অনিরুদ্ধ আলম-এর কবিতা








মুক্তিযুদ্ধ লাল-সবুজের জারনাল 

তালিকাবিহীন চৌরাস্তার আশেপাশে পড়ে-থাকা ভাঙা বেহালাতে প্রতিবাদের টঙ্কার বেজে উঠেছে কি ভাষার দাবিতে হারিয়ে-যাওয়া ভাইদের আকাশি ব্যাকুলতা হয়ে? 

হিংস্রতার নিরেট আশঙ্কা যশোর রোড ধরে এঁকে দিয়েছিল দুর্বৃত্তায়নের পদচারণা। সময় বুঝি কখনোসখনো কালো বেড়ালের সাজ নিতে পছন্দ করে ডহর রাতের আনকোরা অন্ধকারে? 

হাল ভেঙে গেলেও, নদীর দেশের মাঝি জানে কীভাবে নৌকা তাকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে। আর প্রতিটি মৃদঙ্গ মোরগ ঠিকঠিক ডেকে আনে একেকটি আশালতার দিন। 

যে-দেশে সোমেশ্বরীর মতো আথালিপাথালি জোছনা মহুয়া, মলুয়া, কাজলরেখার গল্পে স্নাত, সে-দেশের সোনার ছেলেরা বিপন্ন মায়ের সম্মান রক্ষার্থে অবলীলায় হৃদয়ঙ্গম করে–  কী ক’রে দৃঢ় চিত্তে রাইফেল ধরতে হয়; কী ক’রে ছুঁড়তে হয় প্রতিশোধের গ্রেনেড হায়নাদের পদমূল চুরমার করে দিতে।       

আজো বাতাসি আকাশে ওড়ে কচি পেঁয়াজপাতার উদ্দীপনাতে-রঙিন পায়রার বর্গীয় পাখসাট।

এন্তার জানিয়ে রাখি, একটি গুলিবিদ্ধ ধানশালিকের বদলা হিসেবে দশটি দানব শত্রুর মৃতদেহ অতিতুচ্ছ! অতিনগন্য! রেসকোর্স ময়দানের প্রতিটি ধূলিকণা বুঝেছিল– অভূতপূর্ব স্বকীয়তায়, কেমন করে আত্মবিশ্বাসকে উচ্চশিরে দাঁড়াতে দিতে হয়। 

পাখির চিরায়িত চিৎকারে নদীর ঘুম ভাঙে। রূপালি সারা শরীরে অবারিত পুবালি ঢেউ কোন সে-মায়াময়ী বিছিয়ে দেয়? নায়ের ছোট্ট ছইয়ের ভেতরে পাঁচটি কিশোরের ঊর্ধ্বশ্বাস-প্রতীক্ষা তীক্ষ্ণ তলোয়ারের আবেগে উদ্দীপ্ত করছে হাতে-ধরা স্বর্গীয় আগ্নেয়াস্ত্রগুলোকে। ও-পাড়ে দাঁতাল জিপের আসন্ন হুংকার রোধ করতে গর্জে উঠবে নীরব বন্দুকের মুখরতা। 

সরব পেলবতাতে উদ্বুদ্ধ পানপাতার হৃদয়ে প্রকৃতি যতটুকু বিন্দুবিন্দু শুভাকাঙ্ক্ষা জমা রাখে, ততটুকু ভালবাসা দিয়ে নিরালাকে কাছে পেতে চেয়েছিলাম। 

অতিক্রান্ত তৃণভূমির সীমান্তে হীরের-টুকরো মৌমাছিদের অভিবাদন ঘনীভূত হলেই, বসন্ত ঝোপঝাড়ের গায়ে ফুলেল গর্জন মেখে দেয় সঘন। যেন বলতে চায়, ‘সাহসী হৃদয়ের কৈশোর আর সহিষ্ণু ভালোলাগার যৌবন কখনো ফুরাতে পারে না। একেকটি প্রার্থনাময় গোধূলি আসে তো আরেকটি সোনালি সকালকে আবাহন করতে।’

পিচ্ছিল আঁধারের সঙ্গে লড়তে-লড়তে, চিরন্তন বনানী ছুঁয়ে সূর্য উঠলেই, অপূর্ব মোহমুগ্ধতা মনন ছাপিয়ে লাল-সবুজ পতাকার প্রশান্তি বিলায়। কিংবা জীবনানন্দের এক-অবিস্মরণীয় ধানসিঁড়ি কোথাও সুদূরপুরের দেহলিতে কুলকুল বেগে বয়ে চলেছে থেকে-থেকে। 

কে আমাকে শোনাবে নেকড়েহীন রূপসী বাংলার পবিত্র রূপকথা অবিরল?





জাতক  

পাগলপারা-জোছনাময় আলতার অলিখিত রঙে তোমার রাঙা পা ডুবে গেলে, রুক্মিণী, বুঝবে আমি চলে এসেছি।   

জলাটে অঞ্চলে অপার্থিব মক্তবের নামী শিক্ষক গনিমিয়া তার ছাত্রদের ধারাপাত পড়াতে-পড়াতে ভাবেন, ‘অভিমানী পৃথিবীর সকল থমথমে ভগ্নাংশ একপ্রকার শুভঙ্করের ফাঁকি।‘ ব্ল্যাকবোর্ডে সমর্পিত মহেঞ্জাদারোর ইতিহাস ডাসটার আত্মস্থ করে কী এমন সবল আন্তরিকতায়? 

‘ধবল বকের উড়াল হব’– এমন সাধ নিয়ে মন্দাক্রান্তা ছন্দের জাতক নিগূঢ় চকের গুঁড়োরা ক্লাশরুমের কোলাহলে বিলীন হয়েছিল। অভিভাবকহীন কথকতার সূত্র ধ’রে নারঙ্গি-ঝোপের ডানা-কাটা হলুদ প্রভা বাগদাদি রজনীর ফসিলিষ্ণু ঝলক দেখে ঈর্ষান্বিত নাও হতে পারে। হরিণাকুল পৃথিবীর তাবৎ উঠোন একটি করে নদী পুষে রাখুক। অস্তিত্বের খাতিরে গাঙচিলের কাছে প্রাণবন্ত ঘুড়িটা শিখুক ওড়ার মেঘবাচক কৌশল। কোনো কি মৎস্যকুমারী তার নৈরামণি জানালায় সচিত্র প্রার্থনাতে গুছিয়ে রাখে হারিয়ে-যাওয়া জোনাকিদের সাহসী সন্তরণ? 

আধফোটা জলহাওয়ারা অমন মৈথিলী প্রজন্মের মতো কাঙাল হয়ে আলোর খিলানে এলিয়ে দিল পাখিমূলক উৎকণ্ঠার রথগুলোকে!  

 

 

চন্দ্রমুখী  

সান্ধ্যভাষার ইঙ্গিতে ছিল পঞ্চডালের কথা। সে ডালে কি জোছনাবরণ কোনো পাখি বসে? 

চঞ্চল চিত্তে চন্দ্রমুখীর পরাঙ্মুখ উঁকি অমাবস্যার লতাগুল্মে জর্জরিত।

আমার করার কিছুই থাকে না। হ্যারিকেনের অদ্বৈত সলতেটা একটু উস্কে দিই। এবার ঘরজুড়ে আলো আরো সহজ-নিঃসঙ্কোচ হল। অঙ্ক-আপার কথাগুলো কানে ভাসল, ‘শুধু দেখতেশুনতে ভালো হলেই চলবে না। পড়াশুনাতেও ভালো হতে হবে!’ 

অঙ্ক কষে যাচ্ছি খাতাভরে। একটা বানর তৈলাক্ত বাঁশের ছয়ফুট উপরে উঠেই আবার পাঁচফুট নিচে! তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্বাপদ ঘুম আসা-যাওয়া করছে চোখের পাতায়-পাতায়। 

শঙ্খের মতো সুন্দর অঙ্ক-আপার শাড়ির লাবণ্য আমি কোন গাণিতিক সূত্রে মাপব? নিদ্রার সংক্রমণে বারবার গুবলেট বেঁধে গেল সকল গাণিতিক হিসেবে।



 

বৃষ্টিঘ্রাণ 

তোমার ওই মায়াবী আঁখির পাখিময় দৃষ্টি আমার হৃদয়ে বিরহ-বৃষ্টি অথই বুনে যায়।

দিকচক্রবাল পেছনে ফেলে-আসা উপযুক্ত ফড়িঙের প্রস্তাবে একেকটি বেলা কলাবতী-স্নেহে মুগ্ধতার বেচাকেনা করছিল। 

তুমি যে-পথ দিয়ে এখানে এলে, সে-পথে ব্রজবুলির আকাশ হল আরো নীল। সুস্থির ধুলিরা নিমেষে প্রগাঢ় রঙিন। 

জিয়নকাঠির মতো গাছের মিশুক শিকড় কি ছড়ায় নি প্রাণ মাটির মগ্নতায়? 

অবশিষ্ট নানা নষ্টকীটের আঘাতে শস্যরা আর ভূলুণ্ঠিত হবে না। 

বিষণ্ণতা কোনো মিথ্যেবাদী আলেয়া? 

পূর্বপুরুষ-জাতক পর্দার আড়াল থেকে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী বলে যায় লুপ্ত দেবতাদের কথা। যাদের পদাঘাতে পাষাণ-পাহাড় চিরে ঝরনাধারা নেমে এসেছিল প্রথম। তাদেরও ছিল ভ্রূক্ষেপযোগ্য বজ্রবাণ। সেই বজ্রবাণের সংঘাতে পৃথিবী পেয়েছিল নবীনতম বৃষ্টির ঘ্রাণ। 

বৃষ্টির উমে ঘুমঘুম বীজগর্ভে ক্রমশ বেজেছে সুশীল সবুজের তাগিদ। 

সবুজ হয়ে ওঠে সকল রঙের সফল জনক। 

 

 

মায়াবতী

এত যে পাখি হও, আমার ঠিকানাটা শুধু ভুলে যাও। 

এত যে নৌকা বানানো শিখলাম, তোমার উঠোনটা চেনা হল না। 

এত যে জল খেলা করে সরল আলোর ভেতরে, কেউ তো মায়াবী-মায়াবী দৃষ্টি মেলে বলল না, ‘আমার চোখের দিকে তাকাও।’

আমার বুকের নদীটাও একটি অরণ্যের অন্তরালে হারিয়ে যেতে চায়। ওতে ভাসিয়ে দিই ক্ষণেক্ষণে আমাকে দিয়ে-যাওয়া তোমার পাঁচটি কাগজের নৌকো। একেকটি দেশ হয়ে নৌকোগুলো আমাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি খেলে। ভাবি, ‘বেশ!’

তবুও তো তুমি আমাকে নিয়ে ভাবো। বলেছিলে, ‘একদিন চৈত্রসংক্রান্তির মেলাতে আমরা দুজনে বৃষ্টিতে খুবখুব ভিজব।’

নামুক বৃষ্টি। নরম আঁধারে কোনো পোড়োবাড়ি ডুবে গেল। তার মানে তো একটি মোমবাতি জ্বলে উঠবে মায়াবতী দ্যুতি নিয়ে এখনি। 

কেন যে বাতিঘর হয়ে আমাকেই শুধু ডাকো?  

 


চোখ 

অব্যবহারযোগ্য ঘুমের সম্মিলিত বর্ণালিতে 

ঘুরেফিরে প্লাবিত হয় কোনো এক-চন্দ্রময়ীর বৃষ্টিভেজা মুখ। 

আমি কি কাহ্নপা? 
আমাকে দিয়ে পাদাবলি লেখাতে পারে 
তেমন রমণীয় আঁখি কেন শুধু খুঁজে মরি 
জোছনার রক্তপাতে-স্নাত এই হন্তারক বেলায়?

আর্তনাদে মাতে কিছু ছন্দায়িত কথকতা 
মগজের কুণ্ডুলিতে অবাধ মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়। 
তবে কিছু ঊর্ধ্বশ্বাস হোক তন্ময় পারাবত 
সরোদের চিরায়ু শারদীয় পরিভাষাতে। 
দৃশ্যান্তরে, অঘ্রাণের প্রান্ত চুয়ে নেমে আসে 
ক্ষয়হীন বাঁকাচোরা টান। 
ডাহুক-ডাকের হৃদ্যতা নকল কোরে 
আমার বুকে দানবের তাণ্ডবলীলা চালায়। 

এভাবে থেকে যাই যুগান্তরে দূরদ্বীপবাসিনীর 
অচেনা চোখের পাললিক ইঙ্গিতে।



 

জলছাপ 

ব্যাকুলতার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুকের দ্রাঘিমাতে তুমিজ অক্ষরে লিখি একটি সুললিত বাগান।

যেখানে সুনসান মেঘের ফুল, ফুলেল হাওয়া, হাওয়ার বন্দনা, বন্দনাময় নদীর লাবণ্য-বিলাসিতা, লাবণ্য-কাতর ডুমুরডালের অনবদ্য গায়েহলুদ-উৎসব, আর সদ্য জোসনাস্নাত তোমার চন্দ্রমুখের ছায়া বানভাসি হয় ক্ষণে-ক্ষণে। 

আনমনে হলেও, পাখিদের রান্নাবান্নার খবর কে রাখে? না তুমি! না আমি! অথবা সচেতন বিক্রেতা সেজে বেগুনি আলোর শহরে গিয়ে জাফরানি আলো ফেরি করতে চাই নি কখনো? 

আসলে আমি তো তোমাকে ছুঁয়ে দেখার উছিলা খুঁজি সারাবেলা নিমগ্নতার নৌকাটে ঢেউয়ে চেপে। বললে, ‘তাহলে, তুমি ভুল বুঝে নিরানন্দকে বৃষ্টির অবিরল আবরণ ভেবো না।’

কল্পনার জলছাপে-আঁকা তোমার ছবিটা মননে ভেসে উঠলেই, কেন শুধু-শুধু মায়াবী ভ্রুক্ষেপে আমার দিকে তাকিয়ে থাকো? আহা, নির্ঘুম ঝরনার সুরে-সুরে সোনালি সুখের ধারাপাত পাঠ করি আলস্যবহুল বিকেলের পাশ ঘেঁষে।

হৃদপিণ্ডে একপেশে লালরঙের উচ্ছল ব্যস্ততা বেড়ে গেলে, তুমিও জেনে যাও, ভালোলাগারা কৃষ্ণচূড়ার আন্তরিকতায় ধ্যানমগ্ন!  

আর সেই তুমিই কি আমার লগ্নহীন অনুভবের বর্ণিল জলসায় বারবার উঁকি দিয়ে বলো, ‘চলো-না, দু’ জনে মিলে নীল পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে একটি অনুজ পাড়া গড়ে তুলি এই হেমন্তে…’?  

 

 

গুপ্তধন 

উজবুক উটের অগণন অর্থহীনতা খুঁজে-বেড়ানোতে 
কাতর শেয়ালের কখনোই বিশ্বভ্রমণে যাওয়া হয় না। 
স্বপ্নকূপে ডুবে তন্ময় হয়ে ভাবতে থাকে, 
‘নিমেষে এই অমানবিক দুনিয়াটা শুধুমাত্র বনমোরগদের দখলে চলে যাক!’ 

তাহলে, অবাধ সাঁওতাল সর্দারের মতো সে-বনে কি 
ঘুরে বেড়াবে-না ঈগল, বাজ, শেখ ফরিদ?  

এক-মনসাসঙ্গীত দূরত্বে জেগে থাকে 
আসমুদ্র-হিমাচল পূর্ণিমার নৈঃশব্দ্যবিদ চাঁদ। 

হার্মাদ মগ্নতার থিকথিকে মোড়কে লুকিয়ে-রাখা স্বর্ণমুদ্রার 

অসম লাবণ্য কখনোই জোছনার্ত ঔজ্জ্বল্য ছড়াতে পারে না। 

চটুল তেঁতুলপাতার লোকাতীত কাঠগড়াতে দাঁড়িয়ে 
গোলন্দাজ দুপুর প্রাচীন ঔষধালয়ের নিমগ্নতা নিয়ে 
একটি বৃষ্টিস্নাত বেলার যৌক্তিকতা আওড়াতে থাকে। 

কোথাও ‘চিচিং ফাঁক’ ধ্বনিত-মন্ত্রে 
খুলে গেল সন্দেহদগ্ধ গুপ্তধনের ঘুমঘুম গুহা। 

সেলুনে চুল কাটতে ব’সে, চল্লিশ চোরের যখন 
অতর্কিত চা-তৃষ্ণা পেল, 
তখন ভারপ্রাপ্ত মরজিনা কি শহরের শেষ-বাড়িটার আঙিনায় 
সাংকেতিক আলপনা আঁকতে ব্যস্ত? 

 



তিলোত্তমা 

তিলোত্তমা, 
আমার প্রিয় পাখির নাম তুমিজ। 

প্রিয় পরির নাম তুমিজ। 

আর প্রিয় রাধার নাম? তা তো তুমিজ! 

কিংবা, প্রিয় নদীটার নাম যদি জিজ্ঞেস করো, সে-উত্তরও জানা আছে। 

আকাশ-পাতাল চিৎকারে বিদীর্ণ করে বলব, ‘তুমিজ! তুমিজ! এবং তুমিজ!’ 

বিশ্বাস করছ না? 

তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখার অপরাধে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে, 

কোনো খলমানব আমাকে পাথর ছুঁড়ে মারতেই পারে। 

তীক্ষ্ণ আঘাতে কপালে গোলাপ-বিলাসিতায় টকটকে ক্ষত সতেজ পাপড়ি মেলবে। 

আমি ওই প্রবল গোলাপের নাম দেব তুমিজ। 

পূর্ণিমার্ত রাতে জোছনার জল 

আমাজন অরণ্যের প্রগাঢ়তায় থেকে-থেকে লীন হলে, 

ওতে অবিরল মনপবনের নাও ভাসাই। 

চিত্রকূট আকাশে চিত্রাহরিণীর আলস্যে, 

চাঁদের মতো কোনো মায়াবতীর মুখ 

পরাঙ্মুখ দৃষ্টি মেলে আমাকে বৃষ্টিধারায় ভালোলাগার বর্শা হেনে যায়। 

জানি, দুখজ ও সুখের নাম তুমিজ!  




প্রেমপত্র

পচনে-পচনে ঝরে যাক দিকভ্রান্তির সৌজন্যবোধ। 

আলেকজান্ডারের বিশ্বজয় কোনো প্রান্তিক পরমাত্মার প্রণোদনা? বিশীর্ণ আলিঙ্গনে বেঁচে থাকে না ভালবাসারা! 

নীল মাছিদের অধঃপতন দেখতে চায় নি নীল তারার গান। তাই তো 

ওরা আজো অনাবিল আলো জ্বেলে আঁধার দ্রবীভূত করে। অথই স্বর্গ বেচাকেনা করেছে জোনাকির রূপ ধোরে। 

নিঃস্বার্থ রইরাতা পাখির আন্তরিক অভিবাদনে 

ধুলি-আস্তরণে-হারানো কানাকড়ি আর 

পারা-ওঠা আয়নারা একদিন ঠিক অসহায়ত্ব থেকে সেরে উঠবে । 

আগরবাতির সুগন্ধ নেড়েচেড়ে, বাতাসের গতিবিধি মাপা যায়? 

ঈর্ষার রেলগাড়ি অকালে মৃত্যুগামী প্রতিবেশী। বিরতিহীন পরাঙ্মুখতা ওদের গভীর পরিজন। 

যুযুৎসু কাকতাড়ুয়াদের স্বদেশ পরিভ্রমণে থাকি। ওরা বলে, ‘কখনো রাজা হয়ো না। রাজা হলে মননশীলতার প্রভুত্ব তোমাকে হারাবে।’ 

কী মনে করে সে-দিন বিদ্যাপতির পরিভাষায় সোমাকে লিখে বসলাম একটি প্রেমপত্র। উত্তরে সে লিখল, ‘আনারকলি শুধু কবিতার পঙক্তিতে 

যতিচিহ্ন হয়েই বেঁচে থাকে। রঙিন আলোতে ঝলসানো 

বিবিধ দেয়াল যৌবনের প্রহরী না-হোক। কারণ, 

বাচাল মগজে যুদ্ধজয়ের দামামা বাজে না।‘ 

কাজে-অকাজে আর দখিন পাড়ার দিকে যাই না। 

বড়ো রাস্তার ধারে নশ্বর দেব-দেবীরা অক্ষয় শমপাপড়ি ফেরি কোরে ফিরছে। 

চকচকে রাংতা কাগজ দিয়ে ডজনখানেক যমজ 

রৌপ্যমুদ্রা বানালাম। তারপর লাল-নীল বেলুন 

কিনতে কিছুদিনের জন্যে বেরিয়ে পড়লাম একটি অভূতপূর্ব অভয়ারণ্যের দিকে।





রাঙতা 

রমণীয় রাঙতা-কাগজের ঔজ্জ্বল্য পাতিহাঁসের ডানায় 

ভর করলে, সরলা এক-নদী ধ্যানী হরিণীর অনুসরণে ঈশান্য মেঘ হতে চেয়েছিল। 

 

দুঃস্বপ্নের দুরন্তপনা স্বতঃস্ফূর্ত গুহাচিত্রের আদলে-বিস্তৃত পৃথিবীকে 

নটরাজ হওয়া শেখাতে কতটুকু তৎপর? 

বিপরীতে, ঈদগাহের মতো আদিগন্ত স্নিগ্ধতা তুমি কুড়িয়ে নিলে। তেমনি, 

শেফালী ফুলের অন্তরাত্মাকে উপলব্ধি করতে পারো 

সদ্য জংশন-ছেড়ে-যাওয়া রেলগাড়ির উচ্ছ্বাসে ভর কোরে। 

ঊর্ধ্বশ্বাসে-বিষণ্ণ কাঠগড়ার মূর্তি বেয়ে চুয়ে পড়ে 

একটি রঙিন রাষ্ট্রের উৎপাদিত বিশেষ পণ্যদ্রব্য 

ক্র্যাচের আন্তরিকতা। তেমন 

সৌহার্দ্য জাতীয় প্রতীকের আদর্শ প্রতিচ্ছবি হবে। এমনটা 

ভাবতে-ভাবতে অভিনয়ে-পারদর্শী অলঙ্করণশিল্পী ও 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ছত্রভঙ্গ দল আনমনে বেরিয়ে পড়ল বারমুডা ট্রায়াঙ্গল সফরে। 

পক্ষান্তরে, হাসপাতালের বিনয়ী অডিটোরিয়ামে মঞ্চস্থ হয়েছিল 

‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’। প্রতিক্রিয়াশীলদের এতে 

গা জ্বালা করেছিল কিনা– সে-ব্যাপারে আশাহত সংবাদকর্মীরা 

সংবাদ সংগ্রহ করতে ভুলে গিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিল 

‘হাতধোয়ার কলাকৌশল’ বিষয়ক অসামান্য বচন। 

বৈষ্ণব পদাবলির প্রাচীনত্ব নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। তাই 

বলে কি চিরুনী অভিযানের উছিলায় সকল গোলাপফুল-গাছ 

থেকে কাঁটা ছেটে ফেলতে হবে অচিরেই? 

বলা নেই! কওয়া নেই! জাতিসঙ্ঘও সংগ্রহ করেছিল 

কিছু ভাতঘুম শান্তিরক্ষা মিশনের সূত্র ধ’রে। 

টাইম ম্যাগাজিনের আসন্ন পাতায় রোহিঙ্গাদের দুর্দশার কথা 

যত বেশি বর্ণাঢ্য হতে পারে, তারচেয়ে 

বেশি হৃদয়হীন হয়ত হবে অনাগত 

অন্য কোনো আম্ফান ঝড়ের পূর্বাভাস।  

 



স্মৃতিমঙ্গল  

ভাঙা লণ্ঠনের অপূর্ণাঙ্গ আলোর মানচিত্রে পুরনো প্রেমপত্র নবীন হয়ে উঠলে, পদাবলি বুঝি কেবল আঁকিবুঁকি-রেখাসর্বস্ব স্মৃতিমঙ্গল? 

উত্তরের তালদিঘি আর দখিনের বেলতলা তো এক-সূত্রে গাঁথা। 

ভাবি– পুরনো ছবি এবং নতুন বাঁশির মধ্যে নিগূঢ় সাদৃশ্য একটাই। ওরা উভয় সন্ধ্যার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে আষাঢ়ের শেষ বৃষ্টিবিন্দুটির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে সদাপ্রস্তুত। 

মাঠের মুঠিতে কতটুকু শস্যদানা থাকলে তিলপরিমাণ পাখি দ্বীপান্তরে যায় না?

বিনয়াবনত সন্ধ্যার ঘটনায় বিকেলের অভিনন্দন উবে যেতেই মনে পড়ল– কখনোসখনো গোমতীর মমতা-দীঘল ঘাসবনের খরস্রোতা কোমলতা ছককাটা উদাসীনতার প্রতিরূপ। 

এখনো অজানা মহীপালের দিঘিতে জোছনাজলে সেতারের গীত এঁকে দেয় কোনো নিরুপমা ললিতা। 

এ কেমন পাশাখেলা, যে-খেলায় সকল পক্ষই অভ্যাসবশে জিতে যায়? 

পরাঙ্মুখতার পাপড়ি মেলে, মায়াবতীর অভিমানে তিস্তাময় অশ্রু বসতি গড়ে প্রপাত নামের চোরাগোপ্তা দহনে। 

তেমন উপকূলের সারল্যে সুশোভিত ঝড়ে আন্দোলিত হতে দেখি অনুভূতির কয়েক দিস্তা ভাগ্যহীন ঝাউগাছকে! 

 

 

 

ছোঁয়া  

এমন স্বপ্ন কত দেখেছি, একদিন সত্যি-সত্যি গাছ হব! তুমি পাখি হয়ে উড়ে এসে আমার ডালে বসবে। 

এ-মুহূর্তে ভাবছি, ইশ্‌! ঝড়ো মেঘ যদি হতে পারতাম! নিমেষে উড়ে তোমার কাছে চলে যেতাম। 

কিছুদিন আগেও জোছনারাতে ফেনিল একাকীত্বের হাঙর সবসময় আমাকে গ্রাস করত। আর এখন পূর্ণিমা-তিথিতে নৈঃশব্দ্যের সিংহশাবকদের সঙ্গে খেলতে বড্ড ভালবাসি। 

আমি অবধারিত ধৈর্যহীন বলেই কি তোমার লাবণ্যময় হাসির আন্তরিকতা থেকে শিখে নিতে পারলাম না অতীন্দ্রিয় জাদুর কোজাগরী কৌশল? জানা হল না– কীভাবে শাপলাফুলের হাসিগুচ্ছ দিয়ে ফুসমন্তরে চকিতে বৃষ্টির আতসবাজি বানাতে হয়। 

প্রকৃতপক্ষে, মনেমনে তোমাকে নিয়ে কাব্যকথা রচনা ছাড়া আর তেমন সৃজনশীলতা আমার নেই। 

সেই-সঙ্গে এটাও তোমাকে বলা হয় নি, বুনোহাঁস কখনো আকাশের কাছ থেকে পালিয়ে থাকতে পারে না। তুমি যেখানেই যাও, সেখানেই আমার ছোঁয়া পাবে।
এখানে একদিন পৃথিবীর বিন্দুবিন্দু সবুজ জমা হয়ে গড়ে উঠেছিল রঙিন ফুলদের জলসালয়। সকল ঝরনাধারা থেকে ময়ূরী সুর নুয়ে এসে একত্রিত হল। আর অমনি সোনালি বাঁশের বাঁশিটা বাজতে থাকল অপূর্ব মাদকতা নিয়ে। যেভাবে কোনো-এক নিদাঘ দুপুর ডানা মেলেছিল প্রথম।
স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে, তেমন অনুপম ক্ষণে তুমি এলে। আর আমি রামকিঙ্করের-গড়া জীবন্ত  প্রস্তরমূর্তি হয়ে তোমার মায়াবতী মুখের দিকে একপলকে তাকিয়ে রইলাম। 
না ছুঁয়েই তোমাকে কত ছুঁয়ে যাই! 

 


 

ঋষিত্ব 

সক্রিয় দরবেশের ঝুলির এককোণে পড়ে-থাকা রুটির অস্তিত্ব ক্ষীয়মাণ হতেহতে বটের দয়ার্দ্র ছায়া তীক্ষ্ণধার বধ্যভূমি।

একটি আংটির অভিনয়ে কেটে গেল পাহাড়ে ঘর বাঁধার আকাঙ্ক্ষাময় দিনগুলো।

কালো কালির স্বাক্ষর থেকে আধেক অক্ষর খোয়া গেলে খরার জমিতে ফসলহীনতা না-ও দেখা দিতে পারে। 

ঈগলের নখে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার চেয়ে কিছু রোদ ভেবেছিল– চলনবিলের ধারে ব’সে বড়শি পেতে মাছধরা অনেক ভালো। পরিণতিতে প্রতিশোধের স্পৃহায় আহত হল মাছরা। ঋষি দুর্বাসার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে বর চাইল, যেন তারা কোনো একদিন ঈগলের ঠোঁট হতে পারে। তারপর ঠুকরে খণ্ডবিখণ্ড করে খাবে উচ্ছৃঙ্খল রোদের নির্ঘুম হিংস্রতা। 

নিয়ত নিজ্ঝুম কুহকে স্রোতস্বিনী জোছনার ঐকান্তিক তীরে নিরুত্তর জনপদ মুণ্ডহীন বনগরুর প্রশান্তিতে জাগ্রত।

কারো কি ধীমান উন্নাসিকতা আজব জিরাফের গ্রীবার মতো ঝুঁকে প’ড়ে আমার ব্যক্তিগত বাগানে আত্মমগ্নের ফলাফলে হানা দেয়? 

চোখের মণিতে রাখা কণ্বজ শুশ্রূষা মাকড়সার জাল হয়ে নিশিথসূর্যের উপাসনালয় ঘুরে আসে। মুমূর্ষু মোহরের বড়ো পছন্দ বলিষ্ঠ মুঠির হস্তক্ষেপ।

মানস সরোবর থেকে উড়ে-আসা অপ্সরার মোহে চাঁদনী রাতগুলো কেটেছে বিনিদ্র। কবে, কোথায়, প্রথম নীলনীল চুলের মায়াবিনীরা অপরাজিতার সৌষ্ঠবে সোনালি আলোর তাঁতে বুনেছিল গৃহহীন আকাশ? 
নির্জনতার দেয়ালহীন দ্রষ্টব্যজুড়ে দখিনা দহে তান্ত্রিক কুমির বেড়াতে এলে, একেকটা যান্ত্রিক শেয়াল বনে পাঠশালা খুলে বসে।  

 



শান্তি 

কোন মুখে আসলকে নকল হাত-ধরে নিয়ে যায় অবসরযাপনে? 

চৌরাস্তার মোড়ে নিঃসঙ্গ পাথরপাখি নিমগ্নে ডুকরে উঠল, ‘পাথর-সময়, তোমার কাছে চাই নি বিবর্ণ অমরতা!’ 

হাঁটু মুড়ে ব’সে মাদুরের উপশম আঁজলা ভ’রে নিই। এমন ক’রে একদিন আমার জানালায় উঁকি-দেয়া ডালিমগাছটার সবজে-গোলাপি ভাষাটা মোটামুটি শিখে ফেলেছি। 

ক্ষীরের সুগন্ধে সোনার মাছিরা অনবরত ভনভন সঙ্গীতচর্চা করে কিনা জানি না। তবে একেক দিন দিগন্তের একেক রঙ দেখে বলে দিতে পারি আজ কী বার। 

সাধারণত প্রতি বৃষ্টিবারে একটি সবিশেষ ঝড় প্রত্যাশা করি। সে-ঝড়ে পৃথিবীর সকল বাড়িতে বেজে উঠবে সহিংস সংশয়ের বিদায়ঘণ্টা।    

মসৃণ সংশয়ের দুখজ ঢাল বেয়ে কখনো সুখ কালান্তরে যেতে-যেতে অস্তগামী সূর্যকে আশ্বস্ত কোরে বলে, ‘তোমার আরেক নাম রাখলাম উদয়। নদীর ঢেউ কক্ষনো সমাহিত হয় না। সে অন্য সময়ে ঘুরে-ফিরে আরেক রূপে এসে নদীকে আগলে রাখবেই।’ 

দূরে পাহাড়পুরে পারাবতদের পাখসাট আজ শান্তির নিপাট উৎসব!  





নির্বাসন 

আমার মননে কেবলি চলকে ওঠে একেকটি রুপোলি দিনের সমান তোমার স্নিগ্ধতা। 

নিলুয়া আবেগে-বিদ্ধ বাতাস কি হেমিলনের বংশীবাদক? একাকীত্বে-বিধ্বস্ত পার্কে পড়ে-থাকা বাদামের নিঃসঙ্গ খোসাগুলোকে পেছনে জুটিয়ে এক-লহমায় ছুটে চলে বিস্ময়কর ভঙ্গিতে। 
সহস্র সূর্য যেন দলেবলে ধানটুনির মতো কলরবে মেতে উঠল এ-মনে অপূর্ব নরম রঙ ছড়িয়ে। তোমার অন্তরের বনচ্ছায়াতে স্বেচ্ছায় বনবাস চেয়ে-চেয়ে কত-না বিরক্ত করে চলেছি তোমাকে। বালকের স্মৃতির আড়ালে হারিয়ে-যাওয়া একটি আপ্রাণ অলিন্দ পামির মালভূমির উচ্চতায় তাকে নিরবিচ্ছিন্ন গোলাপ বাগানের স্বপ্ন দেখায়। 

যদি আসো, বসো পাশটায়, তুমি যা চাইবে আমি তা-ই হব। একটি রাজহাঁস হয়ে তোমার কোলে চুপটি করে বসে থাকি–  এমন ভাবনা মনে প্রায়ই দোলা দেয়। কখনো-কখনো খুব ভেবেছি, হতে পারি– প্রশান্ত মহাসাগরের আদলে সকাল, ভরা-যৌবনা যমুনার বুকে শুশুকের কৈশোর, পাথরবিছানো পথে ছাতিম গাছের বর্ণাঢ্য নির্লিপ্ততা, বেলুনের অস্থিরতা নিয়ে কোনো গাছে ঝুলে-থাকা সুদৃশ্য ফল।

অবিরল কোনো মায়াবী মুখ আমাকে কল্পনাতুর করে তোলে। মগ্নতার এক-বর্ণিল আলপনা হৃৎপিণ্ডে বানভাসি হয়– তোমার দুল শুকতারার মতো চলকাতেই সন্ধ্যা নেমে এল। ‘তই তই তই’ ডাকে হাঁসগুলো বাড়ির পথে পা বাড়ালে, নদী নির্জন পথিক। প্রলম্বিত উদাসীনতায়, তোমার চুল সবুজ বাতাসে উড়ছে। 

হরিণার্ত এক-মুগ্ধতা আমার হৃদয়জুড়ে কুবো পাখি হয়ে ভালোলাগার পরিচর্যায় মেতে ওঠে।





টঙ্কার 

সেতারের সুরেলা ধমনীগুলো দৃশ্যান্তরে তিন-ভাগ জলের বিস্তার। কেমন টলমলে ফেনিল কোলাহলের চৌরঙ্গী! উঠোনে পায়রারা বকবক কোরেই যাচ্ছে। তোমার মধ্যমাতে নখের আয়নায় পৃথিবীর সকল বিকেল বরাবরের মতো রজনীগন্ধার প্রতিচ্ছবি হয়ে ফুটে রইল কি? 
সুরুচিসম্পন্ন নীলের হইচই-মহড়া থেকে রোদেলা শস্যের বরাতে, বলা-নেই, কওয়া-নেই, পেয়ে গেলাম কিছু সুরম্য পোশাক। ইস্পাত-দৃঢ় ছায়ার প্রপাতে বেজে চলল ঝিলমিল টঙ্কার। তোমার কাছে যাব বোলে, ক্ষণে-ক্ষণে আনমনে নিষ্ঠ নাবিকের বেশভূষাতে থেকে যাই ব্যাকুল। 
মগ্নতার ময়ূরপঙ্খি উড়ে চলেছে সাঁইসাঁই। জলপাই-রাঙা দূরের ডাঙা ক্রমশ প্রগাঢ় যদি, তোমাকে ছুঁয়ে দেয়ার আকাঙ্ক্ষা আরো তুমুল হয়। 
দৃষ্টির অকূল জলছবিজুড়ে কেবলি উন্মুখ সে-এক প্রশ্নহীন মায়াবতীর হাতছানি। 

তোমার মুখের নির্ভুল জোছনাময়তা আমার কষ্টের তোরণে অফুরান ভালোলাগার চিরায়ু ফুল। 
তুমি কি সর্বাত্মক অনুরাগের প্রান্তিক পুথি? কিংবা বৈষ্ণব পদাবলিতে সুলীন এক-হারা লাবণ্য-শ্রাবণ? তোমাকে পাঠ করি অতলান্তিক মুগ্ধতা নিয়ে। 
প্লাবনের পরমাত্মারা জন্মান্তরে পানকৌড়ির লীলা ছড়িয়ে আমার চারদিকে জলসায় মেতেছিল সেই-বেলা! কখনো এই-বেলা!

 




দীর্ঘশ্বাস 

তুমি তো জুলেখা নও! তবুও মায়াবী চোখের স্নিগ্ধতা ছুঁড়ে তাকিয়ে আছ আমার দিকেই কী নিমগ্নে! দীপান্বিত সেই ছবির শতশত অনুলিপিতে এ-হৃদয়সাগর প্লাবিত।
আলোছায়ার ডাগর বেড়াজালে ডুমুরের কত্থক নৃত্য কত না-নিপুণ! রঙিন কলাকৌশলে শিল্পিত হয় সে-সব আন্তরিকতা টানাপোড়েন জাতীয় বাতাসে।
আমার দীর্ঘশ্বাসে ললিত কষ্টের একটি সঘন চঞ্চলতা তার সূক্ষ্ম অস্তিত্বের জানান দিল। ‘কবে দেখা হবে?’– এমন অস্থিরতা প্রতীক্ষার মাপে কতটুকু বেমানান? 
বুক-টানটান তালগাছের বাবরি চু’য়ে-পড়া রোদের নিয়মাবলি যার-পর-নাই একগুঁয়ে!
নুয়ে-পড়া আলস্যের মারবেল পাথরে কি তা জাফরি-কাটা কায়া এঁকেছিল নিরন্তর? বাবুই পাখিদের আত্মবিশ্বাস নতুন কোরে বয়সী হয়ে ওঠে বেলাবদলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। 
অপ্রয়োজনীয় সব আলখেল্লা ছুঁড়ে ফেলে, রঙদের কিছু অদ্বিতীয় দুর্বলতাকে পুঁজি কোরে, নেমে এসেছে নৈঃশব্দ্যের উমে বিদীর্ণ রাত।
একাকীত্বের প্রপাত সকল অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অভূতপূর্ব বিষণ্ণতায় স্নান শীর্ষক আদর্শে অনুপ্রাণিত হল। কল্পনার ময়ূরপঙ্খি নায়ে চেপে তোমার কাছে ছুটে যাই । পরিদের চেয়েও ভালো উড়াল জানে, এমন ছায়ার উল্কারা ভরাপূর্ণিমাতে মেতে উঠেছিল অনন্য উৎপাতে। 
লাবণ্যঘটিত তোমার মুখের জোছনাচারিতা আমাকে বড্ড বেশি স্বেচ্ছাচারী করে তোলে। তুমি না-চাইলেও,পলকহীন ভালোলাগা নিয়ে তোমাকে অনুভবে রাখি অবিরল।  
আর দূরে কোথাও শঙ্খধ্বনির নীলাভ নীরবতা পাখা মেলল ব্যাঙ্গমা-বেঙ্গমীর দেশে
 





মননশীল  

মননশীল আকাশ থেকে সনাতন একটি তারা খসে পড়লে, তুমি শোবার ঘরের বালিশের কানে-কানে বলো, ‘অক্ষহীন হলেও, ভালোবাসা কক্ষনো একেকটি বকলম বদ্বীপ নয়।‘ 
কাবেরী নদীর তীরে প’ড়ে-থাকা টিপু সুলতানের তীর একটুকরো রোদ্দুর হয়ে কোথাও কি দীপ্ত দিগন্ত এঁকে দিল? 
দক্ষিণের বাতাসে ভর করে শীতের কফিন-কফিন কুয়াশা। কিছুদিন কাটাবে কি উত্তরের তালবিথি-আঁকা তেপান্তরে? 
রুপাঞ্জেলের রাঙা পদচিহ্নগুলো মুছে গেলে, ধুলোদের হৃদয়ে সর্বনাশ রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল। এইসব এপিটাফ কেবলি ডেকে আনে সান্ধ্য আড্ডার অলসতা, মহিষের শুষ্ক চারণভূমিজাত অন্ধকার-প্রবাহ। 
বন্ধ দোরের পাশে পড়ে-থাকা সনির্বন্ধ শ্যাওলারা একসময় পোড়োবাড়ির পরমাত্মা হয়ে উঠেছিল। 
চিত্রলেখা, ঊষাময় পায়রাকে উড়িয়ে দাও দ্বীপান্তরে। আবার তাকে কোন মায়াজালে বন্দি ক’রে কারুকলার নামে দীক্ষা দাও যুদ্ধজয়ের দূতিয়ালি? একটু পেছনে ফিরে তাকালেই দেখতে পেতে, এই অবেলায় সবিনয় ছাতা হাতে নিয়ে তোমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি সবিশেষ।





সমাজ

কে ওই দ্রাবিড় দেবদূতী সারাবেলা 
চোখের চৌকাঠে ঘুরেফিরে দাঁড়িয়ে থাকে? 
কার মুখ জুলেখার কমনীয়তা বিলায়? 
নমনীয় তৃষ্ণার ফসকা জালে ধরা দেয় না জল। 
লাবণ্য-ধনুকের ছিলাতে ভর কোরে কারো 
ছলনাময় দৃষ্টির তীর করুক-না বিদ্ধ এই আমাকে। 
বিক্ষত হই গরল প্রশান্তিতে। 
তোমার আঙুলের ডগায় ঝুলে-থাকা 
বৃষ্টির ফুল বড়ো ভালবাসি। 
প্রার্থনা পেতে রাখি– 
আমার আঁজলাতে জমুক-না অমন কিছু আত্মবিশ্বাস। 
মধুকূপী দিগন্তে ফুটে-থাকা টুকটুকে ঘাসফুলটাই কি 
একান্তে বেড়ে-ওঠা ঋতুহীন রঙদের আত্মসমালোচনা?
শীলভদ্রের কল্লোলিত লিপিতে ছেয়ে আছে 
তেমন প্রান্তরে কে রাখে মেলে ধ্যানের দুয়ার? 
নৌকোর গলুইয়ের মতো একটি গোলার্ধে 
তোমাকে নিয়ে সমাজ গড়ব জলপিপি 
আর পড়ন্ত দুপুরের পরামর্শে।

 
 

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন