তপন গোস্বামী-র গুচ্ছ কবিতা 




দাহ 



১ 

আমার নিজস্ব কোন ঘর নেই
আমার নিজস্ব কোন শেকড় নেই
আমার নিজস্ব কোন সুর নেই 
হাজার মুখের সঙ্গে আমার মুখ
ভেঙে চুরে ভাসতে থাকে জলে।
আকাশ থেকে আ ঝরে পড়লে 
কেবল মার পড়ে থাকে আমার কপালে।


আমার নিজস্ব কোন শরীর নেই 
আপনার শরীরকে বসিয়ে দিলে 
অনায়াসে গড়িয়ে পড়বে রস 
আমার নিজস্ব কোন মুখ নেই 
আপনার জিবের ডগায় 
গোবেচারা যে আলজিব থাকে 
ধরে নিন সেটাই আমার।

আমার মৃত্যু হলে 
পৃথিবীতে কোন পাতাই খসবে না
আমার শরীরে লেপটে যাওয়া 
মুখ হাত জিবগুলো এতটাই নিরাপদ যে
নিঃশব্দে পুড়ে যাবে অল্প আঁচেই।
মুশকিল একটাই 
আমার মত মানুষের কোন নাম নেই
আর একটা নাম না থাকলে
তাকে পোড়ানোয় কোন আনন্দও নেই।




২ 

নিচে কাঠ বিছানো আছে
ওপরেও কাঠ
তাও যদি তুমি বেঁকে যাও
দমাদম লাঠির ঘায়ে 
আবার শুইয়ে দেওয়া হবে।
আগুনের তাপে ব্রহ্মতালু ফেটে গিয়ে
ছড়িয়ে পড়বে ঘি 
মটমট করে ভেঙে পড়বে হাড়
খেঁকশিয়ালের মত ব্যাপক উল্লাসে
ফেটে পড়বে শ্মশানচণ্ডাল।
 পাশ দিয়ে তখনও স্বচ্ছতোয়া নদী
নুড়ি পাথর নিয়ে কুলকুল করে বয়ে যাবে।


এই শ্মশান তোমার চেনা
এই দৃশ্যও তোমার চেনা
কেবল এই কষ্ট তোমার চেনা ছিল না।
কতদিন অস্থি নিয়ে দাঁড়িয়েছো নদীর ধারে
অস্থি তার কষ্টের কথা
বলেছিল কণ্ঠনালীহীন
আজ সেইসব ভাষা তোমার শরীরে ফুটে ওঠে। 
স্বৰ্গ নেই, মর্ত নেই, আত্মীয়স্বজন নেই
কেবল আগুন দাগ দিয়ে যায়
পাঁচনম্বর চুল্লির ধারে।




৩ 

ভাঙামন্দিরে বসে একাকী ঈশ্বর 
বাইরে তাকিয়ে দেখে সবই তো নশ্বর 
বটের কোটর বাড়ে, পাখি আসে যায় 
মনের বয়স বাড়ে শাখায় শাখায় 
আচম্বিতে সেই বট পা রেখেছে ঘরে 
ঝড় এল পায়ে পায়ে ঠিক তার পরে। 
ঈশ্বরও বুঝে নেয় সময়ের ঘড়ি 
আজ তার হাতে নেই, করোনা প্রহরী।

নাবাল ভক্তের ঝুড়ি ইঁটের পাঁজরে 
ক্ষয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন চোখের কামড়ে 
ওপাশে গঙ্গার ঘাট দাউদাউ চিতা 
কেউ কিছু ফেলে যায় ভাগবতগীতা 
শ্রীযুক্ত ঈশ্বরবাবু মনে মনে ভাবে 
এ শরীর আগুনেই একদিন যাবে।




কাল রাতে ধাওয়া করেছিল মেঘ
কুয়াশার পিছে পিছে
একদল পেঁচকের গলা জড়াজড়ি করে
এ গাঁয়ের কীর্তনের দল। 
আমাকে কি চেনা যায়
আমাকে কি চেনবার কথা?
অন্তত গাঁয়ের বলে কেউ তো চেনে না।
স্মৃতির দোআঁশলা জলে ক্রমাগত ভিজে ভিজে
আমি আজ অর্ধেক মানুষ 
চাঁদের আলোয় শুধু দেখতে পাই 
প্রাগৈতিহাসিক আমাদের পূর্বপুরুষের পাপে
ভরে গেল সমস্ত পৃথিবী। 
দু-চারটে কাঁচের টুকরো জলে ফেলে দিলে 
এখনও তো ঝলসে ওঠে রক্তাক্ত নগরী। 
আজ যদি কুকুরেরা তার শোধ নিতে চায়
আমি তাকে কী করে ঠেকাব!

আমাদের মত অর্ধেক মানুষে 
আধখানা বেঁচে আছি
বাকি আধখানা ক্রমাগত ছুটে চলে
পেছনে পেছনে চলে কীর্তনের দল।




আগুন থেকে আগুন জ্বলে, আগুন জ্বালাই কাজ 
মৃত শরীর বেঁচে থাকার নিপুণ তীরন্দাজ 
যত আগুন জ্বালবে তুমি তত তোমার ক্ষয় 
বন্ধু জেনো, ঘরে থাকার এখন সময় নয়।

পুড়ে যাচ্ছে জাহাজঘাটা, তোমার আমার বাড়ি 
পুড়ে যাচ্ছে সূর্যদীঘল সোনামণির শাড়ি 
ছাই উড়ছে মানবতার লালনশাহের গান 
চিতার ভেতর লুকিয়ে আছে আমার আব্বাজান।

আওয়াজ তোলো চিলেকোঠার সেপাইবন্ধুরা 
আওয়াজ তোলো মুখলুকানো কালোমানিক হীরা 
সামনে এসো হাসান হোসেন, পথ ছেড়ে দিক ভয় 
এজিদ যতই ঘৃণা ছড়াক, কারবালা এ নয়।

রাত্রি যত প্রহর হবে, মিশবে যত কালো 
ততখানিই জাগবে দেখো তোমার আমার ভালো 
ভালোর ভেতর লুকিয়ে আছে কী অখণ্ড প্রাণ 
চাই প্রতিরোধ, তোমার আমার হিন্দু মুসলমান।

আজানে আজ মিশুক তোমার চাপা আর্তনাদ 
দুশমনদের দেখাও তুমি সামনে গভীর খাদ 
বিশ্ব জুড়ে মানুষ যখন, হাতের ওপর হাত 
আগুন তোমায় আগুন দিয়ে পুড়বে গভীর রাত।

সংখ্যা দিয়ে মারবে তুমি, সংখ্যা তোমার নয় 
নতুন অঙ্ক বিশ্ব জুড়ে নতুন সূর্যোদয়।





৬ 

ধরা যাক বগলের ক্রাচে লেগে নেই কোনই প্রদাহ 
ধরা যাক একখানা হাতে চর্যাপদ লেখেন ভামহ 
জিব যার কেটে নিলে তুমি, রাগ তার ময়ূরপালক 
নিরুচ্চার কথা ঝরে পড়ে, চোখে মুখে থমথমে শোক 
তোমার পায়ের কাছে শুয়ে যে এখন ঘুমিয়ে পড়েছে 
তার স্বপ্নে ভেসে আসে মেঘ, মেঘ দেখো মাটি ছুঁয়ে আছে।

সব মেঘে বৃষ্টি নেই জানি, তবু সে তো ফোঁস করে ওঠে 
সে আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই, আগুন বিদ্যুৎ বেগে ছোটে।

তোমার সামনে থেকে যদি টেনে নেয় কারও নোংরা হাত
দিন নেই রাত নেই দাহ, পুড়ে যায় রান্না করা ভাত। 
রাত্রির গভীর ছুঁয়ে আছে প্রজাপতি সপ্তর্ষিমণ্ডল 
তার নিচে ধিকি ধিকি নাচ, তার নিচে জ্বলন্ত অনল। 
এ দাহ তোমাকে কী করে, কী করে জানবে বল যথ 
এই দাহে পুড়ে পুড়ে ছাই আমাদের প্রবুদ্ধ ভারত।



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন