সজল কুমার মাইতি-র গল্প





হস্টেল

এক

পি জি হস্টেল। ঠিকানা পঁচিশ নম্বর বিডন রো। উত্তর কলকাতার একটি গলির মধ্যে ছেলেদের এই হস্টেল। এই হস্টেলের চারদিকে গৃহস্থদের বাড়ি। স্বাভাবিক নিয়মে এই ধরনের হস্টেল এইসব এলাকার মধ্যে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাড়িটি এক রাজ পরিবারের দান। বিশ্ববিদ্যালয়কে তারা এই সম্পত্তি দান করেছিলেন। এই বাড়ির ঘরগুলি বসত বাড়ির ঘরের মতো ছোট ছোট। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ক্লাসরুম হিসেবে ব্যবহারের যোগ্য নয়। সেই কারণে বিশ্ববিদ্যালয় এই বাড়ি ছেলেদের বহুদিনের দাবি পূরণ করে বয়েজ হস্টেলে কনভার্ট করে। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সিদ্ধান্তে। ছেলেদের হস্টেলের সমস্যা সমাধান। আবার এই বাড়ির সদ্ব্যবহার।
এই হস্টেলে বর্তমানে জনা পঞ্চাশ ছাত্র থাকার ব্যবস্থা আছে। বেশির ভাগ রুমে তিন থেকে চারজনের থাকার বন্দোবস্ত আছে। একটি রুমে কেবল দুজনে থাকার ব্যবস্থা। সেই রুমের ডিমান্ড খুব বেশি। সকলের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে না। হস্টেলের খাওয়া দাওয়ার মেস ছেলেরাই পালা করে চালায়। প্রতি মাসে দুজন ছাত্র মেস ম্যানেজার হয়। হস্টেল কর্মচারিদের সাহায্যে বাজার করা থেকে অন্যান্য কাজ করে থাকে। মাসের শেষ দিন গ্রান্ড ফিস্ট হওয়া এখানকার রীতি। ছেলেদের মিলের জন্য যোগদান সবচেয়ে বেশি এই দিনটিতে। এই দিনের মেনুতে মাছ মাংস ছাড়াও দই মিষ্টি কোল্ডড্রিংক ও মিঠাপান থাকে। সেই জন্য সকল বোর্ডার পারতপক্ষে এই দিনের মিল মিস করে না।


দুই 

" এ্যাই, বিজয় বাঁ....... ( দু অক্ষরের গালাগালি ) কতক্ষণ ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না? বোকা........( চার অক্ষরের গালাগালি ), খেয়ে খেয়ে গাঁ.....(দু অক্ষরের গালি) মেদ জমে গেছে। শালা এখন ঘুম বেড়ে গেছে। এতবার ডাকছি ঘুম আর ভাঙে না। এই ডাক ও গালির তোড়ে বিজয়দা ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ে। তাড়াহুড়ো করে হস্টেলের গেটের বড় দরজা খানা খুলে দেয়। এক পাল ছেলের দল ঢুকে পড়ে। এদের মধ্যে তরুণ নামের এক বৃদ্ধ প্রকৃতির মাতব্বর বলে ওঠে " বিজয়দা, বাঁ.......(দু অক্ষরের গালি) যাবার সময় তোমায় বলে গেলাম আজ নাইট শোয়ে যাচ্ছি। ঘুমিয়ে পোড়ো না। আর তুমি বা......(দু অক্ষরের গালি) নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছো? আমাদের মিলের কথা শরৎদাকে বলেছিলে?" বিজয় এখানকার নাইট গার্ড। একটু তন্দ্রা এসে গেছিল। সেজন্য দরজা খুলতে একটু দেরি। তার জন্যই এত কান্ড, এত গালাগালি। এই গালি আর ডাকাডাকির শব্দে সেই তন্দ্রা পাততাড়ি গুটিয়েছে। মিহি গলায় বিজয়দা বলে " না। স্বপনদার সঙ্গে এতক্ষন গল্প করছিলাম। মিনিট পনের হল উনি গেছেন। তারপর ওই একটু তন্দ্রা এসে গেছিল।" " গোটা পাড়া জেগে গেল আর তোমার বাঁ.......ঘুম ভাঙে না। গাঁজা ফাঁজা খেয়েছিলে নাকি? পাশের বাড়ির পিঙ্কি চিৎকার শুনে জানালায় চলে এল আর তোমার বাঁ.... কুম্ভকর্নের ঘুম ভাঙে না। মিল বলেছিলে? নাহলে তোমার এ্যায়সে কে ত্যায়সে করে দোব।" তরুণের হুঙ্কার। " হ্যাঁ। শরৎদাকে আপনাদের ছজনের মিলের কথা বলে দিয়েছি।" ছজনে ওই বাইরের পোষাকে খাওয়ার টেবিলে বসে। ছজনের খাওয়া ঢাকা দেওয়া ছিল। ঢাকা খুলে নিজেদের খাওয়ার খেয়ে যে যার রুমে চলে যায়। 


তিন 

হস্টেল বাড়ি পুরোনো জমিদার বাড়ি। এর জানালা দরজাগুলি সব বড় বড়। পুরোনো কালের আলো বাতাস চলাচলের জন্য জাফরি টাইপের। ভেতর থেকে সেগুলো ওপরে তোলা যায়। এরফলে আলো হাওয়া ঘরের মধ্যে স্বচ্ছন্দে যাতয়াত করতে পারে। ভেতর থেকে বাইরের জিনিস দেখা ও যায়। অথচ বাইরের কেউ ভেতর দেখতে পাবে না। দরজা জানালা গুলি ও ভারী শাল কাঠের। এদের ক্ষয় প্রায় নেই। বৃদ্ধরূপী তরুণের রুম হস্টেলের  গেটের ঠিক ওপরে দোতলায়। এই রুমে তিন জনে থাকে। বরুন, সমীর ও তরুণ। হস্টেলের সামনে প্রায় পনের ফুটের রাস্তা। রাস্তার ওপারে পাড়ার গৃহস্তের বাড়ি। এই বাড়ির নীচে ফুট লাগোয়া একটি চায়ের দোকান। ফটিকের চায়ের দোকান। ফটিকের এই চায়ের দোকানের মূল খদ্দের হস্টেলের ছেলেরা। তাই ফটিকের কাছে এদের আলাদা কদর। হস্টেলের থেকে এক ডাকে অর্ডার দিলে তৎক্ষণাৎ চা ও অন্য কিছু যা অর্ডার করা হবে পৌঁছে যাবে। হস্টেলের দোতলা আর উল্টোদিকের ফটিকের দোকানের বাড়ির দোতলা একই উচ্চতায়। এই বাড়ির জানালা দিয়ে ওই বাড়ির ভেতর পরিষ্কার দেখা যায়। পাশাপাশি দুটি রুম। দুটি রুমের অভ্যন্তর হস্টেলের এই রুম থেকে পরিষ্কার দেখা। এই রুমের একটিতে ওই বাড়ির পিঙ্কি পড়াশোনা করে। আর একটিতে পিঙ্কির দাদা বৌদি থাকে। এই পিঙ্কি বেথুন কলেজের ছাত্রী। দেখতে ও সুন্দরী। পড়াশোনায় রীতিমতো ভাল। রাত জেগে পড়াশোনা করে। 
একদিন হস্টেলে আড্ডা মারতে মারতে অনেক রাত হয়ে গেছে। সবাই লাইট অফ করে যে যার বেডে ঘুমিয়ে পড়েছে। তরুণ ও শুয়ে পড়ে। কিন্তু আজ কোন এক কারণে তরুণের ঘুম আসছে না। পড়তে ও ইচ্ছে করছে না। বেড থেকে উঠে বারান্দায় যায়। চাঁদনী রাত। উত্তর কলকাতার গলিঘিঞ্জি থেকে এই নির্মল চাঁদকে আজ মোহময়ী লাগছে। চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় স্ট্রীটল্যাম্প গুলিকে মোমবাতির আলোর মতো লাগছে। এই রাতে রাস্তা শুনশান। দুটি রাস্তার কুকুর রাস্তার মাঝে নিশ্চিন্ত ঘুমিয়ে আছে। দূরে এক মাতাল টলতে টলতে হঠাৎ রাস্তায় পড়ে গেল। অনেক চেষ্টায় আবার উঠে টলমল শরীরে কি এক গান করতে করতে চলে গেল। হঠাৎ পিঙ্কির রুমের খোলা জানালায় চোখ পড়ে তরুণের। পিঙ্কির রুমে এখনো আলো জ্বলছে। ফ্যান চলছে। খাটের ওপর পিঙ্কি শুয়ে আছে। পা হস্টেলের দিকে। বুকের ওপর বই। দুই হাতে বইের দুদিক ধরা। ঘুমিয়ে গেছে না জেগে আছে নিশ্চিতরূপে বোঝা যাচ্ছে না। ফ্যানের হাওয়ায় পিঙ্কির স্কার্ট ওপরে উঠে গেছে। ফর্সা সুডৌল নগ্ন উরুযুগল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পরনের ছোট্ট প্যান্টি দুই উরুর মাঝের স্বল্প পরিসরের মধ্য দিয়ে তরুণকে এক অদমনীয় আকর্ষণে আবদ্ধ করে রেখেছে। নিষ্পলক তরুণ যূপবদ্ধ ছাগের ন্যায় পিঙ্কির গোপন সাম্রাজ্যে আরও কিছুর দেখার আশায় সুদীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে থাকে। আকাশে শুকতারার আগমনে তরুণের আশা ভঙ্গ হয়। ধীর পায়ে নিজের বেডে যায়।


চার

পরদিন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাসের জন্য যে যার সময় মতো রেডি হয়। খাওয়ার টেবিলে তখন পলিটিক্যাল সায়েন্সের সমীর আর ম্যানেজমেন্টের ছাত্র সিদ্ধার্থ বসে খাচ্ছিল। এমন সময় তরুণ হাজির। গত রাতের খবর গোটা হস্টেলে রটে গেছে। সুন্দরী যুবতীর মুখরোচক বিষয় ছেলেদের হস্টেলে ঔৎসুক্য ও চর্চার বিষয় হবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সমীর তরুণের উদ্দেশ্যে বলে " কি তরুণ, আশা ভঙ্গ হল? শেষটুকু আর দেখা হোলো না? একেই বোধহয় বলে বিধিবদ্ধ। কপালে নেই কো ঘি কপাল ঠকঠকিয়ে করবে কি?"
" না বস। জাস্ট একটুর জন্য মিস। " তরুণের হতাশ উত্তর।
" তুই তা বলে সারা রাত ওইভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলি? ঘুম ও পেল না। টায়ার্ড ও হলি না? কি অমোঘ আকর্ষণ!" সিদ্ধার্থর জিজ্ঞাসা।
সমীরের একটু আঁতলামি স্বভাব আছে। সে তরুণকে জিজ্ঞেস করে " তরুণ, তুই দূর্গাচরন মিত্র লেন চিনিস?" 
" না।"
" প্রেম চাঁদ বড়াল স্ট্রীট সেটা কি চিনিস?"
আবার ও সংক্ষিপ্ত উত্তর " না।"
" দূর্গাচরন মিত্র লেন ' সোনাগাছি' নামে খ্যাত। উত্তর কলকাতায়। আর প্রেম চাঁদ বড়াল স্ট্রীট ' হাড়কাটা' নামে খ্যাত। এটা মধ্য কলকাতায়। তোর জি কে একটু বাড়া। আর কালকের বাকি কাজটা এদের কোন এক জায়গায় গিয়ে কমপ্লিট করে ফেলতে পারিস।"  সবার খাওয়া শেষ। তাড়াহুড়ো করে যে যার রুমে যায়। তৈরি হয়ে ক্লাস করতে বেরিয়ে যায়। 
পরদিন সকালে চা টিফিন খেতে এসে  ক্যান্টিন বয় মেজদাকে ত্রিপুরা থেকে আসা কৃপাসিন্ধু বলে " মেজ, তুমি আমার  টোস্টে চিনি দিবা না। মরিচ গুঁড়া দিবা।" সকালে এই সময়টা মেজর ক্যান্টিনে ভিড় হয়। প্রত্যেকের তাড়া থাকে। চা টিফিন খেয়ে পড়তে বসে। তারপর ইউনিভার্সিটি যেতে হবে। এই তাড়াহুড়োর মধ্যে মেজ মাঝে মধ্যে ভুল করে ফেলে। হিসেবের খাতাতে ও মাঝে মাঝে গন্ডগোল ধরা পড়ে। এহেন মেজ আজ সঞ্জয়ের টোস্টে ভুল করে বাটার লাগিয়ে দেয়। আর যায় কোথায়? " তুই বাঁ....কিছু মনে রাখতে পারিস না। মন তোর কোথায় যাচ্ছে? বিয়ের বয়সে বিয়ে না করলে এইসব হবে। তুই  বা....এগুলো খা। আমি খাব না।" এই কথা বলতে বলতে গজগজ করে সঞ্জয় না খেয়ে রেগে চলে যায়। বেচারা মেজ হতাশ হয়ে টোস্টগুলো প্লেটে রেখে দেয়। মেজর ক্যান্টিন যে খুব ভাল চলে তা নয়। পঞ্চাশ জন ছাত্র থাকলে কি হবে মেজর ক্যান্টিনে খায় মেরেকেটে তিরিশ। বিকেলে আর ও কম। বেচারাকে এইসব খদ্দেরদের সামলাতে হয়।


পাঁচ

ফিলজফির সুজয় বাঁকুড়ার ছেলে। সবাই আজ তাকে ঘিরে ধরেছে। মধ্যমনি সুজয় ইউনিভার্সিটিতে তাদের ডিপার্টমেন্টের  গল্প সবাইকে শোনাচ্ছে। আসলে সবার আগ্রহের কারণ ফিলজফি ডিপার্টমেন্টে মোট ছাত্রছাত্রী সংখ্যা একশো দশ। তার মধ্যে ছাত্র মাত্র দুজন। সুজয় ও আর একজন। বাকি সবাই মেয়ে অর্থাৎ ছাত্রী। ইউনিভার্সিটির আর্টস ডিপার্টমেন্টগুলির এই বিষয়ে হাল প্রায় একই। কিন্তু ফিলজফি ডিপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে এই হাল বিপজ্জনক। এ তো কোনো রেশিও তে আসে না। বাওকেমিস্ট্রির রাজীব জানার উৎসাহের প্রাবল্যে জিজ্ঞেস করে " তোদের দুজনকে নিয়ে মেয়েদের মধ্যে কোন হেজিটেশন নেই?"
" দূ...র..র। ওসবের কোন বালাই নাই। ওরা আমাদের আলাদা কোনো পাত্তাই দেয় না। আমাদের আলাদা কোন সেক্স হিসেবেই ওরা ট্রীট করে না। ওদের সব ঠাট্টা মজা আমাদের মাঝেই করে। আমাদের ও আলাদা কোনো ফিল হয় না। চুল টেনে দেওয়া থেকে সবই করে। একদিন তো মালবিকা আমাকে বলল ' গান্ডু, তোর প্যান্টের চেন ও কি আমাদের জীপ করে দিতে হবে? দেখ ভাল করে।' সত্যিই সেদিন আমার প্যান্টের জীপ খোলা ছিল। এভাবেই চলে আমাদের ডিপার্টমেন্ট।" এই আড্ডার মাঝে কমার্সের আশিস বলতে শুরু করে " তবে বলি শোন, আমাদের যে গ্রুপটা আছে, তাদের মধ্যে মেয়েই বেশি। বাংলা, ইংরেজি, পলিটিক্যাল সায়েন্স, ফিলজফি মোটামুটি সব ডিপার্টমেন্টই আছে। "
" তুই তো গ্রেট মা...বাজ। তোকে তো দেখি সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর সিঁড়িতে ওদের সঙ্গে বসে আড্ডা মারছিস। না তো সেন্টিনারী বিল্ডিং এর সিঁড়িতে বসে আছিস।" বাংলার তাপসের সংযোজন। " তোদের দলের মধ্যে একটা বেশ সম্পদশালী আছে রে।"
" হ্যাঁ। ও শিঞ্জিনী। পলিটিকাল সায়েন্সের। ওর যা মুখ না। শোন তবে বলি একদিনের ঘটনা। "
" আমরা একদিন সেন্টিনারী বিল্ডিং এর রকে আড্ডা মারছিলাম। আমি শিঞ্জিনীকে বললাম ' তুই কি খাস রে? তোর সবকিছু বেশ বড় বড়।' আর যায় কোথা? অমনি শিঞ্জিনী বলে উঠল 
' তুই  ঢ্যামনা। ছুক ছুক করিস। সাহস নাই কিছু করার। শুধু লুকিয়ে চুরিয়ে এর তার জিনিস দেখা।' 
' তা তোর বরের কি অবস্থা হবে ভাবছি।'
 ' সেকথা তোকে ভাবতে হবে না। তোর বউের কথা চিন্তা কর। ঠিক জায়গায় মা... ফেলতে গিয়ে কোথায় ফেলবি দেখ।' এই কথা শুনে আমরা সবাই বাকরুদ্ধ।
এই আড্ডার মধ্যে ছোট্টখাটো ফর্সা চেহারার অসিত খালি গায় শুধু জাঙ্গিয়া পরা অবস্থায় ঢোকে। ঢুকেই প্রথম সম্ভাষন " তোরা বাঁ... কিসের আলোচনা করছিস?" সুজয়ের উদ্দেশ্যে বলে " এ্যাই বাঁ... সুজয়, তোর বিচি কাটার অপারেশন হয়ে গেছে?  স্টুডেন্টস হেলথ হোমে করালি তো? তা ডাক্তার কি কুচ করে কেটে দিল? "
" হ্যাঁ। তবে শোন। অপারেশনের দিন সকালে নাপিত এল। আমি প্রথমে বুঝতে পারি নি। বলল ' বাবু চলুন, সেভ করতে হবে।' ' কি সেভ করতে হব?' আমার প্রশ্নের উত্তরে নাপিত বুঝিয়ে বলল সব। তারপর নিচে গিয়ে সেভ করানোর পর নাপিতের মন্তব্য। ' বাবু, আপনার কোন সেনসেশন নেই।' ' কেন?' ' অন্যদের একটু হাত দিলেই যা হয়। আপনার তো কিছুই হোল না।' আমি মনে মনে বলি এরকম দলে থাকলে সবার এক অবস্থাই হবে।"


ছয়

আজ রবিবার। ছুটির দিন। সকাল থেকে যে যার জামা প্যান্ট কাচার কাজে নেমে পড়েছে। তরুণ একটু ফিটফাট থাকে। সেও নেমে পড়েছে। সিধুখুড়ো ( সিদ্ধার্থকে মজা করে সবাই এই নামে ডাকে) তরুণের উদ্দেশ্যে বলে " কি তরুণ, পিঙ্কি কেসটা কতদৃর এগুল? " বস আর বোলো না। একদিন তো বারান্দায় মালটার সঙ্গে চোখাচোখি। সঙ্গে সঙ্গে জানালার পর্দা টেনে দিল। "
" তারপর তুই কি অ্যাডভেঞ্চার বন্ধ করে দিলি?"
" না। তা কেন হবে? আমি স্ট্রাটেজি চেঞ্জ করেছি। আমি জানালার জাফরি থেকে ওয়াচ রাখি।"
" তা ছিপে কিছু পড়ল?"
" হ্যাঁ। ভাল একটা সিন দেখেছি।"
" কি? কি? বল আগে।"
" একদিন রাত আটটা নাগাদ ওয়াচ করতে গিয়ে দেখি পিঙ্কির পর্দা অল্প একটু সরানো। কিন্তু তাতে লাভের কিছু হল না। তেমন কিছু দেখা গেল না।"
" তাহলে কি সিন দেখলি?" সিধুখুড়োর উৎসাহ লাগামহীন।
" আরে শোন না। হঠাৎ চোখ পড়ল পাশের রুমে। পিঙ্কির দাদার রুম। পুরো জানালা খোলা। ওর বৌদি বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে মনে হল গল্প বই পড়ছে। শোয়া অবস্থায় পা দুটো উপরে তোলা। হাঁটু অব্দি শাড়ি নেমে গেছে। ফর্সা পায়ের ওই অংশ দেখতে ভালই লাগছিল। এমন সময়ে পিঙ্কির দাদা অফিস থেকে ফেরে। অফিসের জামা প্যান্ট চেঞ্জ করতে করতে নজর যায় বৌয়ের ওই শোয়া অবস্থার দিকে। তৎক্ষণাৎ ধীর পায়ে খাটের কাছে এগিয়ে যায়। বৌয়ের পায়ের দিকে হাত ঢুকিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে হাত এগিয়ে চলে। সঙ্গে সঙ্গে শাড়ি ও উঠতে থাকে। নগ্ন হতে থাকে দু পায়ের ওই অংশ। হাতের কাজ তো চলছেই। এতক্ষনে শাড়ি কোমরে উঠে গেছে। মহিলা নির্বিকার। বই পড়ায় কোন বিরতি নাই। ভদ্রলোকের হঠাৎ খেয়ালে পড়ে জানালা খোলা। উঠে এসে জানালা বন্ধ করে। "
" হ্যাঁ বুঝলাম। তোর কপাল খারাপ। ফ্রিতে লাইভ পর্ন দেখা মিস হয়ে গেল। বেটার ট্রাই নেক্সট টাইম।" এরমধ্যে অনেকেই জড় হয়ে গেছে। ছোট্টখাট্টো একটা জটলা। রবিবারের আড্ডা জমে উঠেছে।


সাত

বয়েজ হস্টেলে সুপার জোগাড় করা ইউনিভার্সিটির পক্ষে রীতিমতো কঠিন কাজ। কোনো শিক্ষকই এই কাজ করতে রাজি হন না। এর অনেক ঝামেলা। মান সম্মানের কোনো বালাই নেই। সুপারের দায়িত্ব নিতে হলে এসব জিনিস অন্য ঠিকানায় জমা করে রেখে দিয়ে আসতে হয়। সুপার জোগাড় করা সেজন্য ইউনিভার্সিটির মাথা ব্যথার কারণ। এদিকে সুপার ছাড়া হস্টেল চলা অসম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মে বিভিন্ন বিষয়ে সুপারের অনেক কাজ ও দায়িত্ব। বহু চেষ্টায় বিজ্ঞানের শিক্ষক বর্ষাস্নাত চ্যাটার্জি ( বিএসসি নামে পরিচিত) কে রাজী করান গেছে এই দায়িত্ব নিতে। 
এই বিল্ডিং এ দুটি বড় বড় রুম সুপারের জন্য বরাদ্দ। অনেক সুপার সপরিবারে থাকেন। আবার কেউ কেউ ছাত্র ঝামেলার ভয়ে একা একাই থাকেন। বিএসসি সপরিবারে থাকেন। বিশালদেহী সুবিস্তৃত টাক। হস্টেলের ছেলেদের অভিযোগ পুরো পরিবারের খাওয়া খরচ হস্টেলের ছেলেদের ঘাড় ভেঙে আদায় করা হয়। মাছ মাংস যা কিছু ভাল আগে সুপারের পরিবারের জন্য বরাদ্দ হবে। তারপর ছেলেদের কপালে জুটবে। এইসব বিভিন্ন কারণে ছেলেরা ক্ষেপে থাকে এবং কারণে অকারণে চার পাঁচ অক্ষরের গালাগালি নিক্ষেপ করে সুপার ও তার পরিবারকে উপলক্ষ করে। 
একদিন দশাসই চেহারার সুপার বিএসসি স্যার ফটিকের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন। হস্টেলের দুই ছেলে সুপারকে দেখে " ও দাদু, ও দাদু" বলে ডেকে উল্টোদিকে মুখ করে হাঁটা লাগায়। হঠাৎ শোনে পেছন থেকে সুপার ওদের দুজনকে ডাকছেন। অগত্যা আর কি করা। গুটি গুটি পায়ে সুপারের সামনে দুজনে হাজির হয়। সুপার দুজনের উদ্দেশ্যে বলেন " আচ্ছা তোরা আমায় দাদু বলে ডাকলি? " দুজনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। " আমার তো দুটো মেয়ে। একটা থাকে সোনাগাছিতে আর একটা থাকে হাড়কাটায়। তোরা এদের কার ছেলে?" এই কথা শুনে  দুজনের মুখ চোখ লাল হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ধীর পায়ে প্রস্থান করে। এইরকম ছাত্র সুপার সংঘাত মাঝেমধ্যেই লেগে থাকে। আর একদিনের ঘটনা। বিএসসি স্যার সকাল সকাল জরুরি কাজে ইউনিভার্সিটি চলে গেছেন। হস্টেলের মিলের জন্য আগে থেকে বলতে হয়। কারণ এখানে হিসেবমতো মিল রান্না হয়। সেজন্য স্যার ইউনিভার্সিটি স্টাফ খগেনকে হস্টেলে ফোন করে দুপুরের মিলের কথা জানিয়ে দিতে বলেছেন। খগেন ও ফোন করে। দিনের বেলার সিকিউরিটি গার্ড কৃষ্ণদা ফোন ধরলে স্যারের বাড়ির লোককে ডেকে দিতে বলে খগেন। কৃষ্ণদা ডাকতে যায়। এই সময় বাংলার চিন্ময় সেখানে ছিল। তার মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলে। ফোন ধরে চিন্ময় বলে " হ্যালো? কি বলছেন? " অপর প্রান্ত থেকে খগেন বলে " স্যারের দুপুরের মিল হবে। স্যার বলে দিতে বলেছেন।" এ প্রান্ত থেকে চিন্ময় বলে " হ্যাঁ। ঠিক আছে।" " আপনি স্যারের কে হন?" " বাবা।" চিন্ময়ের উত্তর। একটু পরে কৃষ্ণদা সুপারের বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। ফোন তুলে দেখে ফোন কেটে গেছে। কৃষ্ণদা চিন্ময়কে ওখানে বসে পেপার পড়তে দেখে।
এরপর ছাত্ররা যে যার ক্লাসে চলে যায়। দুপুরে সুপার হস্টেলে ফিরে দেখে তার মিল নেই। কৃষ্ণদাকে জিজ্ঞেস করে ব্যাপারটা অনুমান করতে পারে। সন্ধের পর সবাই ফেরার পর সুপারস্যার চিন্ময়কে ডেকে পাঠান। শান্ত গোবেচারা চেহারায় চিন্ময় হাজির হয় সুপারের কোয়ার্টারে। স্যার ভেতরে ডেকে বসান। সুপারস্যার স্ত্রীকে অন্য রুম থেকে ডেকে আনেন। চিন্ময়কে দেখিয়ে বলেন " দেখ তোমার শ্বশুর মশাইকে। তোমার এই শ্বশুর মশাইের জন্য আমার দুপুরে খাওয়ার জোটে নি।" এরপর মাথা নিচু করে চিন্ময় সুপারের রুম থেকে বেরিয়ে যায়। 


আট

আজ হস্টেলে হৈচৈতে টেকা দায়। এই হৈচৈর কারণ ত্রিপুরার কিরণের একটি চিঠি। এই চিঠিটি লিখেছেন কিরণের এক মামা। স্বল্প শিক্ষিত মামা তার উচ্চ শিক্ষার্থী ভাগ্নেকে বড় ভালবাসেন। মামা ভাগ্নেকে চিঠি লিখেছেন তাতে এত হৈচৈর কি আছে? প্রত্যেকেই কিন্তু সেই চিঠি দেখার পর হৈচৈতে সামিল হচ্ছে। কে আর কাকে সামাল দেয়। কাউকে জিজ্ঞেস করলেই সে ও হেসে লুটোপুটি খায়। কারন কেউ বলতে চাইছে না। অবশেষে কারণটা জানা গেল। মামা গোটা চিঠিটাই বাংলায় লিখেছেন। কিন্তু ভাগ্নেকে সম্বোধনটা করেছেন ' মাই ডিয়ার ভাগিনা ' বলে। এবং এই সম্বোধন ইংরেজি লেটারে লেখা। আসলে গন্ডগোলটা হয়ে গেছে ভাগিনা লেখাতে। ইংরেজিতে লেখা  'Vag.. na' ই হল হৈচৈর মূল রহস্য। এই হৈচৈ থামতে না থামতে সবাই আবার শিলিগুড়ির আজানুলম্বিত সৌম্যসুন্দর ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র অন্যমনকে নিয়ে পড়ে। অন্যমন শিলিগুড়ির ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। রূপগুনের সঙ্গে আচার ব্যবহারে ও পারফেক্টলি জেন্টলম্যান। ওর ক্লাসের ভাস্বতী ও তাই। রূপে গুনে জুড়ি মেলা ভার। ক্লাসের সবাই প্রচারে এমনই হাওয়া তুলে দিয়েছে এরা দুজনে যেন 'মেড ফর ইচ আদার'। এই প্রচারে এরা দুজন ও মানসিকভাবে পরস্পরের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। একদিন আশুতোষ বিল্ডিংএর চারতলার ক্লাসে ভাস্বতী অন্যমনের ঠিক পেছনে বসেছিল। পেন দিয়ে অন্যমনের টিশার্টের পেছনে '420' লিখে দেয়। হঠাৎ এক বন্ধুর চোখে পড়ে। সবাই মিলে অন্যমনকে আওয়াজ দিতে শুরু করে। এক ক্লাসমেট প্রবীর বলে " নিশ্চয়ই ভাস্বতী লিখেছে। ওই তো আজ তোর ঠিক পেছনে বসেছিল। তুই ওকে জিজ্ঞেস কর।" স্বভাবে লাজুক অন্যমন কোনমতেই ভাস্বতীকে জিজ্ঞেস করতে চায় না। বন্ধুদের প্ররোচনায় অগত্যা ভাস্বতী জিজ্ঞেস করে " ভাস্বতী তুই কি আমার টিশার্টে লিখছিস?" প্রথমে ভাস্বতী মুচকি মুচকি হাসে। একসময় বলে " ফোর টোয়েন্টিকে ফোর টোয়েন্টি বলবো না তো কি বলবো?" বলেই হাসতে হাসতে কোন পাত্তা না দিয়ে চলে যায়। অন্যমন কিছুটা গুমরে মরে। বন্ধুদের ইন্টিগেশনে প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে ওঠে অন্যমনের মনে। অপেক্ষায় থাকে। একদিন সুযোগ এসে গেল। আজ অন্যমন ক্লাসে ভাস্বতীর ঠিক পেছনে বসেছে। ম্যডাম ক্লাস নিচ্ছিলেন। ভাস্বতীর ভরা যৌবন রূপরেখা বেষ্টনী অন্তর্বাস তার অফহোয়াইট ব্লাউজের মধ্য দিয়ে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। অন্যমন ভাস্বতীর ব্রার ঠিক ওপরে ব্লাউজে পেন দিয়ে লিখে দেয় '420'। ঠিক যেমনটি ভাস্বতী লিখেছিল। ওইদিন ভাস্বতী কিছু বুঝতে পারে নি। পরদিন বাড়িতে জামা কাপড় পরিষ্কারের সময় ভাস্বতীর বৌদির নজরে আসে  ব্যাপারটা। তা থেকে বাড়ির গুঞ্জন। এরপর বহুদিন ভাস্বতী অন্যমনের সাথে কথা বলেনি। 


নয়

ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। নতুন ছাত্ররাও এসে গেছে। হস্টেলের নিয়ম নতুনদের জায়গা করে দিতে হয়। পুরোনোরা ফাইনাল পরীক্ষার একমাসের মধ্যে হস্টেল ছেড়ে দেয়। অনেকেই নিজেদের বাড়ি ফিরে যায়। অনেকে আবার মেস ভাড়া নিয়ে বা বাড়ি ভাড়া নিয়ে বন্ধুরা মিলে মেস বানিয়ে থাকে। বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়। নিজেদের তৈরি করে। এই ট্রানজিসন পিরিয়ডের সময় একদিন খাওয়ার টেবিলে সিধুখুড়ো,  সুধা, কিরণ ও অন্যান্যরা মিলে কালিদাকে ( কালিদা হস্টেলের কুক) বলে " কালিদা, এতদিন হস্টেলে রইলাম। মনে কি হয় না ছেলেগুলোকে একটু ভাল করে রান্না করে খাওয়াই? কতদিন আমরা সবাই ঘর ছাড়া! সেই তোমার ' রাম তেরি গঙ্গা মৈলি' ডাল। আর 'থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোড়'। এর বাইরে গ্রান্ট ফিস্টটায় একটু বৈচিত্র্য। এছাড়া তো আর কিছু নেই। তোমার কি পাপের ভয়ও নেই?" 
" ঠিক আছে বাবু, কি খাইতে আপনাদের ইচ্ছা? বলুন। আমি তৈরি করিয়া দুব। আপনাদের কুছু খরচ দিতে হবে নি। খায়া ভাল লাগলে তখন মনে করলে দিবেন।" কালিদার উত্তর ( কালিদা উড়িষ্যা সংলগ্ন অঞ্চলের মেদিনীপুরবাসী)। 
" তুমি শুঁটকি মাছ রান্না করতে পারবা?" কিরণের জিজ্ঞাসা।
" অনেকদিন কচ্ছপ খাওয়া হয় নি। কালিদা তুমি পারবে?" সিধুখুড়োর অনুসন্ধিৎসা।
" ঠিক আছে। তাউ হবে। কবি খাবেন বলুন? তবি হবে।"
এরপর পরপর দুই রাত্রি ডিনারে একদিন শুঁটকি মাছ হোল। যারা এটা খায়না তাদের জন্য অন্য ব্যবস্থা রইল। অন্যদিন কচ্ছপ মাংস। মশলাপাতি থেকে সব জোগাড় ও রান্না কালিদা নিজের দায়িত্বে সামলালেন। ভোজনরসিকদের দুই দিনই খাওয়ার পর ' অঙ্গুলি চাটতে রহ যাওগে' অবস্থা। সেই স্বাদ স্বাদকোরক এখনো বিস্মৃত হয় নাই। 
পুরোনোরা সবাই হস্টেল ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছে। কলকাতায় যারা থাকে কখনও কখনও তাদের কেউ কেউ কোনো কাজে হস্টেলে মাঝেমধ্যে আসে। রান্নার স্টাফদের সঙ্গে, সিকিউরিটি দাদাদের সঙ্গে গল্প করে, আড্ডা দেয়। অনেকের চিঠিপত্র এলে সেগুলো নেয়। ধীরে ধীরে সেই আসাও কমে যায়। 
এখন হস্টেলবাসী অনেকেই চাকরি পেয়ে গেছে। কেউ অফিসার, কেউ প্রফেসর, কেউ আবার স্কুল শিক্ষক। কেউ পুলিশে, কেউ সায়েনটিস্ট। কেউ পৈতৃক ব্যবসায়ী। কেউ বা সেল্ফ এমপ্লয়েড। প্রথম প্রথম যোগাযোগ ভালই ছিল। পরে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়। আজ হস্টেলের সেই রঙিন দিনগুলি কেবলই স্মৃতি...।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন