দেবাশিস সাহা-র কবিতা



লাশফুল

রক্তের পাশে ফুল রেখো না
ফুল ভিজে গেলে
সংক্রামিত হবে গন্ধ

গন্ধের গভীরে 
জীবনের কুয়ো

লজ্জা পেয়ে
আমার মা আমার বোন
আমার বারবণিতা
ঝাঁপ দিচ্ছে কুয়োয়
নতজানু হচ্ছে মৃত্যুর কাছে

তুমি ফুল রেখো না
ওদের পাশে
জল্লাদের উল্লাসে
ওদের যেন ঘুম না ভেঙে যায়

যারা জেগে আছে 
তাদের ঘুম ভাঙাও
জেগে উঠুক
তাদের আগুন

ফুলের গন্ধ সংক্রামিত হলে
এই দেশ ভরে যাবে লাশফুলে




গোল্লা

গোল্লার ভিতরে 
নিরন্ন মানুষের পা

সোস্যাল ডিসট্যান্স বজায় রেখে
পর পর গোল্লা

নিরন্ন মানুষের আশ্রয় 
এই গোল্লার গভীরে 

দূরত্ব রেখে
তুমি গোল্লার ভিতরে
ঢেলে দিচ্ছো টাকা, রেশন আর নীরবতা। 




২৫শে বৈশাখ 

সমাজের ফাঁক-ফোকর 
ভরাট করছে রবীন্দ্র রচনাবলী

ভাঙাচোরা মুখ নিরলস 
 মেরামত করছে গীতবিতান 

নিরন্ন মুখে অন্নের সংস্থান করছেন
সবার প্রিয় আমার প্রিয় 
রবীন্দ্রনাথ 

গোপন কান্নাগুলো মুছে দিচ্ছে 
এলোমেলো রবীন্দ্রসঙ্গীত 

দুঃখী মানুষের আশ্রয় 
এই একটা ঠাকুর 

খুলে রাখি জোড়াসাঁকোর চৌকাঠ 
ঠাকুর বাড়িতে এসে দাঁড়ায় 
বাঙালির ২৫শে বৈশাখ।



জাগতে রহো

(উৎসর্গঃ শঙ্খ ঘোষ) 

হামাগুড়ি দিয়ে শিরদাঁড়া
 খোঁজাখুঁজি করতে ব্যস্ত বাঙালি 

ঋজু সবল শিরদাঁড়া হাতে রেখে
বাংলার ঘরে ঘরে 
হেঁকে যায় এক প্রৌঢ় বিকেল
     জাগো  জাগো
                             জাগতে রহো

নানা রঙের কলম
        ঋতুর ঢঙে রঙ বদলায় 

এক অবিচল বিবেক
           সদর্পে বলে ওঠেন

 'দেখ খুলে তোর তিন নয়ন 
রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে 
দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন '




চোতক্ষ্যাপা

দারুচিনির দেশে 
কেউ কেউ নেমেছে দারুর খোঁজে 
চিনি নিয়ে আগ্রহ নেই মধুমেহ প্রেমিকের

স্লেট থেকে ভাগ্যরেখা মুছে
দারিদ্র্যরেখা এঁকে দিলো অমাবস্যা 
উড়ালপুল ধরে হেঁটে যায় ভাত
পিছু পিছু ভাই ও আমরা 
সিঁড়ি কাকে কি শেখায় জানিনা
সেই একই পড়া প্রতিদিন
ফুটপাত টকভাত বমি আর
অন্ধকার ঘরে ভ্যপসা গন্ধ

নিজের বুকে ভর করে
ব্রিজের নীচে ফিরেছে কামিজ
লতিয়ে লতিয়ে 
 এ বাড়ি সে বাড়ি
চলে যায় আলো রঙের আনন্দ 
সাবান জলে হাত ধুয়ে রাত ঘুমাতে যায়
সাবান জলে ধোয়া ভোর 
দিদিমণির চাল আলুর দিকে বাড়িয়ে দেয় হাত
মাস্ক গ্লাভসের কাছে 
আরো কিছুটা সময় চেয়ে নেয় জীবন 
পুলিশের ইশারার অপেক্ষায় 
নরম নরম আলোগুলো বসে থাকে 
পাতার আড়ালে 
চোতক্ষ্যাপার দল কাদা করছে রেশন দোকান 

মানুষ আজ সংখ্যা
পরিসংখ্যানের আড়ালে চলছে অন্য এক খেলা
লাঠির তাড়া খেয়ে 
গরম ভাত খুঁজে চলেছে 
এক নিরুপদ্রব ঠেক


এন আর সি / এক
দেবাশিস সাহা

হলুদ কাগজে
        ভয় রঙের গন্ধ
                 রক্ত দিয়ে লেখা

                  সুইসাইডাল নোট

মা,
     আমি একটা নিজের দেশ
            তোমার জন্য
                আনতে গেলাম..

           


ইটভাটা

নরম হাড়ের উপর
মাথা রাখে ইটভাটা

এই ভাবে শক্ত হয় খুলি

পাঁজা পাঁজা শ্রম
আলোর সংগে পাল্লা দিয়ে
নামে আর ওঠে 

পছন্দ না হলে
শক্ত খুলি বল ভেবে
পাঠিয়ে দি মাঠের বাইরে 

নরম মনের উপর 
পা রাখে পিশাচ
লতিয়ে লতিয়ে 
ধোঁয়ার সংগে সংগে
বড়ো হতে থাকে ইটভাটা





আত্মা

বেলুনের মধ্যে আত্মা চালান করছে

বেলুনওয়ালা

সে বেলুনের ঈশ্বর


বেলুনের ঘাতক

যে কেউ হতে পারে


যে কেউ কেড়ে নিতে পারে

বেলুনের আকাশ


প্রতিটি ছেলেবেলা

রঙীন বেলুনের বন্ধু


আততায়ী আলপিন

কখন যে কার হাতে এসে যায়


আমাদের আত্মা আর আলপিন

ছদ্মবেশী জাদুকরের দু-হাতে...




স্বপ্নডগা

ডানা মেরামত করে

আবার উড়ে যায় মেঘ


অনেক নিচু দিয়ে ওড়ে

বাবা রঙের ছাতা


মেঘ, রোদ, পাওনাদার কে

আড়াল করে

ভাঙা ডানা নিয়ে

ক্যালেন্ডার পেরোচ্ছেন বাবা


কখনো কখনো বৃষ্টির জল

ভাঙা ছাতার ভিতর দিয়ে

বাবার গাল বেয়ে আমার বুক ভেজাতো


বাইরে এতো কষ্টের রোদ

টের পাইনি কোনদিন


রোদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে

পুরানো ডানায় বড় হতে থাকে

            স্বপ্নডগা




আমাদের মা

ফুটো হয়ে গেছে আমার রাত

ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে আলো


গলগল করে বেরিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার


ফুটো দিয়ে দেখা যাচ্ছে

আমাদের গোপন তারা

আমাদের লজ্জার গনতন্ত্র


জনমভর সেই ফুটো সেলাই করার চেস্টা করছে আমাদের মা




একা

একা হয়ে যাওয়া বাড়ির নাম দিলাম তপতী 

কলমের ডাক নাম রাখি সু

রাস্তা ছাড়া ভীষণ একা দেবাশিস


এক একটি নি:সঙ্গ সাইকেলরিকশা 

 অপেক্ষা হাতে দাঁড়ায়


তুমি এক এক করে 

সাজিয়ে রাখো একা


আমি একাকার হয়ে যায়

আদরে আদরে শং্খ লাগে

নেমে যায় জোয়ার


আনন্দের আলাদা গন্ধ আছে

একা একা আসে একাকীর কাছে

            



ছায়া 

ছায়া কি গাছের বন্ধু

বন্ধু কি টের পায়

গাছের সর্বনাশ


গাছের ভালোবাসার

অন্য নাম ছায়া


টের পায় গাছের মিত্র-শত্রু সকলেই


ছায়া কখনো

ছেড়ে যায় না গাছকে


সর্বনাশ এসে দাড়াঁলো 

ছায়ায়

গাছ তাকেও জড়িয়ে

নেয় ভালোবাসায়।

3 মন্তব্যসমূহ

  1. সবকটি কবিতাই দেবাশিসদার অনুকরণ মনে হচ্ছে। দারুন।

    উত্তরমুছুন
  2. "গোল্লার ভিতরে
    নিরন্ন মানুষের পা"
    "রক্তের পাশে ফুল রেখো না
    ফুল ভিজে গেলে
    সংক্রামিত হবে গন্ধ"

    "একা হয়ে যাওয়া বাড়ির নাম দিলাম তপতী"
    অনেকদিন পর তোমার উপলব্ধির বারান্দায় দাঁড়াতে ভালো লাগলো। কবিতার শব্দে যেভাবে আত্তীকরণ ঘটিয়েছ তা অসাধারণ। এত সহজ করে এত সাবলীল বলা যায় তুমি তা দেখিয়েছ।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন