রূপের মর্যাদা কতোটুকু রক্ষিত হয়েছে তা খতিয়ে দেখার দায় ও দায়িত্ব সমর্পিত হলো পাঠকের মজলিশে।
একটি প্রথাবিরুদ্ধ তথা অস্বাভাবিক অন্ত্যমিল বিন্যাসে (ABABACDC EDEFEF) রচিত ১৮১৮ সালে প্রকাশিত এই ইতিহাসভিত্তিক সনেটটি একটি সফল কাব্যকর্ম যার অবস্থান ইংরেজি সাহিত্যে নির্ধারিত হয়েছে শিল্পোত্তীর্ণ উচ্চতায়। সনেটের গঠনপদ্ধতির রীতি অনুযায়ী অষ্টক (অক্টেভ)-এর সাথে ষটক (সেস্টেট)-এর চরণমিলগত কোনো সম্পর্ক থাকার কথা না থাকলেও, শেলী তাঁর এই সনেটটি নির্মাণকালে নিয়ম ভঙ্গ করেছেন দুটি ক্ষেত্রে। ১. তিনি অষ্টকের সপ্তম লাইনের ‘D’ চরণের মিল ঘটিয়েছেন ষটকের দ্বিতীয় লাইনে। ২. অষ্টকের ‘A’ (তিনটি) এবং ষটকের ‘E’ (তিনটি) চরণকে বিজোড় মর্যাদা (স্টেটাস) দিয়ে তাঁর সনেটকর্ম সংসাধিত করেছেন। শেলীর এই অনিয়মকেই আমি অনুসরণ করেছি পূর্ণ মর্যাদায়।
কবিতায় বর্ণিত বার্তাগুলো গল্পাকারে বেরিয়ে এসেছে একজন পর্যটকের মুখ থেকে। বক্তার কাছ থেকে শ্রুত গল্পটি সনেটের রূপ ধারণ করে ব্যঞ্জনা ছড়িয়েছে পাঠকের দরবারে। বিদেশী মরুভূমিতে একটি প্রাচীন রাজমূর্তির ধ্বংসাবশেষকে উপাত্ত হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এই কবিতায়। দুটি "বিশাল" পাথুরে পা সমকোণে দণ্ডায়মান; বদনখানা বিচূর্ণ বিকৃত; অসম্পূর্ণ মস্তকটি মরুর বালিতে আধাপোঁতা; কুঁচকানো অধরের ফাঁকে লেগে আছে শীতল হুকুমের পরিহাসপূর্ণ হাসি। মূর্তির এমন জরাজীর্ণ বাস্তবতার বিদ্রূপাত্মক চিত্রকল্প হিসেবে থুবরে পড়ে থাকা শিলাস্তম্ভটি এখনো হুংকার ছেড়ে বলছে, ‘আমার নাম ওজিম্যান্ডিয়াস, রাজাদের রাজা আমি। আমার কিংবদন্তি কীর্তি দেখে আগামির রাজাও হবে হতাশ।’
আলোচিত ওজিম্যান্ডিয়াস হচ্ছে ১৯তম রাজবংশের মিশরীয় ফারাও দ্বিতীয় র্যামসেস (খ্রিস্টপূর্ব ১৩০৩-খ্রিস্টপূর্ব ১২১৩)-এর গ্রীক নাম। প্রকৃতপক্ষে, প্রাচীন গ্রীক ইতিহাসবিদ ডিওডোরাস সিকুলাস (খ্রিস্টপূর্ব ৯০- খ্রিস্টপূর্ব ৩০) রচিত গ্রন্থে উদ্ধৃত দ্বিতীয় র্যামসেসের একটি বিশাল মূর্তির কিছু বিধ্বস্ত টুকরো এবং তাঁর একটি শিলালিপিকে উপজীব্য করে শেলী রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত ইতিহাস ভিত্তিক সনেট ‘ওজিম্যান্ডিয়াস’। এই ফারাও দ্বিতীয় র্যামসেস ৬৭ বছর (খ্রিস্টপূর্ব ১২৭৯- খ্রিস্টপূর্ব ১২১৩) একটানা (আমৃত্যু) ক্ষমতায় থেকে বহু সেনা অভিযান চালিয়ে মিশরের সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ করেছিলেন পূর্বে সিরিয়া এবং দক্ষিণে সুদান পর্যন্ত। মিশর জুড়ে অসংখ্য নান্দনিক স্থাপনাসহ নিজের বেশ কয়েকটি মূর্তিও তিনি নির্মাণ করিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, তাঁর প্রয়াণের পরও, একটি প্রতাপশালী উত্তরাধিকারচক্রের ক্রম পরিক্রমায় সঞ্চালিত হবে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত রাজ্যপ্রবাহ।
কবিতার কাব্যিক পরিস্ফুটন রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্ষণস্থায়ীত্বকে প্রদান করেছে চূড়ান্ত এক অনিবার্যতা – রাজা ও রাজ্য উভয়ই একদিন সমাহিত হয় অসদয় সময়ের নির্দয় সৈকতে। বিচক্ষণ সময় কেবল মূর্তিটিকেই বিক্ষত করেনি, পুরো রাজ্যটিকেই অপনোদিত করে দিয়েছে মরুবালির নিস্তরঙ্গ প্রবাহে। ‘মরুভূমি’র মতো একটি শক্তিশালী চিত্রকল্প ব্যবহার করে শেলী তাঁর পাঠকদের কাছে নির্মম বার্তাটি পৌঁছে দিয়েছেন অত্যন্ত নিখুঁতভাবে – ইতিহাসের পাতা সমৃদ্ধ হয় সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতনে। কোন ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়, একজন শাসক নিজেকে যতই সর্বশক্তিমান বলে মনে করুন। শুধু রাজা নয়, ‘রাজাদের রাজা’ও একদিন হয়ে যেতে পারেন একটি ‘প্রাচীন ভূমি’র বিস্মৃত অবশেষ ।
নাইল (নীল) নদীর পশ্চিম তীরে ‘সিটি অফ দ্য ডেড’ খ্যাত লাক্সোর নগরীর নেক্রপলিস সমাধিপাড়ায় ধ্বংসপ্রাপ্ত র্যামসেস যাদুঘরে মূর্তিটির সন্ধান পাওয়া যায়। রক্তিম গ্র্যানাইট পাথরে নির্মিত খ্রিস্টপূর্ব ১২৭০ সালে স্থাপিত ৮০ ইঞ্চি প্রশস্থ ও ১০৫ ইঞ্চি উচ্চতার এই ভাস্কর্যের ওজন ছিলো ৭.২৫ টন, যার গায়ে খোদাই করা একটি বার্তা ছিলো এই রকমঃ "King of Kings Ozymandias am I. If any want to know how great I am and where I lie, let him outdo me in my work."
শেলীর কবিতাটি ১১ জানুয়ারী ১৮১৮ প্রকাশিত হওয়ার তিন বছর পর, মহাপরাক্রমশালী এই ফারাওর ভগ্ন মূর্তিটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রবেশ করে ১৮২১ সালে। তিনি সিকুলাসের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে এই 'রাজাধিরাজ' সম্পর্কে জ্ঞাত হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, কবিতার প্রথম লাইনে শেলী এই ইতিহাসবিদ সিকুলাসকেই দাঁড় করিয়েছেন একজন পর্যটকের চিত্রকল্প ব্যবহার করে। ব্রিটিশ মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ কবিতার একাদশ লাইনটি (‘Look on my Works, ye Mighty, and despair!’) খোদাই করেন মূর্তির কাঠামোতে। বহু নারীর জঠরজাত পঁচাশি সন্তানের জনক অহংকারী এই রাজার শিলালিপিটি দাম্ভিকতাপূর্ণ হলেও সময় তাঁর সমস্ত দম্ভকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফের তাঁর দিকেই ছুঁড়ে মেরেছে ব্যঙ্গাত্মক হাসির ব্যঞ্জনা ছড়িয়ে। সেই হাসির উত্তাল তরঙ্গে কেবল এই মূর্তিটিই ধ্বংস হয় নি, পুরো রাজ্যটিও মানচিত্র থেকে খসে গিয়ে মিশে গেছে বালির মরুস্রোতে।
রাজা ওজিম্যান্ডিয়াস এবং তাঁর রাজ্য ধূলিকণা হয়ে যাওয়ার পরেও, প্রাণহীন পাথুরে বেদিতে খোদাই করা শব্দগুলো এখনো টিকে আছে প্রাণবন্ত হয়ে। এই শিলালিপিটি বেঁচে না থাকলে ওজিম্যান্ডিয়াসের নাম বা তাঁর দাম্ভিকতার কীর্তনকথা গ্রীক ইতিহাসবিদ ডিওডোরাস সিকুলাসের পক্ষেও জানা সম্ভব ছিলো না। তাই, বলা যায়, সভ্যতার ইতিহাস সংরক্ষণে রাজনীতির চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী ও স্থায়ী হাতিয়ার হিসেবে ভাস্কর্য শিল্পেরই উত্থান হয়েছে শেলীর এই কবিতায়। ভাস্করের দক্ষতার কারণে ক্ষয়ে যাওয়া ভাস্কর্যের খণ্ড খণ্ড প্রতিটি টুকরো রূপান্তরিত হয়েছে একজন জীবন্ত অখণ্ড ফারাওর অহংলিপিতে। কবিতায় ব্যবহৃত মরুভূমির বালির উপরে মস্তকের বিচূর্ণতা, চেহারার বীভৎসতা, কুঁচকানো ঠোঁট ইত্যাদি চিত্রকল্পগুলোর মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে একজন অত্যাচারী স্বৈরশাসকের ব্যক্তিত্ব ও ব্যঙ্গার্থক আবেগ। ওজিম্যান্ডিয়াসের মৃত্যুর পরও তাঁর আবেগ বেঁচে আছে প্রাণহীন শিলালিপিতে। শেলী ধন্যবাদ জানিয়েছেন ভাস্করকে, যিনি জীবদ্দশায় রাজার আবেগগুলোকে ধারণ করতে পেরেছেন, পরে সেই আবেগকে পুনর্জন্ম দিয়েছেন নির্জীব কংক্রিটের নির্লিপ্ত ক্যানভাসে তাঁর শৈল্পিক নিপুণতা দিয়ে। ব্যক্তির মৃত্যুর পরও তাঁর ব্যক্তিত্বকে জীবিত রাখার মাধ্যম হিসেবে একজন ভাস্কর্যশিল্পীর ক্ষমতাকে অসাধারণ উচ্চতায় আসন দিয়েছে এই কবিতা। শিল্প এখানে আত্মপ্রকাশ করেছে অমরত্বের মাধ্যম হিসেবে। মানুষ, বস্তু, শহর এবং সাম্রাজ্যকে সংরক্ষণ করে শিল্প তাদেরকে এক ধরণের অমরত্ব দেয়; যখন অন্য সব কিছু অদৃশ্য হয়ে যায়, এই শিল্পই, এমনকি ভাঙ্গা এবং বালিতে অর্ধেক চাপা দিলেও, মানবতার উত্তরাধিকারকে বহন করে।
শেলীর চূড়ান্ত বৈশ্লেষিক দৃষ্টিতে মানুষের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির চাইতে প্রকৃতি অনেক বেশি শক্তিশালী। কবিতার চতুর্থ লাইনে ‘হাফ সাঙ্ক’ শব্দ দুটি দিয়ে তিনি ইঙ্গিত করেছেন রাজার পরাক্রমশালিতা এবং রাজ্যের বিশালতাসহ সবই একদিন সমাহিত হয় পরিপূর্ণভাবে (ফুল সাঙ্ক) মরুর বালিকণার ঊষর উচ্চতায় সময়ের পরিক্রমায়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন