সংযুক্তা পাল

রবীন্দ্রপরবর্তী কবিদের নারী ভাবনার
আলোকে ব্যতিক্রমী নারী ঘরানা: কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়


পর্ব-১০

অত্যন্ত দুর্মর রোমান্টিকতায় মায়াকোভস্কি বলেছেন–'যেখানে পেলবতা ফুটে উঠেছে, নির্মম আমি তাকে দহন করেছি! এ দহন হাজার বাস্তিল ধ্বংসের চেয়ে বেশি যন্ত্রণার' এই সামাজিক নির্মমতা, যন্ত্রণাই কবি সুভাষের মধ্যে এক অন্তর্দহনের জন্ম দিয়েছে যে দহন তাঁকে দাঁড় করিয়েছে পেলবতার বিপ্রতীপতায়– এও এক অন্যতর রোমান্টিকতা, মিস্টিকতার বিপরীতে যা সংগ্রামী চেতনার কঠোর কাঠিন্যে পরিব্যপ্ত; সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মানসিক এই পরিব্যপ্তির থেকে নারীও বিচ্ছিন্ন নয়, তাঁর সামগ্রিক কবি-ভাবনার কোন খন্ডিত সত্তা নয়, সংগ্রামী আদর্শের সামগ্রিকতায় 'নারী'ও একটি সম্মিলিত অংশ। u'বাংলা কবিতা তাঁর হাতেই প্রথম আবেগের ফেনা ঝরিয়ে কথা বলতে শিখল।' ঠিক তেমনই নারী মানেই যে আবেগ নয় সে কথা প্রথম যে কবি শেখালেন তিনি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। 'সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পৃথিবী বজবজ হলেও তা আসলে আফ্রিকা-এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। '(সুবোধ সরকার, সুভাষ মুখোপাধ্যায় সংখ্যা, দেশ পত্রিকা) সেকারনেই সম্ভবত তাঁর নারী-ভাবনার ভরকেন্দ্রেও বিস্তৃত হয়ে ছিল 'সালেমনের মা' থেকে 'মেজাজ' কবিতা।
জয় গোস্বামী তাঁর সম্পর্কে বলেছেন–"সবসময় সজাগ এই কবি। নিজেকে কোথাও রেহাই দেন না। যদিও জানেন থাকা আর না-থাকার মধ্যে এখন দোল খাচ্ছে সময়। তবু একদিন যে শপথ নিয়েছিলেন, সাম্যবাদী যে মূল্যবোধের রাজনীতিকে আশ্রয় করেছিলেন, ঘটনা পরম্পরার চাপে সেই পার্টি দুভাগ হয়ে গেলেও, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভেতরের মূল্যবোধ কখনও ভাঙেনি।" 

এই সাম্যবাদী মূল্যবোধের তাড়নাতেই নারীকে দেখার প্রতিও তার এক মমত্ব কাজ করেছে। নারীকে নারীত্ব দিয়ে বা যেকোনো রকম গতানুগতিক 'মেয়েলিপনা' র বাইরে মেয়েদের দেখতে চেয়েছেন বা দেখেছেন; তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সিদ্ধান্তই তা প্রমাণ করে।
'নারানদার ছোট ভাই আমার সঙ্গে পড়ে। কিন্তু ওর দিদি মাধুর সঙ্গেই আমার বেশি ভাব হয়ে যায়। ওর মধ্যে 
কোনও মেয়েলিপনা নেই বলেই ওকে আমার ভালো লাগে।' (সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ঢোল গোবিন্দর মনে ছিল এই) নারীর সন্তান জন্ম দেওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার কিন্তু 'মেজাজ' কবিতায় একজন নারী তার আসন্ন সন্তানের মধ্য দিয়ে যে সামাজিক পরিবর্তন বা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছেন, বিশ্বচেতনায় যার মন আধুনিকতাকে স্পর্শ করেছে তা সত্যিই বিরল উদাহরণ। একথা বলা বাহুল্য যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আগে এ হেন নারী চরিত্র অন্য কোন জনপ্রিয় কবির কবিতায় পাওয়া যায়নি।

মার্কসীয় নারীবাদ যেখানে নারীকে শ্রমিকের সঙ্গে এক করে দেখছে অর্থাৎ শোষনের তত্ত্ব একইভাবে প্রতিষ্ঠিত, সেখানে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বর্ণিত নারী-অস্তিত্ব কল্পিত নয় সেভাবে; তারা মিছিলে হাঁটছে, বজ্রমুষ্টি দৃঢ় হাত আকাশের দিকে তুলে রয়েছে সেই শ্রমিকদের প্রাপ্য অধিকারের জন্য। দয়া-দাক্ষিণ্য-করুণা নয়, দাবি আদায়ের লড়াইয়ে তারা শোষনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে। কন্ঠে তাদের সাম্যবাদের মন্ত্র, তাই তাঁর নারীরা 'লবঙ্গলতিকা টাইপ' নয়; চুলের বাহারি সাজ নয়, চটের ফেঁসো জড়ানো মাথাই তাঁর কাছে নিজ স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল, ভাস্বর কারণ সেখানে সন্তান ছাড়াও নারী সামাজিক উৎপাদনের ভার বহন করার ক্ষমতা রাখে।
পূর্ববর্তী ধারা লক্ষ্য করলে দেখা যায় নারী প্রেরণা,আশ্রয় ('আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন'), বিয়ে, সংসার বা কামোদ্দীপনার বাইরেও পুরুষকে যেভাবে মোহিত করেছে তা ভীষণই প্রথাগত; 'মিছিলের মুখ' হয়ে নারী প্রথম প্রথা ভাঙলো সুভাষের কবিতায়।

'আমার বাংলা' গদ্যগ্রন্থে যে প্রচুর সংখ্যক নারী চরিত্রের দেখা মেলে ('আজিমুন্নেসা', 'সুকুরবানু', 
'মাধবের মা', 'বীরকন্যা', 'লছমী',
'পার্বতীয়া', 'আমিনা', 'সালেমন' ও তার 'মা', নিমতিতা গ্রামের বিড়ি বাঁধা মেয়েরা, ফুটপাথের স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ে ইত্যাদি) তাদেরকেই নিজের পর্যবেক্ষণ ও অনুভব শক্তির দ্বারা রীতিমত ছেঁচে-ছেনে তুলে আনছেন সুভাষ তাঁর কবিতায় এমনকি সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও। তারা রচনার উপাদান বা বিষয়মাত্র নয়, কখনো রচনার মূল ব্যতিক্রমী শক্তি হয়ে উঠেছে যা বাংলা সাহিত্য তথা কবিতার সমকালীন ধারাবাহিকতায় নারী ভাবনা রূপায়নের প্রেক্ষিতে তাঁকে স্বাতন্ত্র্যে দীক্ষিত করেছে। আগুনকে কোন না কোন সময় স্পর্শ করে সবাই কিন্তু জীবন দিয়ে স্পর্শ করার অধিকার এবং অবকাশ সকলে পায় না। কেউ কেউ সে অধিকার ছিনিয়ে নেন আবার কখনো সময় নিজেই তাকে সে অবসর দিয়ে দেয়। সুভাষ মুখোপাধ্যায় এমন এক কবি যিনি স্বীয় জীবনাত্মিকতা এবং চৈতন্য ও বেড়ে ওঠার বৌদ্ধিক পারম্পর্যে 'নারী' নামক আগুনকে আত্মস্থ করেছেন এক বিস্তীর্ণ পরিব্যাপ্তি নিয়ে, প্রতিনিয়ত তাঁর তপ্ত-বিপ্লবী মন নারীর মধ্যেকার সেই আগুনকেই, এক অন্যতর বৃহত্তর সম্ভাবনাকেই রূপ দিয়েছেন পোড় খাওয়া কবিতার কালো অক্ষরে।  বক্তব্যের তীক্ষ্ণতায়, মননধর্মীতায় উদার ও ব্যতিক্রমী এই কবি তাঁর কবিতার নারীদেরও তেমনই তীক্ষ্মধী,  মননশীল, উদার ও ব্যতিক্রমী হিসেবেই গড়ে তুলেছেন আর সেটা সম্ভব হয়েছে তাঁর মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে উত্থিত হলেও চোখ দুটো ছিল সর্বদাই  মাটির দিকে ফেরানো।

                                     -: শেষ :-

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন