বাপ্পা ঘোষ




চড়াই উতরাই:সেলিম আলির আত্মজীবনী

 

 

চড়াই উতরাই:সেলিম আলির আত্মজীবনী
নিবন্ধ টি লিখতে বসব ,এমন সময় হঠাৎ করেই একটা গল্পের কথা মনে এল।যাকে নিয়ে সেই গল্প ,তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে উত্তম পুরুষ কথক বলছেন-"বস্তুত আমরা মানুষ বলি সেই পদার্থকে যেটা আমাদের ভিতরকার সব জীবজন্তুকে এক খাঁচায় ধরে রেখেছে।যেমন রাগিনী বলি তাকেই যা আমাদের ভিতরকার সমুদয় সা-রে-গা-মা গুলিকে সংগীত করে তোলে।-তার পর থেকে তাদের আর গোলমাল করবার সাধ্য থাকে না।-কিন্তু সংগীতের ভিতরে এক একটি সুর অন্য সকল সুর কে ছাড়িয়ে বিশেষ হয়ে ওঠে,কোনটাতে মধ্যম,কোনটাতে কোমল গান্ধার কোনটাতে পঞ্চম।" হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন।গল্পটির নাম 'বলাই'                                                                                                            
আজ আর বলাই এর কথা নয়।বরং এমন এক বালকের কথা বলব যার মধ্যে গাছপালা নয়,পাখপাখালির মূল সুর গুলিই হয়ে উঠেছে প্রবল।।                                                              

ছোট্ট একটা চড়াই শিকার যে এইভাবে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে ভাবতে পারে নি ছোটো ছেলেটা। যে সময়ের কথা ,দেশ তখন পরাধীন। সংরক্ষন চেতনা তেতনা তখন বহু দূরের গল্প। হাতে ধরে কেউ শিখিয়ে দেয়নি ,পরিবেশ, ভারসাম্য, ইত্যাদি বৈজ্ঞানিক শব্দগুলোর গুরুত্ব না স্কুলে, না বাড়িতে বরং শুধু পাখি কেন, যেকোনো শিকার কেই তখন বেশ একটা পৌরুষের নজরে দেখা হতো। বালকটি অবশ্য তাই ভাবতেন। নয়- দশ বছর যখন বালকটির বয়স ,খেতওয়ারির(বোম্বাই) আস্তাবলে এক সপ্তাহে গোটা আষ্টেক পুরুষ চড়াইকে সে সাবার করে।  সেই ঘটনার রোমাঞ্চকর কাহিনি ছাপা হয় 'নিউজ লেটার ফর বার্ড ওয়াচার' পত্রিকায়। কী ছিল সেই বীর পুরুষের পৌরুষত্বের রোমাঞ্চকর কাহিনি টি? না আস্তাবলের দেয়ালে গর্তের প্রবেশপথের প্রায় মুখে পুরুষ চড়াই টি বসে পাহারা দিচ্ছে। স্ত্রী চড়াই টি ডিমে তা দিচ্ছে ভেতরে বালকের অতর্কিত আক্রমণে পুরুষ  চড়াই টি ধরাশায়ী কিছুক্ষন যেতে না যেতে ,মেয়ে  চড়াই টি আরেকটি পুরুষ চড়াই জুটিয়ে এনেছে সেটিরও একই অবস্থা। এই করে করে পরের সাত দিনে গোটা আটেক  চড়াই নিধনের পর ,ক্ষান্ত হয় বালকটি। এই বীরগাথা লিখে রেখেছিল বালকটি এই কারণে যে শিকারি হিসেবে সে কত বড় তা দেখানো।।                                                                             

এতক্ষণে আর বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না বালকটির পরিচয় মোটামুটি আন্দাজ করে নিয়েছেন সবাই। হ্যাঁ, আমরা প্রখ্যাত পক্ষী বিশারদ সেলিম আলির কথা বলছি। তার আগে আমরা তাঁর শৈশবের দু-একটি তথ্য বলে নি। তারপর ছোট্ট চড়াই এর শিকার, কী ভাবে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল সে প্রসঙ্গে না হয় যাবো  ।।      

            
আজ যাকে দেশের সকলে এক নামেই চেনে সেই মানুষটির শৈশব কুসুম আকীর্ণ ছিলনা মোটেও। সেলিম আলির  যখন মাত্র তিন বছর বয়স, তখনই তার মা জিনাত উন নিসা মারা যান। তার দুবছর আগে পিতা দেহ রাখেন। ফলে শৈশবেই অনাথ। পাঁচ ভাই, চার বোন সেলিম আলি সবার ছোটো। এমতাবস্থায় নিঃসন্তান মামা মামির কাছে তারা মানুষ হন যদিও বাবা মায়ের অভাব বুঝতে হয়নি ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের। পরম মমতায় আগলে রেখেছিলেন তাদের। বোম্বাইয়ের পীরগাঁও আর চার্নী রোডের মাঝের যে খেত ওয়ারি অঞ্চল ,যেখানে এখন লোকের ভিড়ে পা পাতা দায় ,তখন সেখানে ছিল বিরাট ফাঁকা মাঠ গাছগাছালি। নিম্ন মধ্যবিত্ত কিছু মানুষ, বাস করত সেখানে। আজকের চেহারার সঙ্গে তাকে মেলাতে যাওয়া বৃথা। সেই ক্ষেত ওয়ারীতে তাদের বেড়ে ওঠা।    

        
গরমের ছুটিতে খেতওয়ারি ছেড়ে যখন চেম্বুর যেতেন, প্রকৃতিকে আরো নিবিড় ভাবে উপলব্ধির সুযোগ পেতেন। চেম্বুর তখন সে রকমই ছিল। বাস ,মোটর গাড়ির দেখা মিলত কালেভদ্রে। লোকজন ছিল না জমির দাম আকাশ ছোঁয়া হয়ে যায়নি। ফলে চেম্বুর এর স্মৃতি তাঁর পক্ষী নিরীক্ষার ভাঁড়ার    আজও অমলিন। ভোর বেলায় আধো ঘুম ,আধো জাগরণে, নরম বিছানায় ,আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ,যখন দোয়েলের সুমিষ্ট সুর ,কানে মধু ঢেলে দিত ;সেই স্মৃতি আজীবন সুখ স্মৃতি হয়েই রয়ে যায়, সেলিম আলির জীবনে। পরবর্তী জীবনে বহু দেশ, বহু পক্ষী নিরীক্ষণের সময়, যখনই তিনি দোয়েলের গান শুনেছেন ;চেম্বুর এর সেই ভোর বেলার  সুখ, মনে পড়ে যায় তাঁর।    


                                                                                                     
যে আব্বা মামুর কাছে তিনি মানুষ সেই আমির উদ্দিন মামু ছিলেন, জাত শিকারি ছেলেদের কাছে তিনি ছিলেন আরাধ্য সেই মামুই সেলিমের দশ বছর বয়সে, একটি এয়ারগান উপহার দেন।তা দিয়ে হঠাৎই এক অন্যরকম দেখতে, চড়াই শিকার করে ফেলা গলার কাছটা তে একটা হলদে ছাপ। কোনদিন দেখেনি বালকটি, ইতিপূর্বে। পাখি চেনার যতনে ইচ্ছে, তার চেয়ে বেশি চিন্তা ধর্ম ভয়ের। কৈশোরের ধর্মভীরু মন সায় দেয়নি হালাল করবার। পাছে পরকালে এর জবাবদিহি করতে হয়। অগত্যা তাকে আব্বা মামুর কাছে নিয়ে যাওয়া। মামু দেখে বললেন, সত্যিই পাখিটি অন্য জাতের।  নামী শিকারীও যখন, এর কোনো  সদুত্তর দিতে পারলেন না; তখন তিনি ,সেলিম কে পাঠালেন মিস্টার ডাবলু, এস, মিলার্ড এর  কাছে। 1883 খ্রিস্টাব্দে বোম্বেতে," ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি" পত্তন হয় সূচনা লগ্ন থেকেই ,আমিরুদ্দিন মামু ছিলেন, সোসাইটির ভারতীয় সদস্য দের অন্যতম মিস্টার মিলার্ড ছিলেন সোসাইটির অবৈতনিক সেক্রেটারি।।

                                    
  1883-84
সালে একজন বালক ভারতবাসীর পক্ষে, একজন ব্রিটিশ এর সামনে দাঁড়ানোটা কম ধৃষ্টতার ছিল না। কেননা ব্রিটিশদের ধারণা ছিল, শিক্ষা-দীক্ষা, রুচি, এমনকি জাতের দিক থেকেও ,তাঁরা  অনেক উঁচু দরের। দৈবক্রমে এইসব কালো চামড়ার মূঢ় ভারত বাসির শাসনের ভার এসে পড়েছে, তাদের হাতে। ফলে নিজেদের তৈরি করা  গণ্ডির মধ্যে তাঁরা  বসবাস করত। সরকারি বা বেসরকারি কাজ ব্যতীত সাধারণের চোখে ইংরেজ দেখা ছিল  কদাচিৎ এরকমই যখন অবস্থা ,তখন সেলিম আলিকে  পাঠানো হয় স্টার মিলার্ড নামে ইংরেজের কাছে। বালক সেলিমের তখন হাত পা পেটে ঢুকে যাবার জোগাড়। কথা আটকে গেছে। বহুকষ্টে যখন চড়াই টির শনাক্তকরণের উদ্দেশ্যে তার আসা- কথা জানালেন; প্রচলিত ধারণা বদলে যায় সেলিমের সকলেই সমান নয়।শুধু ছোটো ইংরেজ নয়; বড় ইংরেজ আছে অনেক সময় নিয়ে, ধৈর্য ধরে শেখালেন ,পাখি সংরক্ষণের উপায়। বাতলে দিলেন, জংলি চড়াই এর পরিচয়।।।
                             

মিস্টার মিলার্ড সোসাইটির ছোটো গ্রন্থাগারটি ঘুরে দেখান। এই সময় পাখি সম্পর্কিত দুটি বই পড়তে দেন তাঁকে। এই গ্রন্থ দুটি সেলিম আলির সুপ্ত বাসনাকে উসকে দিয়েছিল। বই দুটি হল -এডোয়ার্ড হ্যামিলটন আইটকেন এর অদ্বিতীয় ক্লাসিক "কমন বার্ডস অফ বোম্বে" অন্যটি "নাচারালিস্ট অন দি প্রউল"বিগত 60 বছর ধরে পড়েও এর প্রতি অনুরাগে বিন্দুমাত্র ভাঁটা পড়েনি 1946 সালে "কমন বার্ডস অফ বোম্বে" বইটির নাম বদলে রাখা হয় "কমন বার্ডস অফ ইন্ডিয়া" সেলিম আলি বইটির টীকা ভাষ্য লেখেন।।                                                                                            

মিস্টার মিলার্ড, সেলিম আলী কে সোসাইটির তরুণ কিউরেটর নর্মান বয়েড  কিনেআর এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি হাতে ধরে পক্ষী সংগ্রহ, সংরক্ষণ বিষয় শেখান।                                                                   

স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের মধ্যে, পাখি সম্পর্কে ব্যাপক আগ্রহের যে জন্ম হয়নি, তার একটা বড় কারণ ,বইপত্রের অভাব এবং উন্নত মানের আধুনিক ক্যামেরা না থাকা। ফলে, সেই সময় পাখি সম্পর্কিত যা কিছু বইপত্র, তা সবই বিদেশিদের লেখা। এদেশে চাকুরীজীবী ইংরেজ এসে যখন দেখে, নতুন দেশে শুধু নানা বিধ বৈষয়িক সম্পদই নয় ;বিরাট এক প্রাকৃতিক সম্পদ আছে; যার মধ্যে পাখপাখালির সাম্রাজ্য টাও বিরাট। ফলে পক্ষী সংক্রান্ত গবেষণা ,(ভারতের পাখিদের সম্পর্কে) তাদের নেশা হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে সেলিম আলি হলেন সেই বিশিষ্ট ব্যক্তি, যিনি তাঁর গোটা জীবনকে নিবেদন করেছেন, পক্ষী সংক্রান্ত গবেষণার কাজে। ফলে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি বিজ্ঞানের মঞ্চে, তাঁর অবদান স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হয়ে আছে।

জংলি চড়াইয়ের শ্রেণি নির্ণয়ের সূত্রে মিস্টার মিলার্ড -এর সংস্পর্শে আসা, এবং সেই থেকে পাখি সংক্রান্ত বিষয়ে আগ্রহ, ছাইচাপা আগুনে ইন্ধন জুগিয়েছিল।.                                                     


সেলিম আলি জীবনে বহুবার এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন যে, একদিকে তিনি হতে চেয়ে ছিলেন শিকারি; কিন্তু অন্যদিকে, সংরক্ষণ নিয়ে তিনি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মুখ। এই দুটি স্ববিরোধ কে, তিনি কেমন ভাবে দেখেন? প্রথমত, বিষয়টি এমন নয় যে, কেউ কোন, শিকার করলেই তিনি খড়গহস্ত হবেন। তবে বিনা কারণে ,কেউ স্বীকার করলে তিনি তা মেনে নিতে পারেন না। জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে শিকারের নেশা তার ছিল বটে, কিন্তু একটা সময় এলো, যখন মূলত দেশীয় রাজা জমিদার'দের তান্ডব এবং চোরা শিকারিদের তাণ্ডবে, বন্য প্রাণীর সংখ্যা আমাদের দেশে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসতে লাগলো। তখন পক্ষী শিকার থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নেন। আর সবচেয়ে বড় কথা, তিনি পাখি সংগ্রহ করেছেন তাদের ওপর বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োজনে। আজ ভারতবর্ষে যত রকমের পাখি রয়েছে ,তাদের বাসস্থান, খাদ্যাভ্যাস, জীবনচক্র, সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা করতে পেরেছি  সেলিম আলির বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য। তা যদি তিনি না করতেন, তাহলে ভারতবর্ষের পাখি সম্পর্কে একটা বিরাট জগত, একেবারে অজানা থেকে যেত।।                                                                                                  

উদ্দেশ্য একটা বড় প্রশ্ন কেজিখানেক মাংসের লোভে পাখি শিকার আর গবেষণার প্রয়োজনে পক্ষী সংগ্রহ এদুটো যে এক নয় বলাই বাহুল্য। সেলিম আলী সংরক্ষণকে কোন মায়া কাজল পরা দৃষ্টি দিয়ে দেখেন নি এখানে সৌন্দর্যচেতনা অথবা মমতা কোন টি বিবেচ্য নয় একমাত্র বিবেচ্য হলো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি একটি সাক্ষাৎকারে সেলিম আলী তাই সঙ্গতভাবেই বলেন- "সংরক্ষণ জিনিসটা আমার কাছে সম্পূর্ণ দুনিয়াদারীর ব্যাপার। তার অর্থ, এর পেছনে রয়েছে একান্তভাবে বৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক, নান্দনিক, বিনোদনমূলক এবং অর্থনৈতিক কারণ। তার সঙ্গে হৃদয়বৃত্তির ছিটেফোঁটাও সম্পর্ক নেই। আজকাল সংরক্ষণ বিষয়ে অহিংসার দোহাই দিয়ে ছোটদের যেভাবে তালিম দেওয়া হয়, সেটাকে আমি একেবারেই দুর্ভাগ্যজনক আর অযথা বলে মনে করি। এটা অনেকটা গোমাংস নিষিদ্ধ করতে- মা- ভগবতী কে টেনে আনা। লগ্নিপুঁজির সুদ থেকেই  সব উসুল হয়ে যাবে।আসলে হাত দিতে হবে না।বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ব্যাপারটাকে এই দৃষ্টিতেই দেখে থাকি।"                                       

পক্ষী চর্ম সংরক্ষণ এর চাইতেও সেলিম আলির আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল, স্বাভাবিক পরিবেশ বেড়ে ওঠা পক্ষীকুলের জীব বৈচিত্র এবং বাস্তুসংস্থান, হাবভাব, আচরণ এবং অনুষঙ্গ। সেই গবেষণায় তাঁর অবদান আজ প্রশ্নাতীত। 

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন