আসামের ছয় জন কবির একগুচ্ছ কবিতার বাংলা ভাষান্তরে- বাসুদেব দাস
অর্চনা পূজারী-র কবিতা
১
অগতানুগতিক একদিন
ঐ গির্জার পেছনে গিয়ে
একটা কাঠে হেলান দিয়ে
যীশু হাত মেলে উড়তে চাইছে
চোখে ধরেছে মোমের আলো
এবং প্রার্থনার শব্দগুলির অসমান
বুজে যেতে চাওয়া চোখগুলি জোর করে মেলে
এখনই যদি ক্রুশবিদ্ধ দুহাতে ডানা গজায়
একটা পথ শিকড় মেলে নীলার বুকে
ঈশ্বরও অসন্তুষ্ট
মন্দিরের কপাট খুলে বেরিয়ে গেছে
দাঁড়িয়ে আছে বিশাল জলের সিঁড়িতে
এখনই জলের গভীরে প্রবেশ করবে
জলকেলি করবে
সবাইকে মুক্ত করতে গিয়ে নিজে আর পারে না
মন্দিরে শ্বাসরুদ্ধ হবে
তাই সে বলল-আমি যাই
ভোরের আজানের সঙ্গে আল্লা উঠে এল
আকাশের সিঁড়ি দিয়ে
ইস বাতাসে শব্দগুলি মুক্ত হয়ে পড়েছে
নির্জনে কোথাও একা বসতে ইচ্ছা করে
এই যে দেখতে পেলাম দিগ্বলয়
প্রত্যেকেই মনের তূলিকায় অল্প আলো তুলে নিয়েছে
প্রত্যেকেই কিছু শব্দের আকার স্পর্শ করছে
ক্যানভাসে ‘আত্মা্র ছবি একটা এই হবে
রঙের পরিধি ছুঁয়ে ছুঁয়ে
জলের রঙ উদ্বেল
মৃত্যুর হাত থেকে ছোঁ মেরে তুলে এনেছে
একটি রূপালি শব্দ
সবাই ফিরে তাকাচ্ছে
২
ভায়োলিনের বাদক
ভায়োলিনটির বুকে হাজারজনের দুঃখ
বিলাপ করতে থাকে রাত থেকে সকাল
অহির ভৈরব
সেই দুঃখে কাতর হয়ে পড়ে ঘরের ভেতর
কেঁপে উঠে থরথর
আর নিজের অজান্তেই খসে পড়ে
ঘরের টই
সুযোগ বুঝে বাতাস
সেই সুর চুরি করে নিয়ে
মেলে ধরে মুক্ত আকাশে
শোকের নক্মা দেখে
রাতে ফোঁটা ফুলগুলি
একটা দুটো পাপড়ি খসে
নীচে আর জায়গা নেই
ভালোবাসা কেন কাঁদায়
কোমল শিশির
সেদিনের রাতটা কুশল বাদক
উৎসর্গ করে
ভায়োলিনটাকে
নীলিম কুমার-এর কবিতা
১
খালি ঘর
তালা মেরে মানুষ যখন
ঘর থেকে বেরিয়ে যায়
খালি ঘর কাঁদে
ঘরের মানুষদের নিয়েই
ঘরের সংসার
ঘরের ভেতরে
কিন্তু মানুষের সংসারটা
ঘরের বাইরেই বেশি
ঘরটা তার ছোট্ট হৃদয়
আর ছোট্ট বাহুর দ্বারা চায়
তার ভেতরে মানুষের অহরহ কথাবার্তা
হাসি-কান্না পায়ের শব্দ ভালোবাসার গুঞ্জন
নীরবতা মৈথুন সঙ্গীত
এইসবের জন্যইতো
মানুষ ঘর বাঁধে
এইসবকে ঢেকে রাখার জন্য
ঘর বাঁধে মানুষ
খালিঘর তাঁর ছোট্ট মগজ নিয়ে ভাবে
তার ভাবনায়
আমার অন্যমনস্ক আকাশে
বৃষ্টি হয়না
তাই একদিন
তালা মেরে আমি
বেরিয়ে যাবার সময়
খালি ঘরটাও আমার সঙ্গে
যাবার জন্য বেরোল
বলল
আমাকেও নিয়ে যাও তোমাকে ছেড়ে আমি
থাকতে পারব না
২
অক্সিজেন সিলিণ্ডার
‘অক্সিজেন খাবে?’
সিলিণ্ডারটি আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করছে
খাবার মতো আর কিছুই ছিল না
বাবার
তাঁর বোবা ঠোঁট বলল –
লম্বা গলার সিলিণ্ডার,
কিছুক্ষণ পরে তুমিও মুক্তি পাবে
তিনটে দীর্ঘ রাত তুমি সঙ্গ দেওয়ার জন্য
তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার মতো
সময়ই হয়তো পাব না
আমার চোখের শেষ ভাষা বুঝতে পারবে সিলিণ্ডার,
‘আমি যে কেবল তোমাকেই
বলে যেতে চাই যাবার সময়
কেউ যেন শুনতে না পায়
এমন কি আমিও ।'
আমাকে ঘিরে রাখা
এই আত্মীয়দের চোখের জল
আমার পথ পিছল করতে চায়
আমি ওদের কীভাবে
যাই বলি বল সিলিণ্ডার
ও আমার শেষ বন্ধু।
আমাকে তুমি ছুঁয়ে আছ
এত নিবিড়ভাবে,
নাক দিয়ে ঢুকে আমার ভেতর পর্যন্ত গিয়েছ
আমার রক্তে মিশ্রিত করে দিয়েছ তোমাকে
তবু বড় কষ্ট পেয়েছি সিলিণ্ডার
ঘন ঘন নিশ্বাসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি
বেঁচে থাকার ধার
এভাবেই সুদে মূলে আদায় করেই
ছাড়বে নাকি আমাকে জীবন?
বল সিলিণ্ডার
কিছুক্ষণ পরে সবাই আমাকে ছেড়ে যাবে
যদি কেউ থাকে টুলটিতে বসে
সে ও পড়বে ঘুমিয়ে
আর সেই সুন্দর মুহূর্তে আসবে
পাখা মেলে দেবে
আমি আন্তে করে ওঠে যাব
তখন আমার চোখ স্থির হয়ে যাবে
আমি কিছুই দেখতে পাব না
তখন তুমি যে একা হয়ে পড়বে সিলিণ্ডার
আমি উড়ে যাব অন্য এক জগতে
সেখানে পুনরায় তোমার সঙ্গে দেখা হবে
পুনরায় দেখা হবে
তুমি আর সেখানে সিলিণ্ডারে ঢুকে থাকবে না
বিদায় বিদায় বিদায়।
সৌরভ শইকীয়া-র কবিতা
১
একটি রূপকথা
চাঁদ নামে এক বুড়ি ছিল
আর সূর্য নামে পাকাচুলের বুড়ো ছিল।
ওরা দুজন আর আকাশটা
তারাদের নিয়ে তাদের সংসার।
কোনো কথায় একদিন বুড়ো-বুড়ির মধ্যে ঝগড়া লাগল।
অভিমানে বুড়ো বেরিয়ে পড়ল সাগর পারের মেয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
বাঁশবাগান দিয়ে নেমে যখন সে পশ্চিম সাগরতীরে
তখন বিকেল বিদায় নিয়েছে
…লাল লাঠির সাহায্যে কেঁপেঁ কেঁপে
বুড়ো জলের ঘাটে নেমেছে কী নামেনি
শিকারি ঢেউগুলি তাকে কেড়ে নিয়ে পাতাল চলে গেল।
রক্তে তার জল লাল হল,ঢেউগুলি লাল হল
আর পার না হওয়া সাগরটাও।
সেদিন বিকেলে বুড়ো সাগরে ডুবে মরল।
এই কথায় বুড়ি খুব দুঃখ পেল।
চোদ্দ রাত না খেয়ে-দেয়ে সে শুকিয়ে ক্ষীণ হয়ে গেল
বুড়োর আত্মার খোঁজে সে বিবাগী হল।
তারপরে কী হল?
অমাবস্যার পরে একদিন বিকেলে
পরিত্যক্ত বাড়ির সেই সপ্তপর্ণীর ডালে
একটা কাঁচি হয়ে সে ঝুলে ছিল।
২
উজ্জ্বল মৃত্যু
সত্যি সত্যিই সে চাঁদটাকে
ভালবাসল
কেন না,চাঁদের বিষণ্ণ চোখ
কেন না,চাঁদের রক্তাক্ত বুক
আকাশে সুর...যখন নেশা লেগেছিল
সরষে ফুল দিয়ে ছেঁচড়ে ছায়াপথে নামার সময়
সে অনুমান করল
আরও একটি চাঁদ
আরও একটি চাঁদ
জলে নাচন
চাঁদটাকে ধরার জন্য
সে ঢেউয়ের ওপর দিয়ে দৌড় লাগাল
সে দৌড়াল…
সে দৌড়াল...
এবং অবশেষে,যদি আমার সঠিক মনে থেকে থাকে
চাঁদ নয়,জল তাকে ঘিরে ফেলল
বিবাগী
ফিরে আসতে পারল না।
কুমুদ ঘোষ-এর কবিতা
১
আমেরিকা না চিন?
আমেরিকা না চিন?
চিন না আমেরিকা?
এই কথাগুলি এখন থাক।
বেঁচে থাকলে একদিন জিজ্ঞেস করব
আসলে কে কী রকম?
কাল রাতে স্বপ্নে ডোনাল্ড ট্রাম্প
এসেছিলেন
আর এসেছিলেন জি জিনপিং
আমার সামনে দুজনে করমর্দন করেছিল,
নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে আমি কথা-বার্তাগুলি
শুনছিলাম।
লোকের মুখে শুনেছি
আমেরিকা!
অন্যের স্বধীনতায় চটকরে হস্তক্ষেপ করা
তোমার স্বভাব?
লোকের মুখে শুনেছি
চিন!
ভালো থেকেও ভালোটা নিজের জন্য রেখে,সস্তা
জিনিসের দ্বারা বাজার দখল করা তোমার অভ্যাস?
বল তো বল
আমেরিকা এবং চিন তোমাদের আমরা কেন করব না ঘৃণা?
তোমাদের ওখানে কিছু একটা হলে
আমাদের এখানে শুরু হয় ধর্মের টুয়েন্টি
টুয়েন্টি ম্যাচ।
তোমাদের ওখানে কিছু একটা হলে
আমাদের এখানে জলের দরে বিক্রি হয় মানুষের
প্রতিটা দিন।
আমেরিকা না চিন?
চিন না আমেরিকা?
কথাগুলি এখন থাক।
সন্দেহ করা ভালো,
সন্দেহ না করলে কীভাবে জানব
আমেরিকা না চিন?
২
ধন্যবাদ মহাশয়, ধন্যবাদ
অন্ন,বন্ত্র,বাসস্থানহীন দিনগুলিতে
আপনি আমাদের নাম দিলেন গরিব
কী মনে হল আপনার
হঠাৎ সেদিন শব্দ বদলে
আপনি আমাদের দুঃখী বলে ডাকলেন
তারপরে দরিদ্র তারপরে নিঃস্ব
শব্দের ভিড়ে শব্দ বদলানো আপনার সখ
মহাশয়,আপনি জানেন কি
নাম বদলালেও আমাদের ক্ষুধা একই থাকে
নাম বদলালেও আমাদের লজ্জা একই থাকে
নাম বদলালেও আমাদের জন্য শীত-গ্রীষ্ম একই নামে
শব্দ সাধনার জন্য আপনাকে
ধন্যবাদ জানানো উচিত। আমরা কিন্তু নিরুপায় মহাশয়।
এই মুহূর্তে আপনাকে ধন্যবাদ জানাবার কোনো প্রস্তাব আমাদের নেই
আমরা জানি,আপনি আপনার স্থিতি হারানোর ভয়ে কাতর,
আর আমরা প্রাপ্তির লক্ষ্যে সবল প্রতিনিয়ত
মহাশয়,ক্ষুধার তাড়নায় অন্ন কমে এলেও
আপনি যন্ত্রণাকে জীর্ণ বলে ভাববেন না
শীত-গ্রীষ্মে কাঁপতে থাকলেও
মুক্ত আকাশ কংক্রীটে ঢাকব বলে ভাববেন না
আর লজ্জার কথা একেবারে বলবেন না
আপনার কাপড় কমে আসতে দেখে
আমরা মুষ্টিবদ্ধ করেছি হাত
মহাশয় বিনীতভাবেই বলছি
শির নত করুন তো একবার
শির নত করলে আমরা বলব
ধন্যবাদ মহাশয়,ধন্যবাদ।
প্রকল্প রঞ্জন ভাগবতী-র কবিতা
১
মৃত্যু -দর্শন
সেদিন হঠাৎ মৃত্যুকে দেখলাম
আকস্মিকভাবে
দুপুরবেলা
রাস্তায়।
বাড়ি ফিরে বললাম
কেউ বিশ্বাস করল না।
মৃত্যুকে দেখার পরে নাকি কেউ বেঁচে থাকেনা―
মৃত্যুকে দেখতে পেয়েছি বলার জন্য
আমি বেঁচে আছি, কেননা মৃত্যুকে আমিই দেখেছিলাম,
মৃত্যু আমাকে দেখেনি।
কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, মৃত্যু দেখতে কেমন?
বললাম, শিশুর মতো―
তিনি তর্ক জুড়লেন, হতেই পারে না,
মৃত্যু নিশ্চয় ভয়ঙ্কর চেহারার এক যুবক।
আমি বললাম, না, মৃত্যুর শিশুর মতো–
হাস্যমুখী এবং পবিত্র।
কেউ বিশ্বাস করল না আমার কথা।
যেন প্রত্যেকেই মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখেছে!
২
বিকল্প
তুমি আমাকে বিকল্প দিলে―
কবিতা এবং প্রেম।
আমি বেছে নিলাম প্রেম,
কেননা কবিতার সঙ্গেই আমার প্রেম।
তুমি আমাকে বিকল্প দিলে―
কবিতা এবং জীবন।
আমি বেছে নিলাম জীবন,
কেননা কবিতাই আমার জীবন।
তুমি আমাকে বিকল্প দিলে–
তুমি এবং কবিতা।
আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম,
কেননা তোমাকেই আমি কবিতা বলে ভেবেছিলাম।
ভিক্টর রাজকুমার-এর কবিতা
১
মুখোস
বহু মানুষ,
বহু চেহারা
বহু মানুষ বহু কথা
বহু মানুষ বহু মুখোশ
মুখোশ মুখোশ এবং মুখোশ
সময়ে সময়ও
মুখোশ পরে
পৃথক পৃথক…
হিসাবে তিনটি মুখোশ, আমার
ভালোবাসার জন্য
তোমার কাছে সব সময়
অটুট থাকে, প্রথমটি মুখোশ
বিশ্বাস এবং আন্তরিকতার দড়িতে
বাঁধা থাকে এই মুখোশ
অন্যে না বোঝা, অন্যে না দেখা।
তাঁদের জন্য
দ্বিতীয় মুখোশ, আমার সঙ্গীরা
যেখানে কথায় কথা থাকে
দেয়া –নেয়ার খেলা
আমি দায়বদ্ধ মাতার জন্য।
হয়তো, তাই
আলাদা করে রাখা আছে
না জেনে সৃষ্টি হওয়া
তৃতীয় মুখোশ…
যাক,
আমি না জানার জন্য
তুমি না জেনেই আছ
এতদিন!
মুখোশ মুখোশ এবং মুখোশ
দেখা মুখোশ, না-দেখা মুখোশ
জানা মুখোশ, না জানা মুখোশ
কোমল মুখোশ, কঠিন মুখোশ
নেতার মুখোশ
অথবা, অভিনেতার
মুখোশ এবং মুখোশের মধ্যে
কখনও খুঁজে দেখি
নিজেকে…
আমি কোথায়
আমি কোথায়
মুখোশহীন আমি
কতটুকু আমার নিজের।
২
ক্যালেন্ডার
প্রতিটি নিঃশ্বাসের
সীমানায় পরিবর্তিত হয় গতিশীল সময়ের ঠিকানা
অনুভব করার পূর্বেই
সরে যায় মুহূর্তের সোনালি পাখি
থেকে যায় স্মৃতির প্রাত্যহিকতা
ঝরা পাতার মালা
প্রাপ্তির সমস্ত গৌরব
অথবা, অপ্রাপ্তির বিষাদময় অনুভব
খোদিত হয়, একটি ক্যালেন্ডারে
যেখানে থেমে যায়
সময়ের প্রতিটি হিসাব নিকাশ
পরিবর্তিত হওয়া, সমস্ত
সেকেন্ড, মিনিট ,ঘন্টা
অথবা, দিন, মাস এবং বছর…
আরম্ভ হয়,
নতুন পুরোনোর খেলা
নতুনের উল্লাসে, পুরোনো গুলি ফ্যাকাসে হয়ে পড়ে
আর স্মৃতির ধুলোয় ধূসরিত হয়ে
পড়ে থাকে
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন