উৎপলেন্দু পাল  -র কবিতা


১) 
শ্রাবণের সজলধারায় 


শ্রাবণের মেঘগুলান যেন সাকিনার মায়ের কোঁকড়ানো একঢাল চুল 
চুলের ফাঁক দিয়া ঝিলিক মারে কালাচাঁদ বনিকের দোকানের সোনালি ক্লিপ 
আশমান জুইরা যেন গর্জন কইরা ওঠে সামাদ মিঞার গুরু গম্ভীর হাঁকডাক 
কথায় কথায় ঝইরা পড়ে পঁদি পিসির চোখের জলের মত টুপটাপ বৃষ্টিধারা 
ফেলানীর মায়ের নরম মনডার মতো গইলা গইলা যায় পথঘাটের মাটি 
ছাতার নীচে আশ্রয় নেয় উঠতি লায়লা-মজনুর অপরিপক্ক পাক ভালোবাসা 
ভেজা মাটি থেকে যেন ভাইসা আসে ফুলবিবির চুলের অজানা ভেজা সুবাস 
কমলা সুন্দরীর যৌবনের মতো তরঙ্গ খেইলা যায় মরা গাঙ্গের বুকে 
নয়া বৌয়ের চোখের কাজলের মতো রং ধরে আকাশের জলভরা মেঘ 
রসিক নাগরের মতো বছরভর শ্রাবণের অপেক্ষায় থাকে বাংলার প্রাণ ।


২) 
পরকীয়া 

কমলাদি'র যৌবনে অপরাহ্নের রইদ 
তবুও তার রোশনিতে চোখ ঝলসায় দিলুদা'র 
দোকানে চা রুটি বানানের ফাঁক ফোঁকরে 
নজর চইল‍্যা যায় পান দোকানির শাড়ির ভাঁজে 
নজরের আর দোষ কি কও , সবই মন 
নজরে ঢাকনা দিয়াও মনডারে আটকানি যায় ? 

কমলাদি'র চোখ দুইখান এক্কেবারে চুম্বক 
দিলুদা'র পরানডারে টাইন‍্যা নেয় কোন ছুমন্তরে 
পান খাওয়া লাল লাল ঠোঁট দুইখান যেন 
সময়ে অসময়ে মনডারে হাতছানি দিয়া ডাকে 
চায়ের কাপে চিনি মিশাইতে মিশাইতে 
দিলুদা'র রসনায় কমলাদি'র গতরের রসাস্বাদন , 

কমলাদি'র সেইদিগে অতশত ভ্রুক্ষেপ নাই 
আপন মনে পান ব‍্যাচে আর গুনগুনাইয়া গান গায় 
সোয়ামির ঘর ছাইরা আইছে কতকাল আগে 
তবে কপালে এখনো টুকটুকে লাল সিন্দুরের টিপ 
যৌবনের শেষ কিনারে দাঁড়াইয়া আছে তবুও 
টসটসে তার উজ্জ্বল শ‍্যামলা রসবতী গায়ের গড়ন , 

সকাল সন্ধ‍্যায় দোকানে উপচাইয়া পড়ে ভিড় 
কামুক নজরগুলা শালীনতার পর্দা ভেদ কইরা দেখে 
কমলাদি'র চোখ ঠোঁট বুক হইয়া নিতম্বজোড়া 
লোলুপ বন‍্যতায় শুইঙ্গা নেয় শরীরের ঘামের আঘ্রাণ 
তাদের দেওয়াল ভেদ কইরাও ছুইট‍্যা চলে 
কমলাদি'র প্রতি দিলুদা'র অব‍্যক্ত প্রণয় নিবেদন , 

মাঝে মইধ‍্যে একটু আধটু চোখাচোখি হইলে 
বিদ‍্যুতের ঝিলিক খেইল‍্যা যায় কমলাদি'র চোখে 
বিদ‍্যুৎস্পৃষ্ট হইয়া দিলুদা'র হাতপাও অবশ 
কাপের গরম চা চইলকা পড়ে হাতে পায়ে হৃদয়েও 
ঘরের বৌয়ের কথা ভুইল‍্যা গিয়া খাবি খায় 
কমলাদি'র বুকের ওই পদ্মগন্ধি সুগভীর বৈকালে । 

(রইদ - রোদ , কও - বলো , কিনারে - প্রান্তে , হাতপাও - হাত পা , আইছে - এসেছে , শুইঙ্গা - শুঁকে , বৈকাল - গভীরতম হ্রদ)


৩) বাইষ‍্যার দিনে 

ঝমঝমাইয়া বাইষ‍্যার বিষ্টি নামলে পরে 
মনডা উতলা ময়ূরের মতো নাইচ‍্যা উডে 
টুপটাপ বৃষ্টির তালে তালে গাইতে থাহে 
অন্তরের ভেতরের অদেহা ওই মানুষডা 

ইলিশের ঝাঁকের লাহান উজান ঠেইল‍্যা 
মনের গাঙ্গে ঢুইক‍্যা পড়ে স্মৃতির ঝাঁক 
বৃষ্টিস্নাত দিনমানে আবেগের বারিধারায় 
খুইজ‍্যা পাই এক নতুন জীবনের ঠিহানা 

নদীর স্রোতে ধুইয়া যায় হগল মলিনতা 
রসিক নাগরের হাত ধইরা নাইচ‍্যা উডে 
নতুন রসসিক্ত পুরোনো জরাগ্ৰস্ত জীবন 
নয়া বাইষ‍্যার অচিন জলনুপুরের ছন্দে । 


(বাইষ‍্যা - বর্ষা , উডে - ওঠে , থাহে - থাকে , ঠিহানা - ঠিকানা , হগল - সব , অদেহা - অদেখা , লাহান - মতন , খুইজ‍্যা - খুঁজে , ঢুইক‍্যা - ঢুকে , নাইচ‍্যা - নেচে)



৪) 
ওগো তোর্ষা তুমি 

তোর্ষা , ওগো তোর্ষা 
তোমার বুকে উদাং ভাসে ফজলে নাইয়ার নাও  
তোমার জলে চুল ভিজাইছে রামপিয়ারীর মাও , 
তোমার কূলের গল্পকথা 
তোমার ঘাটের রসিকতা 
তোমার বুকের ধারা লইয়া কোথায় চইলা যাও । 

তোর্ষা , ওগো তোর্ষা 
তোমার জলে জাল ফেলাইছে হরেন জাইলার পো 
তোমার ঘাটে কাপড় ধুইছে রাজেন কামারের বউ 
তোমার জলে জীবন খুঁজি 
তোমার কোলে মাথা গুঁজি 
তোমার আমার মনের কথা বুঝবো না আর কেউ । 

তোর্ষা , ওগো তোর্ষা 
তোমার যারা আপন ছিল গিল‍্যা খাইছ তাগো 
তোমার চরে বসত করে কতো অভাগা মা'গো 
তোমার জলের ঝিলমিলানি 
তোমার চরের কথা - কাহিনী 
তোমার গর্ভেই সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় লইয়া থাকো । 

(উদাং - উদোম)



৫) 
টোপ 

মনে পড়ে , ছোটবেলায় বড়শী দিয়া মাছ ধরতাম 
বড়শীতে কেউচার টোপ দিয়া বইসা থাকতাম চুপ্ 
নজরটা তখন স্থির থাকতো ওই ফাৎনাডার দিকে 
ইস্ , এত মনযোগ দিয়া যদি লেহাপড়াডা করতাম ! 

ফাৎনাডা একটু লইড়া উঠলেই তৎপরতা বাড়তো 
তারপর ফাৎনা তলাইয়া যাওয়ার মুহুর্তেই দে টান , 
মাছ উঠলে পরে আনন্দের আর কোনো সীমা নাই 
আর না উঠলে মুখটা ব‍্যাজার কইরা আবার চেষ্টা । 

আইজকাইল আমার আর মাছ ধরবার ধৈর্য্য নাই 
সংসারের ভ‍্যাজালে পইরা মনযোগের দফা শ‍্যাস 
এখন ডাঙায় বইসা মাইনসেরে টোপ গিলাই আর 
বেশিরভাগ সময়ে নিজেই টোপ গিল‍্যা বইসা থাকি । 

এখনকার দিনে চাইরদিহে কত্ত রকমের টোপ আছে 
টোপের ভিতরের বড়শীটা না দেইখ‍্যাই গিল‍্যা ফেলি 
আগে মাছগুলানরে যেভাবে টোপ গিলাইয়া ধরছি 
এখন একই কায়দায় টোপ গিল‍্যা রোজ ধরা পড়ি । 

(কেউচা - কেঁচো , লেহাপড়া - লেখাপড়া , লইড়া - নড়ে, ভ‍্যাজাল - ঝামেলা , শ‍্যাস - শেষ , মাইনসেরে - মানুষকে , গিল‍্যা - গিলে , চাইরদিহে - চারিদিকে , দেইখ‍্যা - দেখে)

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন