অনুপম অধিকারী-র  





দুর্গাপুজার আবাহনী ও মাহাত্ম্য

শরৎকাল। বিশ্বজননীর পুজার সময়কাল। নদী, পুকুর কানায় কানায় ভরা। চারিদিক শ্যামলে শ্যামল। ঢেউ খেলানো ধানের খেতে রৌদ্রছায়ার খেলা। কাশের বনে হাওয়ার তালে তালে যেন সহস্র চামড় দোলানোর প্রতিচ্ছবি। নীল আকাশের কোলে সাদা মেঘের বৈজয়ন্তী তারার হাট বসেছে শুনো। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে টুপটুপ শিউলি পড়ছে। জলে পদ্ম, স্থলে পদ্ম। রূপে 'পূর্ণ সবদিক 'পূর্ণম অদঃ পূর্ণ মিদম।'

শরতে সবুজের প্রাচুর্য নবপত্রিকার পক্ষে ভারি অনুকূল। নয়টি গাছ দিয়ে এর রচনা। প্রথমটি বস্তা অর্থাৎ কলাগাছ। সঙ্গে আরও আটটি গাছ। সাদা অপরাজিতা লতা জড়িয়ে শাড়ি পরিয়ে কলাগাছের মাঝের ডগাটির মাথায় সিঁদুর দিয়ে দেবীর ডানদিকে গনেশের পাশে একে রাখা হয় আল্পনা দেওয়া পিঁড়ির উপর। চলতি কথায় কলাবৌ। দেবীর এক এক রূপে প্রকাশের এক একটি নাম। তাঁর ব্রহ্মানী রূপটি বস্তায় অধিষ্ঠিত। কচুগাছে কালিকা, হলুদ গাছে দুর্গা, জয়ন্তী গাছে কার্তিকী, বেলগাছে শিবা, ডালিমগাছে রক্তদন্তিকা, অশোকগাছে শোকরহিতা, মান গাছে চামুন্ডা, ধানগাছে লক্ষ্মী। প্রত্যেকটি গাছের পৃথক পৃথক পুজা হয় এবং শেষে একসঙ্গে 'নবপত্রিকাবাসিনে দুর্গাঁয়ে নমঃ' মন্ত্রে নবপত্রিকার পূজা হয়। দুর্গাপুজায় রাজকীয়তা ও নিয়মকানুন বিশাল। দেবীর মাহাত্ম্যের জন্য একটি নয় তিনটি প্রসিদ্ধ পুরানে এই পুজার পদ্ধতি লিপিবদ্ধ। সেগুলি হল দেবীপুরান, কালিকাপুরান এবং বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরান। দুর্গার বিরাট রূপও আকর্ষনীয় ও রাজরাজেশ্বরী। দশটি হাত, বাহন সিংহ, পায়ের তলায় ত্রিভুবনজয়ী অসুর শূলাগ্রবিক্ষত মূর্তিতে। তিনি মহাদেবী। 'ত্বং হি দুর্গা দশগ্রহরনধারিনী' মহামন্ত্রে তাঁকে জাগ্রত করে অসময়ের এই পুজাই পরবর্তীকালে শ্রেষ্ঠ উৎসবে পরিণত হয়েছে।

দুর্গাপুজা চারদিনের। ষষ্ঠীতে মায়ের বোধন। বোধন মানে ঘুম ভাঙানো। শ্রাবন থেকে পৌষ পর্যন্ত ছয় মাস ‘দক্ষিনায়ন’ তখন সূর্যকে দক্ষিণে সরে যেতে দেখা যায়। এই সময়টা দেবতাদের রাত্রি। দেবতারা ঘুমোন। শারদীয়া দুর্গাপুজা হয় আশ্বিনে বা কার্তিকে। দক্ষিনায়ন চলে তখন। তাই দেবীকে জাগিয়ে তুলতে হয়। শাস্ত্র একেই বলেছেন বোধন। এরপর হয় আমন্ত্রন ও অধিবাস। পুরোহিত বোধনের সময় মাকে জাগিয়ে বলেন -আশ্বিনের ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় তোমায় জাগিয়ে তুলছি যেমন রামচন্দ্রের প্রতি অনুগ্রহ করে অকালে ব্রহ্মা তোমার বোধন করেছিলেন। 'আয়াহি দেবী' অর্থাৎ তুমি এসো। বোধনে জেগে উঠলেন দেবী। কিন্তু জাগলেই তো হল না। পুজো নেওয়ার জন্য ভক্তির নৈবেদ্য দিয়ে তাঁকে আহ্বান জানানো হবে। এরই নাম আমন্ত্রণ। আমন্ত্রণের পরই হবে অধিবাস। মাটি, চন্দন ইত্যাদি বাইশটি জিনিস দিয়ে তৈরি প্রশস্তিপাত্র। বাংলায় একে বলে বরন ডালা।

ষষ্ঠীর পর সপ্তমীর পুজোও মায়ের আবাহনী বা আমন্ত্রনের জন্য। তবে অষ্টমী ও নবমীর পুজোর খুবই মাহাত্ম। তাই কালিকাপুরান এদের আগে 'মহা' বিশেষন দিয়েছেন। আবার অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষনে হয় সন্ধিপুজো। অষ্টমীর শেষ চব্বিশ মিনিট এবং নবমীর প্রথম চব্বিশ মিনিট সন্ধিপুুজোর মাহেন্দ্রক্ষন। অনেকে বলেন হিন্দুরা পৌত্তলিক পুতুল পুজো করে। আমরা বলি আমরা দুর্বা, আতপচাল, ফুল, চন্দন দিয়ে বোধন আমন্ত্রণ অধিবাস করে মূর্তিতে প্রাণ সঞ্চার করি। পুষ্পাঞ্জলি দিই, অর্ঘ্য দিই, নৈবেদ্য দিই। পুজার মঞ্চে মৃন্ময়ী মা হয়ে ওঠেন চিন্ময়ী। লক্ষ্যনীয় এটাই যে মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর অনধিকারী কেউ দেবীকে ছোঁবে না। তাঁকে একটুও নাড়ানো যাবে না। আবার পুজো সাঙ্গ হয়ে গেলে যেই পুরোহিত ঘট এবং প্রতিমা নেড়ে দেবেন সঙ্গে সঙ্গে দেবতা অন্তর্হিত হবেন মূর্তি থেকে আর তার পুজো হবে না। তাকে সবাই স্পর্শ করবে, প্রতিমা ভাসিয়ে দেওয়া হবে জলে। দুর্গাপুজায় এত প্রাণ সঞ্চারিত হয় বলেই সপ্তমীতে যেমন আনন্দের বান শুরু হয় বিজয়া দশমীতে সবার চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। কিন্তু শাস্ত্রের এমন মহিমা আমরা দুর্গাপুজো করি দশপ্রহরনধারিনী মাকে মেয়ে রূপে, ঘরের কন্যা রূপে অথবা নিজের মা রূপে তাই আমরা তাঁকে বিদায় জানাই আবার আসতে বলি, আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রতিমা বিসর্জনের পর মাথায় হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে বলি। ‘পুনরাগমনায় চ’ অর্থাৎ আবার এসো মা, আবার, বারবার। তাই দুর্গাপুজোয় বিসর্জনের পর এই আমন্ত্রণই পরের বছর বোধনের মন্ত্র। 

বিসর্জনের পর শুরু হয়ে যায় পরের বছরের প্রতীক্ষা আর প্রহরগোনা। এটাই শারদোৎসবের মাহাত্ম্য।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন