অনিরুদ্ধ আলম-এর একগুচ্ছ কবিতা




সবুজ কাঁকড়া 

সবুজ কাঁকড়ার অবুঝ দিনগুলো কখনো হলে শেষ
অধীর অশ্বের মতন বুনো আলো ফিরবে না এখানে 
দেখি নি কি– বৃষ্টি মদির নদীজুড়ে ছড়ায় আশ্লেষ?
মরীচিকার স্নেহে লুটেরা ভিড়ছেই। বিষের তীর হানে। 

নিয়তিহীন প্যাঁচা ক্ষণে কি চিৎকারে দিয়েছে ইঙ্গিত–
লোমশ কালো রাতে দাঁতাল হয়ে ওঠে বিনয়ী শূন্যতা
ইটের জ্বলন্ত ভাটার পুঁজি কত উগড়ে দেবে শীত?
মোরগফুল তবু উঠোনে টগবগে! মানে নি নীরবতা। 

এখনো ডুমুরের ডহর ডালে ব’সে নিপুণ পাখি ডাকে!
বজ্রাঘাত ধ্যানমগ্ন শকুনের কোনো কি পরিজন
কষ্ট যত আছে, কেন যে তারা এত ছদ্মবেশে থাকে 
কখন, সুলোচনা, এ-মনে রেখে গেলে মায়াবী মন্থন?

কে ওই ফেরিওলা করছে ফেরি গাঁয়ে স্বপ্ন-উচ্ছ্বাস? 
অমন কোনো স্রোতে দীর্ঘশ্বাস ক্ষয়ে হয়েছে বুনো হাঁস। 




পৌরাণিক পাখি 

দোরের পাশ ঘেঁষে মেঘেরা নুয়েছিল। তুমি কি আসবেই
এখন হেমন্তে রোদের শিথিলতা বৃষ্টিফুল সাজে
সফল শস্যের সরল প্রাণ বেয়ে বিষণ্ণতা নেই 
জেনেছ– কী কারণে প্রীতির ব্যস্ততা স্মৃতির কারুকাজে?

কখনো চৌকাঠ পেরুলে, আনমনে বর্ষা নেমে এল
দুঃসময় কোন অবসরের নীল ব্যথাতে থাকে লীন? 
নিমেষে তুমি এক পৌরাণিক পাখি। আলোরা এলোমেলো
কিশোর উড়িয়েছে রঙিন কিছু ঘুড়ি– স্মরণে বাড়ে ঋণ।  

নোনতা হাওয়াদের দীর্ঘশ্বাস জেঁকে বসুক পাখসাটে 
ভোলে না বুনোহাঁস দূরের হাতছানি। জানে না সংশয়
নদীও নিভে গেলে, ক্রুদ্ধ কাশদের অবেলাগুলো কাটে
বলেছ, ‘শুকতারা বোঝে না কক্ষনো বিষাদ-সঞ্চয়।’

কায়ার অঞ্চলে ছায়ার বাড়িঘর। মায়ার দামে কেনা 
কোনো কি চোরাটান খনন আঁকে মনে? পিছু কি ছাড়বে না? 




গুপ্তদহন 

কেউ কি এল দোরে? নাড়ছে কড়া কে সে? নদী কি কাছে ডাকে? 
বকের যে-উড়াল আমাকে বুঝেছিল, কতটা চিনি তাকে? 

ভালোলাগার গাঢ় ঘূর্ণিস্রোত এসে বোধকে করে গ্রাস
লেখি নি কি কবিতা, যা দিয়ে হতে পারে মুগ্ধ-বাগদান? 
অর্বাচীন গুহাচিত্র নীলাকাশে ছড়ায় উচ্ছ্বাস 
জানালে, ‘মিলবে না গুপ্তধনে কোনো প্রকৃত রূপটান।’  

আমার ঘর ভাঙে উজানে বারবার। হাওয়ারা ক্ষণে ঝড়ো  
ফেলি না জলে জাল। নিয়তি, তুমি এত ছলনা কেন করো?  

ভুলি নি– অধীরতা মদির হেমন্তে আমাকে বলেছিল–  
সভ্যতার খেরো খোলসে মুড়ে রাখে বধিরতার গ্লানি!  
ওসব সংশয় হঠাতি হাঁটু মুড়ে পলকে বলে দিল–    
অমলতাসদের আলোরা রোদ হলে, নদীও আসমানি।

বৃষ্টি এসেছিল। নিরালা ভেসেছিল পাতার উৎসবে 
কিছুটা তার আছে সাবেক বৈশাখে, কিছু এ-অনুভবে!




বাগান-বিলাসিতা 

টিকেট কিনবার কাউনটারে ভিড়! সে-চড়া মগ্নতা 
পূর্ণিমাতে দেখি। চন্দ্রমুখী জানে বৃষ্টি-মুখরতা। 

জোছনা কি আঁধারে শৃঙ্খলিত স্নান? স্নানের গুঞ্জন?
অমন দুর্গের বাগানবাড়িজুড়ে আমার কিছু ছায়া 
সাজায় পায়চারি। রেশন দোকানের মতন উচাটন
বিষণ্ণতাগুলো লগ্ন হলে, মায়া মনের নয়া কায়া। 

ব্যাকুলতার নীল রক্তমাংসেই লোলুপ ভালোলাগা 
নীরবে বেড়ে ওঠে। দীপান্বিত হয় ধাতব রাত-জাগা। 

হৃদয়ে কনিষ্ঠ রক্তপাতগুলো দারুণ এলোমেলো 
কৃষ্ণচূড়া আর গোলাপ ফোটানোতে ব্যস্ত খুব তারা
কিছু তো অগ্রজ ক্ষরণ পলাশের সঘন রূপ পেল 
আহা এ-অন্তর ফুলের যেন এক-অনির্বাণ পাড়া! 

নিয়ন আলো ঘেঁষে নির্জনতাগুলো দেয় না কোনো ফাঁকি 
ব্যথাতে ক্ষয়ে গিয়ে জন্ম নিই ক্ষণে। ওখানে আমি থাকি! 




স্বর্গ-উদ্যান 

বোধের ইশকুলে রোদের আনাগোনা। কাকতাড়ুয়া চুপ
নামতা ভুলে গেছে? ও-মুখে সংশয়-ভীতির স্তূপ! 

প্রীতি কি জানে নাই ঋণের অবসর, অবসরের ঋণ?
বন্য মহিষের ঘাড়ের মতো দৃঢ় প্রাচীন ক্র্যাচে চেপে 
কে ঘোরে এইবেলা? আলোর লাল রঙে বেগুনি হল লীন 
কৃপণ মেঘগুলো এখানে আলস্য সাজায় মেপে-মেপে। 

আগন্তুক-বেশে তুমিও হতে পারো হামেশা বাজিকর 
কখনো এলে শীতে, ওড়াবে বেলুনের ফাগুন-রাঙা ঝড়। 

ভীষণ  ভালুকের স্থিরতা নিয়ে বিকেল আলিশান 
বৃষ্টি নামল না? বিষণ্ণতা চিরে পাখিরা ফেরে নীড়ে!  
কোনো কি মিস্তিরি এ-গাঁয়ে গড়বেই স্বর্গ-উদ্যান?
কিশোর ডাংগুলি খেলতে যায় নাই দিগন্তের তীরে। 

এসব চিত্রল মগ্নতাকে নদী ঢেউয়ে পুষে রাখে 
স্নিগ্ধ কারো আঁখি পাখির প্রতিলিপি। কেন যে পিছু ডাকে! 




মাথুর 

যে-পথ চলে গেছে মুগ্ধতার গান পেছনে ফেলে দূরে 
সে-পথে ফিরে এল এখানে ঘুরেফিরে প্রাচীন ভবঘুরে। 

রাতের মেল এই ইস্টিশানে ভুলে দাঁড়ায় না কখনো 
আঁধারে বেড়ে ওঠে অসংযত নীল জোনাকিদের পাড়া 
আকাশে আকরিক তারারা ঊর্মিল। আপন মনে গোনো
গুনেছ তো, মাথুর আঁখিতে মন পোড়ে? পেলে কি তার সাড়া?

ঈর্ষা ইশারার আপন কেউ নয়। ঢেউ তা বুঝেছিল 
নদীর লাবণ্য মদির দস্যুতা অধীর খুঁজেছিল। 

বয়সী যত মোহ আত্মবলিদান রূপার জলে মাপে 
শীতের বুজরুকি মানেই বুঝি কোনো সজারু-ব্যস্ততা?
প্লাবনে ক্ষয়রোগ হঠাতি লেগেছিল খরার অভিশাপে 
কনকলতা, কেন শ্রাবণে চেয়ে নাও বধির নীরবতা?

অভিযোগের পালা চিত্রলিপি যদি, দোহাই বাড়ে তাতে?
সবটা অপরূপ– গোলাপ চাষ করো বেগানা দোলনাতে।  




সংক্ষিপ্ত লেখক-পরিচিতি 

অনিরুদ্ধ আলম (Anirudha Alam) মূলত একজন কবি। তিনি এ পর্যন্ত পঞ্চাশটিরও অধিক বই লিখেছেন এবং সম্পাদনা করেছেন। তাঁর প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: সোনালি নৈঃশব্দ্যের হরিণাবলি (কবিতা), প্রেম কি কেবলি পাখিপ্রবণ (কবিতা), ভালবাসা প্রিয়তমাসু (কবিতা), অনেকটা পথ হাঁটতে হবে ঘুমিয়ে পড়ার আগে (কিশোর কবিতা), এইসব রাতদিন (কিশোর কবিতা), দূরের ডাক (ছড়াকবিতা), তারপর তারপর (ছড়া), সকলের জন্যে পরিবেশ পরিবেশের জন্যে সকলে (ছড়ানাটিকা), ২৪ অক্টোবর ১৯৭১ (উপন্যাসিকা), পিঁপড়ে (সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস), অপারেশন ক্যালপি বত্রিশ (সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস), এবং ক্রিনোর অপেক্ষায় (সায়েন্স ফিকশন), তেইশ শত দুই সালের এক জানুয়ারি (ছোটো গল্প), দু’ শ’ বছরের সেরা বাংলা কিশোর গল্প (সম্পাদিত গল্পের সংকলন), তোমাদের জন্যে বাংলা বানান (বাংলা বানান বিষযক প্রবন্ধ), আমাদের কালো মানিক: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (জীবনী)। কিংবদন্তিতুল্য নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুন অনিরুদ্ধ আলমের ছোটোগল্প ‘দোয়েলের সংসার’ নাট্যরূপ দিয়েছিলেন এবং তারই পরিচালনায় তা বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছে।  
 
শিক্ষাগত জীবনে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, ইংরেজি সাহিত্য এবং কমপিউটার-প্রযুক্তি বিষয়ে 
দেশেবিদেশে পড়াশুনা করেছেন। বর্তমানে সপরিবারে কানাডায় বসবাসরত।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন