দেবানন্দ ভট্টাচার্য-এর কবিতা







অস্পষ্ট কে একজন

অলকানন্দার তিন তলার বারান্দায় 
সারা রাত হালকা নীলবাতি জ্বলে থাকে।
নীলাভ আবহ ঘিরে অলৌকিক অন্ধকারের
আশ্চর্য সমন্বয়.....মায়া বিস্তার!

ঠিক স্পষ্ট নয়, কে যেন একজন মধ্যযামে
রোজ দাঁড়িয়ে থাকেন! তিনিও কি আমারই
মতো রাতজাগা রোগে ভুগছেন?

আকাশের চন্দন ফোঁটা ঝিকিমিকি তারা
নেমে আসে অলকানন্দার নীল বারান্দায়।

তারপর এলোমেলো কী যে সব হয়ে যায়---
তা জেনেছে শুধু রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত
যক্ষ----তাছাড়া এরকম, আর কেউ নয়।
            


মৃত দানসামগ্রী

সাধারণত আমি কোন শোকসভায়
থাকি না।বড্ড বেশি সাজানো গোছানো।
মার্জনা করবেন, কথাটা না বলে পারছি না-----
এরকম সভায় মালায় মোড়া প্রয়াতর ছবি থাকে
ধূপ জ্বলে। মঞ্চে মানানসই মৃদু আলো। নির্বাচিত
রবীন্দ্রসঙ্গীত। সবই আছে। নেই শুধু শোক।
স্মৃতিচারণে অনেকেই মিথ্যা বলেন। সুযোগ
বুঝে  নিজের কথা বেশি বলে ফেলেন।
মালায় মোড়া প্রয়াতর ছবি মূক ও বধির।

অদিতিকে বলে রেখেছি, আমার মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধ
বা শোকসভা যেন না হয়। মরদেহ ফুল মালা ধূপ
গীতা নামাবলিতে  সাজানো চলবে না
চিতা চুল্লি বাদ।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্বার্থে আমার দেহ যেন
দানসামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হয়। অথবা
এই অধমের কঙ্কালচূর্ণ জনকল্যাণে

বিস্ফোরক হিসেবে কাজে লাগুক।
            


এ কেমন তুই

ডান দিকে রুখা শুখা খেত
বাঁদিকের নদীটাও মজা
খরাপোড়া মাটি ফুটিফাটা
ধারে কাছে গাছপালা নেই।
কেন এই নির্বাসনে অযথা পাঠালে?

আমি কি এমনই আসামি?

রংতুলি ক্যানভাস দাও
ছবি এঁকে দেখাব এখনই

পয়মন্ত নদী। শান্তশ্রী ছায়াপথ। 
প্রশান্তসাগর।

এ কেমন বেরসিক তুমি! ডেকে যাই
সাড়াশব্দ নেই। ছত্রভঙ্গ যত কাক
চেঁচিয়ে অস্থির। 
যদি সন্ধ্যা নেমে আসে----

খানিকটা অন্ধকার চাই।

         

নিষ্ঠুর হতে চেয়েছিলাম

বাজি ধরে ওই শয়তান লোকটা
বাদামি-হলুদ নকশাকাটা 
তরতাজা এক মনোরম প্রজাপতিকে

চিবিয়ে খেয়ে ফেললো।

কেউ কেউ হায় হায় করলো বটে, তবে
অধিকাংশই হাত তালি দিয়েছিল।

বাজি জিতে কী জান্তব উল্লাস!

আরো একটা কথা। সেই প্রথম  আমিও
ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর হতে চেয়েছিলাম।
পিশাচটাকে খুন করতে ইচ্ছে হচ্ছিল।

এ যাবৎ ওই সাংঘাতিক দৃশ্য এবং
কষ্টের কথাটা বলতে পারি নি।
আজ সম্ভব হল। তবে এরকম অনেক
নরম সুন্দর প্রতিদিনই

দাঁতে নখে থেঁতলে যাচ্ছে। নীরবে দেখছি
কিন্তু পুড়ছি না। জ্বলে উঠছি না!

           

আবার সুবর্ণরেখা

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার আগে আরো
একবার ভাবা দরকার----খাদের
কিনারে দাঁড়াবে কিনা।

খাদ---গভীর অন্ধকার। বয়সে প্রাচীন
পাথরের চিহ্ন পড়ে বেশ বোঝা যায়
নিপুণ গাছপালা ঝোপঝাড়ে বোনা।

নিঃশব্দ বিপদ সংকেত। 
তুলনামূলক কম বেশি কিছু  কি
জানা যেতে পারে?

যেমন নদীতে নামার আগে অন্তত
একবার ভেবে দেখ----ভাসবে কিনা।

খাদের অন্ধকার..... তার চেয়ে
মরমিয়া নদী : ভালো নয় কি! এবং 
সে যদি অনিবার্য সুবর্ণরেখা হয়!
               

সবজে ফড়িং

আমার বাগানে
তিনটে প্রজাপতি বেড়াতে এসেছিল।
শিউলিফোটা দেখে চন্দ্র মল্লিকারা
ঘর গোছানো শুরু করেছে।

আজ বৃষ্টি আসে নি। বড্ড গরম।
আকাশে খানকয়েক ঘুড়ি 
আপন মনে চরকি কাটছে। চিল
উড়ছে মেঘ ছুঁই ছুঁই দূরত্বে।

এমন দিনে পুরনো চাতালে
জলছাপ পা। সে নয় তো?----আমার
কবিতায় ছত্রে ছত্রে চোখ বুলিয়ে যায়
হতেও পারে। না-ও হতে পারে। তবে

কোন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বাগানে নবাগতদের সংখ্যা বেড়ে গেল
এবার সবজে ফড়িং কয়েক জোড়া।
সচিত্র সংবাদে জানা গেল :
রোদ কখনো পুরানো বা বাসি হয় না। 
               


1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন