আবহমান
-উচ্চমাধ্যমিক তো হয়ে গেলো। এবার নিশ্চই গ্রাজুয়েশন করবি। বি.এ.সি অনার্স কর। ভবিষ্যতে অনেক পথ পাবি চাকরি করার জন্য।(একটু ভেবে নিয়ে) অবশ্য তোর যা পড়াশুনার হাল পাশ করতে পারিস কি না দেখ! আর যদিও বা করিস ওই লাস্ট ডিভিশন ই পাবি। ওই নাম্বার এ কোন কলেজেই বা আর নেবে! যখন পড়তে বলেছিলাম তখন তো তোমার অন্যদিকে মন , এখন আর কি করার। আমাকে বসে বসে দেখতে হবে আমার ছেলে উচ্চমাধ্যমিক ফেল। হা.....
টেবিলের উল্টোদিকে বসে চুপ করে বাবার কথা গুলো শুনছিল বুবাই।
না তার উচ্চমাধ্যমিক এর ফল এখনও প্রকাশিত হয় নি। গত পরশু সে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেছে। এখনই বাবার কাছ থেকে তাকে এসব শুনতে হচ্ছে। অবস্য সে জানতো এরকমই হবে। এটা নতুন কিছু নয়। মাধ্যমিক এর সময় ও একই ঘটনা। যদিও বা সে ফেল করেনি। খুব একটা ভালো ফল না করলেও ফার্স্ট-ডিভিশন এ পাশ করে একটা ভালো স্কুল এ সায়েন্স নিয়ে ভরতি হয়েছিল।তার কোনও দিন ই সায়েন্স পড়ার ইচ্ছা ছিল না।
বুবাই বাংলা বা সাহিত্য কে খুব ভালোবাসে , তার লেখাও অসাধারন। কয়েকটা কবিতা এর মধ্যেই একটা পেপারে বেরিয়েছে। কিন্তু তার বাবার মত ,"ছেলে হয়ে আবার কবি-সাহিত্যিক। লজ্জা করে না। এই সব কবিতা ভবিষ্যতে খাবার এর সন্ধান দেবে তো ?"
বুবাই এর বাবার ইচ্ছা ছেলে সায়েন্স নিয়ে পড়বে। বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে। সবাই বলবে দিলীপ বাবুর ছেলে মস্ত বড় ইঞ্জিনিয়ার। দিলীপ বাবু একটা নামি কলেজের অঙ্কের প্রফেসার ,আর সেখানে তার ছেলে কিনা একজন সাহিত্যিক! সে কোনও দিনই এটা মেনে নিতে পারে নি।
তাই বুবাই কে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবার ইচ্ছায় এবং মার অনুরোধে এই সায়েন্স পড়তে হয়েছিল।
কিন্তু আর নয় সে এবার ঠিক করেই রেখেছে , গ্রাজুয়েশন সে রবীন্দভারতী উনিভার্সিটি থেকে সাহিত্য নিয়েই করবে।
যথারিতি উচ্চমাধ্যমিক এর ফল প্রকাশিত হলো। সায়েন্স এর কোনো সাব্জেক্ট এ লেটার না পেলেও সে বাংলা তে লেটার পেয়েছে।
-ছিঃ! এই তোর রেজাল্টের অবস্থা। সায়েন্স নিয়ে পড়ে উনি বাংলাতে লেটার পেয়ে বসে আছেন। ছিঃ! আমি এখন সবাইকে কি বলব! আমার ছেলে এই রেজাল্ট করেছে! লোক কে মুখ দেখানোর উপায় রাখলি না। আর বি.এ.সি অনার্স করতে হবে , করো গিয়ে ওই সাহিত্য নিয়ে....
বাবাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বুবাই বলে উঠল
-হ্যাঁ , আমি সাহিত্য নিয়েই পড়াশুনা করতে চাই বাবা। আমি এতদিন তোমাদের কথামতো চলেছি। ছোট থেকে তোমাদের ইচ্ছামতো পড়াশুনা করেছি। মাধ্যমিক এর পড় যখন নিজের ইচ্ছামতো পড়তে চাইলাম তাও দিলে না। শুধুমাত্র লোকে কি বলবে আর তোমার সন্মান নষ্ট হবে বলে! আর আমার ইচ্ছা , সেটার কোন দাম নেই?
-ইচ্ছা! কি বুঝিস তুই এইটুকু বয়সে ইচ্ছার ব্যপারে? এই সাহিত্য ভবিষ্যতে খেতে দেবে না। ছেলে হয়ে যদি রোজগার করতে না পারো ..কেউ খাওয়াবে না। এই সব সাহিত্য বাদ দিয়ে যা রেজাল্ট করেছিস সেই মতো দেখ কোন কলেজে ভর্তি নেয়।
-বাবা। আমি সাহিত্য নিয়েই পড়াশুনা করব। রবীন্দ্রভারতী তে আমি ফর্ম ফিল-আপ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।
-কি? এতবর কথা। এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওসব করবি।
সত্যি সেই নববর্ষের ভোরে সে বাড়ি ছেরেছিল। ভেবেছিল একটা নতুন ভোর নতুন বছর সে ঠিক পাড়বে।
তারপর তো কত বাধা , কত না পাওয়া , কতদিন না খেয়ে থাকা , সব গিয়ে আজ .......
-স্যার।
-.......
-স্যার , স্যার?
(হঠাৎ করে বুবাই অর্থাৎ অনির্বাণ রায় এর ভাবনার জগতে ব্যাঘাত করে ডেকে ওঠে একজন)
-হ্যাঁ!কে?
-স্যার আমি ভূবন।(ভূবন হল তার একমাত্র সঙ্গি। একই বাড়িতে থাকে। বুবাই এর সব দেখভাল করে।)
-ও। হ্যাঁ বলো।
-স্যার কাল তো আপনার ন্যাশানাল অ্যওয়ার্ড এর দিন। যাবেন না ?
-ও হ্যাঁ। কখন যেনো ?
-এই তো স্যর বিকেল ৫টায় ফ্লাইট। এখন ২টো বাজে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিন। এয়ারপোর্ট যেতে এবং চেকিং এর জন্য তো ৩ঘন্টা সময় হাতে নিয়ে যেতে হবে।
-আচ্ছা।
আজ সে কলকাতার সবথেকে নামকরা একজন সাহিত্যিক। মোটামোটু সবার মুখেই অনির্বাণ রায় নামটা ঘুরে বেরায়। স্কুলের পাঠ্য বইতেও তার কবিতা পড়ানো হয়।তার লেখা উপন্যাস, "জীবনের প্রবাহমানতা" কাল দিল্লিতে ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছে। আজ সে সত্যি খুব খুশি।
তার এখন কোনকিছুর ই অভাব নেই। টাকা-পয়সা ,গাড়ি-বাড়ি ,প্রতিপত্তি ,সন্মান সবই আছে। শুধু মা-বাবা....
-ভূবন।
-হ্যাঁ স্যার
-চলো।
-হ্যাঁ চলুন।
গাড়িতে যেতে যেতে বুবাই এর ফোন এ একটা নাম্বার থেকে ফোন আসে। বুবাই মনে মনে ভাবে নিশ্চই শুভেচ্ছা জানানোর জন্য কোন মিডিয়া থেকে ফোন করেছে। তাই সে ফোনটা কটে দেয়।
কিং ,কিং ,কিং......
আবারও সেই একই নাম্বার থেকে ফোন।
-উফ! ফোনটা কেটে দিচ্ছি তবুও বার বার ফোন করছে।
বিরক্তি ভাব টা নিয়েই সে এবার ফোনটা ধরল।
-হ্যালো! কে বলছেন?
-বুবাই?
হঠাৎ করে এই নামটা শুনে একটু চমকে গেলো সে। সাহিত্য জগতে তো এই নামে তাকে কেউ চেনে না। তাহলে... গলাটাও যেন কেমন চেনা চেনা লাগছে।
-কে বলছেন? আ..প..নি , আপনি আমার এই নাম জানলেন কি করে?
-আমি দিলীপ রায় বলছি।
বুবাই সত্যি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যি তার বাবা ফোন করেছে তাকে!
-হ্যাঁ বলো। কেমন আছো তোমরা?
-তুই কেমন আছিস বাবা?
-আমি ভালোই আছি। তা এতদিন বাদে আমায় ফোন করলে? কোন দরকার!
-কোন বাবা কি সন্তান কে দরকারে ফোন করে? এমনিই করলাম ।
-ও আচ্ছা। তা বলো কি বলবে।
-অনেক শুভেচ্ছা তোকে আমার তরফ থেকে। কাল তো ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড এর দিন।
-হ্যাঁ ওখানেই যাচ্ছি। এয়ারপোর্ট এর দিকে রওনা দিলাম এই।
-আচ্ছা। জানিস তো বাবা আমি তোর সব লেখা পড়ি। সত্যি খুব ভালো লিখিস তুই। তোর মাও পড়ে।(একটু খন চুপ থেকে সে আবার বলে)আমি ভুল ছিলাম রে বাবা। তোকে আটকে এবং সেদিন তোর সাথে যোগাযোগ না করে আমি সত্যি ভুল করেছি। তো..র তোর এই কটা বছর খুব কষ্ট করে কেটেছে না রে বাবা! আমায় ক্ষমা করে দিস বাবা।
-আর কিছু বলবে!
-বলছি যে বাবা দুদিন বাদে তো নববর্ষ। আসবি একবার। কতদিন দেখি না তোকে।
-না বাবা। আমার সময় হবে না গো। তোমরা ভালো থেকো বাবা।
-একবার যে তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে বাবা!
-ওই যে টিভি তে দেখাবে আমায়। সেখানেই না হয় দেখে নিয়।
এই বলে সে ফোনটা কেটে দিল। ফোনে কথপকথন রত দুজন ব্যক্তির ই চোখে জল তখন।
কাল আবারও একটা নতুন ভোর নতুন বছর এর সূচনা হবে। কেউ আবারও কিছু হারাবে আবার কেউ তার হারানো জিনিস ফিরে পাবে।
ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন