রাজর্ষি মাইতি-র  না



অ্যাকোরিয়াম

চরিত্র:-{ড. সেন, রেখা (ড. সেনের স্ত্রী), অভি (ড. সেনের ছেলে), মনামী (অভির স্ত্রী), রায়বাবু (ড. সেনের প্রতিবেশী), বিনয় (ড. সেনের চেম্বার অ্যাটেনডেন্ট)}


(সময় সকাল ৮টা)

রায়বাবু: [দু-বার কলিংবেল বাজিয়ে] ডাক্তারবাবু বাড়িতে আছেন নাকি? ডাক্তারবাবু... ও ডাক্তারবাবু...

রেখা: (ডাইনিং টেবিলে শব্দ করে চায়ের কাপটা রেখে) এত সকালে আবার কে চিৎকার শুরু করেছে একটু দেখো না। তোমাকেই তো ডাকছে মনে হল।

ড.সেন: দেখছ তো আমি খবরের কাগজটা দেখছি, তুমি কী এমন ব্যস্ত। একটু বারান্দায় গিয়ে দেখলেই তো পারো।

রেখা:(মুখের অবয়ব বিকৃত করে) এ্যাঁ... খবরের কাগজ দেখছি। সারা জীবন তো কতকিছুই পড়লে! তা ডাক্তারি ছাড়া আর কোন কাজটা পারলে? আর তাছাড়া আমি ব্লাউজ পরে নেই, বাইরে বেরোতে পারব না।

ড.সেন: সারারাত তো এসি চলল, তাও তোমার কী করে এত গরম লাগে বুঝি না বাবা!

রেখা: তা তুমি আর বুঝবে কী করে? সন্ধেবেলা থেকে প্রথমে তোমাদের টিফিন তারপর একেক জনের পছন্দমতো রান্না শেষ করে যখন নিস্তার পাই তখন গায়ের সাথে কাপড় সেঁটে যায়।

রায়বাবু: (আবার দু-তিনবার কলিং বেল বাজিয়ে) ডাক্তারবাবু, ও ডাক্তারবাবু বাড়িতে আছেন?

ড.সেন: (বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে) কে ডাকছেন? কী চাই?

রায়বাবু: সুপ্রভাত ডাক্তারবাবু। সকালবেলায় আপনাকে একটু বিরক্ত করলাম।

রেখা: (ডাইনিং থেকে) তা জানেন যখন বিরক্ত করছেন তখন তো না ডাকলেই পারতেন।

ড.সেন: একটু আস্তে কথা বলো, লোকে শুনতে পাবে তো!

রায়বাবু: আপনি উপরে, আর আমি গেটের এপারে, আস্তে বললে আপনি শুনবেন কেমন করে?

ড.সেন: না, না, আপনাকে বলছি না। আপনি বলুন কী দরকার?

রেখা: আদিখ্যেতা দেখলে সকালবেলায় গা জ্বলে যায়।

ড.সেন: তুমি থামবে? চুপ থাকতে পারো না!

রায়বাবু: ও ডাক্তারবাবু, আপনার কি শরীর খারাপ? একবার জানতে চাইছেন কেন এসেছি আবার এখন বলছেন চুপ থাকতে। কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

ড.সেন: আরে বাবা আপনাকে বলছি না। আাপনি বলুন না কী জন্য এসেছেন?

রেখা: কী জন্য আবার? হয় জ্বর, নয়তো পেট খারাপ। যাও ওই জল মেশানো ওষুধ দিয়ে এসো আর পঞ্চাশটা টাকা হাতিয়ে নাও।

ড.সেন: আর একটাও কথা যেন শুনতে না পাই।

রায়বাবু:(ভয় পেয়ে) তাহলে এখন যাই।

ড.সেন: কেন এসেছিলেন বললেন না তো!

রায়বাবু: (তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে) না থাক। আমি পরে চেম্বারে আসব, তখন না হয় বলব।

ড.সেন: (বারান্দা থেকে ডাইনিং-এ আসতে আসতে) শোনো রেখা তোমার অত্যাচারে না আমি পাগল হয়ে যাই। দেখো একদিন এই ঘর ছেড়ে আমাকে পালাতে হবে। সকাল সকাল একটা রুগী বাড়ি বয়ে এসেছিল, সেও ভয়ে পালাল।

রেখা: তা আমি বাঘ না ভাল্লুক যে আমার ভয়ে পালাতে হবে?

ড.সেন: আর কথা বাড়িয়ো না। জলখাবার রেডি করো। আমি তৈরি হয়ে আসছি।

রেখা: তা বাজার কে যাবে শুনি! মাছ না হলে তো আবার ভাত খেতে পারো না।

ড.সেন: আচ্ছা তোমার ছেলের তো একমাত্র কাজ ঘুম, তাকেও তো একটু বাজারে পাঠালে পারো নাকি! এভাবে বসে বসে খেলে তো একদিন সুমো পালোয়ানের দলে নাম লেখাতে হবে।

রেখা: তুমি তাড়াতাড়ি জলখাবার খেয়ে চেম্বারে যাও তো দেখি। তোমাকে আর ছেলের শরীরে নজর দিতে হবে না। বাপ হয়ে কী করে যে ছেলের দিকে এমন কুনজর দাও বুঝি না বাবা।

ড.সেন: এমনি এমনি দিই না। বুঝবে, সবাই বুঝবে। শুধু আমায় মরতে দাও, তারপর সব বুঝবে পায়ের উপর পা তুলে খেলে কী হয় আর কী হয় না।


(ড. সেনের চেম্বার)

বিনয়: স্যার, একটা পেশেন্ট আছে, ভিতরে পাঠাব?

ড.সেন: পাঠাও, পাঠাও।

রায়বাবু: ডাক্তারবাবু আসছি। এখন কেমন আছেন?

ড.সেন: কেন, আমি খারাপ ছিলাম নাকি!

রায়বাবু: না মানে, সকালে কীসব বলছিলেন তো তাই।

ড.সেন: ও আচ্ছা। আপনিই সকালে বাড়ি গিয়েছিলেন? তা বলুন কী দরকার! আমি খুব লজ্জিত, কিছু মনে করবেন না। আসলে সকালবেলায় আমার খবরের কাগজ পড়া না হলে কেমন যেন অস্বস্তি হয় সারাদিন। তারপর জানেনই তো মধ্যবিত্তের সংসারে সারাদিনই অশান্তির আগুন জ্বলে। বলুন কী বলবেন।

রায়বাবু: আসলে সংসারের সমস্যায় একটা গণতান্ত্রিক ব্যাপার আছে। অন্তত আমার তাই মনে হয়। যেমন ধরুন আপনি সারাদিন চেম্বারে বসে নাড়ি টিপে আয় করে যে সংসার টানছেন, সেখানেই আপনার স্ত্রী, পুত্র, বউমাও মতদানের বিষয়ে আপনার সমকক্ষ হয়ে উঠেছন। মানে উপার্জনকারী কেবল আপনি হলেও মতদানকারী কিন্তু সবাই। কেমন গণতান্ত্রিকতার গন্ধ মিশে আছে ভাবুন।

ড.সেন: ঠিক বলেছেন দাদা। সত্যি আপনার সাথে গল্প করে বেশ ভালো লাগছে একন।

রায়বাবু: দেখলেন তো! আমি ঠিকই জিজ্ঞেস করেছিলাম এখন কেমন আছেন? আপনি রাগ করছিলেন।

ড.সেন: আচ্ছা, এখন বলুন কী সমস্যা আপনার?

রায়বাবু: এটা সমস্যা না আতঙ্ক জানি না। তবে কয়েকদিন সহ্য করার পর আজ আর পারলাম না, চলে আসতে হল। আসলে প্রায় সাত-দশদিন হল প্রতিদিন স্বপ্ন দেখছি, আমার মৃত্যু হচ্ছে। অথচ তারপরেই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। আর ঘুমোতে পারছি না।

ড.সেন: আপনার সমস্যা কি স্বপ্ন দেখা না আর ঘুমোতে পারছেন না, সেটা।

রায়বাবু: দুটোই।

ড.সেন: প্রথমত আপনি মৃত্যুর স্বপ্ন দেখছেন কিন্তু মরছেন না, এটা পজিটিভ। আর দ্বিতীয়ত তারপরেও ঘুমোতে চাইছেন, কিন্তু পারছেন না, এটা নেগেটিভ সাইড। আচ্ছা স্বপ্নের ধরণগুলো কেমন? মানে কী কী ভাবে মৃত্যুকে দেখছেন জানতে চাইছি।

রায়বাবু: কোনোদিন দেখছি পাগলা ষাঁড়ের গুঁতোয় লুটিয়ে পড়েছি রাস্তায়, আবার কোনোদিন ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছি, তো কোনোদিন চ্যাংদোলা করে কিছু লোক নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে দিল জ্বলন্ত চিতায়।

ড.সেন: আচ্ছা মৃত্যুর পর কী হয়েছে তা কি কখনও দেখেছেন? মানে সে অভিজ্ঞতা আছে?

রায়বাবু: ওটাই তো আপশোশ। যদি দেখতে পেতাম তাহলে তো সমস্যাই থাকত না। নিজেই বেছে নিতাম।

ড.সেন: আচ্ছা স্বপ্ন শেষ হলে কি ঘাম হয়, জলতেষ্টা পায়? ভয় করে?

রায়বাবু: কোনোটাই নয়, তবে বাকিটুকু দেখতে ইচ্ছে করে।

ড.সেন: না, না, তা আপনার ইচ্ছেমতো সম্ভব নয়।

রায়বাবু: তাহলে উপায় কী বলুন! এই যে প্রতিদিন স্বপ্নের মধ্যে মৃত্যুভয় অনুভব করছি, তার শেষটুকু না দেখেই ছেড়ে দেব?

ড.সেন: আপনার আক্ষেপটা বুঝতে পারছি। কিন্তু অনেক বিশেষ অনুভূতির মতোই মৃত্যু অনুভূতি কেউ শেয়ার করতে পারে না।

রায়বাবু: সে তো ঠিকই। তবে যে বলে স্বপ্নসন্ধানী হলেই সাফ্যলের কাছাকাছি পৌঁছোনো যায়। সবই কি মিথ্যে!

ড.সেন: মিথ্যে হবে কেন? আপনি তো সব গুলিয়ে ফেলছেন মশাই! এই যেমন ধরুন প্রতিটা শিশিতে আলাদা আলাদা ওষুধ রয়েছে, তাদের কাজও ভিন্ন ভিন্ন, তেমনি স্বপ্নসন্ধানী আর মৃত্যুসন্ধানী একই মানুষের অনুভূতি হলেও তাৎপর্য ভিন্ন।

রায়বাবু: আপনি ঠিকমতো ডায়াগনোসিস করতে পারছেন না বলেই ফিলোজফি বোঝাচ্ছেন।

ড.সেন: তাহলে সময় নষ্ট না করে মৃত্যুসন্ধান করুন।

রায়বাবু: যদি জানতে পারি মনে ক্ষত হলে, বা প্রিয়জনের আঘাতে রক্তপাত হলে বা দিনে দিনে একটু একটু করে আহত হলে কী কী অনুভূতি হয় তবে লিখে যাব। নিকষ অন্ধকারের গায়ে জোনাকির ছিটে লাগলে যদি ভোর হয় তবে মৃত্যুর পরেও ফিরে আসব এই পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে কোনো মায়ের কোলে।



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন