বাসুদেব দাস--এর অনুবাদ কবিতা





বীরেশ্বর বরুয়া-র কবিতা

অনুবাদ– বাসুদেব দাস


জানি একদিন

জানি যে একদিন সন্ধ্যা নামবে আমার জীবনের
যেভাবে শস‍্যের শীষগুলি
বাড়ে এবং খসে পড়ে অচিন মাঠে 
আমাদের অজান্তে।

রাতের তারাগুলি ঢাকছে মেঘে
দূরের পাহাড় আলোকিত করছে বিদ্যুৎ
জানি যে একদিন থেকে যাবে এইসব
আমারই প্রতিবিম্ব।




প্রতিটি সকালকেই


প্রতিটি সকালকেই অনুর্বর বলে মনে হয়
যেন একটি ঘুণেধরা গোলাপ
মূর্ছা যেতে অনিচ্ছুক।

আমি চিৎকার করে উঠিঃ
'কোথায় সেই শৈশবের নিষ্পাপ গ্রামের হৃদয়?'
কিন্তু আমার কন্ঠস্বর আমার মুখেই থেকে যায়
কারণ
আমার বন্ধু আসানউল্লা
তাঁর আপন শৈশবের গ্রামেই নিহত
কোনো এক বিত্তবান দেশপ্রাণ আততায়ীর হাতে
গ্রীষ্মের এরকম এক সকালবেলা।




দিগন্ত শইকীয়া-র কবিতা

অনুবাদ- বাসুদেব দাস



কোথাও কিছু একটা কমে গেছে

আমি বাড়ছি
তুমি বাড়ছ

শিসার বৃষ্টি বেড়েছে 
ধাতব  শব্দগুলি বেড়েছে 

আমাদের আলাপ বেড়েছে
বিলাপও 

প্রার্থনার সুরে বাড়ছে ঈশ্বরের গা
নিঃশ্বাসে অরণ্য

বাড়ছে আঁক বাঁক স্বপ্ন
ইতিহাসের পৃষ্ঠা 
এভাবেই সবকিছু বেড়ে বেড়ে
কোথাও কিছু একটা কমে গেছে



আত্মপাঠ

নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলি
নিজের সামনে
নিজেই হয়ে পড়ি উলঙ্গ

নিজের ভেতরে অরণ্য এবং পাখির কাকলি
নিজের ভেতরে মৈথুন
নিজের নদীতে নেমে নিজে করি জলকেলি

নিজেই নিজের দিকচক্র রেখায়
সূর্যের মতো উঠি এবং অস্ত যাই

মাটি হয়ে
জল হয়ে
নিজের সামনে হয়ে পড়ি উলঙ্গ




পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি-র কবিতা

অনুবাদ- বাসুদেব দাস



ঐরাবত

মাঝ রাতে দরজায় টোকা
ধীরে ধীরে টোকার শব্দ বেড়ে  চলল

আমি জেগে উঠলাম
মোবাইলে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকালাম
রাত দুটো বেজে সাতাশ মিনিট

কে ভয়াতুর
কে বিপদে আতুর

দরজায় শব্দের প্রকোপ ক্রমশ বেড়েই চলেছে
আমি প্রতিক্রিয়া জানালাম 
একটা অস্ফুট গোঙানি ভেসে এল

আওয়াজটা যেন পরিচিত 
অতিশয় পরিচিত

একলাফে 
 এসে
 দরজাটা খুলে দিলাম
আর আমি চিৎকার করে উঠলাম– ঐরাবত
হাজার বছর ধরে প্রদর্শন করে আসা ভঙ্গিমায়
ঐরাবত দন্ডায়মান
আমাকে স্পর্শ করার জন্য এগিয়ে দেয় শুঁরটা 

একি ঐরাবতের পেছনের দিকে কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে রয়েছে
নব প্রজন্মের প্রতিভূ এক স্নেহশীল প্রতিনিধি 
সে বেচারা ভয়ে 
ত্রস্তমান 

আমার সব কিছু শেষ হয়ে গেল
আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেল
ওরা প্রত্যেকেই–
তারপরে এক অস্ফুট গোঙানি

আমি চমকে উঠলাম
গতকাল আমি ওদের দেখেছিলাম
ওরা প্রকৃতির জয় গান গাইছিল

ঘর থেকে আমি এক লাফে বাইরে বেরিয়ে এলাম
আমি বসবাস করা ঘরটা আমার কাছে এমন মনে হল
মানুষ তৈরি করা এটা একটি কলঙ্কের স্তূপ

আমি এক লাফে দৌড়াতে লাগলাম
আমার সঙ্গে ঐরাবত এবং তার পরবর্তী প্রজন্ম

একি ঐরাবতের ধরাশায়ী সংসারে
আকাশের দিকে মুখ করে মৌন প্রার্থনা করছে
ঈশ্বরকুল, এরা নিরপরাধ, এদের ক্ষমা করে দাও
হস্তিকুলের নিথর শরীরে হত্যার আর্তনাদ

ঐরাবত এবং শাবকটি আমার গা ঘেষে দাঁড়িয়ে রয়েছে
আমি ওদের শরীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি
ওদের সান্ত্বনা দেওয়ার মতো আমার ভাষা নেই
আমার ইচ্ছা হচ্ছে আমি আমার গালে চড়াই কপাল চাপড়াই
একটা ছুরি এনে বসিয়ে দিই মানব সভ্যতার শরীরে

কোন নির্বোধ কাঁচা খেল হাতি পরিবারের জনগণের মাংস
কী লোভে কী পাপে,কী লাভে

হত্যাকারীর প্রজাতি নেই
তবুও সেই প্রজাতির একজন হিসেবে ঐরাবতকে বলেছি
তোর শক্তিশালী দাঁত দুটি বসিয়ে দে আমার বুকে

ঐরাবত কাঁদছে তার দুই চোখে জলের ধারা
শাবকটা মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে মৃতদেহের স্তুপের মধ্যে

আমি ঐরাবতের শুঁরটা জোরে জড়িয়ে ধরেছি 
তাদের ক্ষমা কর না
তাদের ক্ষমা কর না
হে, ভারতবর্ষের ন‍্যায়ের দেবতা 




ক্রন্দন কাব্য

তুমি কাঁদছ
সেটা তোমার অভিনয়

সুদক্ষ অভিনেতার কান্না সাবলীল মসৃণ
দর্শকের জন্য অভিনেতা ব্যক্তিটি সরল এবং আত্মজ
সেই জন্য বহু অভিনেতা দর্শকের কাছে অত্যন্ত কাছের
তার ছবি মনের কোঠায় গেঁথে বহু জন হয় তাঁর প্রতি অতি ভক্ত অনুরক্ত

তার ধরনে চুল কাটে চুল আঁচড়ায়
চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে টুপি পরে পরায়

অভিনয় ধরতে না পারা পর্যন্ত লুকিয়ে থাকে তাঁর প্রকৃত পরিচয়
অভিনেতার কান্নায় ভেঙ্গে পড়া  দর্শক সত্যি-মিথ্যা স্থির করতে পারে না

রাজনীতির মতো খেলা সাহিত্য এবং অন্যান্যতেও   সেরকম অভিনেতা থাকে
দক্ষ প্রশিক্ষক ধরতে পারে অভিনেতা খেলোয়াড়
পাঠকও দুদিনেই বুঝতে পারে কোন অভিনেতা সাহিত্যিক কতটা কাজের

আমরা যে দৈনন্দিন কাঁদতে শুরু করেছি সেটা কিন্তু নয় অভিনয়
আমার দু'চোখ দিয়ে অন্তরের নিরন্তর তপ্ত অশ্রু অহরহ বয়

অভিনয় নয় বলে দর্শকের ক্রন্দন সত‍্য অলক্ষিতে থাকে না





বিনয় কুমার মজুমদার-এর কবিতা

অনুবাদ– বাসুদেব দাস


তারা

আমাদের গ্রামের বাড়ির উঠোনে একদিন বসে থাকার সময়
আগে সেই জায়গায়  না দেখা একটা তারা দেখলাম
এমনিতে দেখার কথা ছিল না যে তারা

উঠোনে বসলে ওপর দিকে তাকানো একটা অভ্যাস
শৈশবে গড়ে ওঠা বলেই
আকাশে তারার গতিবিধি অবস্থান তখনই চিনি  
আমাদের উঠোনের আকাশে মাথার ওপর দিয়ে 
নতুন করে আশা সেদিন দেখা সেটা অতিথি তারা

তিরবির এবং জ্বলজ্বল করতে থাকা তারা চোখ ধাঁধিয়ে দেয় 
কে জানে হয়তো নতুন তারার তিরবিরানি এবং জ্বলজ্বলে ভাব
পুরোনোর চেয়ে কিছু বেশি
পরের দিনও উঠোনে বসার  সময় আকাশে  দেখলাম 
অনেকগুলি নতুন নতুন তারা

তারা দেখলেই মনে নানান প্রশ্ন 
অনেকে অমূলক বললে বলুক
আকাশে  নতুন নতুন তারা ভরা কথা
পৃথিবীতে মরা মানুষের খবর

মরা মানুষগুলি কোথায় যায় বলে
ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা জিজ্ঞেস করলেই
তখনকার দিনের বুড়ো- বুড়ি
আকাশের দিকে দেখিয়ে দিয়ে বলেছিল-
প্রতিটি মৃত মানুষকে দেখছি আকাশে
এক একটি তারা হয়ে উজ্জ্বল ভাবে জ্বলতে।




বালা

আমার হাতে একটি পেতলের বালা আছে
তামিলনাডুতে কেনা দশ বছর আগে
অ্যাপোলো হাসপাতালের দরজা মুখে
প্রেশার নাশক-
এটা আমার প্রেশার কমাল বাড়াল!
বালা কেনার আগে প্রেশার ছিল না

আজকাল নাকি প্রেশার একটু বাড়লে
ঘরোয়া চিকিৎসক সেদিন বলল,
মাঝেমধ্যে বালাটা হাতে ঘুরাই
বালাটাকে আমি ছাড়তে পারিনি
এটা এখন আমার একান্তই নিজের হয়ে পড়েছে।




বিমান কুমার দলে-র কবিতা

অনুবাদ- বাসুদেব দাস


একটা পথ খুঁজে বেড়াচ্ছি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা 
একটা পথ খুঁজতে গিয়ে নাকানি-চোবানি খাচ্ছি
নিজের ভেতরে ফিরে আসার জন্য

চারপাশে আগুন জ্বলছে, ধোঁয়া উড়ছে
লাল কালো কিছু অপদেবতায় ভর করা ঘোড়া 
নানা বর্ণের কিছু পাগল কুকুর
পাহাড়ে সমতলে দৌড়ে বেড়াচ্ছে

মানুষ গুলি বন্ধ করে দিয়েছে
বাড়ির প্রবেশপথ
ঘরের দরজা

মানুষগুলি জীবন্ত যন্ত্রণায় ভুগছে
জল চেয়ে পেয়েছে রক্ত
মাটি চেয়ে পেয়েছে রক্ত

মোষদের লড়িয়ে দিয়ে,ষাঁড়দের লড়িয়ে দিয়ে
রাজা মজা দেখছে
মজা পাচ্ছে

গ্রামের ছেলে আমরা
কখনও কোথাও পথ ভুল করেছি
বিপথে গিয়ে পথ হারিয়েছি

তবু, নিজের ভেতরে ফিরে আসার
পথ একটা খুঁজে বেড়াচ্ছি




চোখ

চোখ
যার
তিড়বিড়ে  তারাদের চেয়েও  তীব্র  
সেই ধরনের
একজোড়া কালো-সাদা চোখ

চোখ জোড়া আমাকে খুঁজে বেড়ায়
আমাকে চোখ জোড়া তন্ন তন্ন করে খোঁজে
আমার ঘরের উঠোন বাড়ির সামনের প্রবেশপথ

কী যে একজোড়া চোখ।

কিছু একটা বোঝাতে না পারার আতঙ্কে
আমি আমার কাছ থেকে পালাই
ভাবনার একটা ঘরে ঢুকিয়ে রাখি

কোনোভাবে যদি গলে যায় চোখজোড়ার তীব্রতায়
কোনোভাবে যদি পিছলে পড়ি নৃত্য ভঙ্গির চাহনিতে 

কখনও  ভাবি–
নিজেরই অগোচরে হঠাৎ   

আমার চোখজোড়াও যদি চায়
সেই জোড়াচোখের অন্তস্থল
উকি দিয়ে দেখার জন্য জানালা

তখন কী হবে
কী হবে তখন…?




ধ্রুবকুমার তালুকদার-এর কবিতা 

অনুবাদ- বাসুদেব দাস


মেঘের ছবি

একটা জানালা–

অষ্টমীর চাঁদটা দেখার জন্য
এর চেয়ে ভালো দূরবীন আর চাইনা

তুমি একটু দূরে সরে গেছ
আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছি
একটু ভুলে থাকার চেষ্টা করছি
ছেলেমেয়েদের উপস্থিতি

আকাশের কোথাও কোথাও
মেঘ ছবি আঁকছে
বাতাস কোথাও থেকে বহন করে আনছে
অপরিচিত ফুলের গান

সিগারেটটা পুড়িয়ে আনা আগুনটা 
আমার আঙ্গুলে এসে লাগছে



কথা

একটা কথার পথে
অন্য একটি কথা ভ্রমণে বের হয়
তারপরে আরও একটি 
তারপরে আরও একটি

কথার পথে মাঝেমধ্যে
আমিও হাঁটি
কথার মাঝের কথাগুলির সঙ্গে
মনের মাপ-জোক নিই

কথাগুলির কথা মিলে মিশে দিনটিতে
রামায়ণ হয়
কথার দৌড়ে সোনার হরিণ তাড়িয়ে নিয়ে যাই
কথার শরে রাবণ বধ করি

কথার ভয়ে সীতা
ফাটল ধরা বসুমতীর পাতালে
লুকোল

আর আমি কথা শুনে শুনে
বুড়ো হয়ে পড়লাম।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন